জুনায়েদ বাগদাদীর জ্ঞানের দোকান

জানুয়ারি ২৯, ২০১৯
Spread the love

অনিন্দ্য আফরোজ

জুনায়েদ বাগদাদী  একজন বিখ্যাত সূফিসাধক। বাগদাদের বড় পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানীকে কোলে নিয়ে যিনি প্রথম দোয়া করেছিলেন । তাঁর প্রধান শিষ্যের নাম হযরত মনসুর হাল্লাজ। হযরত জুনায়েদ বাগদাদী বাগদাদ নগরে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর সময় সুফিবাদ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।

তাঁর প্রধান শিষ্য মনসুর হাল্লাজ যখন ঘোষণা করলেন, ‘আনাল হক’ অর্থ্যাৎ আমিই মহাসত্য, তখন তৎকালীন বাগদাদের শাসক এবং অনেকে ব্যাপারটি মেনে নিতে পারেননি। এজন্য তারা হাল্লাজের বিরুদ্ধে ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগ এনে তীব্র  প্রতিবাদ জানান। শেষ পর্যন্ত তার প্রধান শিষ্য মনসুর হাল্লাজকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে হয়েছিল। অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে তিনি তার শিষ্যের মৃত্যুদণ্ড দেখেছিলেন। জুনায়েদ অতিন্দ্রীয় সাধক হলেও  নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারতেন। কিন্তু  তাঁর শিষ্য মনসুর হাল্লাজ তা প্রকাশ করে দিয়েছিলেন।

আরো পড়ুন….জুনায়েদ বাগদাদীঃ প্রেম ও জ্ঞানের দরিয়া

সূফি সাধক জুনায়েদ বাগদাদী ২১৮ হিজরি সালে বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন। ২৯৭ মতান্তরে ২৯৮ হিজরির রজব মাসে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।জুনায়েদ বাগদাদী বিশ্বাস করতেন, প্রকৃত সূফি সাধকের ব্রতহলো, জগতের মোহ থেকে আপন প্রবৃত্তিকে প্রভাবমুক্ত রাখা, চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধন, প্রবৃত্তির প্রবঞ্চনা ও প্রতারণা, মোহ আত্মাকে পুত-পবিত্র রাখা তথা আত্মিক উৎকর্ষ সাধন, অন্তরের কুটিলতা পরিহার করে সদা সৎ চিন্তায় বিভোর থেকে জীবন মরণ কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টিতে উৎসর্গ করা। 

জুনায়েদ বাগদাদী যখন মৃত্যুশয্যায়, তাঁর প্রধান মুরিদ তাঁর কাছে এসে বললেন, ‘গুরু, আপনি আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। আমাদের মনে সবসময়ই একটি প্রশ্ন লালিত রয়েছে কিন্তু যথেষ্ট সাহসের অভাবে আপনাকে কোনোদিন সেই প্রশ্নটি করতে পারিনি। আমাদের সবার মধ্যেই এ বিষয় নিয়ে জানার আগ্রহ রয়েছে যে, আপনি তো আমাদের গুরু, কিন্তু আপনার গুরু কে’?

জুনায়েদ তাঁর চোখ খুললেন এবং শান্ত স্বরে বললেন, ‘এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া আমার জন্য সত্যিই একটু কস্টকর। কারণ আমি এ দুনিয়ায় বিরাজমান সকল কিছুর কাছ থেকেই শিখেছি। আমার জীবনে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনা থেকেই আমি শিক্ষা নিয়েছি।আমি তোমাদের জানার আগ্রহকে পরিপূর্ণ করার জন্য তিনটি গল্প বলব’-

একটি কুকুর ভিক্ষার পাত্র

একদা আমি খুবই তৃষ্ণার্ত ছিলাম।  আমার শেষ সম্বল- ভিক্ষার বাটিটি নিয়ে পানির খোঁজ করছিলাম। কিছুক্ষণ পর আমি একটি নদী খুঁজে পাই। নদীটির কাছাকাছি যাওয়ার পরেই হঠাৎ একটি কুকুর দৌঁড়ে গিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেয় ও নদীর পানি পান করতে থাকে।আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখার পর আমার হাতে থাকা বাটিটি দূরে ফেলে দিই। কারণ, বাটিটিকে আমার কাছে অব্যবহার্য জিনিস মনে হচ্ছিল। কুকুর যদি বাটি ছাড়া পানি খেতে পারে, তবে আমি মানুষ হয়ে কেন পারব না?  আমার জীবনে বাটির প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়।

কুকুরটির মত আমিও এক লাফে নদীর পানিতে গিয়ে নামি ও সেখানে পানি পান করতে থাকি। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমার পিপাসা শেষ হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি অনবরত পানি পান করতে থাকি।

পানিতে ডুবে পানি পান করায় আমার সমস্ত শরীর শীতল হয়ে যায়। আমি প্রশান্তি অনুভব করি। আমি কুকুরটির পা ছুঁয়ে তাকে সম্মান জানাই। কারণ একটি ছোট ঘটনার মাধ্যমে আমাকে সে অনেক বড় শিক্ষা দিয়েছে।

আমি আমার জীবনের সকল সহায়-সম্পদ অনেক আগেই ত্যাগ করেছি। শুধুমাত্র ভিক্ষার বাটিটি অবশিষ্ট ছিল। এটিকে আমার খুব প্রয়োজনীয় মনে হত। এটি খুবই সুন্দর ছিল। এই বাটিটিতে আমি খাবার খেতাম, কারো দান গ্রহণ করতাম। এমনকি রাতে ঘুমানোর সময় আমি এটিকে মাথার নিচে বালিশ হিসেবে ব্যবহার করতাম, যাতে কেউ আমার শেষ সম্বল টুকু চুরি করে না যেতে পারে।

কিন্তু একটি কুকুর আমার শেষ পরনির্ভরশীলতাকে বিলুপ্ত করে দেয়। কুকুরটি যদি কোনো প্রকার সহায়-সম্পদ বা কোন বস্তু ছাড়া জীবন যাপন করতে পারে, তবে আমি কেন পারব না? আমি তো মানুষ!  ওই কুকুরটি আমার অন্যতম এক গুরু ছিল।

ধৈর্য্যশীল সেই চোর

দ্বিতীয়ত, তিনি পুনরায় শুরু করেন। আমি একবার জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হাটতে হাটতে পথ হারিয়ে ফেলি। পথ খুজতে খুজতে আমি নিকটের এক গ্রামে চলে আসি। কিন্ত গ্রামে এসে দেখতে পাই, মধ্যরাত হওয়ায়, সকল মানুষ ঘুমিয়ে পড়েছে। আরো কিছুদুর আসার পরে দূরে আমি একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। আমি তাঁর নিকট গেলে তিনি আমার দিকে তাকান।

আমি তখন তাকে আমার বিপদের কথা খুলে বলি এবং তাকে জিজ্ঞেস করি তিনি আমাকে একটি রাতের জন্য আশ্রয় দিতে পারবেন কি না।

মানুষটি আমার দিকে ভালভাবে তাকিয়ে জবাব দেন, আপনাকে দেখে একজন সুফি মনে হচ্ছে। আমি আপনাকে আশ্রয় দিতে পারলে অবশ্যই ভাল বোধ করব। তবে, আপনাকে অবশ্যই আমার সম্পর্কে খুলে বলা উচিত। আমি একজন চোর। আপনি কি একজন চোরের অতিথি হতে ইচ্ছুক?

কিছুক্ষণের জন্য আমি নির্বাক হয়ে যাই। লোকটি আবার শুরু করেন, আমি বুঝতে পারছি আপনি কিছুটা ইতস্তত বোধ করছেন। আপনি আমার থেকে শারীরিক ভাবে দুর্বল। তবুও আপনাকে আমার ভয় করা উচিত। কেননা আমি জানি, আপনাকে আমার বাসায় নিয়ে গেলে, আপনি আমাকে পরিবর্তন করে ফেলবেন। আমার ভেতর থেকে খারাপ চরিত্র অদৃশ্য করে দিবেন। এতে আমার জীবিকা নির্বাহের পথ ও হুমকির সম্মুখীন হতে পারে। তবে আমি সত্যিকার অর্থে ভীত নই। আপনি আমার বাসায় আসুন, খাবার খান, পানীয় গ্রহণ করুন, নিশ্চিন্তে ঘুমান। আপনার যতদিন ইচ্ছে হয়, ততদিন থাকুন। আমি যথেষ্ট আয় করি, আমাদের দুজনের দিব্যি চলে যাবে। কিন্তু আপনি এখনো ইতস্তত বোধ করছেন একজন চোরের বাসায় যাবেন কি না, সেটা ভেবে?

তখন আমি সংবিৎ ফিরে পাই এবং ভাবি লোকটি সঠিক কথা বলছেন। আমি তাঁর পা ছুঁয়ে তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি। তাঁকে আমি জানাই যে, আমি শুধুমাত্র একটি রাত নয়, বেশ কয়েকদিন তাঁর সঙ্গে থাকব।

লোকটি আমাকে তাঁর ঘরে নিয়ে  বেশ আদর আপ্যায়ন করলেন। এরপর আমাকে শোয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে, তিনি জানালেন তাকে এখন তার কাজে যেতে হবে। প্রভাতের আগেই তিনি ফিরে আসবেন।

লোকটি সকালে এলো, আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, আজকে কি তুমি সফল হয়েছো? জবাবে তিনি জানান, আজকে তিনি সফল হননি কিন্তু আগামীকাল অবশ্যই সফল হবেন। বললেন,‘আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি কিন্তু আজ সফলতার মুখ দেখিনি। তবে স্রস্টা চাইলে আগামীকাল অবশ্যই সফলতার দেখা মিলবে’- লোকটি আমাকে জবাব দেয়।

পরবর্তী ৩০ দিনের একটি দিনও তিনি আর সফল হন নি। কিন্তু এর মাঝে একটি বারের জন্যও লোকটিকে আমি গম্ভীর হতে দেখিনি। সর্বদা হাস্যোজ্জ্বল ছিলেন এবং নিজের ওপর ভরসা রাখতেন।

এক মাসের মত লোকটির কাছ থেকে আমি যা শিক্ষা পাই, আমি সারা জীবন তা ধরে রাখি। যখনই আমি কোনো কাজ ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা করি, তখনই আমার ওই লোকটির কথা মনে পড়ে।

সেই চোর লোকটিই আমাকে ধৈর্য্য ধারণ করা শিখিয়েছেন এবং সর্বদা চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়েছেন। অর্থাৎ তিনিও আমার একজন গুরু।

আলোকিত মোমবাতিটি

আরেকবার আমি এক গ্রামের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় এক বালককে দেখি একটি মোমবাতি হাতে নিয়ে সে যাচ্ছিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, হে বালক বল তো, মোমবাতির এ আলো তুমি কোথায় পেলে’? যেহেতু তুমি এটা জ্বলতে দেখেছো, তাহলে তুমি নিশ্চয়ই জানো এ আলো কোথা থেকে এসেছে।

বালকটি আমার প্রশ্ন শুনে মৃদু হাসে ও হঠাৎ ফুঁ দিয়ে মোমবাতিটি নিভিয়ে দেয়। বালকটি আমাকে প্রত্যুত্তর করে- ‘জনাব, আপনি তো মোমবাতিটি নিভে জেতে দেখেছেন, এবার আপনি বলুন এই আলো কোথায় চলে গেল? আপনি যদি তা বলতে পারেন, তবে আমিও আপনাকে আলোর উৎপত্তি সম্পর্কে বলতে পারব। মূলত, আলো যেখান থেকে এসেছে, সেখানেই চলে গেছে।”

আমি বালকের জ্ঞানে মুগ্ধ হয়ে যাই। সত্যিই তো, আলো কোথা থেকে এসেছে, সেই প্রশ্ন মুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয় না। আলো কোথায় চলে গেল সেটাই বড় প্রশ্ন। পৃথিবীর সবকিছুই অসীম শূন্যতা থেকে এসেছে আবার সবকিছু শূন্যতেই মিলিয়ে যায়।

এত বড় শিক্ষা লাভের পরে, আমি বালকটির পা ছুঁয়ে তাকে সম্মান জানাই। এই বালকটি ছিল আমার একজন গুরু।সে থেকে আমি অসীম শূন্যতা নিয়ে ধ্যান শুরু করি। ধীরে ধীরে সবকিছুই সেই উৎসের কাছে চলে যাবে, যেখান থেকে সবকিছু এসেছে। আমি (মৃত্যুশয্যা) এখন সেই মুহূর্তে রয়েছি। ধীরে ধীরে মোমবাতির আলো নিভে যাবে। অসীম শূন্যতায় প্রবেশ করব আমি। আমি জানি, আমি সেখানেই যাচ্ছি, যেখান থেকে আমি এসেছি।

আমি এখনো সেই ছেলেকে দেখছি যে, মোমবাতি হাতে নিয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আর মোমবাতির আলো নিভিয়ে দেওয়ার অপেক্ষায় আছে। মনে রাখবে, শিক্ষা ছাড়া কোনো ঘটনাই ঘটনা না।