সিলভিয়া রাফায়েলঃ বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এক নারী গুপ্তচর

ফেব্রুয়ারি ৭, ২০১৯
Spread the love

অনিন্দ্য আফরোজ

নিজেদের ক্ষমতা, শক্তি, প্রভুত্ব বাড়াতে এবং তা  বজায় রাখতে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো একে অন্যের ওপর নজরদারি রাখে। আধুনিকালে একে এই নজরদারিকে  গুপ্তচরবৃত্তি বা গোয়েন্দাগিরি বলে।গুপ্তচরবৃত্তি প্রথার গোড়ার দিকে শুধু তথ্য পাচার বা খোঁজ-খবর রাখাই ছিল গোয়েন্দাগিরির মূল কাজ। কিন্তু সময় যত বদলেছে এবং দেশগুলোর প্রভাব-প্রতিপত্তি যতই বেড়েছে ততই ধরণ পাল্টেছে গোয়েন্দগিরির। বিশেষত আমেরিকা-রাশিয়ার মধ্যকার ঠাণ্ডা যুদ্ধ চলাকালে  গোয়েন্দাপনা এক ভয়ঙ্কর পরিণতি লাভ করে।

চলমান বিশ্বে সবচেয়ে ভয়ানক গোয়েন্দা সংস্থার নাম ‘মোসাদ’। মোসাদ হচ্ছে ইসরাইলের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। ঐতিহাসিকভাবে এটাই প্রমানিত এখন যে, মোসাদই বিশ্বে প্রথম গোয়েন্দাপনায় ভয়ঙ্কর ও ধ্বংসাত্মক কাজের সূচনা করে।

ইহুদিরাষ্ট্র ইসরায়েল ১৯৪৮ সালের ১৪ মে প্রতিষ্ঠিত হয়।  ১৯ মাসের মাথায়  দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডাভিড বেন গুরিয়ন ১৯৪৯ সালের ১৩ ডিসেম্বরে ‘দ্য সেন্ট্রাল ইন্সিটিটিউট ফর কোরডিনেসন’ নামে সংস্থাটি গড়ে তোলেন। তবে হয় ১৯৫১ সালের মার্চের শেষের দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘মোসাদ’ নাম দিয়ে এটির কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। রাজধানী তেলআবিবে সংস্থাটির সদর দপ্তর ।

১৯৭২ সালের অলিম্পিককেন্দ্রিক এক হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে পরবর্তী ২০ বছর ধারাবাহিক অসংখ্য গুপ্তহত্যা মোসাদকে এই কুখ্যাতি দেয়।  ইসরায়েল  তাদের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের অনেক এজেন্টকে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের অনেক দেশে গুপ্তচর বৃত্তির কাজে ব্যবহার করে। বিশেষ করে শীতল যুদ্ধের সময় গুপ্তচরদের ব্যাপক দৌরাত্ম্য ছিল দেশে দেশে।

এদের মধ্যে অনেক নারী গোয়েন্দাদের শিহরণজাগানিয়া গল্পও শোনা যায়।তবে এসব গল্পকে ছাড়িয়ে যাওয়া এক নারী গোয়েন্দার নাম সিলভিয়া রাফায়েল। তিনি মোসাদের একজন এজেন্ট ছিলেন।

 মতি কাফির নামে এক লেখক ইতিহাসবিখ্যাত ইসরায়েলি গুপ্তচর সিলভিয়া রাফায়েলের ওপর লেখা একটি বইয়ে এই নারী গোয়েন্দার দুঃসাহসী নানা গল্প উঠে এসেছে। যা ছিল  অবিশ্বাস্য ভয়ঙ্কর । তাঁর লেখা বইয়ে ওঠে আসে সিলভিয়া রাফায়েলের  মোসাদে যোগদান, উত্থান ও মৃত্যু পর্যন্ত পুরো ঘটনাপ্রবাহ ।এজন্য সিলভিয়া রাফায়েলকে এখনো বিশ্বের গুপ্তচরদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হিসেবে মনে করা হয়।


১৯৭২ সালে ৬ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৪টা। হালকা অস্ত্রে সজ্জিত ফিলিস্তিনি গুপ্তচর সংস্থা ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের  ৮ জনের একটি দল অতর্কিতে আক্রমন করে জার্মানির এক গ্রামে। দ্যলটির সদস্যরা ইসরায়েলি কোয়ার্টার ভেঙে মিউনিখ অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করতে যাওয়া তিন অলিম্পিক ক্রীড়াবিদকে বের করে আনে। এরপর এদের মধ্যে  দুজনকে তারা হত্যা করে এবং একজনকে জিম্মি করে। আক্রমণকারী দলটির অন্য দুই সদস্য আলী সালামেহ ও আবু দাউদ  বাইরে থেকে এই হামলার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছিলেন।  তারা যখন গুলির শব্দ পান তখনই বুঝতে পারলেন  মিশন সফল, এবার পালাতে হবে। নিকটবর্তী অপেক্ষারত গাড়িতে ওঠে তারা কাছাকাছি বিমানবন্দরে  যান। সেখান  তারা ভুয়া পাসপোর্ট ব্যবহার করে রোমে চলে যান । রোম থেকে সালামেহ  যান বৈরুত এবং আবু দাউদ  যান বেলগ্রেডে।  জার্মান নিরাপত্তারক্ষীরা গুলির শব্দ পেয়ে তাৎক্ষণিক পুরো  গ্রামটিকে ঘিরে ফেললেও তারা বুঝে উঠতে পারছিল না, ঠিক কি ঘটছে । তারা কোনো পদক্ষেপও নিতে পারছিল না, কারণ তাতে যদি জিম্মি ইসরায়েলিদের কেউ আহত হন। 

এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে  সন্ত্রাসীদের সঙ্গে মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করেন জার্মান কর্তৃপক্ষ।এরইমধ্যে মোসাদের প্রধান জাভি জামির তাৎক্ষণিক মিউনিখে  আসেন। তিনি মিউনিখে এসে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে জার্মানির মধ্যস্থতায় ভূমিকা রাখতে চেষ্টা চালান। জামিরের এই প্রস্তাবে জার্মান কর্তৃপক্ষ সরাসরি তা প্রত্যাখা্যান করে জামিরকে  জানিয়ে দেয়, বাইরের কারও হস্তক্ষেপ  আশা করছে না তারা।এরপর  মধ্যস্থতার এক পর্যায়ে জার্মানি কর্তৃপক্ষ সন্ত্রাসী দলটিকে প্রস্তাব দেয়, ইসরায়েলের জিম্মি করা ওই ক্রীড়াবিদকে ছেড়ে দিতে হবে এবং বিনিময়ে তাদের একটি বিমানযোগে নির্বিঘ্নে উড়ে চলে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। দলটি সেই প্রস্তাবে সম্মত হয়।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সন্ত্রাসীরা  বিমানে ওঠার পর জিম্মি ক্রীড়াবিদকে মুক্তি দেওয়া হয়।এরপর পরই জার্মানী বাহিনী সন্ত্রাসীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। পুরো বিষয়টিই ছিল জার্মান সেনাদের পূর্ব পরিকল্পনার অংশ। জার্মান বাহিনীর গুলিতে দলটির পাঁচজন সদস্য মারা যায়, একজন আহত অবস্থায় আটক  হয়। দলটির সদস্য সালামেহ ততক্ষণে বৈরুতে অবস্থিত ফিলিস্তিনি গুপ্তচর সংস্থা ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের সদর দপ্তরে পৌঁছে গেছেন। সেখানে পৌঁছে সালামেহ জানতে পারেন জার্মান বাহিনী কীভাবে তার দলের পাঁচ  সদস্যদের হত্যা করে। সেই রাতেই রাতেই ইসরায়েলি ক্রীড়াবিদদের হত্যার জন্য আনন্দ উদযাপন করছিলো ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরে আগতরা। 

এই মিশসের পুরো বিষয়টি প্যারিসের একটি বাড়িতে বসে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করছিলেন একজন। তিনিই হলেন সিলভিয়া রাফায়েল। যিনি  ইসরায়েলি গুপ্তচর। টেলিভিশনের পর্দায় মুখোশধারী সন্ত্রাসী ও জার্মান বাহিনীর নৃশংসতা প্রত্যক্ষ করছিলেন সিলভিয়া। ইসরায়েল তার দেশ কিংবা দেশের বাইরে  তাদের কোনো নাগরিকের ওপর হামলাকে সবচেয়ে গুরুত্ব অপরাধ বিবেচনা করে।  এমন অনেক হামলার পরিকল্পনা মোসাদ এজন্টা বেশ কয়েকবার নস্যাৎও করেছে। কিন্তু অলিম্পিকের মতো বড় ও বিশ্বজনীন কোনো হ্রীড়া আসরে  ইসরায়েলি ক্রীড়াবিদদের ওপর এমন ভয়ঙ্কর  হামলা হবে সেটা মোসাদ কল্পনাও করেনি।

মিউনিখে এই ভয়াবহ হামলার পর দিন হেরাল্ড ট্রিবিউনের শিরোনাম প্রকাশ করে , আলী সালামেহর নেতৃত্বে এ ঘটনা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে ‘ ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’।

সিলভিয়া এতোটাই সুদক্ষ ছিলেন যে তিনি নিজের পরিচয় আড়াল করতে প্যারিসে মোসাদদের অন্য এজেন্টের সঙ্গেও কোনো যোগাযোগ করতেন না। কেবল তার ঊর্ধ্বতন এজেন্ট ডেভিডের সঙ্গে  অল্প যোগাযোগ ছিল তার। মিউনিখে ওই ঘটনার পর ডেভিড প্যারিস ছেড়ে  ইসরায়েল চলে যান।  সিলভিয়া ডেভিডকে ফোন করে তার সাক্ষাৎ চান।  এরপর দুজনের দেখা হলেও তারা তেমন এই হামলার পাল্টা প্রতিশোধ নিতে তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে পারেননি। এ ক্ষেত্রে ডেভিড পদস্থ কর্মকর্তাদের সাড়া পেতে ব্যর্থ হয়ে নিস্ত্রিয় হয়ে পড়েন। কিন্তু  দমে যাননি সিলভিয়া।  

বরং সিলভিয়া তার কাছে থাকা তথ্যগুলো তৎকালীন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ারকে সরবরাহ করেছিলেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ার মোসাদের একটি বিশেষ বাহিনীকে ‘ঈশ্বরের ক্রোধ’ নামের এক অপারেশনের দায়িত্ব দেন। আর এই পুরো অপারেশনটির নকশা করেন আলোচিত নারী সিলভিয়া। ওই গোপন মিশনের প্রধান ছিলেন মাইক হারিরি। 

এই বিশেষ মিশনের দলটিকে পাঁচটি স্কোয়াডে বিভক্ত করা হয়। প্রত্যেক স্কোয়াডে  ১৫ জন সদস্য ছিল। ১৯৭২ সালের ১৬ অক্টোবর। মোসাদের এই বিশেষ অপারেশন দল তাদের মিশন আরম্ভ করে ফিলিস্তিনের একজন অনুবাদক ও পিএলওর প্রতিনিধি আতিয়ারকে হত্যার মধ্য দিয়ে। তিনি ( আতিয়ার)  রাতের খাবার শেষ করে বাড়িতে ফিরছিলেন তখন তার ওপর অতর্কিতে হামলা চালিয়ে গুনে গুনে ১২টি গুলি করা হয় তার শরীরে। এরপর একের পর এক হত্যা মিশন চালায় মোসাদের এই বাহিনী। এর ধারাবাহিকতায় একই বছরের ৮ ডিসেম্বর ফ্রান্সে ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের সদস্য মাহমুদ হামশারিকে টেলিফোন বোমায় হত্যা  করা হয়। ১৯৭৩ সালের ২৪ জানুয়ারি ফাতাহর প্রতিনিধি হুসেইন আর বশিরকে সাইপ্রাসে হত্যা  করে মোসাদ। 

ওই বছরের ৬ এপ্রিলে বৈরুতে বাসিল আল কুবাসিকেও আতিয়ারের মতো ১২ টি গুলি করে হত্যা করে মোসাদ। টানা ২০ বছর এই অভিযান চালিয়ে চালায় ইসরাইল। অপারেশন চলাকালে  ‘রেড প্রিন্স’ নামে খ্যাত আলী সালামেহকে হত্যা করার জন্য সিলভিয়া কয়েকদফা চেষ্টা চালান । তা সম্ভব হয়নি। তবে সালামেহ ভেবে আহমেদ বুশিকি নামের এক মরক্কোর নাগরিককে হত্যা করেছিলেন ভয়ঙ্কর এই নারী গোয়েন্দা সিলভিয়া। 

এই হত্যাকান্ডের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় নরওয়ের এক আদালত সিলভিয়াকে  পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়। যদিও ১১ মাস কারাভোগের পর মুক্ত হন  তিনি। এরপর  যে আইনজীবী তাকে মুক্তি পেতে সাহায্য করে পরে সেই আইনজীবীকে বিয়ে করে দক্ষিণ আফ্রিকায় চলে যান সিলভিয়া। এতো গেলো কেবল একটি ঘটনার খণ্ডিত অংশ। মোসাদের পক্ষে  এমন আরও অসংখ্য কিলিং মিশনের পরিকল্পনা করেছেন এই গুপ্তচর নারী।  ২০০৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে মারা দুর্ধর্ষ  গুপ্তচর এই নারী।