জুনায়েদ বাগদাদীঃ প্রেম ও জ্ঞানের দরিয়া

জানুয়ারি ২৮, ২০১৯
Spread the love

 

অনিন্দ্য আফরোজ

জুনায়েদ বাগদাদী  একজন বিখ্যাত সূফিসাধক। বাগদাদের বড় পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানীকে কোলে নিয়ে যিনি প্রথম দোয়া করেছিলেন । তাঁর প্রধান শিষ্যের নাম হযরত মনসুর হাল্লাজ। হযরত জুনায়েদ বাগদাদী বাগদাদ নগরে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর সময় সুফিবাদ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।

তাঁর প্রধান শিষ্য মনসুর হাল্লাজ যখন ঘোষণা করলেন, ‘আনাল হক’ অর্থ্যাৎ আমিই মহাসত্য, তখন তৎকালীন বাগদাদের শাসক এবং অনেকে ব্যাপারটি মেনে নিতে পারেননি। এজন্য তারা হাল্লাজের বিরুদ্ধে ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগ এনে তীব্র  প্রতিবাদ জানান। শেষ পর্যন্ত তার প্রধান শিষ্য মনসুর হাল্লাজকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে হয়েছিল। অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে তিনি তার শিষ্যের মৃত্যুদণ্ড দেখেছিলেন। জুনায়েদ অতিন্দ্রীয় সাধক হলেও  নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারতেন। কিন্তু  তাঁর শিষ্য মনসুর হাল্লাজ তা প্রকাশ করে দিয়েছিলেন।

সূফি সাধক জুনায়েদ বাগদাদী ২১৮ হিজরি সালে বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন। ২৯৭ মতান্তরে ২৯৮ হিজরির রজব মাসে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। জুনায়েদ বাগদাদী বিশ্বাস করতেন, প্রকৃত সূফি সাধকের ব্রতহলো, জগতের মোহ থেকে আপন প্রবৃত্তিকে প্রভাবমুক্ত রাখা, চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধন, প্রবৃত্তির প্রবঞ্চনা ও প্রতারণা, মোহ আত্মাকে পুত-পবিত্র রাখা তথা আত্মিক উৎকর্ষ সাধন, অন্তরের কুটিলতা পরিহার করে সদা সৎ চিন্তায় বিভোর থেকে জীবন মরণ কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টিতে উৎসর্গ করা। 

একবার জুনায়েদ বাগদাদীর চোখে খুব ব্যথা হলো। চিকিৎসক এসে বললেন, চোখে পানি লাগাবেন না। তিনি অজু করতে গেলেন এবং ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুম থেকে তিনি যখন জেগে উঠলেন তখন দেখলেন তার চোখ ভালো হয়ে গেছে। তিনি অদৃশ্য থেকে শুনতে পেলেন, আমার সন্তুষ্টির জন্য জুনায়েদ তার চোখকে বিপন্ন করেছে, এ কারণেই আমি তাকে চোখের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিলাম। জুনায়েদ বাগদাদীর আরেকটি ঘটনা, একবার তিনি স্বয়ং ইবলিসকে দেখতে চাইলেন। তিনি মসজিদের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, একটু পর তিনি দেখলেন এক বৃদ্ধ লোক তার দিকে এগিয়ে আসছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে? উত্তর এল, তোমার ইচ্ছা। আমি তাকে বললাম, কেন তুমি আদমকে সিজদা করনি? উত্তর এল, আমি আমার প্রভুকে ছাড়া আর কাকে সিজদা করব? অথচ প্রভুই তাকে হুকুম করেছেন।

আরো্ পড়ুন…মনসুর হাল্লাজঃ মরমী প্রেমের শ্রেষ্ঠ শহীদ

একবার হজের মৌসুমে সুফিদের মধ্যে`প্রেম` নিয়ে আলোচনা উঠল । সবাই এনিয়ে বিভিন্ন মত প্রকাশ করলেন । হযরত জুনায়েদ (রাহ.) ছিলেন তাঁদের মধ্যে  বয়সে নবার ছোট । সকলে তাঁকে বললেন , তোমার যা মনে আসে তা তুমি বলেত পারো। এরপর তিনি মাথা নিচের দিকে ঝুকিযে কাঁদতে লাগলেন । তারপর বললেন , প্রেমিক ওই ব্যাক্তি, যার নিজের বলতে  কোনো কিছু নেই । সে সবর্দা আল্লাহর জিকিরে মশগুল থেকে তাঁর হক সমূহ আদায় করে। সে দেখতে পায় , তার অন্তর ঐশী প্রেমের আলোয় উদ্ভাসিত। তাঁর একমাত্র সুপেয় পানীয় হল, আল্লাহর দয়া ও প্রেম। স্বয়ং আল্লাহ্ তাঁর জন্য অদৃশ্য জগত থেকে আত্নপ্রকাশ করেন। সে কথা বললে একমাত্র আল্লাহ্র সঙ্গেই কথা বলে। যদি নড়াচড়া করে তাহলে আল্লাহর নির্দেশেই নড়াচড়া করে। সে প্রশান্তি পেলে একমাত্র আল্লাহর কাছেই প্রশান্তি পায় । সে সবর্দা আল্লাহর সঙ্গেই থাকে । জুনায়েদ বাগদাদীর কথা শুনে উপস্থিত সুফিগণ কাদঁতে লাগলেন । অতঃপর বললেন,তারচেয়ে বেশি আর কে প্রেম সম্পর্কে বলতে পারবে? এবং বললেন , হে তাজুল আরেফিন ! আরেফগণের মাথার তাজ আল্লাহ্ তোমাকে আরো বেশি জ্ঞান বুদ্বি দান করুন ।

আরো পড়ুন……শামস তাবরিজির অজানা প্রেমের রসায়ন

বাগদাদের আরেকটি ছোট  ঘটনা। একদিন জুনায়েদ বাগদাদী বক্তব্য রাখছিলেন, সে আসরের মধ্য থেকে একজন লোক ভিক্ষা চাইতে শুরু করলেন। জুনায়েদ বাগদাদী ভাবলেন, লোকটি সুস্থ, কেন সে ভিক্ষা চাইছেন? সেই রাত্রেই জুনায়েদ বাগদাদী স্বপ্নযোগে দেখলেন তাঁর সামনে একটি ঢাকনা দেওয়া থালা। তাঁকে খেতে আদেশ দেওয়া হলো। ঢাকনা খুলে তিনি দেখলেন সেই ভিখারীটি মৃত অবস্থায় থালায় শুয়ে আছেন। জুনায়েদ বললেন, আমি মানুষের মাংস খাই না। অদৃশ্য থেকে আওয়াজ এলো, তুমি মসজিদে কেন মানুষের মাংস খাচ্ছিলে? তিনি বুঝতে পারলেন তিনি ভুল করেছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি সে ভিক্ষুককে খুঁজে বের করলেন এবং তাঁর কাছে ক্ষমা চাইলেন। এভাবেই মহাপুরুষরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন এবং ক্ষমা চেয়ে নেন।

জুনায়েদ বাগদাদীই প্রথম ইলমে তাসাউফের নিয়ম কানুন লিপিবদ্ধ করেন। তিনি একই সঙ্গে আরিফবিল্লাহ ও রাহনামায়ে হিসেবে জগত জোড়া খ্যাতি পেয়েছেন। তাঁর আরেক শিষ্য  শেখ আবু বকর শিবলীর মতে, তাঁর গুরু হযরত জুনায়েদ বাগদাদী আল্লাহর প্রেমে মনে হতো পাগল হয়ে গেছেন। তিনি ভক্তিমূলক গান ও সামা পছন্দ করতেন। এই মহান সুফি বছরের সাত থেকে আট মাস নফল রোজা রাখতেন। বছরের প্রতিটি দিন সালাতুল তাহাজুদ নামাজ আদায় করতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সিজদায় পড়ে মহান আল্লাহর দরবারে চোখের পানি ফেলতেন।

 

জুনাইদ বাগদাদীর  কিছু বানী

 

#‘ প্রকৃত বুদ্ধিমান সে-ই, যে নির্জনতা পছন্দ করে’।

#‘নিজেকে নিয়ামতের অনুপযুক্ত বলে ধারণা করাই হল কৃতজ্ঞতা’।

 

#‘প্রতি মুহূর্তে আজাবের আশঙ্কায় সন্ত্রস্ত হয়ে থাকাকে বলে ভয়’।