ভ্যালেন্টাইনস ডে কীভাবে আমাদের হলো

ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২০
Spread the love

অনিন্দ্য আফরোজ

ভ্যালেন্টাইনস ডে বা ‍ বিশ্ব ভালবাসা দিবস এখন আমাদের এক আলোচিত এবং সর্বাধিক উদযাপিত দিবস। কিন্তু প্রশ্ন কীভাবে উদ্ভব হলো এ দিনটির। এনিয়ে নানা মতো যেমন আছে তেমনি আছে মানুষের কৌতূহল। 

কে  ছিলেন সন্ত ভ্যালেন্টাইন? যদিও তাঁর পরিচয় নিয়ে  বিস্তর মতভেদ এবং একাধিক মত আছে। প্রাচীনকাল থেকে   ইতিহাসে একাধিক সময়ে বিভিন্ন প্রসঙ্গে এসেছে সন্ত ভ্যালেন্টাইনের কথা। আজ আমরা তাঁর পরিচয় খুঁজে দেখার চেষ্টা করবো। তবে  তাঁর পরিচয় খোঁজার আগে দেখে নেওয়া যাক ‘ভ্যালেন্টাইন’ শব্দটির উৎস কী।

 মূলত,  ‘ভ্যালেন্টাইনাস’ বা ‘ভ্যালেন্টাইনাস’লাতিন শব্দ। এর অর্থ সুযোগ্য বা শক্তিশালী। খ্রিস্ট্রিয় রোমান ক্যাথলিক নথি অনুযায়ী, দ্বিতীয় থেকে অষ্টম শতক অবধি খ্রিস্টধর্মের অনেক সন্তের বাযাজকের নামের পাশে যুক্ত হয়েছে ‘ভ্যালেন্টাইন’ উপাধি। যাঁদের অনেকেই রাজরোষে প্রাণ দিয়েছিলেন | এ জন্য ঠিক কার জন্য ভ্যালেন্টাইন ডে পালিত হয়, তা নিয়ে অনেক ভিন্নমত আছে|

ঐতিহাসিক মত বলছে,  ৮২৭ খ্রিস্টাব্দে   এই ‘ভ্যালেন্টাইন’ উপাধি ছিল একজন পোপের নামের পাশেও। কিন্তু তাঁর সম্বন্ধে তেমন কোনো তথ্য মেলেনি। যাকে কেন্দ্র করে আজকের ভ্যালেন্টাইনস ডে উদ্‌যাপন হয়, তিনি মূলত ২৭০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।   ত্রয়োদশ শতকের এক নথি সূত্র ধরে পাওয়া  তথ্যে দেখা যায়, সন্ত ভ্যালেন্টাইনকে রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্লদিয়াস প্রাণদণ্ড দিয়েছিলেন। তাঁর অপরাধ ছিল, তিনি খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী জুটিদের বিয়ে করে ঘর বাঁধতে সাহায্য করছিলেন।

সম্রাট দ্বিতীয় ক্লদিয়াস বিশ্বাস করতেন, অবিবাহিত তরুণদের দিয়ে শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী গঠন করা যায়। ফলে তিনি তাঁর সাম্রাজ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ করেন। কিন্তু সম্রাটের এই নির্দেশ মানতে পারেন নি সন্ত ভ্যালেন্টাইন। তিনি গোপনে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী তরুণ-তরুণীদের বিয়ে দিতে থাকেন। সন্ত ভ্যালেন্টাইনের এই বিরুদ্ধাচরণে ক্ষিপ্ত হন সম্রাট দ্বিতীয় ক্লদিয়াস। ক্রদ্ধ  ক্লদিয়াস তাঁকে প্রাণদণ্ডের নির্দেশ দেন। সম্রাটের নির্দেশে মস্তকছেদ করে সন্ত ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদণ্ড   দেওয়া হয়।

আবার  আরেকটি  নথির সূত্র বলছে, মধ্যযুগে ইতালির তার্নি শহরের আর্চ বিশপকেও প্রাণদণ্ড দিয়েছিলেন সম্রাট দ্বিতীয় ক্লদিয়াস। দুটি ঘটনার সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকার কারনে অনেক ঐতিহাসিক মনে করছেন, এই বিশপ আর রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্লদিয়াসের বিরুদ্ধে গিয়ে খ্রিস্ট  তরুণ- তরুণীদের বিয়ে দেওয়া সন্ত ভ্যালেন্টাইন একই ব্যক্তি।তৃতীয় শতকের ১৪ ফেব্রুয়ারি বা তার কাছাকাছি কোন এক দিনে রোমের শহরতলিতে হত্যা করা হয় যাজক ভ্যালেন্টাইনকে | প্রেমের দূত ভ্যালেন্টাইনের মাথার খুলি এখনও সংরক্ষিত এবং ফুল দিয়ে সুসজ্জিত রাখা হয়েছে রোমের কোসমেদিয়ানের ব্যাসিলিকা অফ সান্তা মারিয়ায়।উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ওই অঞ্চলে খননে একটি কঙ্কাল পাওয়া মিলেছিল। কঙ্কালের সঙ্গে উদ্ধার হওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক জিনিস পরীক্ষা করে  গবেষকেরা  মত দেন, এটা যাজক  ভ্যালেন্টাইনেরই দেহাবশেষ। এরপর সে দেহাবশেষটি  সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত হয় ব্যাসিলিকায়।

উদ্ধার হওয়া কঙ্কালের খুলি ইতালির সান্তা মারিয়া ব্যাসিলিকায় সজ্জিত থাকলেও এর অন্য অংশ আছে চেক প্রজাতন্ত্র, ফ্রান্স, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড এবং ইংল্যান্ডের বিভিন্ন চার্চে|

কীভাবে প্রচলন হলো ভ্যালেন্টা্নি ডে

গোড়ার দিকে   ভ্যালেন্টাইন ডে ছিল আত্মাহুতির দিন। এরপর মধ্যযুগে এর সঙ্গে প্রেমের মেলবন্ধন ঞটে। এটা  করান জিওফ্রে চসার নামে একজন লেখব। জিওফ্রে চসার রচনাতেই প্রথম এই দিনের সঙ্গে যুক্ত হলো প্রেমের অনুসঙ্গ। আর ক্রমে সে ধারণা জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে দেশে দেশে। এর ঊনিশ-বিশ শতকে এসে  তো ভ্যালেন্টাইনস ডে আর প্রেম অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।এখনও অবধি সন্ত ভ্যালেন্টাইন পরিচয়ে একজনই সাধকের সন্ধান মেলে। কোথাও আবার তাঁর নাম উচ্চারিত হয় সন্ত ভ্যালেন্টিনা নামে। ৩০৮ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে তাঁকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয় প্যালেস্টাইনে। এ জন্য ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চ বছরে দুবার, ৬ জুলাই এবং ৩০ জুলাই ভ্যালেন্টাইনস ডে পালন করে।

ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী,  খ্রিস্টধর্ম প্রসারের আগে পৌত্তলিক যুগেও শীতের শেষ দিকে এবং বসন্তের শুরুতে একটি পার্বণ উদ্‌যাপনের রীতি ছিল। আর প্রাচীন রোম সভ্যতায় মধ্য ফেব্রুয়ারি ছিল উর্বরতার ঈশ্বর ফনাস-এর পার্বনের দিন | সেই পার্বণে গ্রামের অবিবাহিত তরুণেরা একটি বাক্স থেকে চিরকুট তুলত | তাতে লেখা থাকত তরুণিীদের নাম | যে তরুণ যে তরুণীর নাম তুলতো, তাঁরা সে দিন থেকে প্রেমের জুটি বলে বিবেচিত হতেন | কখনো কখনো এ সম্পর্ক পৌঁছত বিয়ে অবধি|

খ্রিস্ট ধর্মের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির পরে পঞ্চম শতাব্দীতেও প্রচলিত ছিল এমন রীতি । কিন্তু  এরপর ধীরে ধীরে এমন লোকাচার বিলুপ্ত হয়। ইতিহাস গবেষকদের মতে, প্রাচীন সভ্যতার উর্বরতার উৎসবও বিলীন হয়।

ভালবাসা ও প্রেমের প্রতীক লাল গোলাপ। এখানেও বহমান প্রাচীন সভ্যতার রীতি। রোমান সভ্যতার প্রেমের দেবী ভেনাস | কথিত, তাঁর এবং যুদ্ধের দেবতা মার্সের পুত্র হলেন কিউপিড | ভেনাসের প্রিয় ফুল লাল গোলাপ | দেবীর প্রিয় ফুল ও ছেলে দুজনেই প্রেমপার্বণ উদযাপনের অবিচ্ছেদ্য অংশ | সেই থেকেই মনের মানুষকে এই দিনে শুভেচ্ছা কার্ড দেওয়ার রীতি চলে আসছে। সেই প্রাচীন কাল থেকে পালিত হয়ে আসছে আবহমান প্রেমের এই উৎসব।