জোসেফ গোয়েবলসঃ প্রপাগান্ডার জাদুকর

সেপ্টেম্বর ৯, ২০১৯
Spread the love

অনিন্দ্য আফরোজ

‘তিলকে তাল বানানো’! এমন বাগধারার ব্যবহার হরহামেশাই আমরা শুনি। কিন্তু এটা নিছক কথার কথা নয়। আমাদের চারপাশে এর নজিরও মেলে।  জোসেফ গোয়েবলস– এমনই এক ব্যক্তি যার নাম নিলে আর বলতে হয়না  প্রপাগান্ডা বা অতিরঞ্জিত শব্দগুলো। আমাদের দেশেও  প্রচলন আছে  ‘গোয়েবলসিয়’ শব্দটি। তিনি ছিলেন জার্মানির  এক নায়ক হিটলারের প্রচারমন্ত্রী। যা কম্মিনকালেও ঘটার সম্ভাবনা নেই, এমন ঘটনা ঘটেছে রব তুলতে যার জুড়ি ছিল না। শুধু ভাষণ-বক্তৃতায় নয়, খোদ রেডিও-খবরের কাগজে গুজবের বেসাতি ছড়িয়ে প্রতিপক্ষকে ধোঁকা দেওয়া আর স্বজাতির মনে সরকারের আনুগত্য সৃষ্টি করাই  ছিল তার মূল লক্ষ্য।  

এবার জানুন সেই ভয়ঙ্কর মিথ্যাবাদী জোসেফ গোয়েবলস সম্পর্কে।

ভয়ঙ্কর মিথ্যাবাদী এই জার্মান রাজনীতিবিদ হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য ও ইতিহাসে পড়াশোনা শেষ করে একজন লেখক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন। একটি উপন্যাস, কয়েকটি নাটক লেখেন তিনি। এ ছাড়া বার্লিনে কিছুদিন সংবাদপত্রেও কাজ করেন।

১৯২২ সালে অ্যাডলফ হিটলারের বক্তৃতা শুনেই তার জীবনের ধারা পাল্টে যায়। যোগ দেন হিটলারের ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টিতে (নাৎসি পার্টি)। বাচনশৈলী ও অন্যান্য যোগ্যতার কারণে শিগগিরই হিটলারের নজরে পড়ে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হন।

জার্মানি তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের খেসারত দিচ্ছে। হেরে গিয়ে তখনকার পরাশক্তি ফ্রান্স আর ইংল্যান্ডের কাছে এই মর্মে খত দিয়েছে, তারা আর যুদ্ধ করবে না_ এখন থেকে শান্তির পথে চলবে। ভার্সাই চুক্তির শর্তানুসারে চীন, প্রশান্ত মহাসাগর এবং আফ্রিকায় সব জার্মান কলোনি ব্রিটেন, ফ্রান্স, জাপান এবং অন্যান্য মিত্রশক্তির কুক্ষিগত হয়। জার্মানিকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় এবং মিত্রশক্তির অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোতে জীবন, অর্থ ও অবকাঠামোগত সব ক্ষয়ক্ষতির জন্য জার্মানিকে দায়ী করা হয়। চুক্তি অনুসারে, জার্মানিকে তার সাম্রাজ্যের অনেক অংশ মিত্রবাহিনীর হাতে ছেড়ে দিতে হয়। পিতৃভূমির এমন হতশ্রী অবস্থা তাকে দারুণভাবে ক্ষুব্ধ করে।

১৯২৪ সালের ৪ জুলাই তিনি লেখেন, ‘জার্মানিতে এখন শক্ত মানুষের দরকার। জার্মানিকে নিয়ে
সব রকমের ফঁfকা বুলি আর পরীক্ষা-নিরীক্ষার অবসান হওয়া দরকার। আমাদের এখন মন-প্রাণ উজাড় করে কাজ শুরু করতে হবে। ইহুদিদের আমরা চাই না। কারণ তারা কখনও সত্যিকার জার্মান হতে চায় না। ওদের শক্ত পিটুনি দেওয়া দরকার। আর দারুণ খরায় পৃথিবী যেমন বৃষ্টির জন্য হাহাকার করে, তেমনি জার্মানিও এখন এমন এক মানুষের অপেক্ষায় আছে, যে তাকে এই দৈন্যদশা থেকে উদ্ধার করবে।’

৪ জুলাই তিনি লেখেন, ‘সব কিছুতে ভীষণ হতাশা বোধ করছি। যা করতে চাই, কিছুই ঠিকমতো হচ্ছে না। মনে হয়, একটা গর্তে পড়ে আছি, যেখান থেকে বেরোবার কোনোই পথ নেই। কেন বেঁচে আছি, তার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। মাঝে মাঝে সকালে ঘুম থেকে উঠতেও ইচ্ছা হয় না। মনে হয় না, তার কোনো দরকার আছে।’

এ সময় পর্যন্ত গোয়েবলস তার বেঁচে থাকার কোনো উদ্দেশ্য খুঁজে পাচ্ছিলেন না। আসলে নিজ পিতৃভূমির দৈন্যদশা তার মনে পাষাণভারের মতো চেপে বসেছিল। এ অবস্থা থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসা যায়, তার কোনো উপায় দেখছিলেন না। তবে এর প্রায় দু’বছর পর ১৩ এপ্রিলে লেখা তার ডায়েরি অন্যরকম ইঙ্গিত দেয়। এবারই প্রথম তার ডায়েরিতে হিটলারের নাম আসে।

তিনি লেখেন, ‘শুনলাম হিটলারের ফোন এসেছে। আমরা গেলাম। তিনি আমাদের স্বাগত জানালেন। আমরা তাকে কাছে থেকে দেখলাম। লম্বা, স্বাস্থ্যবান, সবল মানুষটা। … তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করলাম। তিনি চমৎকার করে সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন। আমি তাকে পছন্দ করে ফেললাম। তাকে আমি আমার নেতা হিসেবে বরণ করে নিলাম। মনে হলো, তিনি এক রাজনৈতিক প্রতিভা।’

১৯২৬ সালের ৬ জুন লেখা ডায়েরিতে আবারও হিটলারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ গোয়েবলস। বলেছেন, হিটলার তার কাছে আগের মতোই প্রিয়। তার মতো নেতাকে ভালো না বেসে থাকা যায় না। তার এমন ধারণার কথাও বলেছেন যে, তার মতো নেতা থাকলে বিশ্বজয় করা যায়।


গোয়েবলসের লেখা ডায়েরি
১৯২৮ সালের ২৬ অক্টোবর লেখা ডায়েরিতে হিটলারের কোনো প্রসঙ্গ নেই। এখানে গোয়েবলস নিজের কিছু শারীরিক ও মানসিক সমস্যার কথা বলেছেন। এখানে তার একাকিত্বের কথাই ফুটে উঠেছে। বলেছেন, ‘আমার কোনো বন্ধু নেই। আমার স্ত্রীও নেই। আমি বোধ হয় খুব বড় ধরনের একটা মানসিক সমস্যায় ভুগছি। পায়ের সে পুরনো যন্ত্রণাটা আবার দেখা দিয়েছে। ভীষণ কষ্ট পাচ্ছি। এদিকে আবার গুজব রটেছে, আমি নাকি সমকামী। আমাদের বিরুদ্ধবাদীরাও উঠেপড়ে লেগেছে। সব কিছু মিলিয়ে আমার জন্য এ এক অসহনীয় অবস্থা। রীতিমতো কান্না করার মতো।’

১৯২৯ সালে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট এবং জার্মানদের মধ্যে বেকারত্ব ও খাদ্যের অভাব নাৎসি পার্টির জন্য এক দারুণ সুযোগ নিয়ে আসে। ১৯৩৩ সালে হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর হয়ে বসেন। ৩১ জানুয়ারি গোয়েবলসের ডায়েরিতে পাওয়া যায় ক্ষমতায় যাওয়ার পর গোয়েবলসের উচ্ছ্বাস। তিনি লেখেন, ‘শেষ পর্যন্ত আমরা পেরেছি। হিটলার এখন চ্যান্সেলর। এটা তার প্রাপ্য ছিল। আমাদের রূপকথার মতো স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। আমি রেডিওতে ভাষণ দিয়েছি। জার্মানির সবাই আমার কথা শুনেছে!’

হিটলার সরকারের প্রোপাগান্ডা মিনিস্টার হন জোসেফ গোয়েবলস। যুদ্ধের আগে বাকি বছরগুলোতে মনপ্রাণ ঢেলে দেন নাৎসি আদর্শ প্রচারে। তার ডায়েরিতে এসেছে বিভিন্ন সময়ের ঘটনা, তার সম্পৃক্ততাসহ নানা বিষয়।

এর পরের বছরগুলো এবং ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পরের চার বছর বিভিন্ন সময়ে ডায়েরি লিখেছেন গোয়েবলস। তাতে উঠে এসেছে যুদ্ধ, জার্মানির প্রাথমিক অগ্রগতি, রণকৌশল, হিটলারের প্রশংসাসহ অনেক বিষয়। কিন্তু ১৯৪৩ সাল থেকে ধীরে ধীরে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যেতে শুরু করে। ১৯৪৩ সালের ২৪ নভেম্বর গোয়েবলস লিখেছেন, ‘বার্লিনের ঘটনা আমাকে হতাশ করেছে। বুঝতে পারছি না ইংরেজরা কীভাবে আমাদের এতটা ক্ষতি করল? উইলহেলমপ্লাজের অবস্থা তো বর্ণনাতীত।’

অবস্থা দ্রুত পাল্টাচ্ছে। গোয়েবলসের প্রচার (একই মিথ্যাকে বারবার পরিবেশন করে ‘সত্য’ বানানোর কসরত), হিটলারের রণহুঙ্কার, কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ইহুদি নিধন_ কোনো কিছুতেই আশার আলো দেখানোর মতো কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ১৯৪৪ সালের ৭ জুলাই গোয়েবলস লিখলেন, ‘আমাদের সব উদ্যম যেন ফুরিয়ে গেছে। পশ্চিম রণাঙ্গনে আমাদের প্রতিরোধ শক্তি নিঃশেষ প্রায়। পূর্ব রণাঙ্গনে আশার আলো দেখছি না। আমাদের তথ্যব্যবস্থাপনা ব্যর্থ এবং চরম সমালোচনার মুখে পড়েছে। আমাদের সাংবাদিক এবং সংবাদ উপস্থাপকরা ফের তাদের মুখকে বুলেটের মতো চালাতে শুরু করেছে। এ বিষয়টা আমি কখনও পছন্দ করিনি। সাধারণ মানুষ আমাদের আর বিশ্বাস করছে না। তারা সত্য জানতে চাইছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছেন, আমাদের জার্মানদের জন্য পরিণতিতে অপেক্ষা করছে, অহেতুক কঠিন পরিশ্রম, রক্ত, অশ্রু আর ঘাম। আমাদের মানুষরা কি সেটাই বিশ্বাস করতে শুরু করেছে? সত্যি বলতে কী, আমাদের কাছেও এখন যেন সেটাই সত্যি হতে চলেছে বলে মনে হচ্ছে।’
১৯৪৫ সাল। অবশেষে শেষের দিনগুলো ঘনিয়ে এলো। ৫ মার্চ মিত্রবাহিনীর হাতে মার খেতে খেতে নাস্তানাবুদ জার্মান বাহিনী ঘরে ঢুকে গেল। মার্কিন বাহিনী পশ্চিম দিক থেকে রাইন নদী পেরিয়ে এলো। পুব থেকে রুশ বাহিনীর তাড়া। বার্লিনে রুশ-জার্মান রক্তক্ষয়ী লড়াই। এপ্রিলের শেষ দিকের সপ্তাহগুলো জুড়ে অসংখ্য সাধারণ মানুষ আর জার্মান সেনার মৃত্যু।

৩০ এপ্রিল বার্লিনে বাঙ্কারে অবস্থানরত হিটলার নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করলেন। গোয়েবলস এবং হিটলারের খুব কাছের মানুষদের কয়েকজন মিলে তার দেহ বাগানে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে ফেললেন।

পহেলা মে, ১৯৪৫। হিটলারকে দাহ করার পর একদিনও অপেক্ষা করলেন না গোয়েবলস। প্রথমে নিজের ছয় ছেলেমেয়েকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করলেন। তারপর স্ত্রীকে গুলি করে মারলেন। সবশেষে নিজের নেতার মতোই আত্মহত্যা করলেন গোয়েবলসও।