সুখের ফেরিওয়ালা ব্রিটিশ তরুণী হান্নাহ

ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২০
Spread the love
অনিন্দ্য আফরোজ

প্রতিটি মানুষকে সুখী, হাসিখুশী দেখতে চান ব্রিটিশ নাগরিক হান্নাহ কার্ন। পচিশ বছর বয়সী এই তরুণী সারা পৃথিবীর মানুষের মাঝে খুশি ছড়াতে দেশ থেকে দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন সাইকেলে। তিনি চান প্রাণীদের প্রতি বৈষম্য দূর করতে। প্রচার করছেন, জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবিলায় প্লাস্টিক পণ্য বর্জন এবং নারীদের সমতার কথা। তাঁর এই প্রকল্পের নাম ‘সবার জন্য আনন্দ’। এরইমধ্যে সাইকেলে চেপে পাঁচটি দেশ ঘুরে এসেছেন বাংলাদেশে। গত মঙ্গলবার তিনি এসেছেন দক্ষিণের বিভাগীয় শহর বরিশালে।

সব সময়, সব পরিস্থিতিতে নিজেকে সুখী ভাবা বা ইতিবাচক চিন্তা করা, প্লাস্টিক পণ্য বর্জন, পশুর প্রতি মানবিক আচরণ, নারীর সমঅধিকার-এই চারটি বিষয় নিয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষে সাইকেলে ২৪ টি দেশ ভ্রমণের লক্ষ্য হান্নাহর। ২০২১ এর এপ্রিলের মধ্যে এ কাজ শেষ করতে চান তিনি। গত বছরের এপ্রিলে ভিয়েতনাম থেকে যাত্রা শুরু করে পাঁচটি দেশ ঘুরে ষষ্ঠ দেশ হিসেবে গত ৩ ফ্রেব্রুয়ারি এসেছেন বাংলাদেশে।

এ লেভেল শেষ করা হান্নাহ শোনালেন সাইক্লিং কীভাবে শুরু এর পেছনের গল্প। ছয় ভা্ই-দুই বোনের মধ্যে হান্নাহ দ্বিতীয়। ছোটবেলাটা খুব সুবিধের কাটেনি তাঁর। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ গভীর দাগ কাটে জীবনে। এর থেকে হতাশা, বিষণ্নতা। একসময় নিজেকে হারিয়ে ফেললেন হতাশার গহ্বরে। এরপর যেন সৎবিৎ ফিরে ফেলেন তিনি। না জীবনটাকে এভাবে হতাশায় নিমজ্জন করার মানে হয় না। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তাঁর উপলব্ধি হলো যে, এভাবে আর নয়। নিজেকে ফিরে পেতে কিছু একটা করতেই হবে! সে উপলব্ধি থেকে হান্নাহ নিজের জীবনে সুখ-খুশি-আনন্দ শব্দগুলোর অস্তিত্ব খুঁজতে শুরু করেন। অনেক চড়াই- উৎড়াইয়ের পর পাঁচটি ধাপে তিনি সুখকে খুঁজে পান। এই পাঁচটি ধাপ হচ্ছে- চিন্তা-ভাবনার প্রতিফলন, চারপাশের বিষয়বস্তুর পর্যবেক্ষণ, প্রেরণা গ্রহণ, উদ্দেশ্য নির্ধারণ ও কাজ শুরু। শেষের ধাপে এসে তিনি অনুধাবণ করলেন, সাইক্লিং করবেন। এতে কম খরচে অনেক পথ ঘোরা সম্ভব, তেমনি বেশি মানুষের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করা যায়। এর মধ্যদিয়ে নিজেকে সুখী করাও সম্ভব। এরপর থেকে সা্ইক্লিংয়ে নেমে পড়েন হান্নাহ।

আঠার বছর বয়সে একা ভ্রমণ শুরু করেন। এরপর দুটি ব্যবসা পরিচালনা করেন। কিন্তু পরবর্তীতে সেগুলো ছেড়ে নিজের চ্যারিটি প্রজেক্ট শুরু করেন।

বুধবার রাতে বরিশালে কথা হয় হান্নাহর সঙ্গে। তিনি বললেন, একটি চ্যারিটি প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করার সময় গত বছরের ফেব্রুয়ারির দিকে সাইকেলে হাতেখড়ি। এক মাস যেতে না যেতেই একরকমের কঠিন সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেলেন। মানুষের জন্য সুখ খুঁজতে সারা বিশ্বব্যাপী সাইকেল চালাবেন তিনি। দৃঢ়চেতা হান্নাহ মনে করেন, ‘সুখ হলো একটি প্যাকেজ। আমাদের জীবনের প্রতিটি ঘটনাকে আমরা কীভাবে গ্রহণ করি তাঁর ওপরে নির্ভর করবে আমরা সুখী নাকি অসুখী’।

প্লাস্টিক বর্জন, পশুর প্রতি বৈষম্য বন্ধ, নারীদের সমঅধিকারসহ নানা বিষয় নিয়ে হান্নাহ কাজ করেন চারটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। সা্ইক্লিং করে তিনি বিভিন্ন দেশের মানুষকে সচেতন করেন এসব বিষয়ে। তাঁর এ সাইকেল ভ্রমণের মাধ্যমে মানুষের কাছ থেকে যে অনুদান পাওয়া যায় সবটাই তিনি ওই চারটি প্রতিষ্ঠানকে দান করেন। হান্নাহ সা্ইকেলে বিভিন্ন দেশে ঘুরে এই চারটি বিষয়ে মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি এসব কাজকে এগিয়ে নিতে  ৫০ হাজার পাউন্ডের একটি তহবিল গঠন করার লক্ষ্য নিয়েছেন। তহবির গঠনের জন্য হান্নাহ একটি ওয়েবসাইট খুলেছেন। ইতিমধ্যে তাঁর কাজকে সমর্থন করে সারা বিশ্ব থেকে ছয় হাজার পাউন্ড অনুদান পাঠানো হয়েছে। তাঁর বিশ্বাস সকলের সহযোগিতা অব্যাহত থাকলে তিনি ৫০ হাজার পাউন্ড মাইলফলক ছুঁতে পারবেন।https://ayna24.com/wp-content/uploads/2020/02/ayna24.mov

গত বছরের এপ্রিলে ভিয়েতনাম থেকে যাত্রা শুরু করে বিভিন্ন দেশ হয়ে ষষ্ঠ দেশ হিসেবে ৩ ফ্রেবুয়ারি তামামিল বন্দর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন তিনি। সিলেট- মৌলভীবাজার-শ্রীমঙ্গল ঘুরে চাঁদপুর আসেন। এরপর লঞ্চে চেপে আসেন বরিশালে। লঞ্চে উঠে যখন শুনলেন রাত তিনটায় লঞ্চ বরিশাল পৌঁছাবে, ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলেন তিনি। কোথায় থাকবেন, কীভাবে শহরে যাবেন- সবকিছুই ছিল অজানা।

এ প্রসঙ্গ আসতেই তিনি বাংলাদেশ আর পশ্চিমা দেশগুলোর একটা তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরলেন। বললেন, লঞ্চে বসে তিনি সেদিন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান। এরপর ফেসবুকে ‘বরিশাল সাইক্লিস্ট’ নামে একটি গ্রুপ খুঁজে পান। সেখানে সাহায্যের জন্য পোস্ট দিতেই সেই গভীর রাতে অনেক প্রতিক্রিয়া পান। বরিশালের অনেকেই তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। আমি নিশ্চিত মধ্য রাতে আমি যদি কোনো পশ্চিমা দেশে সাহায্যের জন্য ফেসবুকে পোস্ট দিতাম, তাহলে কেউ আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসতো না। এটা বাংলাদেশিদের উদারতা ও পরোপকারী মনোভাবের কারনেই হয়েছে’।

বাংলাদেশের কি কি ভাল লেগেছে- জানতে চাইলে একটি লম্বা তালিকা তুলে ধরলেন। বললেন,‘এদেশের মত অতিথি পরায়ন দেশ দ্বিতীয়টি খুঁজে পাইনি’।

বাংলাদেশ ভ্রমণ শেষেই তিনি যাবেন ভারতে। সেখানে বিশ্বখ্যাত কনফারেন্স ‌‌’টেড টক’ এ মানুষের সুখ ও আনন্দ নিয়ে বক্তৃতা করবেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত এ অনুষ্ঠানে নিজের ভ্রমণ অভিজ্ঞতাও শেয়ার করবেন তিনি।

আবার বাংলাদেশে আসতে চান কি না জানতে চাইলে বললেন, ‘অবশ্যই’! বললেন, আমি বাংলাদেশকে নিয়ে কাজ করতে চাই। বাংলাদেশের তরুণদের মাঝে অপার সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে ।ইতিমধ্যেই বাংলাদেশকে নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করছি যেখানে বিদেশি পর্যটকদের এদেশে আসার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে। অনলাইনে আমার নিজস্ব ব্লগ ও সোশ্যাল মিডিয়ায় বাংলাদেশকে সকলের সামনে তুলে ধরতে চাই’।

ভবিষ্যতে কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান- জিজ্ঞেস করলে কিছুটা সময় নিয়ে বললেন, `অনেক পজেটিভ পরিবর্তন দেখতে চাই। সবার আগে দেখতে চাই, পুরুষ ও নারীর সমতা। এরপর যখন বাংলাদেশে আসবো তখন পিছিয়ে পড়া নারীদের নিয়ে কাজ করবো। কারণ, এদেশের নারীরা এখনো পুরুষের থেকে অনেকটা পিছিয়ে আছে বলে মনে হয়েছে আমার’।

ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে হান্নাহ বলেন, ‘বাড়ি ফিরে কিছুদিন পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাবো। এরপর গ্রান্ড ক্যানেরিয়ার উদ্দ্যেশ্যে যাত্রা শুরু করব। সেখান থেকে নৌকায় করে দক্ষিণ আমেরিকা যাব। আর আমার হ্যাপিনেস প্রজেক্টটা চালু রাখব এবং সামাজিক অ্যাক্টিভিজমে নিজের জীবন উৎসর্গ করার ইচ্ছা’।

বললেন,‘নিজের বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে সংসারী হতে আমার ভাল লাগবে। কিন্ত কোনো মতেই জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টাকে হালকাভাবে নিতে পারছি না। এ কারনে নিজেকে উৎসর্গ করাই এখন জীবনের লক্ষ্য’।

Comments are closed