গোড়াপদ্মা- ম্যানগ্রোভ বন আর সৈকত এর অপরূপ মিশেল

ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২১
Spread the love

রাকিবুল ইসলাম, গোড়াপদ্মা থেকে ফিরে

দখিন আর উত্তরের হাওয়া মিলে মিশে দোল খেয়ে যাচ্ছে সোনালী রঙয়ের ধানক্ষেতে। কয়েকজন কৃষক কে দেখা যায় কাঁচি নিয়ে ধান কেটে চলেছেন অবিরাম। দুজন আলোচনা করছিলেন ধান কাটা শেষ হলেই ছোট-খাট একটা নবান্ন উৎসবের মত করবেন। সাথে থাকা তার বাচ্চা ছেলেটা বলল, বাবা খেজুর রসের চিতই হলে খুব ভাল হবে!

দখিনের জেলা বরগুনার সমুদ্র তীরবর্তী এক গ্রাম গোড়াপদ্মা। সমুদ্রের কোলঘেষে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ম্যানগ্রোভ বন,  কুমিরমারা বন। প্রায় এক দশক আগে এটিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। গ্রামের নামানুসারে এর নাম রাখা হয় গোড়াপদ্মা সমুদ্র সৈকত। এ পর্যটনকেন্দ্রে প্রবেশের সময় রাস্তার দু ধারে চোখে পড়ে সোনা রঙা ধানক্ষেতে। শীতের রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে হিমেল হাওয়ায় ধানক্ষেতের দৃশ্য আপনাকে আলাদা এক আনন্দ দিবে। 

সরু রাস্তা ধরে কিছুক্ষণ এগোলে হাতের বাম পাশে দেখা যায় বিশাল এক মাঠ। মনে হবে যেন ছোট ছোট দুর্বাঘাসে আগাগোড়া সবুজের চাদরে মুড়িয়ে দেয়া হয়েছে মাঠটিকে। যারা ছোটবেলায় সবুজ ঘাসে ফুটবল কিংবা ক্রিকেট খেলেছেন, তাঁরা নিমেষেই শৈশবের স্মৃতি আওড়ানো শুরু করবেন, তা নিশ্চিত। দুপ্রান্তের দুটি গোলপোস্ট আর তার চারপাশে বসার স্থান জায়গাটিকে একটা ছোটখাট স্টেডিয়াম বানিয়ে ফেলেছে। সময় পেলে নিজেদের মধ্যে ক্রিকেট কিংবা ফুটবলের একটি ম্যাচের আয়োজন করা যেতেই পারে!

মাঠ পেরিয়ে গেলে রোমাঞ্চকর কুমিরমারা বন শুরু। গাছের পাতার ফাঁক গলিয়ে রোদের ঝলকানি আপনার চোখে এসে লাগবে। ঝিরি ঝিরি হাওয়া বয়ে চলবে অবিরাম। আর পাখপাখালির কলকাকলি মনটাকে আনন্দদায়ক করে তুলবে।

কিছুদূর এগুতেই চোখে পড়বে বরগুনা জেলা প্রশাসন কর্তৃক নির্মিত একটি বসার স্থান। উপরে চাল দেয়া এ ঘরটি বনের একদম মাঝখানে। সেখানে বসে কিছুটা জিরিয়ে নিতে পারেন। চারপাশে শ্বাসমূলীয় গাছ এর মাঝে নিজেকে সুন্দরবনে হারিয়ে যাওয়া এক ভবঘুরে মনে হলে, মনকে দোষ দেয়া যাবে না কিছুতেই। 

খানিক বাদে আপনার ভ্রম কাটবে যখন আপনি দক্ষিণ দিকে তাকাবেন। বেশ খানিকটা খোলা মাঠ সেখানে। বড় বড় ঘাসের মাঠটি একসময় সৈকত ছিল। কিন্তু বনের বৃদ্ধিতে এখন সৈকত আরো দূরে সরে গিয়েছে। এ মাঠের পরেই মাঝারি একটা বন। আপনার মন যখনই ওই বনের পরে কি আছে জানতে চাইবে, আপনি দেখবেন বনের মাঝ থেকে বেড়িয়ে এসেছেন ২-১ জন জেলে। হাতে তাঁদের সদ্য শিকার করা মাছ। কিংবা আপনাকে পাশ কাটিয়ে উলটোপথে কেউ হয়ত বনের দিকে যাচ্ছে মাছ ধরার উদ্দেশ্য নিয়ে। 

আপনি যখন এ বনটির মধ্য দিয়ে হেটে যাবেন, তখনই সমুদ্রের ঝিরি ঝিরি হাওয়ার আবেশ পাওয়া শুরু করবেন। বনের শেষে উর্ধ গগনে সদা হাস্যোজ্জ্বল সূয্যি মামার দেখা মিলবে। আর নাক বরাবর তাকালে দিগন্তহীন বঙ্গোপসাগর। বনের শেষ দিকের মাটি কিছুটা নরম। সাধারন জুতা বা খালি পায়ে যাওয়াই শ্রেয়। 

বনের শেষে কিছুটা যায়গায় বড় বড় লাল ঘাসের মধ্যে দাঁড়ালে মনে হবে আপনি গম বা যবের ক্ষেতে দাঁড়িয়ে আছেন। এরপর প্রায় আধা কিলোমিটার সৈকত। রোদের আলোয় ঝিলমিল করে ভিজা বালিগুলো। সৈকত মাড়িয়ে পানিতে নেমে যেতে পারবেন। বর্ষাকালে বড় বড় ঢেউ হলেও শীতকালে শান্তই থাকে।

গোড়াপদ্মা সমুদ্র সৈকতে দাঁড়িয়ে পূর্ব দিকে আপনার চোখে পড়বে পায়রা নদীর মোহনা আর পশ্চিম দিকে বিষখালী নদীর মোহনা। এ সৈকত থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দুটিই উপভোগ করতে পারবেন খুব ভালভাবে। 

এ এলাকার যে জিনিসটি সবথেকে আপনার হৃদয় হরণ করবে, তা হল এখানের বাসিন্দাদের সরলতা ও আতিথেয়তা। ভয়াবহ ঘুর্ণিঝড় সিডর-আইলা-বুলবুল মোকাবিলা করে বেঁচে থাকা সংগ্রামী লোকগুলো আপনাকে আপন করে নিবে নিমিষেই।

যেভাবে যাবেন– ঢাকা থেকে লঞ্চে করে বরগুনা যেতে হবে। এরপর লঞ্চঘাটের গেটেই পাবেন বরগুনা-নিশানবাড়িয়া রুটের বাস। ভাড়া নিবে ৫০ টাকা। যেতে সময় লাগবে ১ ঘন্টা। লোকাল বাস হলেও বাসের সার্ভিস খুবই ভাল। এ বাসস্টান্ড থেকে প্রতি আধা ঘন্টা পরপর বাস ছাড়ে। 

নিশানবাড়িয়া গেলে সেখান থেকে অটো বা মটরসাইকেলে চেপে চলে যেতে পারেন গোড়াপদ্মা সমূদ্র সৈকত। অটোতে একজনের ভাড়া ৫০ টাকা সেখান থেকে। আর মটরসাইকেলেও ৫০ টাকা করে। নিশানবাড়িয়া থেকে গোড়াপদ্মার দূরত্ব ৮ কিলোমিটার।

নিশানবাড়িয়া থেকে গোড়াপদ্মার মাঝে কিছু রাস্তা কাচা মাটির। বাকিটা পাকা রাস্তা। বর্ষাকালে গেলে আপনাকে বাবুগঞ্জ ঘুরে সেখানে যেতে হবে।

থাকার ব্যবস্থা– গোড়াপদ্মা সমুদ্র সৈকতে ২ রুমের একটি জেলা পরিষদ ডাকবাংলো আছে। দুটিতেই এটাস্ট বাথরুম। ভাড়া সাশ্রয়ী। 

খাওয়ার ব্যবস্থা– খাওয়ার জন্য ডাকবাংলোর দায়িত্বে থাকা ব্যক্তির শরনাপন্ন হতে হবে। তিনি ব্যক্তিগতভাবে ব্যবস্থা করে দিবেন। অথবা আপনার ইচ্ছাঅনুযায়ী রান্না করে দিবেন। দেশি মুরগি আর তাজা সমুদ্রের মাছ খেতে পারবেন যখন তখন। 

তাছাড়া ১ কিলোমিটার দূরেই রয়েছে বাবুগঞ্জ বাজার। সেখানেও চলে যেতে পারেন।

নিরাপত্তা– বরগুনা শহর থেকে কিছুটা দূরে হলেও নিরাপত্তা নিয়ে কোন চিন্তা নেই। এখানের মানুষগুলোর সাথে কথা বলে জানা গেল, তারাও চান যেন আরো বেশি পর্যটক এখানে আসেন। এর জন্য সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করতে তাঁরা প্রস্তুত। তারপরও কোন সমস্যা হলে বাবুগঞ্জ পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সাহায্য নেয়া যেতে পারে।