• Home  / 
  • বিশ্ব  / 

মিয়ানমারে রয়টার্সের দুই সাংবাদিককে কারাদণ্ড বিশ্বজুড়ে নিন্দা

সেপ্টেম্বর ৪, ২০১৮
Spread the love

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

  বার্তা সংস্থা রয়টার্সের দুই সাংবাদিককে সাত বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন  মিয়ানমারের আদালত।  সোমবার (০৩ সেপ্টেম্বর) ইয়াঙ্গুনের উত্তরাঞ্চীয় জেলা জজ আদালতের বিচারক ইয়ে লুইন রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার দায়ে এ রায় দেন।

 রায় ঘোষণাকালে বিচারক  বলেন, যেহেতু তাঁরা দাপ্তরিক গোপনীয়তা আইন ভঙ্গ করেছেন, তাই তাঁদের প্রত্যেককে সাত বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হলো।  দণ্ডের এ মেয়াদ কার্যকর হবে গ্রেপ্তারের সময় থেকে ।

দণ্ডপ্রাপ্ত দুই সাংবাদিক হলেন ওয়া লোন (৩২) ও কিয়াও সোয়ে ওউ (২৮)।  রাখাইন রাজ্যের একটি গ্রামে ১০ জন রোহিঙ্গা পুরুষ ও কিশোন হত্যার ঘটনা নিয়ে অনুসন্ধান চালানোর সময় গত ডিসেম্বরে এই দুই সাংবাদিক  গ্রেপ্তার হন ।

গদ ২৭ আগস্ট এই মামলার রায় ঘোষণার কথা থাকলেও বিচারক অসুস্থ থাকায় তা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ওইদিন দুই সাংবাদিকের  আইনজীবী বলছিলেন, ‘যদি বিচার নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ হয়’, তাহলে তাঁর দুই মক্কেল  খালাস পাবেন।

এই দুই সাংবাদিকের মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হন লেখক, সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীরা। জাতিসংঘ, প্রেস ফ্রিডম অ্যাডভোকেটস, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশ  দুই সাংবাদিকের মুক্তি  চেয়েছিল।

 মিয়ানমারে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত স্কট মার্শেল রায় ঘোষণার পর  বলেন, ‘এখানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য যারা কঠোর লড়াই করে যাচ্ছেন, তাদের জন্য এরায় ঝুকিপূর্ণ হয়ে দাড়াবে।’

রয়টার্সের প্রধান সম্পাদক স্টিফেন জে অ্যাডলার ‘আজকের দিনটি মিয়ানমারের জন্য, রয়টার্সের সাংবাদিক ওয়া লোন ও কিয়াও সোয়ে ওউ এবং বিশ্বের গণমাধ্যমের জন্য দুঃখের একটি দিন বলে অভিহিত করেছেন। সাংবাদিক

কিয়াও সোয়ে ওউয়ের তিন বছরের মেয়ে রয়েছে। আর ওয়া লোনের স্ত্রী গত মাসে তাঁদের প্রথম সন্তানের জন্ম দিয়েছেন।

গত ১২ ডিসেম্বর দুই পুলিশ কর্মকর্তা ওই দুই সাংবাদিককে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানান। সেখানে তাঁদের হাতে কিছু কাগজপত্র তুলে দেওয়া হয়। রেস্তোরাঁ থেকে বের হওয়ার পর তাঁরা গ্রেপ্তার হন।

বিশ্বজুড়ে নিন্দা 

মিয়ানমারে  রয়টার্সের দুই সাংবাদিক ওয়া লোন এবং কাইওয়া সোয়ে ও’কে দণ্ড দেওয়ার প্রতিবাদ উঠছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। বিভিন্ন দেশ ও অধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো একে ক্ষোভ থেকে অবিচার বলে আখ্যায়িত করেছে। এ খবর দিয়েছে  অনলাইন আল-জাজিরা। এতে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংস গণহত্যার রিপোর্ট করার কারণে ওই দুই সাংবাদিককে ৭ বছর করে জেল দিয়েছেন আদালত। এতে বিশ্বজুড়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তাদের সোমবার শাস্তি দেয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন মিয়ানমারে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেনের রাষ্ট্রদূতরা। তারা এমন রায়কে মিয়ানমারের গণতন্ত্রে উত্তরণের ক্ষেত্রে একটি বড় আঘাত বলে উল্লেখ করেছেন। মিয়ানমারে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত স্কট মারসিয়েল।

তিনি বলেছেন, ওয়া লোন, কাইওয়া সোয়ে ও এবং তাদের পরিবারের জন্য তিনি বেদনাহত। একই সঙ্গে মিয়ানমারের জন্যও। তিনি আরো বলেন, যারা মিডিয়ার স্বাধীনতার জন্য কঠোর লড়াই করছেন তাদের সবার কাছে এ বিষয়টি অত্যন্ত হতাশাজনক। এ রায়ে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে যে, মিয়ানমারের জনগণ তাদের বিচার ব্যবস্থার ওপর কতটা আস্থা রাখেন।

মিয়ানমারে বৃটিশ রাষ্ট্রদূত ড্যান চাগ। তিনি বৃটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, এই রায়ে আমরা গভীরভাবে হতাশ। বিচারক দৃশ্যত প্রমাণকে অবজ্ঞা করেছেন। মিয়ানমারের আইনকে তিনি অবজ্ঞা করেছেন। আইনের শাসনের বিরুদ্ধে এটি হাতুড়ির আঘাত। 

 বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মিডিয়া উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী এ রায়ের কড়া নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এটা এখন ওপেন সিক্রেট যে, যেকোনো মিডিয়া বা যেকোনো ব্যক্তি যদি মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বা প্রশাসনের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো নৃশংসতা প্রকাশ করতে চায় তাহলে মিয়ানমার সরকার তাদের বিচারের মুখোমুখি করবে। 

উল্লেখ্য, রাখাইনের ইন ডিন গ্রামে ১০ রোহিঙ্গাকে হত্যা ও অন্যান্য অপরাধের বিরুদ্ধে তদন্ত করার অপরাধে রয়টার্সের ওই দুই সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয় ১২ই ডিসেম্বর। কিন্তু মিয়ানমার বারবার তার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে যাচ্ছে। কিন্তু রয়টার্সের ওই দুই সাংবাদিককে গ্রেপ্তারের পর সেনাবাহিনী স্বীকার করে নেয় ইন ডিন গ্রামের ওই ১০ রোহিঙ্গাকে হত্যার অভিযোগ। ফলে ওয়া লোল ও কাইওয়া সোয়ে ও’র বিরুদ্ধে দেয়া রায়কে একপেশে ও অবিচার বলে আখ্যায়িত করেছেন সাংবাদিক ওয়া লোন। তিনি বলেছেন, এই রায় মিয়ানমারের গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। এটা সরাসরি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতি হুমকি। কাইওয়া সোয়ে ও বলেছেন, তারা কোনো অপরাধ করেননি। তারা সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার অধিকারের অধীনে কাজ করছিলেন। তিনি বলেন, আমি সরকারকে একটি কথা বলতে চাই। তা হলো, আপনারা আমাদেরকে জেলে দিতে পারেন। কিন্তু মানুষের চোখ ও কানকে বন্ধ করতে পারবেন না। 

মিয়ানমারে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত ক্রিস্টিয়ান শমিডট টুইটারে বলেছেন, এই দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে দেয়া শাস্তি পর্যালোচনা করা উচিত এবং তাদেরকে অনতিবিলম্বে শর্তহীন মুক্তি দেয়া উচিত। মিয়ানমারে জাতিসংঘের আবাসিক ও মানবিক সহায়তা বিষয়ক সমন্বয়ক কুট ওস্টবি ওই সাংবাদিকদের মুক্তি দাবি করেছেন। তিনি এমন রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, জাতিসংঘ অব্যাহতভাবে রয়টার্সের সাংবাদিকদের মুক্তি দাবি করে আসছে। একই সঙ্গে মতপ্রকাশ ও তথ্যপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি সম্মান দেখাতে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে জাতিসংঘ। সাংবাদিক ওয়া লোন ও কাইওয়া সোয়ে ও’কে তাদের পরিবারের কাছে ফিরে যেতে দেয়া উচিত এবং সাংবাদিক হিসেবে তাদের কাজকে অব্যাহত রাখতে দেয়া উচিত। ওদিকে এ শাস্তিকে অবিচার আখ্যায়িত করে তা বাতিল করতে মিয়ানমার সরকারের কাছে একটি বিবৃতি দিয়েছে ডেনমার্ক। মিয়ানমারে ডাচ দূতাবাসের একজন মুখপাত্র মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ওই দুই সাংবাদিককে যত দ্রুত সম্ভব মুক্তি দিতে। রয়টার্সের প্রধান সম্পাদক স্টিফেন জে আদলার এ রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক পালাবদলকে এই রায় পশ্চাৎ দিকে নিয়ে যাবে। 

জরুরি হিসেবে নিয়ে এ বিষয়টি ঠিক করতে হবে মিয়ানমার সরকারকে। তার ওই দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগকে মিথ্যা বলে আখ্যায়িত করেন তিনি। বলেন, এমন অভিযোগ এনে তাদের রিপোর্র্টিংকে স্তব্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে এবং মিডিয়াকে ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। আমরা এ বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে যাবো। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়াবিষয়ক উপপরিচালক ফিল রবার্টসন এই রায়কে ক্ষোভ থেকে অবিচার বলে আখ্যায়িত করেছেন। নিন্দা জানিয়েছে সাংবাদিকদের অধিকার বিষয়ক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস। তারা বলেছে, এই রায় চিহ্নিত হয়ে থাকবে যে মিয়ানমার নতুন করে অবনতিতে।

সিজেপির দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র প্রতিনিধি শাওন ক্রিসপিন এক বিবৃতিতে বলেছেন, যে প্রক্রিয়ায় এই রায় দেয়া হয়েছে তা ন্যায়বিচারের জন্য হাস্যকর। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তিরানা হাসান এই রায়কে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সিদ্ধান্ত বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন, এ রায়ের মধ্যদিয়ে অন্য সাংবাদিকদের কাছে কঠোর হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে যে, তারা সেনাবাহিনীর নির্যাতন নিয়ে কোনো রিপোর্ট করলে তাদের জন্যও একই রকম ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে। এর ফলে আতঙ্কে অনেকেই সেন্সরশিপ আরোপ করবে। মিয়ানমারের ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার থান্ট মিন্ট-ইউ এ রায়কে মিডিয়ার স্বাধীনতার জন্য একটি ট্রাজেডি বলে আখ্যায়িত করেছেন। ওদিকে বাংলাদেশে কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা নেতা মোহিব উল্লাহ ওই দুই সাংবাদিকের দ্রুত মুক্তি দাবি করেছেন।