‘ঔরাং মেডান’ এক ভৌতিক জাহাজ!

সেপ্টেম্বর ৯, ২০১৯
Spread the love

 

অনিন্দ্য আফরোজ

 ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপ আর মালয়েশিয়ার মধ্যবর্তী মালাক্কা প্রণালী দিয়ে চলাচল করে অসংখ্য জাহাজ। এমনিতেই এই অঞ্চলে এ নৌপথটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অসংখ্য জাহাজের ভিড় লেগে থাকে এখানে। ১৯৪৭-এর জুন মাসের ঘটনা। আকষ্মিত এ পথে চলাচলকারী দুটি জাহাজের ক্যাপ্টেন একটি এসওএস  (বিপদবার্তা) পেলেন। খুব হালকাভাবে বার্তাপ্রেরক লিখেলেন, আমাদের জাহাজের ক্যাপ্টেন, ক্রু  সবারই মৃত্যু হয়েছে। আমিও মৃত্যুবরণ করতে চলেছি। এরপর আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। যেন শ্মশানের নীরবতা।

গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ মালাক্কা প্রণালীতে একটি অজানা জাহাজ থেকে পাঠানো এই  বিপদবার্তা বা এসওএস ছড়িয়ে পড়েছিল অন্য জাহাজের কাছে। সেই বিপদবার্তা পেয়ে অজানা জাহাজটিকে  উদ্ধার করতে দ্রুত এগিয়ে আসে দুটি জাহাজ।  দুটি জাহাজ ওই এসওএস চিহ্নিত করেছিল। এর একটি ছিল মার্কিন জাহাজ সিলভার স্টার।  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই জাহাজটিই প্রথম অজানা ওই জাহাজটিকে চিহ্নিত করেছিল।
বিপদের বার্তা পাওয়ার পর যুক্তরাষ্টের জাহাজ ‘সিলভার স্টার’ একটু সময়ও নষ্ট না করে দ্রুত  জাহাজটির কাছে চলে আসে। তারা কাছে এসে  দেখেন অজানা জাহাজটির নাম ‘ঔরাং মেডান’। এটি ছিল একটি ডাচ  (নেদারল্যান্ডস) জাহাজ। ১৯৪৭ এর  ওই সময়ে   ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপটি ছিল ডাচ কলোনি।  সুমাত্রা দ্বীপের একটি বড় শহরের নাম মেডান। ইন্দোনেশিয় ভাষায় ‘ঔরাং’ শব্দের অর্থ ব্যক্তি বা মানুষ।  তার মানে ভ্যেতিক ওই জাহাজটির নামের অর্থ ছিল মেডানের মানুষ। সিলভার স্টারের ক্যাপ্টেন ওই জাহাজটির কাছে এসে  দেখলেন, জাহাজটিতে  প্রাণের কোনোই স্পন্দন নেই। তিনি নাবিকদের নির্দেশ দিলেন ওই জাহাজটিতে গিয়ে অনিুসন্ধান চালাতে।
সিলভার স্টারের নাবিকেরা জাহাজ ঔরাংয়ে নামতেই তাঁদের চোখ চরকে ওঠে। তাঁরা দেখলেন, এসওএস-টা মোটেই ভুল ছিল না। ডেকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে নাবিকদের স্পন্দনহীন দেহ। তাদের সবার চোখ বিস্ফোরিত। অবস্থা দেখেনাবিকদের  মনে হলো, কোনো এক অজ্ঞাত হামলাকারীর কবল থেকে  নিজেদের বাঁচাতে ডেকে পড়ে থাকা নাবিকদের হাত মুষ্টিবদ্ধ। কিন্তু তারা সবাই  মৃত। অথচ তাঁদের শরীরের কোথাও  বিন্দুমাত্র আঘাতের ছিঁটেফোঁটা নেই। তবে নাবিকদের দেখে বোঝা যায়, তারা ভীষণ  কষ্ট পেয়ে মারা গেছেন। জাহাজটিতে সব কিছুই ছিল। ক্যাপ্টেন, বার্তাপ্রেরক সবাই  নিজ নিজ স্থানে রয়েছেন।  মনে হচ্ছে যেন, আকষ্মিক কোনো দৈব-দুর্বিপাকে সবকিছু নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। অজানা আতঙ্কে সবকিছু স্থির হয়ে গেছে।   ‍যিনি যে অবস্থায় ছিলেন, সেভাবেই তাঁদের প্রত্যেকের মৃত্যু হয়।কিন্তু, সিলভার স্টারের নাবিকরা সর্বত্র ঘুরেও এমন কোনো দুর্ঘটনা কিংবা আক্রমনের আলামত  দেখতে পেলেন না, যাতে এতো লোকের মৃত্যু হতে পারে।  

এরপর নাবিকরা যখন জাহাজের ভেতরে ঢুকলেন, তখন তাঁদের শিরদাঁড়া শীতলতা অনুভব করছিল। অথচ তখন প্রায় ৪০ ডিগ্রি তাপ বইছিল। কিন্তু এতো তাপদাহের মধ্যেও সিলভার স্টারের নাবিকরা ঠান্ডার অনুভূতি পেলেন। তাহলে কী ঘটেছিল এই  জাহাজে, কেনই বা এমন প্রাণহানি হলো ? সিলভার স্টারের ক্যাপ্টেনও সব দেখে  হতভম্ব। তিনি কিছুই বুঝতে পারলেন না। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন   অক্ষত জাহাজটি নিজের জাহাজের সঙ্গে বেঁধে পাড়ে টেনে নিবেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দড়িও বাঁধলেন। এবার সিলভার স্টার যখন ওই জাহাজকে টেনে আনতে তৈরি, ঠিক তখনই ঘটলো  বিকট শব্দে বিস্ফোরণ। এরপর নিমজ্জিত হলো ‘এস এস ঔরাং মেডান’ নামের জাহাজটি।

আরো পড়ুন………বরফখন্ডে ধাক্কা নয়, টাইটানিক ডোবার কারণ ছিল আগুন!

২০০ বছরের ডুবন্ত জাহাজ এগিয়ে আসছে ডাঙার দিকে!

জাহাজটি  নিয়ে  রহস্য কিন্তু এখানেই শেষ হলো না। এরপর অনেক খুঁজেও পাওয়া গেল না ‘ঔরাং’ নামে কোনো জাহাজের সনদ। ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা তো  এমনকি নেদারল্যান্ডসেও ওই জাহাজের অস্তিত্ব মেলেনি। বিষ্ময়কর ব্যাপার হলো,এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সিলভার স্টারের নাবিকরা ওই জাহাজ সম্পর্কে মুখও খোলেননি।

ডাচ ‘ঔরাং’ নিমজ্জিত হ্ওয়ার  কারণ সন্ধান করেছেন জার্মানির  এক অধ্যাপক। থিওডোর নামে ওই অধ্যাপক লিখেছেন, মূলত ‘ঔরাং’নামে ওই জাহাজটি পটাশিয়াম সায়ানাইড ও নাইট্রোগ্লিসারিন বোঝাই করে সুমাত্রা  যাচ্ছিল। এ দুটি রাসায়নিকই খুব ভয়ঙ্কর। কারণ, এই রাসায়নিক দুটি উদ্বায়ী। এজন্য উত্তাল সমুদ্রপথে এই রাসায়নিক বহর করায় নিষেধাজ্ঞা আছে। কারণ উত্তাল সমুদ্রের ঢেউয়ের তোড়ে এই দুই রাসায়নিকের  বিস্ফোরণ অনিবার্য।

আরো পড়ুন….৯০ বছর পর খোঁজ মিলল অন্য এক ‘টাইটানিক’

যদিও ‘ঔরাং’ ডুবে যাওয়া এবং এর নাবিকদের মৃত্যু নিয়ে আরো অনেক তত্ত্ব আছে। অবশ্য কেউ কেউ বলেন, উড়ন্ত চাকি থেকে ভিনগ্রহের কোনো জন্তু, জাহাজের সব নাবিকদের মেরে ফেলেছিল। আবার কেউ কেউ বলেন, মেঘের মিথেন গ্যাসের প্রভাবে এমন  দুর্ঘটনা ঘটেছে।

তবে রয় বেইনটন নামে এক ঐতিহাসিক জাহাজটির এমন রহস্য নিয়ে গবেষণা করেছেন। রয় বেইনটনও মনে করেন, জাহাজ ডুবির ঘটনাটির সঙ্গে কোনো অতিপ্রাকৃত ব্যাপার ছিল না। জাহাজটিতে বিষাক্ত রাসায়নিক বয়ে নিয়ে যাওয়ার কারণে এমনটা হয়েছে। তাঁর মতে, উত্তাল সমুদ্রের পানি যে কোনোভাবে জাহাজের খোলের মধ্যে ঢুকে পড়ে। আর সেই পানির সঙ্গে  রাসায়নিক বিক্রিয়া হয়ে সেখান থেকে নির্গত বিষাক্ত গ্যাসের প্রভাবেই ওই জাহাজের নাবিকেরা সবাই প্রাণ হারান। আর এর প্রভাবেই জাহাজটিতে বিস্ফোরণ হয়েছিল।
কিন্তু প্রকৃত সত্য যাই হোক ঔরাংয়ের এই ঘটনা আসলেই কি সত্যি  কি না, তা আজও রহস্যঘেরা। এজন্য এখনো মানুষ এই  জাহাজটিকে ‘ঘোস্ট শিপ’ বা ভৌতিক জাহাজ বলেই মানেন এবং জানেন।