আয়না২৪ বিশেষ প্রতিনিধি
হঠাৎ মা বললেন, “এই ছেলের সঙ্গে তোর বিয়ে হয়েছে। এখন লেখাপড়া ছেড়ে ওর সঙ্গে ঘর-সংসার করতে হবে।” আমি তো অবাক। শুধু বলেই ক্ষ্যান্ত হলেন না তিনি বরং আমাকে ওই ছেলের সঙ্গে একইকক্ষে থাকার জন্য চাপ প্রয়োগ করলেন। রাজী না হওয়ায় মারলেন। তাতেও যখন কাজ হয়নি তখন জোর করে ওই ছেলের একসঙ্গে থাকতে বাধ্য করলেন। আমার বয়স কম কিন্তু এটা বুঝতে পারছিলাম যে মা আমার সঙ্গে অন্যায় করছেন। কারন, একে তো আমার বিয়ের বয়স হয়নি। তার উপরে বিয়েতে আমার মতামত নেওয়া হয়নি, কোনো কাগজে স্বাক্ষরও নেওয়া হয়নি। এসবই তাঁর জবরদস্তি।
কথাগুলো বলছিল, কিশোরী শারমিন আক্তার। ১৪ বছরের এই এক সাহসী কিশোরী ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী।
গত মঙ্গলবার আয়না২৪ ডটকমকে শারমিন বলে, ‘সেই সময়ের কথা মনে উঠলে শরীরটা আজো শিউরে ওঠে। আমার ওপর চাপিয়ে দেওয়া অন্যায় কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। কিন্তু কী করবো। বাবাও কাছে নেই যে তাঁর কাছে বলবো। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম বাঁচি- মরি লড়াইটা চালিয়ে যাবো’। বাড়ি থেকে অবশেষে পালিয়ে আশ্রয় নিলাম সহপাঠীর বাড়িতে। সহপাঠীকে সব খুলে বললাম। সেখান থেকে সোজা থানায় হাজির হয়ে মা আর ওই ছেলের বিরুদ্ধে মামলা করলাম। এভাবেই আমি আমার জীবনকে রক্ষা করেছি।’
২০১৫ সালের জুলাই মাসের কথা। শারমিন তখন নবম শ্রেণিতে পড়ে। বাবার অনুপস্থিতিতে মা গোলেনুর বেগম তার অভিভাবক। শারমিন বলে, ‘প্রতিবেশী স্বপন খলিফা ঘনঘন তাদের বাড়িতে আসতেন। বিষয়টি আমার কাছে ভাল মনে হয়নি’। অবশেষে সন্দেহ নির্মমভাবে সত্যি হল। মা গোলেনুর বেগম স্বপন খলিফার সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করেন। মায়ের সিদ্ধান্তে রাজী না হওয়ায় শুরু হয় চাপ প্রয়োগ। কিন্তু আমি টলিনি। তারপর শুরু হলো শারীরিক নির্যাতন। কিন্তু কিছুতেই কাজ হয়নি। একদিন হঠাৎ করেই ওই লোকটিকে বাড়িতে এনে শারমিনকে বলে দেয়া হয়, ‘ এই ছেলে তোর স্বামী, ওর সঙ্গে তোকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে এর সঙ্গেই তোকে থাকতে হবে’। তখন আমার বয়স মাত্র ১৪। লোকটিকে দেখতে অর্ধবয়সী। পড়াশোনা বন্ধ হবে, স্কুলে যেতে পারব না। এই লোকের সঙ্গে আমাকে সংসার করতে হবে! ভাবতে গিয়ে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ছিল ।
তারপর জোরকরে এক ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। বাইরে থেকে ছিটকিনি আটকে আমাকে স্বপন খলিফার সঙ্গে এককক্ষে থাকতে বাধ্য করা হলো। তখন চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। বাবা বিদেশে। বাবার কথা খুব মনে পড়ছিল। নিজেকে এতটা অসহায় লাগছিল যে মনে হয়েছে আত্মহনন করি। কিন্তু না, আমাকে সাহসী হতে হবে। যে করেই হোক এই বন্দিদশা থেকে আমাকে বেরুতে হবে। কি করে বের হব, বাইরে কড়া পাহারা। বুঝতে পারছিলাম এই ছেলের সঙ্গে থাকা আর মৃত্যুর সঙ্গে বসবাস ভিন্ন নয়। বাঁচতে আমাকে হবেই। ২০১৫ সালের ৬ অগাষ্ট চিকিৎসার অজুহাতে মা আমাকে নিয়ে গেলেন খুলনায়। সেখানে দূর সম্পর্কের এক মামার বাসায় তোলেন। ওই বাসায় আগে থেকেই স্বপন অবস্থান করছিল। রাতে জোর করে এক কক্ষে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে ছিটকানি আটকে দেওয়া হয়। ৭ আগষ্ট সকালে ওই বাসা থেকে কৌশলে পালিয়ে রাজাপুরে উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। টের পেয়ে স্বপন ও তার লোকজন পিছু নেয়। পিরোজপুরে এসে তারা আমাকে ধরে ফেলে । বাস থেকে নামিয়ে মোটরসাইকেলে তুলে আমাদের রাজাপুরের থানা সড়কে ভাড়া বাসায় এনে আটকে রাখে। ১৬ অগাষ্ট সুযোগ পেয়ে ওই বাসা থেকে দ্বিতীয়য় বারের মত পালিয়ে জুঁই নামের এক সহপাঠির বড়িতে চলে আসি । সব খুলে বলি জুঁইকে। পাশের থাকার আশ্বাস দিয়ে সাহস জোগায় জুঁই। এরপর দুজন মিলে স্থানীয় সাংবাদিকদের সহায়তায় ওইদিন রাতেই সরাসরি রাজাপুর থানায় চলে যাই । ওসির কাছে খুলে বলি এসব ঘটনা। এরপর মা ও কথিত স্বামীর বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করি। পরে মা গোলেনুর ও স্বপন খলিফাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর ঝালকাঠি জেলা নারী-শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক শফিকুল করিম আমাকে দাদি দেলোয়ারা বেগমের জিম্মায় দেন। দাদীর জিম্মায় থেকেই এখন পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছি আমি।
ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলার সত্যানগর গ্রামের কবির হোসেনের মেয়ে শারমিন আক্তার। বাবা প্রবাসে থাকায় মা গোলেনুর বেগমের সঙ্গে রাজাপুরের থানা সড়কে একটি ভাড়া বাড়িতে থাকত। প্রতিবেশী স্বপন খলিফার সঙ্গে মা গোলেনূর বেগমের ঘনিষ্ঠতা শারমিনকে মর্মাহত করত। স্বপনের সঙ্গে তার মায়ের ঘনিষ্ঠতা ও অন্যায় কর্মকাণ্ডে রীতিমত বিমর্ষ ছিল শারমিন। মায়ের অন্যায় ঢাকতে স্বপনকে তাঁর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হবে এমনটা ভাবতেই পারেনি সে।
শারমিন বলে,‘এমন অন্যায়কে কিছুতেই মানতে পারিনি। মাথা নত করিনি, সাহসের সঙ্গে মোকাবিলার জন্য মানসিক প্রস্ততি নিয়েছিলাম। বাবাকে খুব মিস করেছি। সহপাঠি নাদিরা আমাকে হেল্প করেছে। ওর প্রতি আমার আজীবন কৃতজ্ঞতা।’
ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি? লেখাপড়া চালিয়ে যেতে চাই, বড় কোনো আইনজীবী হতে চাই। বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে প্রচারণা বাড়াতে কাজ করতে চাই।’ এসব কথা বলার সময় শারমিনের চোখের ঔজ্জ্বল্য আর কণ্ঠের দৃঢ়তা ছিল লক্ষনীয়।
চারদিকে সবুজে ঘেরা সত্যানগর গ্রাম। এখানেই কথা শারমিনের দাদি দেলোয়ারা বেগমের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘মেয়েটার জীবনটা ধ্বংস করে দিয়েছিল ওরা। ও নিজেই সাহস করে থানায় গিয়ে মামলা করেছিল বলে রক্ষা পেয়েছে। এখন কত মানুষ ওর প্রশংসা করে। শুনে আমারও ভাল লাগে।কিন্তু দুঃশ্চিন্তা হয় আমি মরে গেলে মেয়েটোকে কে আগলে রাখবে।’
শারমিনের সাহসের গল্প এখন ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। তার এই সাহসিকতা কিশোরীদের কাছে এখন এক অনন্য প্রেরণা। অভিবাদন শারমিন তোমার সাহসিকতাকে।