চেঃ পৃথিবীর সমান হৃদয় যাঁর

Spread the love

অনিন্দ্য আফরোজ

আর্নেস্তো চে গুয়েভারা  বিশ্বব্যাপী বিপ্লবী প্রেরণার এক অনন্ত উৎস। বহু পরিচয়ে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেয়া যায়। মার্ক্সবাদী বিপ্লবী তো বটেই, এর বাইরে তিনি চিকিৎসক, লেখক, গেরিলা নেতা, কূটনীতিবিদ, সমর তত্ত্ববিদ এবং কিউবার বিপ্লবের প্রধান ব্যক্তিত্ব। তাঁর প্রকৃত নাম আর্নেস্তো গেভারা দে লা সের্না। তবে তিনি পৃথিবীর মানুষের কাছে কেবলমাত্র ‘চে’ নামেই বেশি পরিচিত।

তরুণ বয়সে ডাক্তারি ছাত্র হিসেবে চে লাতিন আমেরিকা ভ্রমণ করেছিলেন। সেসময় ওই অঞ্চলের সর্বব্যাপী দারিদ্র্য তাঁর মনে গভীর রেখাপাত করে। এই ভ্রমণকালে তাঁর অর্জিত অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে- ওই অঞ্চলে বদ্ধমূল অর্থনৈতিক বৈষম্যের স্বাভাবিক কারণ হলো- একচেটিয়া পুঁজিবাদ, নব্য ঔপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদ; এবং এর একমাত্র সমাধান বিশ্ব বিপ্লব। এই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে চে রাষ্ট্রপতি জাকোবো আরবেনজ গুজমানের নেতৃত্বাধীন গুয়াতেমালার সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫৪ সালে সিআইএ-এর ষড়যন্ত্রে গুজমানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলে চে-র বৈপ্লবিক আদর্শের চেতনা বদ্ধমূল হয়। পরবর্তীকালে মেক্সিকো সিটিতে বসবাসের সময় তাঁর সঙ্গে রাউল ও ফিদেল কাস্ত্রোর পরিচয় হয়। চে তাঁদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেন। মার্কিন-মদদপুষ্ট কিউবান একনায়ক ফুলজেনসিও বাতিস্তাকে উৎখাত করার জন্য চে সমুদ্রপথে কিউবায় প্রবেশ করেন। অনতিবিলম্বে চে বিপ্লবী সংঘের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড পদে তাঁর পদোন্নতি হয় এবং বাতিস্তা সরকারকে উৎখাত করার লক্ষ্যে দুই বছর ধরে চলা গেরিলা সংগ্রামের সাফল্যের ক্ষেত্রে তিনি গৌরবময় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। আর এভাবেই চিকিৎসক চে হয়ে ওঠেন আমৃত্যু এক বিপ্লবী। 

চে কবিতাপ্রেমী। পাবলো নেরুদার ‘ক্যান্টো জেনারেল’ তাঁর প্রিয় কাব্যগ্রন্থ। যদিও কবি হিসেবে তাঁর পরিচিতি আমরা খুব একটা পাই না।  কবি পাবলো নেরুদা ঠিকই বলেছেন, ‘তাঁর জীবন নিয়ন্ত্রিত হয়েছে কবিতা ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দিয়ে।’ সে বিচারে বলা যায়, কবিতা চে’র ছুটে চলার, বিপ্লবী নেশার প্রেরণা। কবিতা যে তাঁর জীবনের কতটা জুড়ে ছিল এর প্রমাণ মেলে তারুণ্যে, তার পাঠাভ্যাসে। সেখানে মার্ক্স-এঙ্গেলস, ফ্রয়েড  ছাড়িয়ে কবিতাই প্রধান। এর মধ্যে লাতিন আমেরিকার কবিতাই ছিল তার প্রিয়। গেরিলা যুদ্ধের উপর তিনি একটি প্রভাবশালী ম্যানুয়েল রচনা করেন। তরুণ বয়সে দক্ষিণ আফ্রিকায় মোটরসাইকেলে ভ্রমণের স্মৃতিকথাটিও তাঁর অত্যন্ত জনপ্রিয় রচনা। ডায়েরি লেখক হিসেবেও চে’কে আমরা চিনি। আজ বিশ্বব্যাপী তার ডায়েরি পঠিত হয়। সেখান থেকে তরুণ প্রজন্ম নেন নতুন কোনো বিপ্লবের প্রেরণা।

সেই উনিশ বছর বয়সে যখন বিপ্লবের স্বপ্ন তার মনে  জেগে ওঠেনি তখনই তিনি দেখেছেন তার বুলেটে ঝাঁঝরা, বেয়নেটে ক্ষতবিক্ষত দেহ। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে মনে- তিনি কি ভবিষ্যত দেখতে পেয়েছিলেন? বলিভিয়ার অখ্যাত গ্রামে বুলেটে-ঝাঁঝরা তার দেহ?  মৃত্যু নিয়ে লেখা তাঁর কবিতা শুধু বিস্ময়কর নয়, বরং মনে করিয়ে দেয় স্পেনীয় কবি লোরকার নিজ মৃত্যু নিয়ে লেখা কবিতার কথা। দু’য়ের মধ্যে আশ্চর্য মিল! দু’টোই অদ্ভুতভাবে সত্য হয়ে ওঠে তাদের জীবনে; তাদের যেন ভবিষ্যতদ্রষ্টার মর্যাদায় পৌঁছে দেয়। হ্যাঁ, লড়াইয়ে তার মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই তার কবিতা সত্য হয়ে ওঠে। কিন্তু এই বিপ্লব মৃত্যুহীন। যে কারণে পৃথিবীব্যাপী উচ্চারিত হয় সেই অমর পঙ্‌ক্তি- চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।

একথা আজ আমরা সবাই জানি, বিশ্বের নিপীড়িত, শোষিত মানুষের মুক্তির জন্য চে সংগ্রাম করেছেন। যে কারণে তাঁর নাম ষাট ও সত্তরের দশকে ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়া তথা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের কাছে বিপ্লবের সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছিল। তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিকতাবাদের মূর্ত প্রতীক। দার্শনিক জ্যাঁ পল সার্ত্রে তাঁকে আমাদের কাছে ‘একজন সম্পূর্ণ মানুষ’ হিসেবে পরিচয় করিয়েছেন। যেখানেই বিপ্লবের প্রয়োজন অনুভব করেছেন চে ছুটে গেছেন। মানুষকে জাগিয়ে তুলেছেন। তাঁর চেতনার মন্ত্রবলে মানুষ উজ্জীবিত হয়েছে। ছুটে গিয়ে রুখে দিয়েছে শোষণের হুঙ্কার। 

বিপ্লবী এর্নেস্তো চে গুয়েভারার জন্ম ১৪ জুন ১৯২৮ আর্জেন্টিনায়। ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর বলিভিয়ায় তাঁকে আহত অবস্থায় আটক করে হত্যা করা হয়। বিপ্লবী নেতা চে গুয়েভারার জীবনের শেষ কথা ছিল, ‘গুলি কোরো না। আমি চে গুয়েভারা। মৃত চে গুয়েভারার চেয়ে জীবিত চে গুয়েভারা তোমাদের জন্য বেশি মূল্যবান।’ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা গতকাল মঙ্গলবার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ত্রাস চে গুয়েভারাকে হত্যা করা নিয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানেই এ তথ্য জানানো হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, হাঁটুতে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাত থেকে নিজের রাইফেল খসে পড়লে বলিভিয়ার জঙ্গলে আত্মসমর্পণে বাধ্য হন চে। ঘিরে থাকা সৈন্যদের হাত থেকে বাঁচতে আরনেস্তো চে গুয়েভারার শেষ আকুতি ছিল, ‘গুলি কোরো না।’

১৯৬৭ সালের ৮ অক্টোবর চে গুয়েভারা ধরা পড়েন। সেখান থেকে চার মাইল দূরে বলিভিয়ার ল্যা হিগুয়েরা শহরের এক কক্ষবিশিষ্ট একটি বিদ্যালয়ে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়।

নিজেকে বলিভীয় সৈন্য হিসেবে পরিচয় দেওয়া ফেলিস্ক রদ্রিগেজে নামক জনৈক সিআইএ কর্মকর্তা পরের দিন ওই বিদ্যালয়ে ময়লার স্তূপে তাঁকে দেখতে পান। তাঁর পোশাক ছিল ছেঁড়া ও ময়লায় ভরা এবং হাত-পা ছিল বাঁধা।

১৯৬৭ সালের ৮ অক্টোবর চে গুয়েভারা ধরা পড়েন। সেখান থেকে চার মাইল দূরে বলিভিয়ার ল্যা হিগুয়েরা শহরের এক কক্ষবিশিষ্ট একটি বিদ্যালয়ে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়।

নিজেকে বলিভীয় সৈন্য হিসেবে পরিচয় দেওয়া ফেলিস্ক রদ্রিগেজে নামক জনৈক সিআইএ কর্মকর্তা পরের দিন ওই বিদ্যালয়ে ময়লার স্তূপে তাঁকে দেখতে পান। তাঁর পোশাক ছিল ছেঁড়া ও ময়লায় ভরা এবং হাত-পা ছিল বাঁধা।

সাংবাদিক জন লি এন্ডারসনের আত্মজীবনী ‘চে গুয়েভারা: আ রেভল্যুশনারি লাইফ’ নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে, চে গুয়েভারাকে গুলি করার দায়িত্ব দেওয়া হয় জ্যাইমি টিরান নামক জনৈক সার্জেন্টকে। চে গুয়েভারা তাঁকে বললেন, ‘আমি জানি তুমি আমাকে খুন করতে এসেছ। গুলি করো। তুমি কেবল একজন মানুষকে মারতে যাচ্ছ।’ টিরান চে গুয়েভারার হাত, পা ও বুকে গুলি করলেন। চের বয়স তখন মাত্র ৩৯ বছর।

ডায়েরিতে লিখেছিলেন কমান্দান্তে চে, ‘আমি ভাবতে শুরু করি, মরে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ পথ সেটাই, যখন মনে হবে সব শেষ হয়ে গেছে। জ্যাক লন্ডনের একটি পুরোনো গল্প মনে পড়ছে। তাতে গল্পের মূল চরিত্র একটা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে গরিমার সঙ্গে নিজের জীবনের সমাপ্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে।’

শত্রুসৈন্যদের সঙ্গে সারাটা বিকেল যুদ্ধ করার পর গুলি লেগেছিল চের পায়ে। আরেক গুলিতে ছিটকে যায় হাতের অস্ত্র।নিশ্চিতভাবে বলা যায়, চে গুয়েভারার মৃত্যুর খবর সঙ্গে সঙ্গে নয়, কিছুদিন পর যুক্তরাষ্ট্রে আসে। প্রেসিডেন্ট জনসনের উপদেষ্টা ওয়াল্ট রোসটো ১৯৬৭ সালের ১৩ অক্টোবর একটি সংক্ষিপ্ত স্মারকপত্র লেখেন, ‘সব ধরনের সন্দেহ দূরীভূত করে বলা যায় যে চে গুয়েভারা মৃত।’১৯৬৭ সালের অক্টোবরে চের মৃত্যুসংবাদ পৃথিবী জানতে পারে। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা তখন লিখেছিল, ‘একজন মানুষের সঙ্গে সঙ্গে একটি রূপকথাও চিরতরে বিশ্রামে চলে গেল।’ কথাটা সত্য হয়নি। কমরেডের মৃত্যুর পর কিউবায় লাখো জনতার সামনে আবেগঘন কণ্ঠে ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, যারা মনে করছে, চে গুয়েভারার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তাঁর আদর্শ বা তাঁর রণকৌশলের পরাজয় ঘটেছে, তারা ভুল করছে।

চে’র মৃত্যুতে সেদিন নিশ্চয়ই হাঁফ ছেড়েছিল সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী। ভেবেছিল, বিপ্লবের মৃত্যু হলো। আদতে, মৃত্যুর ৪৮ বছর পর জীবিত চে গুয়েভারার চেয়ে মৃত চে গুয়েভারা এখন আরও অনেক শক্তিশালী। আলোকচিত্রী আলবের্তো কোর্দার তোলা তাঁর মুখাবয়বের প্রতিকৃতি এখনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সব প্রতিবাদে-জমায়েতে আপসহীনতার প্রতীক। পৃথিবীর সেরা কবিরা তাঁকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন, লিখছেন। গায়ক-গীতিকার কার্লোস পাবেলো ১৯৬৫ সালেই ‘আস্তা সিয়েম্প্রে কমানদান্তে চে গুয়েভারা’ শিরোনামের যে গানটি গেয়েছিলেন, তা ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে, হচ্ছে বিশ্বব্যাপী শিল্পীদের কণ্ঠে কণ্ঠে। কারণ, চে বিশ্ববিপ্লবের পথে পা বাড়িয়েছিলেন। বিপ্লবীর কোনো স্বদেশ থাকতে নেই। বিপ্লবেরও স্বদেশ থাকে না। চে এখনো, এখানেও, বিজয়ের পথে হাঁটছেন। হাঁটবেন অনাদিকাল।

কিউবা বিপ্লবের প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ১৯৫৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব লাস ভিয়াসের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে চে এই ভাষণ দেন।  সেই ভাষণের শিরোনাম  ছিল- মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে। সেই ভাষণে  কি বলেছিলেন   অনন্ত  এই বিপ্লবী। আসুন জেনে নিই।

 ‘আজ আমাকে এখানে যে মর্যাদায় ভূষিত করা হলো, তা শুধু আমি বিনম্রভাবে এ দেশের জনগণের পক্ষ থেকে গ্রহণ করতে পারি, ব্যক্তি হিসেবে নয়। ব্যক্তি এর্নেস্তো গুয়েভারা কীভাবে স্কুল অব এডুকেশনের পক্ষ থেকে সম্মানসূচক ডক্টর উপাধি লাভ করতে পারে যেখানে তাঁর শিক্ষার পুরোটাই এসেছে গেরিলা ক্যাম্প, তিক্ত বাদানুবাদ আর সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে? আমি বিশ্বাস করি, আমার শিক্ষাকে ক্যাপ আর গাউনে রূপান্তর করা যায় না। তাই আমি আজকেও তোমাদের সামনে আমাদের সেনাবাহিনীর সম্মানে সামরিক পোশাকে এসেছি। এই উপাধি গ্রহণের শুভক্ষণে আমি আমাদের সেনাবাহিনীকেও পূর্ণ গৌরবে উপস্থাপন করতে চাই। আমি একবার এই ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা নিয়ে আমার ভাবনাকে তাদের সামনে তুলে ধরব। হাজারো ঘটনা আর কাজের চাপে এত দিন আমি সে কথা রাখতে পারিনি। আজ, আমি সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করব।এই নতুন কিউবায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ভূমিকা কী হওয়া উচিত? আমি বলব, বিশ্ববিদ্যালয়কে ভেঙেচুরে ভিন্ন ধাঁচে গড়ে তোলার সময় এসেছে। কালোদের, মিশ্র বর্ণের, শ্রমিকদের, চাষিদের জন্য এ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুয়ার খুলে দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় হবে গণমানুষের। মনে রাখতে হবে, এই বিশ্ববিদ্যালয় কারও পৈতৃক সম্পত্তি নয়, এটি কিউবার জনগণের সম্পত্তি। বিজয় হলে কেবল জনগণেরই হবে। জনগণ এখন জানে যে তারা অপ্রতিরোধ্য। আজ তারা আশায় বুক বেঁধে এদিকে তাকিয়ে আছে, বিশ্ববিদ্যালয়কেই আভিজাত্যের মুখোশ খুলে তাদের হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানাতে হবে। হয় আপামর জনসাধারণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দুয়ার খুলে দাও, নয়তো শুধু দুয়ার খোলো; জনগণই বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজেদের মতো করে গড়ে নেবে।

আমাকে যদি জনগণ ও বিপ্লবী সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি হিসেবে এবং অবশ্যই তোমাদের অধ্যাপক হয়ে কিছু উপদেশ দিতে হয়, তবে আমি বলব, মানুষের কাছে পৌঁছাতে হলে মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে হবে। তোমাদের জানতে হবে জনগণ কী চায়, তাদের কী প্রয়োজন, তারা কেমন আছে, কী ভাবছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখো, কতজন শ্রমিক, কৃষক, দিনে আট ঘণ্টা মাথার ঘাম পায়ে ফেলা মানুষেরা এখানে পা ফেলতে পেরেছে। তারপর নিজেকে প্রশ্ন করো, কিউবার শাসনব্যবস্থায় জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে কি না। এবার একটু চিন্তা করো, যে সরকার জনগণের ইচ্ছাকে তার কাজে পরিণত করছে, সেই সরকার এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কী করছে? দুর্ভাগ্যজনকভাবে গোটা কিউবার জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী সরকারেরও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তেমন কোনো সংযোগ নেই। দেশের সাধারণ মানুষের ইচ্ছা, আশা, আকাঙ্ক্ষা মুক্তভাবে এখানে পৌঁছাতে পারে না।

আমি মাটির সন্তান, দেশের মানুষেরাই আমাকে গড়ে তুলেছে। আমি বিশ্বাস করি, এই মানুষদের শিক্ষার সুফল ভোগ করার অধিকার আছে। শিক্ষাব্যবস্থাকে ঘিরে গড়ে তোলা প্রাচীর ভেঙে ফেলতে হবে। শিক্ষা কোনো বিলাসদ্রব্য নয় যে শুধু যাদের বাবার পকেটে টাকা আছে, তারাই শিক্ষিত হবে। কিউবার ঘরে ঘরে প্রতিদিন রুটির সঙ্গে শিক্ষাকেও পৌঁছে দিতে হবে। আমি এখনো গর্ব করে বলতে পারছি না যে এখানকার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা হাজার হাজার শ্রমিক ও কৃষকের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা খুলে দিয়েছে। আমাদের এখনো অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। একজন বিপ্লবী হিসেবে আমি তোমাদের সবাইকে বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই যে শিক্ষার ওপর আর কারও একচ্ছত্র অধিকার নেই, এই ক্যাম্পাসও কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জন্য নয়। কিউবার প্রতিটি নাগরিকের এখানে সমান অধিকার আছে। হয় তাদের অধিকার তাদের ফিরিয়ে দিতে হবে, অথবা তারা নিজেরাই তা আদায় করে নেবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আমার জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছিল; মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বাসিন্দা, সেদিনের সেই যুবক ডাক্তার এর্নেস্তো একসময় তোমাদের মতোই স্বপ্ন দেখত। সংগ্রাম আমাকে বদলে দিয়েছে, আমি বিপ্লবের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছি, জনগণের কাতারে এসে দাঁড়িয়েছি। আমি আশা করি, তোমরা যারা আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের চালিকাশক্তি, তারা একে জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেবে। এটি কিন্তু তোমাদের জন্য কোনো হুমকি বা দুঃশ্চিন্তার কারণ নয়। আমি শুধু বলতে চাই যে ইউনিভার্সিটি অব লাস ভিয়াসের শিক্ষার্থীরা যদি জনগণের ও জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী বিপ্লবী সরকারের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়, তবে সেটি হবে কিউবার সাফল্যের টুপিতে আরেকটি পালক যোগ করবে।

আমার বর্তমান সহকর্মী, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের উদ্দেশে আমি বলতে চাই, পুরোনোকে ঝেড়ে ফেলুন। সমাজের কালো, মিশ্রবর্ণ, শ্রমিক ও কৃষকের কাতারে নিজেদের শামিল করুন। দেশের মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। তাদের সঙ্গেই আপনাদের বাঁচতে হবে, একই বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে হবে। এক ও অভিন্ন কিউবাকে অনুভব করার চেষ্টা করুন। আমরা সবাই মিলে যখন এই কাজগুলো করব, তাতে কারও অসম্মান হবে না। কেউ ছোট হব না, হেরে যাব না। দেশ হিসেবে কিউবা দৃঢ় পদক্ষেপে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। সেদিন এই প্রফেসর অব এডুকেশন, ডাক্তার, ব্যাংক, প্রেসিডেন্ট, কমান্ডার—যে কিনা আপনাদের এখন বিদায় জানাচ্ছে, তাকে ভুলে গেলেও আমার দুঃখ থাকবে না।

সূত্র: দ্য মিলিটেন্ট