ভেনিসঃ কেন পৃথিবীর স্বর্গ!

ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১৯
Spread the love

 

কামাল হোসাইন, ভেনিস

ইতিহাসে প্রাচীন আর ঐতিহাসিক নগরের নাম ভেনিস। এটি ইতালির নান্দনিক সৌন্দর্যের নগরী। এটি  ইউরোপের সবচেয়ে রোমান্টিক শহর।  পানির ওপর ভেসে থাকা দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদ, এসব ইমারতের গা ঘেঁষে এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে লেক। এজন্য পৃথিবীজুড়ে বিখ্যাত ভাসমান শহরের তালিকার শীর্ষে আছে ভেনিস নগরীর নাম।

পুরো শহরের বুক জুড়ে থাকা লেকের স্বচ্ছ জলে  প্রাসাদের প্রতিচ্ছবি আর আকাশের মেঘগুলোও  জলের বুকে লুটোপুটি খায়। এ জন্য অপূর্ব সুন্দর এই নগর সারা পৃথিবীর পর্যটকদের কাছে মোহনীয়। বলতে গেলে  সারা বছরই পর্যটকের ভিড়ে মুখর থাকে ভেনিস। ঐতিহ্যমণ্ডিত আর অপার সুন্দরের নগর ভেনিসকে আসুন আজ জানা যাক।

পৃথিবীর ইতিহাসে ইতালীয় সভ্যতা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত।শিল্প সাহিত্য, বিশেষ করে স্থাপত্যশিল্পে ভেনিস নগরীর তুলনা হয় না।  নগরের প্রতিটি স্থাপনায় এর ছাপ ফুটে আছে এখনো। নান্দনিক রূপ, রঙ-বেরঙের কারুকার্য নিয়ে স্বচ্ছ জলের সরোবরে দাঁড়িয়ে আছে এসব স্থাপনা। বস্তুত, ভেনিস নগর  বেশকিছু দ্বীপের সমষ্টি।

যেভাবে গড়ে উঠল ভেনিস

বর্তমান ভেনিসের  যে নগর আমরা দেখছি সেখানে, একসময় বসতি গড়া  মোটেই সহজতর ছিল না।  সেখানে কোনো ভবন বানানো ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। এরপর কয়েক শতক ধরে তিলে তিলে চেষ্টা-পরিশ্রমের পর ভেনিস নগরটি  গড়ে ওঠে।

ইতিহাস বলছে, চতুর্থ শতকে জলদস্যুদের কবল থেকে সুরক্ষার ভেনিসের বাসিন্দাদের পূর্বসূরিরা এখানে বসতি গড়ে তুলেছিলেন।রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর আলপসে হানা দেওয়া উত্তরের জলদস্যুদের কবল থেকে রক্ষা পেতে তারা এই  জলমগ্ন এলাকাকে বেছে নিয়েছিলেন।শুরুতে গাছের গুঁড়ি দিয়ে পাইলিং করে এর ওপর ভবন নির্মাণ করতে আরম্ভ করেন। কিন্তু পাইলিং করার সময় তা শুধুই অতলে দেবে যেতে থাকে। একটি ভবনের ভিত্তি গাড়তে গেলে কয়েকশ পাইল বা লার্স  গাছের  কাণ্ড মাটির গভীরে পুঁততে   হতো।এভাবে নগর গড়ে তোলার পর ভেনিস নগর নির্মাণকারী কৌশলীরা পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থায় অগ্রসর হলেন। এতে অগ্রগতিও অর্জন করলেন তাঁরা। পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা তদারকির জন্য পোর্তো অ্যালে একিউ নামে একটি পদও সৃষ্টি করা হলো।মূলত, তার তত্ত্বাবধানেই এসব খাল খনন ও নদীর গতিপথ পরিবর্তনের কাজ করা হয়।

  এরপর ক্রমেই নগরটির লোকসংখ্যা বাড়তে থাকে। ভেনিস নগরে গাড়ি চালানোর জন্য কোনো সড়কপথ নেই, পুরো নগরজুড়েই জালের মতো বিছিয়ে আছে অসংখ্য খাল।  এ জন্য ডিঙি নৌকায় এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়ত করতে হয়। ভেনিসের বাসিন্দাদের একমাত্র বাহনই হলো নৌকা। প্রতিটি  বাড়ির  সানবাঁধানো ঘাটে নোঙ্গর করা থাকে নিজস্ব নৌকা অথবা দ্রুতগামী নৌকা।  ভেনিসবাসীর কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয়  জলযান হল ‘গন্ডোলা’। ভেনিসের সংস্কৃতির অঙ্গ এই ঐতিহ্যবাহী গন্ডোলা  পর্যটকের দৃষ্টি কাড়ে । দৃষ্টিনন্দন কারুকার্য খচিত, শিল্পীর শৈল্পিক ছোঁয়ায় ফুটে উঠা গন্ডোলায় চড়ে খালের স্বচ্ছ জলে  ভাসতে ভাসতে ঘোরা যায় পুরো নগর। যদি নৌকায় না চলেন তবে খালের পাশের হাঁটা পথ ধরে ঘুরে বেড়াতে যায়। পুরো নগরে  একটু পরপরই দেখার মতো কিছু না কিছু প্রাচীন ও সৌন্দর্যময় স্থাপনা চোখে পড়বে। হতে পারে প্রাচীন কোনো গির্জা, কোনো জাদুঘর কিংবা কোনো দর্শনীয় স্থান। মুখোশ, হ্যাট বা নানা রঙের কাচের জিনিসপত্রের পসরা সমৃদ্ধ দোকানগুলো তো চোখে পড়বেই।  

আবহাওয়া

শহরটি শরৎ ও বসন্ত ঋতুর আগে প্রায়ই বন্যার আতঙ্কে থাকে ভেনিসবাসী। কিন্তু তারা নানা  কৌশলে বন্যার পানি হৃদ দিয়ে অপসারণ করে দেয়। যাতে তাদের জনবসতিতে তা আঘাত না হানে। দেশটির আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সেখানে প্রধানত জলবায়ু আর্দ্র । শীত ও তীব্র গরমের মিশেল  আবহাওয়া। জানুয়ারিতে গড়ে তিন দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং জুলাইয়ে গড়ে ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্র থাকে। এ ছাড়া পুরো বছরে গড়ে ২৯ দশমিক ৪ মিলি বৃষ্টিপাত হয়।

 

আধুনিকায়ন

১৭৯৭ সালে যখন নেপোলিয়ান ভেনিস জয় করার পর তারা স্বাধীনতা হারায়। পরবর্তীতে ১৮৬৬ সালে আবার স্বাধীনতা ফিরে পায়। এরপর ভেনিস ইতালির নতুন অংশ হিসেবে যুক্ত হয়। আগে নগরের ভবনগুলো  কাঠ দিয়ে নির্মাণ হতো। তবে ওই সময় প্রথম ইস্পাত, ইট আর পাথরের ব্যবহার শুরু হয়। ভবনগুলোর ডিজাইনেও আসে অনন্য নান্দনিকতা। এ সময় গোটা নগরকে  এমনভাবে সাজানো হয় যে, তারা যেন কোনো সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে। আঠারো শতকে এসে ভেনিস তার স্থাপত্যকর্ম, শিল্প, সাহিত্যে আধুনিকতার উল্লেখযোগ্য ছাপ রাখে।

প্রশাসন

ভেনিস শহরের পৌরসভার পরিষদ ব্যবস্থায় ৪৫ জন কাউন্সিলর রয়েছেন।  প্রতি পাঁচ বছর মেয়াদে নির্বাচিত হন তাঁরা।  ভেনিস শহরটি মূলত কেন্দ্রীয় প্রশাসনের দ্বারাই শাসিত হয়। এখানে ১৯৯০ থেকে ২০১০ সাল অবধি বামপন্থি  সরকারের  শাসন ছিল।

পরতে পরতে সৌন্দর্য

ভেসিনের পুরো নগরের  পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে  সৌন্দর্য। রোমান্টিক এই শহরকে এজন্য ‘ সিটি অফ লাভ’ বলেও ডাকা হয়। জালের মত  ভেনিস নগরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য খালের মাঝে এই শহরকে দ্বিখণ্ডিত করেছে ‘গ্র্যান্ড ক্যানেল’। নৌকা, স্পিড বোটের যাতায়াতের পথের এসব খাল থেকে দেখা যাবে  নগরের চোখ ধাঁধাঁনো রঙ, নকশা ও  স্থাপত্যশৈলী। খালের ওপরে রয়েছে অসাধারণ কারুকাজ খচিত অনেক সেতু।

এসব সেতুর সৌন্দর্য পর্যটকদের মুগ্ধ করে। তবে সবচেয়ে সুন্দর ও জমকালো সেতুটি হলো ‘ রিয়ালটো’ সেতু। এটি গ্র্যান্ড ক্যানেলের ওপর অবস্থিত। খালের মধ্যে থেকে এই সেতুর অপূর্ব কারুকার্য দর্শনার্থীদের মন ছুঁয়ে যায়। ভেনিস আসলে গন্ডোলায় চড়ে এই সেতুর নিচ দিয়ে পার না হলে পুরো ভ্রমণই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
 নগরের এক পিয়াজ্জা সান মার্কোতে রয়েছে আকর্ষণীয় ভৌজ প্যালেস। প্রাচীন স্থাপত্য রীতিতে নির্মিত এই ভবন মূলত একটি জাদুঘর। এছাড়াও এখানে ছোট ছোট আরো অনেক পুরনো মনোমুগ্ধকর স্থাপত্য, প্রাসাদ, জাদুঘরও আছে। রয়েছে অনেক বুটিক, ক্যাফে ও রেস্তোরা।

ভাসমান শহর ভেনিস সামুদ্রিক খাবারের জন্য বিখ্যাত। সামুদ্রিক খাবার প্রেমীদের  জন্য  স্বর্গরাজ্য ভেনিস। ভূমধ্যসাগরের নানা সামুদ্রিক খাবারের সঙ্গে  সুদূর উত্তর আটলান্টিক থেকে নিয়ে আসা অক্টোপাস, স্কুইডও রয়েছে এখানে। পৃথিবী বিখ্যাত ইতালির অপেরার নাম হয়তো সবাই শুনেছেন। এটা এই নগরেই অবস্থিত।  ‘ট্র্যাট্টো লা ফেনিস’ প্রাসাদ ‘টি দ্যা ফিনিক্স’ নামে এই অপেরা হাউসে পর্যটকেরা ভিড় করেন।

সেন্ট মার্কোয় অবস্থিত বিখ্যাত স্থাপত্য ‘ক্যাথেড্রাল’। এই ক্যাথেড্রালের চার দিকের দেয়াল নানা কারুকার্যে সুসজ্জিত।  অক্ষরে লিপিবদ্ধ নানা কাহিনী সবাইকে বিমোহিত করে। এখানের ‘লিডো দ্বীপ’ আরেকটি চমৎকার সৌন্দর্যময় স্থান।

ভেনিসে এর নাম  সোনালি দ্বীপ। এই দ্বীপের সমুদ্র সৈকতে গোধূলি লগ্নের সূর্যাস্তের দৃশ্য উপভোগ করার সূবর্ণ সুযোগ রয়েছে। সৌন্দর্যের মোহচ্ছটায় মুগ্ধ এই প্রাচীন নগর যেন সমগ্র বিশ্বের সুন্দরের এক অপার বিষ্ময়।  

 

Comments are closed