অনন্য জুলকার, অনবদ্য জুলকার 

Spread the love
রাকিবুল ইসলাম
প্রাক্তন শিক্ষার্থী
আদর্শ একাডেমি ভোলা
১৫ দিন। নির্ঘুম রাত। স্বাস্থ্যঝুকি। টেনশন। একটি লক্ষ্য। সফলতার গল্প।
জুলকার নাইনকে নিয়ে বলতে গেলে এ শব্দগুলোই মাথায় আসে। “বিদ্যালয়ের জন্য ভালোবাসা” উদ্যোগের মাধ্যমে আদর্শ একাডেমির প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয় এবং তাঁদের প্রিয় শিক্ষকদের যেভাবে সম্মানিত ও গৌরবান্বিত করেছে তা সত্যিই এ দেশের ইতিহাসে বিরল। সবাই মিলে আমরা মনে হয় এক নতুন ইতিহাসই লিখে ফেললাম!
১৯৯৮ ব্যাচের জুলকার নাইনকে যখন ব্যাচের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়, তখন তাঁর বেশ কিছু ব্যক্তিগত কাজ চলছিল। এর মধ্যে সময় করে উদ্যোগের সাথে কাজ করাটা কিছুটা মুশকিল হয়ে যায়। তবু, নিজের মত গুছিয়ে নেয় সে। সারারাত ব্যক্তিগত কাজ করে সেহরি খেয়ে শুয়ে পড়ে। আর সকাল ৯ টা বাজলেই উঠে পড়ে ফান্ড কালেক্ট এর জন্য।
আমাদের হাতে সময় খুব একটা ছিল না। অনেক হিসেব করে জুলকার দেখল প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সাথে সামনাসামনি দেখা করতে পারলে সুফল পাওয়া যাবে। করোনার মধ্যে নিজের জীবনকে বাজি রেখে, অসুস্থতার তোয়াক্কা না করে প্রতিদিন সকালে আধঘুম থেকে উঠে বেড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন সিনিয়র শিক্ষার্থীদের সাথে দেখা করতে। যার শুভ প্রভাব পড়তে থাকে ফান্ডের উপরে। কম সময়েই আমাদের ফান্ড বেড়ে চলতে থাকে।
এর মধ্যে হঠাত ঘূর্ণিঝড় আমপানের আবির্ভাব। টানা তিন দিন বাইরে বের হওয়া সম্ভব হয় নি। তখন শুরু হয় ফোন করা। যাকে যেখান থেকে পেরেছে, ফোন করেছে। ঘূর্ণিঝড়ের রাতে হঠাত মনে পড়ল, পরের দিন স্কুল বন্ধ হয়ে যাবে। যে করেই হোক দপ্তরী-ভ্যান কাকুদের জন্য কিছু একটা করতে হবে। ন্যুনতম অর্থসাহায্য আর যদি কিছু নিত্যপণ্য কিনে দেয়া যায়, তবে বড় উপকার হয় তাদের।
২১ মে সকালে ঘূর্ণিঝড় এর প্রভাবে বেশ বাতাস বইতে থাকে। সাথে থাকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। সারারাত চিন্তা-টেনশনে ঘুম হয়নি। সেহরির পরেও বিছানায় যায় নি- যদি ঘুমিয়ে পড়ে! সকাল ৭ টা বাজলে সেই বাতাস আর বৃষ্টির মাঝে বাজারে গিয়ে কাকু-ভাইদের জন্য বাজারটা সেড়ে ফেলে। ৯ টার মধ্যে সব প্যাকিং করে স্কুলে হাজির। একে একে সবাই আসলে সকাল ১১ টার মধ্যে সকলের হাতে তুলে দেয়া হয় নগদ অর্থ সাহায্য এবং ঈদের জন্য নিত্য পণ্যের শুভেচ্ছা প্যাকেট।
প্রিয় শিক্ষকদের সহায়তার জন্য হাতে মাত্র ২ দিন বাকি। আমাদের ফান্ডে লক্ষ্য অনুযায়ী তখনও অর্থ সংগ্রহ হয়নি। আমরা এক কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ে যাই। প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে আমরা স্যারদের সহায়তার সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু এতে বেশ কিছু জটিলতা তৈরি হয়। তবুও শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করি আমরা।
২৩ মে বিকাল ৫ টায় ছিল তহবিল সংগ্রহের শেষ সময়। এরপর থেকে শুরু হয় সবথেকে চ্যালেঞ্জিং কাজ- হিসাব ক্লোজ করা। জুলকারের মাথায় পড়ে এ গুরুদায়িত্ব। প্রাক্তন শিক্ষার্থী, শিক্ষক আর ব্যাচ প্রতিনিধিদের অংশগ্রহনে ৪ ঘন্টা যাবত চলে হিসাব নিকাশের কাজ। হ্যান্ড ক্যাশ, বিকাশ, রকেট, ব্যাংক ট্রান্সফার- সবগুলো হিসাব একত্রে করা চাট্টিখানি কথা নয়। রাত ৮ টার দিকে সবাই চলে গেলে একা হয়ে যায় জুলকার। ভীষণ কঠিন এক দায়িত্ব পড়েছে তার উপর। ২ দিন ধরে ছিটেফোঁটা ঘুম নেই চোখে।
সারারাত বিভিন্নভাবে হিসাব কষে দেখা গেল প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে শিক্ষকদের দিতে গেলে কয়েকজন শিক্ষক বাদ পড়ে যান। এটা সতিই অনেক কষ্টকর পরিস্থিতি ছিল জুলকারের জন্য। কেউ কেউ ভিন্ন মত দিতে থাকে। চাপটা বেড়েই চলে। তবু সকলের মতামত নিয়ে ওই কয়েকজন শিক্ষককে পরবর্তীতে সাহায্যের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
২৪ মে সকাল ১১ টায় বিদ্যালয়ে সকল শিক্ষক, প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও ব্যাচ প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে শিক্ষকদের মাঝে ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ নগদ অর্থসহায়তা হস্তান্তর করা হয়৷ উপস্থিত সবার মনে কিছুটা প্রশান্তি এলেও, মানসিকভাবে জুলকার খুশি হতে পা্রেনি। বঞ্চিত শিক্ষকদের জন্য কিছু একটা করার তাড়া আসে ভেতর থেকে। স্কুলের আনুষ্ঠানিকতা সেরে বেড়িয়ে পড়ে আরো কিছু তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। হাতে সময় নেই একদম। তবুও শেষ চেষ্টা।
রাত পোহালেই ঈদ। সারাদিনে এক মুহূর্ত বসার সময় পায়নি জুলকার। শেষ ইফতারটাও করতে হয়েছে বাইরে। রাত তখন ১১ টা। মোটামুটি একটা এমাউন্ট সংগ্রহ হয়েছে যা দিয়ে বাকি শিক্ষকদের জন্য কিছুটা ব্যবস্থা করা যাবে। সেই রাতে সকল শিক্ষকদের কাছে পৌছে যায় আমাদের সকলের ভালোবাসার নিদর্শন। একজন প্রাক্তন শিক্ষকের পরিবারেও ঈদের আনন্দ দ্বিগুণ করে দেয় প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের পাঠানো সহায়তা।
গল্পটা এখানেও শেষ হতে পারত। কিন্তু জুলকারের অনন্যতা এখানেই শুরু। সবার কাছে অর্থ সহায়তা পৌছে দেয়ার পরেও সামান্য কিছু টাকা থেকে যায়। এ আমানত কিভাবে সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায় তা নিয়ে ভাবনা চলে। হঠাত মনে পড়ল এক দরিদ্র মেধাবীর কথা। এসএসসি পরীক্ষার্থী হলেও সে এখনো বই,সহায়ক বইসহ অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ কিনতে পারে নি। প্রিয় শিক্ষক তরিক স্যারের উপস্থিতিতে ওই শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দেয়া হয় তার প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ।
এভাবেই জুলকার নাইন তার সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে “বিদ্যালয়ের জন্য ভালোবাসা” উদ্যোগে যেভাবে কাজ করেছে, তা সত্যিই অনবদ্য, অনন্য।
জুলকার নাইন, তোমাকে স্যালুট। তোমার জন্য সীমাহীন ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।