আদিবাসী রাখাইনদের গোড়াপত্তন ও সংস্কৃতি

নভেম্বর ২১, ২০১৮
Spread the love

 

অনিন্দ্য আফরোজ
প্রাচীন পালি ভাষার শব্দ ‘রক্ষা’ থেকে রাখাইন শব্দটির উৎপত্তি। রাখাইন সম্প্রদায় মূলত একটি ক্ষুদ্র জনসমাজ। রাখাইনেরা মঙ্গোলীয় মহানৃগোষ্ঠির অন্তভক্তূক্ত। এ জাতির আবির্ভাব খৃষ্টপূর্ব ৩৩১৫ থেকে। 
প্রচলিত আছে যে প্রাচীন ভারতে শাক্য বংশের রাজত্বকালে কপিলাবস্তুর রাজা অর্জুন রাজপদ ত্যাগ করে সন্যাস গ্রহণ করেণ। একদা তিনি হাঁটতে হাঁটতে কচ্ছপ নদীর কল্লোলিত এক মনোরম পরিবেশে এসে থমকে যান। সেখানে তিনি শুরু করেণ তপস্যা। এসময় তিনি শাক্যবংশীয় রূপবতী এক যুবতীকে ধাবমান জলস্রোত থেকে রক্ষা করেণ। পরবর্তীতে উদ্ধার করা ওই রমণীকে তিনি বিয়ে করে সংসার জীবন শুরু করেণ। তাঁদের পরিবারে মারায়ু নামে এক পুত্র সন্তান জন্ম লাভ করে। এভাবে পর্যায়ক্রমে সেখানে একটি নতুন জাতি গোষ্ঠীর বিকাশ ঘটে। পরবর্তীতে কোন এক সময় এলাকার বাসিন্দারা একত্রিত হয়ে অর্জুনপুত্র মরায়ুকে ওই জনগোষ্ঠীর অধিপতি ঘোষণা করে। আর এর মধ্যদিয়েই বর্তমান মায়ানমারের অর্ন্তগত আরাকান ভূখন্ডে প্রথম ধান্যবতী নগর প্রতিষ্ঠিত হয়। এই নগরে পরবর্তীতে শাক্যবংশীয় রক্ষণশীল জাতির লোকজনের আধ্যিক্য বাড়তে বাড়তে প্রতিষ্টিত হয় রাখাইন বা রাক্ষাইন জাতি ও রক্ষাপুর দেশ। বর্তমানে এই ভূখন্ডটি আরাকান রাজ্য নামে পরিচিত। এর অর্থ হচ্ছে রৌপ্য, শুভ্র ও শান্তিময় দেশ। রাজা মরায়ু কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রক্ষাপুর নামে রাজ্যটির স্থিতি ছিল ১৭৮৪ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত। ম্রাউকের ২৭ তম রাজা মহাসামন্তের সময় তার পরিসমাপ্তি ঘটে। (মংতাহান প্রবন্ধকার)


প্রায় ছয় হাজার বছর স্থিতি ছিল রাক্ষাইন রাজ্য। ১৭৮৪ খৃস্টাব্দে বার্মিজ রাজা বোদ্রোপ্রা আরাকান রাজ্য আক্রমন করলে রাক্ষাইনেরা প্রাণরক্ষার্থে পার্শ্ববর্তী চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয় নেয়। এসময় বৃটিশরা বাংলার ইজারা নিয়ে তারা পার্শ্ববর্তী রাজ্য আরাকান দখলেওে অভিপ্রায়ে বিতাড়িত রাক্ষাইনদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে এবং আরাকান মুক্তির সংগ্রামে রাখাইনদের সহযোগীতা করে। একইসঙ্গে বৃটিশরা রাখাইনদের জঙ্গলাকীর্ণ দক্ষিণ বাংলা আবাদের জন্য দক্ষিণ উপকূলের বিভিন্ন দ্বীপ ও উপকূলীয় এলাকায় স্থানান্তর করে (মু- মজিদ) । তবে এর মতান্তরে কথিত আছে যে বার্মিজ রাজার অনুগত বাহিনীর তাড়া খেয়ে অনেক রাখাইন পরিবার সরাসরি দক্ষিণ উপকূলের পটুয়াখালী জেলার কুয়াকাটা, বরগুনা জেলার তালতলী ও বালিয়াতলী এলাকায় আশ্রয় নেয়। তখন এসব এলাকা ছিল জনমানবহীন ও জঙ্গলময়। বন্য প্রাণী যেমন বাঘ, শূকর, গরু, মহিষ ও অন্যান্য হিংস্র প্রাণী ও নদী-থালে কুমির, হাঙরের হিংস্র থাবা এবং নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে রাখাইনেরা বন-বাদাড় পরিস্কার করে এই জনপদটি আবাদী জনপদে পরিণত করে (মংতাহান) ।

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা দশমিক ৬ ভাগ উপজাতি। এদেশে ৪৫টির বেশি উপজাতির বসবাস রয়েছে। রাখাইন সম্প্রদায় এরকম একটি উপজাতি।বাংলাদেশের সাগরপাড়ের জেলা পটুয়াখালী ও বরগুনা, কক্সবাজার জেলায় এদের বসবাস বেশি।এছাড়া পার্বত্য এলাকায়ও এরা বসবাস করে,তবে সংখ্যায় কম।
রাখাইন কারা
রাখাইন শব্দটি রক্ষা ও রক্ষাইন শব্দ থেকে উদ্ভব। রক্ষা ও রক্ষাইন পালি শব্দ,এর অর্থ রক্ষনশীল । এ জাতির জীবন- যাপন,ধর্মীয় অনুশাসন,সংস্কৃতি প্রমান করে আসলেই এ জাতি রক্ষনশীল জাতি ।এ জাতির আর্বিভাব ঘটে খৃস্ট্রের জন্মেরও তিন হাজার তিন শত পনের বছর আগে,এ দাবী রাখাইন যুবনেতা তাহানের। তিনি তার ”বাংলাদেশের উপজাতি: রাখাইন” শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন’ ”যিনি স্বীয় ব্যক্তিগত,ভাষাগত,ধর্মগত এবং চরিত্রগত আদর্শকে রক্ষা করেন তিনিই রাখাইন ”।
রাখাইন জাতির উদ্ভব : রাখাইনদের অদিবাস বর্তমান মিয়ানমারের আরাকানস প্রদেশ। আরাকানস বর্তমানে মিয়ানমারের অঙ্গরাজ্য হলেও একসময় এটি ছিল স্বাধীন সার্ভভৌম দেশ। একত্রে আরাকনস শব্দের অর্থ রৌপ্য শুভ্র সুখ ও শান্তিময়। তালতলীতে বসবাসকানী রাখাইন সম্প্রদায়ের ইতিহাস খুঁজে দেখা যায়, আরাকানসের নামের যথার্থতা ছিল। ইউরোপীয় বনিকেরা এ নামকরন করেছিল। ১৭৮৪ সালে বর্মরাজা আরাকানস বা রাখাইন প্রের দখল করার কারনে এরা দেশত্যাগ করে এবং বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলীয় এলাকায় বসতি স্থপন করেন। ১৭৮২ সালে রামপ্রের বিভাগীয় শাসনকর্তা মহাসামন্ত উপাধি ধারণ করে রাখাইন সিংহাসনে আরোহণ করে। তখন থেকেই রাখাইন জাতির ভাগ্যের পতন ঘটে। বর্মীরাজা বোদকায়া আরাকান দেশ বা রাখাইন প্রে’র স্বাধীন রাজাকে যুদ্ধে পরাজিত করে বিশ্বখ্যাত মহামুনি ফয়া বা বৌদ্ব মূর্তি তার রাজধানী মন্দালয়ে নিয়ে যান এবং স্থাপন করেন । এতে আরাকানবাসী রাখাইন বৌদ্বরা ক্ষিপ্ত হয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তাঁরা বর্মী দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করে। কিন্তু বর্মী দখলদার বাহিনীর রাজা বোদকায়া আরাকান বিদ্রোহীদের দমনে নিষ্ঠুরতার পথ অবলম্বন করেন । তারা নির্বিচারে পুরুষ-নারী, শিশুদের উপড় নির্মম নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালায় । নির্মম নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের বীভৎস্যতায় অতংকিত ,পরাজিত ক্যাপটেন মংগ্নী,ক্যাপটেন উম্রাচো তিনখানা বড় সমুদ্রগামী নৌকাযোগে সপরিবারে আরাকানের পশ্চিম-দক্ষিণ তীরে অবস্থিত সচেতন তং গ্রাম থেকে সোজাসুজি পশ্চিম দিকে সাগর পাড়ি দিয়ে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় পশ্চিম তীরে অবস্থি’ত পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালী নামক দ্বীপে নোঙ্গর করে। তখনকার দিনে এসব দ্বীপ ছিল জঙ্গলাকীর্ন , দুর্ভেদ্য ও জনমানবহীন ।

বাংলাদেশে প্রথম বসতি 

১৭৮৪ সালে আরাকানের মেঘবতীর স্বান্দ্যে জেলার এক নির্জন এলাকা থেকে ১৫০ টি পরিবার বর্মী রাজার অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি লাভের আশায় ৫০টি নৌকাযোগে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে , অবশেষে তিনদিন তিনরাত পর বাংলাদেশের সর্বদক্ষিনে পটুয়াখালী জেলার হিংস্র জীবজন্তুতে পরিপূর্ন অরণ্য ভূমির বিভিন্ন দ্বীপাঞ্চলে পৌঁছায় । হিংস্র জীবজন্তু’র সঙ্গে যুদ্ধ করে রাখাইনেরা এসব অরণ্যভূমি বা বনজঙ্গল পরিস্কার করে তাদের সঙ্গে আনা ধান ও অন্যান্য বীজ বপন করে ।আজ থেকে ২৩০ বছর আগে এদেশে আসার ফলে রাখাইন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ইতিহাস ও
ঐতিহাসিক ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল । রাঙ্গাবালী দ্বীপ থেকে আস্তে আস্তে এরা ছড়িয়ে পড়েছিল-বড়বাইশদিয়া , মৌডুবি , কলাপাড়া ,তালতলী , বালিয়াতলী ও কুয়াকাটায় । ১৯৪৫ সালের হিসাব অনুযায়ী দক্ষিনাঞ্চলের পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলায় রাখাইন এর সংখ্যা ছিল ২৫ হাজার আর পাড়ার সংখ্যা ছিল ২২০টিরও বেশি । পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলায় ১৯৭০-১৯৭১ সালের জরিপ অনুযায়ী রাখাইন এর সংখ্যা ছিল ১০ হাজার আর পাড়ার সংখ্যা ছিল-২৮টি । ১৯৯০-৯১ সালের জরিপে এদের সংখ্যা ছিল ৫২৮২ জন আর পাড়ার সংখ্যা ছিল-২৮টি ।

২০০০-২০০১ সালের জরিপে এদের সংখ্যা ছিল ১৫৬০ জন আর পাড়ার সংখ্যা হল-২৮টি । রাখাইনরা যখন উপক’লীয় এলাকায় বসবাস শুরু করে তখন তা ছিল অরন্যভূমি বনজঙ্গল ,দুর্গম ও হিংস্র শ্বাপদের বিচরন ভূমি ।বাঘ ,বন্য মহিষ ,গরু, বিষধর সাপ ডাঙ্গায় আর জলে ছিল কুমির । তবু তারা বহু কস্টে অপেক্ষাকৃত পরিস্কার জায়গায় গাছপালা কেটে ঝোপঝাড়
পরিস্কার করে ঘরবাড়ি ও আবাদীজমি তৈরি করে । হিংস্র প্রানীর হাত থেকে বাঁচার জন্য উচু মাচা তৈরি করে ঘর বাড়ী তৈরি করে । বাড়ীর চারপাশে বেড়া দিয়ে রাখত । সমস্ত এলাকা ১০-১২ হাত উচু সুন্দরী কাঠ দিয়ে প্রাচীর বানিয়ে রাখত বন্য মহিষ ,শুকর ,বন্য গরু ,হরিণ ইত্যাদি ফসল নষ্ট করে ফেলত । ফলে আবাদী জমির চারপাশে বেড়া দিয়ে রাখতে হত। এছাড়াও ছিল বড় বড় ইদুরের উপদ্রব । সুপেয় পানির ছিল খুব অভাব ছিল তখন। সমুদ্র তীরবর্তী এলাকা হওয়ায় চারিদিকে ছিল লবনাক্ত পানি । সুস্বাদু পানি লাভের আশায় এরা কুয়া কেটে মিষ্টি পানি সংগ্রহ করেছিল । আর এই কুপ
কাটা থেকেই আজকের বিখ্যাত পর্যটন এলাকা কুয়াকাটা নামের উৎপত্তি।

রাখাইনদের দৈহিক বৈশিষ্ট্য 

রাখাইনদের মুখমন্ডল গোলাকার ,নাক প্রশস্ত এবং চ্যাপ্টা ,চুলের রং কালো ,পুরুষের মুখে দাড়ি কম । এরা মাঝারি আকৃতির এবং বেশ শক্তিশালী ও কর্মঠ । গায়ের রং উজ্জল ফর্সা । অধিকাংশই দেখতে সুন্দর । বিশেষ করে মেয়েরা খুব সুন্দরী হয় । এদের শিশুরা দেখতে খুবই সুন্দর ।

রাখাইনদের পোশাক পরিচ্ছদ 

রাখাইনদের পোশাক আসাক খুবই সাধারন । এরা সুন্দরের পূজারী । মেয়েরা রূপচর্চা খুব পছন্দ করে । এরা একধরনের উপটন ব্যবহার করে যা তাখোদা নামে পরিচিত । ছেলে-মেয়ে উভয়ই এটা ব্যবহার করে । তাখোদা ব্যবহারে চেহারার উজ্জলতা ও লাবন্য বাড়ে এবং গায়ের রং ফর্সা হয় । মেয়েরা লুঙ্গি ও ব্লাউজ পড়ে । পুরুষেরা লুঙ্গি ও ফতুয়া ব্যবহার করে । রাখাইনদের পোশাক এরা নিজেরাই নিজেদের তাতেঁ তৈরি করে পুরুষ-মহিলা উভয়েই অলংকার পরতে ভালবাসে। বাংলাদেশীদের মতই এরা মাছ ভাত খায় । এছাড়া গো মাংস মহিষ,ছাগল,শুকর , এদের প্রিয় খাবার । মদ এরা নিজেরাই তৈরি করে, রাখাইন ভাষায় যাকে ‘আরা’ বলে। পরিমিত মাত্রায় মদ পান এবং উৎসব পার্বনে মদ এদের অনুষাঙ্গ । বর্তমান সমাজ পরিবর্তনের আধুনিকতার ছোয়া এদের পোশাক পরিচ্ছদে এনেছে বিশাল পরিবর্তন ।

পেশা 

রাখাইনরা মূলত কৃষি নির্ভরশীল । ধান এবং নানারকমের শাক-সবজি এরা উৎপাদন করে। বর্তমান সমাজ ব্যবসা ও আধুনিকতার ছোয়া এদের মধ্যে এনেছে কর্ম ক্ষেত্রের বিশাল পরিবর্তন । বর্তমানে কৃষি ছাড়াও অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত । চাকুরী ক্ষেত্রে এদের জন্য রয়েছে বিষেশ কোটা পদ্বতির ফলে এরা এখন চকুরি পেশায় দক্ষতা দেখাতে সক্ষম ।
ভাষা ও সংস্কৃতি : রাখাইনদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি। এরা নিজেদের মধ্যে নিজেদের ভাষায় কথা বলে। শিক্ষার হার বর্তমানে সন্তোষজনক। রাখাইনদের রয়েছে নিজেদের ভাষার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এদের ভাষার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বলে কিয়াং। সাধারনত বৌদ্ধ ভিক্ষুরা কিয়াং এ পাঠদান করে থাকে । এদের সংস্কৃতিতে রয়েছে বিশেষ বৈচিত্র্য।
আচার-প্রথা : রাখাইনরা রক্ষনশীল জাতি। তাদের রয়েছে নিজম্ব আচার-প্রথা । এদের বড় বড় সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে -প্রবারনা পূর্নিমা , মাঘী পূর্নিমা , জলকেলী (লেই খেখু ), নববর্ষ ,কঠিন চিবরদান , বিয়ে । রাখাইন সমপ্রদায়ের বিয়ে উৎসব ,মৃত্যর পড়ে সৎকার তাদের অনুষ্ঠানগুলোর অন্যতম।

রাখাইনদের আচার-আচরণ
রাখাইনেরা রক্ষণশীল হলেও তাদের সাদাসিদে সহজ-সরল জীবন-যাপন নানা আচারে বর্ণিল। নদীরপাড়, ও বঙ্গোপসাগর উপকূলে সমতল ভূমিতে দলবদ্ধভাবে ঘরদোর তৈরি করে বসবাস করে তাঁরা। এসব বসতিস্থলকে ‘পাড়া’ নামে অভিহিত করা হয়। আর তাদের বসতগৃহকে বলা হয় ‘ টং’। রক্ষণশীল জনগোষ্ঠী হওয়ায় আধুনিকতা তাদের এখনো তেমন আচ্ছন্ন করেনি। তাদের ঘরদোর ও জীবনাচরণের মধ্যেই এর ছাপ স্পস্ট । এক সময়ে বাঘ, ভল্লুকের আক্রমন ও জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে রক্ষা পেতে তাঁরা ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রর আদলে উঁচু পাটাতনের টংঘরে বসবাস শুরু করলেও এখনো সেই ধারা অভ্যাহত আছে।
মাতৃতান্ত্রিক সমাজে বসবাসকারী রাখাইন সম্পদ্রায়ের নারীরাই পরিবারের প্রধান বা নেতৃক্বদাতা। তাই বিয়েসাদিতে তাঁদের সমাজে কোন যৌতুক বা পণপ্রথা নেই। বিয়ের পর বর-কনে বসে ঠিক করে তাঁরা শ্বশুর না বাবার বাড়িতে থাকবে। রাখাইন সমাজের প্রচলন অনুযায়ী বেশীরভাগ রাখাইন ছেলেরাই বিয়ের পর স্ত্রীর বাড়িতে স্থায়ীভাবে বসবাস করে।
রাখানেরা আমোদ-প্রমোদ যেমন পছন্দ করে তেমনি তারা পরস্পরের মধ্যে সৌহাদ্য বজায় রাখারও পক্ষপাতি। অর্থ্যাৎ অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠির চেয়ে শান্তিপ্রিয়। কারো সঙ্গে দেখা হলে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে হাতজোড় করে অভিবাদন জানানো, মৃদু হেসে কুশল বিনিময় তাদের ঐতিহ্য বলা যায়। বার মাসে তাঁরা নানা পার্বণ করে উৎসবের মধ্যদিয়ে। এসময নারী, পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে নানা বরণে সেজে অংশ নেয় নৃত্যগীতে। হরেক রকম নকশী পিঠা, সুস্বাদু পায়েস তৈরি করে। বিয়ে রাখাইনদের একটি উৎসবের মত। বৈচিত্র্যময় এই বিয়েতে সেবাই মেতে ওঠে অপার আনন্দ আর উৎসবে। গৌতম বুদ্ধের জন্মোৎসব, বৈশাখী পূর্ণিমা, মাঘী পূর্ণিমা, প্রবরণা পূর্ণিমা, বসন্ত উৎসব, নবান্ন উৎসব, বিবাহ, নতুন গৃহে প্রবেশ, জন্ম ও মৃত্যুর পর অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া এসব নানা উৎসব খুব বর্নাঢ্যভাবে উদযাপন করে রাখাইনেরা।
রাখাইনেরা পোশাক-আশাকে খুব বৈচিত্র্যময় । পোশাকে তারা বাহারি ও ঝলমলে রঙের ব্যবহারের পাশাপাশি লতা-পাতা, ফল-ফুল ও পশু-পাখির নকশা ব্যবহার করে। রাখাইনদের হস্তচালিত তাঁতে বোঁনা কাপড়ে বাহারি ও ঝমমলে রংয়ের ব্যবহার এবং বিভিন্ন লতা -পাতা, ফুল-ফল, পাখি ও প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গের সংমিশ্রণে আলাদা বৈচিত্র্যময়। তালতলীর রাখাইন তাতি মাচেজেন বলেন, রাখাইনেরা ঐতিহ্যগতভাবেই সবকিছুতেউ রংঙের জৌলুস, প্রকৃতি ও জীবজন্তুর প্রতি বেশী সংবেদনশীল। তাই তাঁদের পোশাক-আশাক ও সংস্কৃতিতে এর রেশ পরিলক্ষিত হয়। এজন্যে তাঁতে বোঁনা কাপড়ে ছয় থেকে আট ধরনের রঙ আমরা ব্যবহার করি। এসব রঙ কৃত্রিম নয় প্রকৃতি থেকে নেওয়া। যেমন সুতায় বিভিন্ন রঙ করতে আমরা শাল, বকুলসহ বিভিন্ন গাছের পাতা ও বাকল ব্যবহার করি। এতে কাপড়ের রঙ খুব টেকসই হওয়ার পাশাপাশি বাজারের অন্য যেকোনো কাপড়ের সঙ্গে আমাদের কাপড়ের রঙে ও বৈচিত্র্যে ভিন্নতা থাকে ।
রাখাইন সাধারণত, পুরুষেরা লুঙ্গি আর ফতুয়া পরে। মাথায় বাঁধে গেরুয়া রঙের পাগড়ি যা তাদের ঐতিহ্যের প্রতীক। নারীরা লুঙ্গির ওপর ব্লাউজ পরে। এটাকে রাখাইন ভাষায় ‘থামি ’ বলে। নারীরা হাতে বালা, কানে বাহারি কানবালা ও দুল, গলায় হাড় , কোমড়ে বিছা, পায়ে মল ও নুপুরসহ নানা অলংকার পরে।
রাখাইন সম্পদ্রায়ের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ভাষা যাকে মারমা সংস্কৃতি ও ভাষার উত্তরাধিকার হিসেবে ভাবা হয়। তারা দীর্ঘদিন বাঙালীদের সঙ্গে পাশাপাশি বসবাস করেও এই উত্তরাধিকারকে বহন করছে যতেœর সঙ্গে । রাখাইন শিশুরা তাদের নিজস্ব ভাষার হাতেখড়ি নেয় বৌদ্ধ বিহারগুলোর পাঠশালায় যা ‘কিয়াং’ নামে অভিহিত। এসব বিহারে রাখাইন ভাষা-সংস্কৃতির পাশাপাশি নানা শাস্ত্রীয় শিষ্টাচার শেখানো হয়। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এসব শিক্ষা ও জ্ঞানদান করেণ । এজন্য রাখাইনেরা স্বাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন হয়। রাখাইনেরা শতভাগ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। ‘হীনযান’ ও ‘মহাযান’ বৌদ্ধ ধর্মের প্রাচীন ধারা। বরগুরায় বসবাসকারী রাখাইনেরা ‘হীনযান’ গোত্রের।
বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠান ও স্থাপত্যসমূহ
ক্যাপ্টেন ক্যোঅং এবং তার সহযোগী রাখাইন রাখাইন নেতা ও কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে বরিশালের দক্ষিণাঞ্চল তথা সমুদ্রতীরবর্তী পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলায় রাখাইন জনপদে গড়ে ওঠে আকর্ষনীয় ধর্মীয়, সামাজিক এক ভিন্নধারা সংস্কৃতির জীবন্তরূপ। ধমীয় সংস্কৃতিকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে ধারাবাহিকখাবে তুলে ধরার জন্য কালজয়ী বৌদ্ধ মন্দির ও বৌদ্ধমূতিসমূহ স্থাপন করে রেখে গেছেন তাঁরা। সবে সত্ত্বা সুখীতা হোন্তু’ এই শ্লোকটি উচ্চারণ করে জগৎময় সুখ-শান্তির প্রার্থনা করে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা। শত বছরের পুরণো এসব বৌদ্ধ মন্দির ও বৌদ্ধ মূর্তি বর্তমানে পুরাকীর্তি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। বরগুনার বঙ্গোপসাগর তীঁরবর্তী তালতলী থানার রাখাইন অধ্যুষিত এলাকা সমূহে এরকম শত বছরের পুরণো ১৫টি বৌদ্ধ নবগ্রহ ও চৈত্য মন্দির রয়েছে। এসব মন্দির নাভিস্থলে বৌদ্ধমূর্তিসহ বৌদ্ধ ও অহরৎ শ্রাবকদের দেহভষ্ম প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। নবগ্রহ মন্দিরে গ্রহাদি সম্পর্কিত যে কোন পুজা অর্চণা করা হয়। এতে গ্রহদোষ মুক্ত হয়ে মঙ্গল সূচিত হয়। আর চৈত্য মন্দির হলো বুদ্ধের প্রতীক স্বরূপ।

তালতলীর বৌদ্ধ মূর্তি
বরগুনার   তালতলী, পটুয়াখালীর কলাপাড়া, কুয়াকাটা ও কক্সবাজারে  রাখাইনদের  এলাকা। এখানে একাধিক রাখাইন বৌদ্ধ মন্দির রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান একটি মন্দির ছিল তাঁতীপাড়ায়। স্থানীয়ভাবে জানা যায়, সাধীনতার পর তাঁতীপাড়ার রাখাইন সমপ্রদায়ের লোকজন হ্রাস পেতে থাকলে পার্শ্ববর্তী কলাপাড়া উপজেলার জনৈক থঞ্চানন মাষ্টার সেই তাঁতীপাড়ার মন্দির থেকে অষ্টধাতুর তৈরী আশি মণ ওজনের বুদ্ধ মূর্তিটি চট্টগ্রাম হয়ে বার্মায় নিয়ে যাওয়ার জন্যে সামপানে তুলে রওয়ানা দেয়। তখন বড়বগী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অংকুজান তালুকদার, চানজোয়া তালুকদার, মংখেলা, আমজাদ মৃধা প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ স্থানীয় লোকজন নিয়ে মূর্তিসহ নৌকাটি আটক করেন। এ সময় রাখাইন নেতৃবৃন্দ মূর্তিটি পার্শ্ববর্তী তালতলী জয়ারামা বৌদ্ধ মন্দিরে (তালতলী বৌদ্ধ বিহার) প্রতিস্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই থেকে মূর্তিটি তালতলী মন্দিরে রয়েছে। ধর্মপ্রাণ রাখাইন সমপ্রদায়ের লোকজন পরম শ্রদ্ধায় অষ্টধাতু নির্মিত এ মূর্তিতে তাদের পূজা দিয়ে থাকেন। জানা যায়, মূর্তিটি ১৯১৬ সালে নলবুনিয়া আগাপাড়াতে তৈরী হয়। আশি মণ ওজনের এ মূর্তির সমপূর্ণ অংশ খাঁটি সোনার প্রলেপে ঢাকা। তালতলীতে আগত পর্যটকদের জন্য এই বুদ্ধ মূর্তি অন্যতম প্রধান আকর্ষণ।

 বর্ণাঢ্য অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া উৎসব
রাখাইন সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি প্রবাদ আছে, যে জন্মে কাদো, মৃত্যুতে হাসো। গৌতম বুদ্ধের মতানুসারে , জীবন হলো দু:খের অসীম সমুদ্র। জীবনের একমাত্র চাওয়া হচ্ছে নির্বান প্রাপ্তি। আর এই নির্বান আসে মৃত্যুতে। তাই মৃত্যু আনন্দের ও অপার শান্তিময়। ’ সেই মতানুসারে রাখাইনেরা অন্ত্যোষ্টিক্রিয়াকে একটি সামাজিক উৎসবে পরিণত করে জীবনকে স্মরনীয় বরে তোলেন। এটা তাদের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির অংশ বলা যায়। বিশেষ করে রাখাইন পুরোহিতদের অন্ত্যোষ্টিক্রিয়াকে কেন্দ্র করে আয়োজন হয় বর্ণিল উৎসবের ।
পুরোহিত চিরনিন্দ্রায়তুয়ে থাকেন অন্তিম শয্যায়। তার জন্য নির্মাণ করা হয় সুবিশাল গৃহ (কাকলা) । বাঁশ দিয়ে তৈরি সেই গৃহ সুসজ্জিত করা হয় রঙিন কাগজ আর বাহারি রঙ দিয়ে ( বৌদ্ধ মন্দিরের আদলে তৈরি) । এই ঘরে অন্তিম ঘুমে মগ্ন থাকেন পুরোহিত । চা -পাতা, তামাক ও অন্যান্য সামগ্রী দিয়ে মমি করে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী তাঁর কফিনটি সংরক্ষণ করা হয় অনেকদিন। তারপর তাঁর অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত হয় মহা আয়োজনে। ৩-৪ দিন ধরে চলে নানা উৎসব ও ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা। সর্বোচ্চ ধর্মীয় বিনয়, সম্মান জানিয়ে তাঁকে বিদায় জানানো হয়। এতে যোগ দেন দেশ-বিদেশের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রধান পুরোহিত, ভক্তবৃন্দ। এ উপলক্ষে পুােহিতের জীবন -দর্শন ও বৌদ্ধ ধর্মের মৌলিক বিষয়বস্তু নিয়ে প্রকাশিত হয় বিশেষ স্মরনিকা।
বরগুরা জেলা রাখাইন বৌদ্ধ সমাজ কল্যান সংস্থার সদস্য সচিব খে মংলা জানান, অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ার আগে পুােহিতের মরদেহ স্থানান্তর করা হয় (কফিনটি সুসজ্জিত রথের বাইরে আনা হয় ) । এরপর কফিনটি অন্য একটি রথে রেখে সেখানে রাখাইন তরুনীদের নৃত্যরথ (কাদলো) অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেই কফিনটি রাতে চক্ররথে করে রাখা হয়। পরের দিন কফিনটি রথের অভ্যন্তরে বানানো ড্রাগণ আকৃতির দোলনায় তুলে রাখাইন তরুনীরা দোলান আর ধর্মীয় সংগীত (এয়েনচুয়ে) পরিবেশন করবেন। পুরোহিত যেদিন প্রথম পৃথিবীতে আসেন সেদিন যেমন নিষ্পাপ ছিলেন তেমন নিষ্পাপ হয়ে তিনি বিদায় নিলেন -এমন অবস্থা বোঝাতেই তাঁর কফিনটি দোলনায় দোলানো হয়। যেদিন পুরোহিতের মরদেহ প্রকৃতির মাঝে বিলীন করা হয় সেদিন সকালে সাজ -সজ্জিত আরেকটি রথে তাঁর কফিনটি তুলে রাখাইন নর-নারীরা দুদিকে রশি ধরে টানেন। সারাদিন এই রথ টানার শেষ হয় সন্ধ্যায় এবং রাতে ধর্মীয় গান,নৃত্য, ধ্যান শেষে আতশবাজি দিয়ে তাঁর কফিনটি প্রকৃতির মাঝে বিলিন করে দেন। এজন্য বাঁশ দিয়ে বিশেষভাবে তৈরি করা হয় প্রায় ৬০০ আতস।
খে মংলা বলেন, এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বৌদ্ধ ভ্ক্ষিু ও তাঁদের ভক্তবৃন্দ তালতলীতে আসতে শুরু করেছেন। মঙ্গলবার সকালে বান্দরবান থেকে একজন ভিক্ষুর নেতৃত্বে ৬০ জন শিষ্য তালতলী পৌঁছেছেন। আমরা আশা করছি এই উৎসবে দেশ-বিদেশের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছাড়াও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কমপক্ষে পাঁচ হাজার মানুষ যোগ দেবে।
স্থানীয় রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সঙ্ঘনায়েক উচেলাচা ২৪ বছর বয়সে ভিক্ষুত্ব(ওয়া) গ্রহণ করেণ এবং ৬০ বছর তিনি ভিক্ষু হিসেবে জীবন-যাপন করেন। তিনি ছিলেন তালতলী জেয়ারামা শ্রী মঙ্গল বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ । এই বিহারে ৮৪ মন ওজনের দেশের (সর্ববৃহৎ) বুদ্ধ মূর্তি রয়েছে। ২০১০ সালের ২৮ মার্চ বরগুনার তালতলী থানার জেয়ারামা বৌদ্ধ বিহারের পুরোহিত সঙ্ঘনায়েক উকেলাচার অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয় এমন বর্ণিল আয়োজনে। এর আগে ১৯৯৯ সালে তালতলী বৌদ্ধ বিহারের সঙ্ঘনায়েক উতারা মাহাথের পরলোক গমন করলে এমন উৎসবের মধ্যদিয়ে তাঁর অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিল।

সাংগ্রাই উৎসব

বাংলা সনের প্রথম দিন অর্থ্যাৎ পয়লা বৈশাখে রাখাইন বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা অষ্টশীল পালনের জন্য মন্দিরে যান। এদিন বুদ্ধ মূর্তিকে চন্দন জলে স্নান করানোর পর বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও স্নান করেন এবং নতুন পোশাক পরিধান করেন। বাড়ির আঙ্গিনায় আঙ্গিনায় এখানে চলে পানি খেলার আয়োজন। সঙ্গে থাকে রাখাইন সম্প্রদায়ের সব বয়সের নারী-পুুরষের সম্মিলিত নাচ আর গান। মূল উৎসবে রাখাইন যুবকরা বাদ্য আর গানের তালে তালে এসে উপস্থিত হন বিভিন্ন বাড়ির আঙ্গিনায়। সেখানে ফুলে ফুলে সুজ্জিত প্যান্ডেলের ভেতরে পানি নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন রাখাইন তরুণীরা। এখানে যুবকেরা দলবেধে কোরাস করে গাইতে থাকে সাংগ্রা গীত-
লে: লে: লে: লে:
মংরো মংরো
মংরো মংরো, লে: লে: লে: লে:
অহ্ মিরিসে- মিরিসে রি তাফল্যাসে-লংগামে
সাংগ্রা রি ঈরে ঈরে মিরিসে হ্লারে হ্লারে
রো-রা কো থইং থিংছিং কেপা
চেইনলা কো ম্রেংনো ক্যপা
রো-রা হিহ্মা য়েইন ক্যেপারে
চেইনলা হিহ্মা লুমিউ মেংরে ।

অর্থ্যাৎ-
এই শুভ দিনে সাংগ্রার হিমজল ছিটিয়ে তোমাকে শুভেচ্ছা
তারও (শীতল জলের পরস)বেশী তুলনাহীন তুমি
এ সুন্দর ঐতিহ্যের পোশাকে এই শুভদিনে ।
এ কৃষ্টিকে লালন কর
ঐতিহ্যকে ধরে রাখ
ঐতিহ্যতে মেলে পরিচয়
সভ্যতারও সাক্ষী থাকে।


এরপর চলে একে অপরকে পানি ছিটানো। পনিকে প্রবিত্রতার প্রতীক ধরে নিয়ে রাখাইন তরুণ-তরুণীরা পানি ছিটিয়ে নিজেদের শুদ্ধ করে নেয়। পুরণো বছরের সব কালিমা আর জীর্ণতাকে ধুয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেন তাঁরা। সাংগ্রাই উৎসব উপলক্ষে এ সময়ে সবাই নতুন পোশাক পরেণ। রাখাইনদের সাংগ্রাই উৎসব বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। সব আদিবাসীরাই বর্ষবরণের এ উৎসব পালন করেন বিভিন্ন নামে। কেউ বৈসুক, কেউ আবার সাংগ্রাই আবার কেউ বিজু। তবে বরগুনা, পটুয়াখালী এলাকার রাখাইদের কাছে এটা সাংগ্রা নামেই পরিচিত। বৈসুক, সাংগ্রাই আর বিজু এই তিন নামের আদ্যাক্ষর নিয়েই বৈসাবি শব্দের উৎপত্তি।
তথ্য সংগ্রহে সহযোগীতা, খে মংলা , সদস্য সচিব, রাখাইন-বুড্ডিষ্ট এসোসিয়েশন, বরগুনা জেলা শাখা।

কঠির চিবরদান উৎসব
দানোত্তম উৎসবকে বরগুনায় বসবাসকারি বৌদ্ধরা জাঁকজমকভাবে উদযাপন করে থাকে। এখানে উল্লেখ্য, যে বৌদ্ধ বিহারে বর্ষাব্রত পালন করা হয়নি সেই বিহারে কঠিন চীবর দানোৎসব উদযাপিত হতে পারে না।
বুদ্ধের সময় ভিক্ষুরা শ্মশানে বা পথে-প্রান্তরে ফেলে দেওয়া পুরনো কাপড় সংগ্রহ ও সেলাই করে
পরতেন। বর্তমানে ভিক্ষুরা বিশেষভাবে সেলাই করা গৌরিক বস্ত্র (চীবর) পরে থাকেন। ভিক্ষুরা একসঙ্গে তিনটি মাত্র চীবর পরতে পারেন। চীবরগুলো হল : অন্তর্বাস বা পরিধেয় বস্ত্র, উত্তরাসঙ্গ বা বহির্বাস এবং সংঘাটি বা দোয়াজিক। রাখাইন ভাষায় এই তিনটি চীবরকে বলা হয় যথাক্রমে সাংবাইং, সাংঘেং এবং ধূগউ বা কোদাং। এই তিনটি চীবরের যে-কোনো একটি বা একাধিক দ্বারা কঠিন চীবর দান করতে হয়। কঠিন চীবর নামের তাৎপর্য হচ্ছে, চীবর তৈরি করা অর্থাৎ তুলা থেকে সুতা কাটা, কাপড় বোনা, নির্দিষ্ট নিয়মে কাপড় কেটে বিশেষভাবে সেলাই করা, রং করা ইত্যাদি কাজ চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে অর্থাৎ অরুণোদয় থেকে পরদিন অরুণোদয় পর্যন্ত সময়ের মধ্যেই সমাপন করা। মোট কথা, কঠিন নিয়ম অনুসরণ করে চীবরটি প্রস্তুত করতে হয় বলে এর নাম কঠিন চীবর (কাথিং সাংঘেং)।
বুদ্ধ পূর্ণিমা
শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা। এ পূর্ণিমা তিথিটি বৌদ্ধদের পবিত্রতম তিথি। এ তিথিটি বৈশাখ মাসে না পড়লেও বৈশাখি পূর্ণিমা নামে খ্যাত। বৌদ্ধদের কাছে এটিই বুদ্ধ পূর্ণিমা। বুদ্ধ পূর্ণিমা মহামানব গৌতম বুদ্ধের ত্রিস্মৃতি বিজড়িত একটি পবিত্র দিন। বুদ্ধ পূর্ণিমা তিথিতেই নিস্পন্ন হয়েছিল ভাবী বুদ্ধ কুমার সিদ্ধার্থের মাতৃকুক্ষি হতে নিষ্ক্রমণ, বুদ্ধত্ব লাভ এবং মহা পরিনির্বাণ। খ্রিস্টপূর্ব ৬২৩ অব্দের বৈশাখি পূর্ণিমা তিথিতে লুম্বিনী কাননের শালতরুতলে কুমার সিদ্ধার্থের জন্ম হয়। জন্মের পর বড়-বড় রাজজ্যোতিষীগণ রাজকুমার সিদ্ধার্থের জন্মপঞ্জিকা তৈরি করেন। পণ্ডিতগণ কুমার সিদ্ধার্থের মধ্যে মহাপুরুষোচিত বত্রিশটি সুলক্ষণ দেখতে পান। বৌদ্ধদের পবিত্রতম গ্রন্থ ত্রিপিটকে এর বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। কুমার সিদ্ধার্থের জন্মের সাতদিন পর তাঁর গর্ভধারিনী মহামায়া বা মায়াদেবী অকষ্মাৎ দেহ ত্যাগ করেন। মায়ের মৃত্যুর পর সৎমা বা মাসি গৌতমীর (মহামায়া এবং গৌতমী পর¯পর সহোদরা, রাজা শুদ্ধোদন দু’জনকেই বিয়ে করেন) দ্বারা পালিত হন বলে কুমার সিদ্ধার্থের নাম হয় গৌতম। ঊনত্রিশ বছর বয়সে রাজকুমার গৌতম রাজসুখ ছেড়ে গৃহত্যাগী হন। দীর্ঘ ছবছর কঠোর সাধনার পর খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৮ অব্দে আর এক বৈশাখি পূর্ণিমা তিথিতে পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে উরুবেলার নৈরঞ্জণা নদীর তীরে বোধিদ্রুম বা অশ্বত্থবৃক্ষের তলে রাজকুমার সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধত্ব লাভ করেন। মহামানব গৌতম বুদ্ধ আশি বছর বয়সে খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৩ অব্দে আরেক বৈশাখি পূর্ণিমায় কুশীনগরের মল্লদের শালবনে পরিনির্বাণ লাভ করেন।


পরিনির্বাণের পর বুদ্ধের দেহাবশেষ দ্রোণ নামের এক ব্রাহ্মণ মগধের অজাতশত্র“, বৈশালির লিচ্ছবি, কপিলাবস্তুর শাক্য, অল্লকপ্প দেশের কোলিয়গণ, রামগ্রামের কোলিয়গণ, বেটদ্বীপের ব্রাহ্মণগণ এবং পাবার মল্লগণের মধ্যে ভাগ করে দেন। দ্রোণ ব্রাহ্মণ যে কুম্ভ দিয়ে বুদ্ধের দেহাবশেষ ভাগ করেন সেই পাত্রটি নিজে গ্রহণ করেন। অতঃপর পিপ্পলিবনের মৌর্যগণ এসে কিছু না পেয়ে চিতা থেকে অঙ্গার সংগ্রহ করে নিয়ে যান। পরবর্তীকালে প্রিয়দর্শী মহামতি অশোক বুদ্ধের অস্থিধাতুসমূহ উদ্ধার করেন এবং সমগ্র ভারতবর্ষে স্তূপ নির্মাণ করে সংরক্ষণ করেন।মহামানব বুদ্ধের পরিনির্বাণের বছর থেকে তাঁর নামে যে অব্দ গণনা করা হয় তা বুদ্ধাব্দ নামে পরিচিত। বুদ্ধ শব্দের প্রকৃত আভিধানিক অর্থ জ্ঞানী। অন্যদিকে বুদ্ধ নামটির তত্ত্বমূলক অর্থ হচ্ছে আলোকপ্রাপ্ত। বাস্তব সত্যের সন্ধান যিনি পেয়েছেন, যিনি সম্যক জ্ঞানের অধিকারী তিনিই বুদ্ধ। তাঁর আবিষ্কৃত সত্য বা মতবাদ অন্যদের তুলনায় ভিন্ন এবং বাস্তবধর্মী। তাই গৌতম বুদ্ধ যথার্থই বুদ্ধ। মহামানব বুদ্ধ যে সত্য ধর্ম প্রচার করে গেছেন তাতে কোনো ধরনের অন্ধবিশ্বাস বা কুসংস্কারের স্থান নেই। সেখানে দেব-দেবীর পূজা, ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি বা বিশ্বাসের স্থান নেই, আছে সর্বজন গ্রহণযোগ্য কতকগুলো নীতি, আদর্শ ও দর্শন। তিনি জ্ঞানীর শরণ, ন্যায়ের শরণ এবং একতার আশ্রয় গ্রহণের কথা বলেছেন।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, বুদ্ধ পূর্ণিমা তিথিটি বৌদ্ধদের কাছে পবিত্রতম দিন। বুদ্ধ পূর্ণিমা তিথিকে বৌদ্ধরা স¤পূর্ণ ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে উদযাপন করে থাকে। তবে ভাষা, পরিবেশ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ভিন্নতার কারণে পৃথিবীর ভিন্ন-ভিন্ন অঞ্চলের বৌদ্ধ সম্প্রদায় ভিন্ন-ভিন্ন আঙ্গিকে বা আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে এ পূর্ণিমা তিথিকে উদযাপন করে থাকে। বরগুনায় বসবাসকারি রাখাইন সম্প্রদায়ও তাদের কৃষ্টি
এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনুযায়ী বুদ্ধ পূর্ণিমা (রাখাইন ভাষায় কাছুং লাহব্রে) তিথিকে উদযাপন করে থাকে। বুদ্ধ পূর্ণিমা বা কাছুং লাহব্রে উপলক্ষ্যে যে উৎসব হয় তাকে রাখাইন ভাষায় ‘ঞংরি লং পোয়ে’ বলা হয়। বুদ্ধ পূর্ণিমা তিথিতে বোধিদ্রুম বা অশ্বত্থবৃক্ষের গোড়ায় জল ঢালা হয় বলে রাখাইন ভাষায় এ রকম নামকরণ (অশ্বত্থবৃক্ষকে রাখাইন ভাষায় ঞং পাং বা বঃথি পাং বলা হয়)। সিদ্ধার্থ গৌতম দীর্ঘ ছয়বছর সাধনার পর বোধিবৃক্ষের তলায় বুদ্ধত্ব লাভ করেছেন বলে প্রতিবছর বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন বিকাল বেলা বিহার আঙিনায় রোপণ করা বোধিবৃক্ষের গোড়ায় (প্রতি বছর একই গাছে) চন্দন মিশ্রিত জল ঢালা হয়। এর অর্থ হচ্ছে সিদ্ধার্থ গৌতমের বুদ্ধত্ব লাভকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা। বুদ্ধ পূর্ণিমা উপলক্ষ্যে রাখাইন অধ্যুষিত কোনো-কোনো এলাকায় ‘ওয়াংকাবাহ’ (এক ধরনের চক্রব্যূহ) বসানো হয়। নারী-পুরুষ, ছোট-বড় সবাই ওই ওয়াংকাবাহ-র অভ্যন্তরে প্রবেশ করে প্রদক্ষিণে অংশগ্রহণ করে। বিকালে বৌদ্ধ বিহার থেকে ধর্মীয় শোভাযাত্রা বার করা হয় এবং গ্রাম প্রদক্ষিণের পর পুনরায় বৌদ্ধ বিহারে এসে শেষ হয়। শোভাযাত্রা শেষে নির্দিষ্ট বোধিবৃক্ষের গোড়ায় চন্দন মিশ্রিত জল ঢালা হয়। এর পর সমবেত প্রার্থনা এবং পঞ্চশীল গ্রহণ করা হয়। পঞ্চশীল গ্রহণের পর বয়োজ্যেষ্ঠ বৌদ্ধ ভিক্ষু ধর্মীয় আলোচনা করেন। ঞংরি লং পোয়ে উপলক্ষ্যে সেদিন রাতে জ্যাঃ (গীত-নৃত্য-অভিনয়ের ত্রিসঙ্গমজাত নাট্য) পরিবেশনের আয়োজন করা হয়। ইদানীং জ্যাঃ-এর পরিবর্তে লোকজ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান (রোঃরা পোয়ে) এবং প্র্রাজ্যাঃ (মঞ্চ নাটক) পরিবেশন করতে দেখা যায়। এ ছাড়া বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন বয়স্ক রাখাইন নারী-পুরুষ পূত-পবিত্র হয়ে বৗদ্ধ বিহারে গিয়ে উপোসথ বা অষ্টশীল পালন করে থাকেন।

বিয়ে

সাধারনত ফসল তোলার মৌসুমে এরা বিয়ের অনুষ্টান করে থাকে। বিয়ের জন্য ছেলে পক্ষ মেয়ের খোজ করে।এ সময়ে নির্বাচিত হলে ছেলে পক্ষ মুরুব্বি বা পাড়ার প্রধান বা সম্মানিত কাউকে মেয়ে পক্ষের নিকট বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে পাঠায়। মেয়ে পক্ষ প্রস্তাব মনঃপুত হলে ছেলে পক্ষকে আলোচনা ও বাগদান করার জন্য খবর পাঠায়। ভাল দিন তারিখ দেখে পাড়ার মাতুব্বর, মুরুব্বি, আত্মীয়-স্বজন, ছেলে ও বন্ধু সহ মেয়ে পক্ষের বাড়িতে যায়। আংটি পড়ানোর মাধ্যমে বাগদান স¤পন্ন হয়। পুরোহিত ডেকে পত্রিকা দেখে বিয়ের শুভ দিনক্ষন ঠিক করা হয়। উভয় পক্ষ ছেলে মেয়েকে কি কি দিবে তার হিসাব করা হয়। বিয়ের কয়েক দিন আগে থেকে চলে ছেলে এবং মেয়ে বাড়ি উৎসব। মেয়ের বাড়ীতেই হয় বিয়ের প্রধান আয়োজন ।পাত্র পক্ষ বাজি ফুটিয়ে , বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে কনে বাড়ী আসে । এ সময় ঐতিহ্য অনুযায়ী বরের প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র ছাড়াও -একটি লম্বা দা ,পাখা ,তামাক খাবার পাইপ সাথে নিয়ে আসে । বিয়ের আসরে আসার
পর বর-কনের জন্য সজ্জিত মঞ্চে বরকে বসতে দেয়া হয় । নাস্তা ছাড়াও এ সময় তবরক দেয়া পান খেতে দেয়া হয় । বিয়ের লগ্ন শুরু হবার পূর্বে কনেকে সাজিয়ে বরের পাশে বসানো হয় । মোম জালিয়ে মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে পুরোহিত বিয়ের কাজ শুরু করেন । একজন বয়স্ক মহিলা বর-কনের হাত একত্রিত করে তাদের জন্য তৈরি পায়েস খাইয়ে দেয় । এরপর বর -কনে একে অন্যকে খাইয়ে দেয় । ঐতিহ্য অনুযায়ী বিয়ের দিন বর পড়ে লুঙ্গি ,ফতুয়া ও পাগড়ি এবং কনে পড়ে
লুঙ্গি ,ব্লাউজ ,ওড়নার মত একখন্ড কাপড় । বর ৩-৪ দিন কনে বাড়ী থেকে কনে নিয়ে বাড়ী চলে যায় ।

রাখাইন সাহিত্য ও সংস্কৃতি

রাখাইন শব্দটির উৎপত্তি মূলত, রক্ষণ শব্দ থেকে। রাখাইন শব্দের উৎপত্তি স¤পর্কে কর্ণেল ফেয়ার বলেন- রাখাইন শব্দটি রাখাইনতঙ্গী বা রাখাইনপি থেকে গৃহিত যার অর্থ হচ্ছে দৈত্য বা রাক্ষস। সত্যিকার অর্থে রাখাইন শব্দটির আভিধানিক অর্থ হচ্ছে যে জনগোষ্ঠী স্ব-ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি ও লোকাচারকে সযতেœ সংরক্ষণ ও পরিচর্যা করে এবং ধ্বংসের হাত থেকে যারা রক্ষা করে তারাই রাখাইন। তাদের ভূমির নাম রাক্ষাপুরা বা রাখাইন পে। অনেকেই পালি শব্দ রক্ষা থেকে রাখাইন শব্দের উৎপত্তি বলে উল্লেখ করে থাকেন। প্রত্যেক জাতিরই একটি নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, জীবনাচরণ রয়েছে এবং তা এখনো অনেক জাতি নিজস্ব স্বকীয়তায় তা অব্যাহত রেখেছে। তেমনি রাখাইনদের নিজস্ব একটি সত্তা রয়েছে। রাখাইনেরা সুদীর্ঘ ইতিহাস থেকে নিজেদের মধ্যে নিজস্ব ভাষা নিয়ে মনের ভাব আদান-প্রদান করে যাচ্ছে।
রাখাইন জাতিকে স্থানীয়ভাবে অনেকেই মগ বা মগজাতি বলে থাকেন। কিন্তু আসলে তারা মগজাতি নয়। তাদের একটি পৃথক জাতিসত্তা রয়েছে। মগ শব্দটি অবজ্ঞার সাথে তুলনা করে ডাকা হয়। কারণ ষোল শতকে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের পর্তুগীজ দস্যূ ও মগদস্যুদের অত্যাচারে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। মগেরা আসলে জলদস্যূজাত। রাখাইন এবং মগদের দৈহিক ও শারিরীক আকৃতির সাদৃশ্যগত মিল থাকায় স্থানীয়রা রাখাইনদেরকে মগনামে অভিহিত করে। যদিও মগ নামে কোন শব্দ রাখাইন অভিধানে নেই।ইতিহাস পাঠে জানা যায়, খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩৪১ বছর আগে রাখাইন জাতির উৎপত্তি। পন্ডিতমহলের মতে, খ্রিষ্টপুর্ব ৫০০০ ও ৪০০০ খ্রিষ্টপুর্ব যথাক্রমে নিগ্রিতা এবং দ্রাবিডিয়ান জাতির আবাসভূমি ছিল। পরবর্তীকালে আর্য এবং মঙ্গোলিয়রা এখানে বসবাস শুরু করে। আগন্তুক এই দ্রাবিডিয়ান জাতিরা
প্রথম জনগোষ্ঠী নিগ্রিতাকে এ অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করে। পরে দ্রাবিডিয়ানদেরকে আর্য ও মঙ্গোলিয়রা বিতাড়িত করে স্থায়ী ভাবে বসবাস করে। পরবর্তীতে সভ্য জনগোষ্ঠী আর্য ও মঙ্গোলীয়দের সংমিশ্রনে রাখাইন জাতির সৃষ্টি হয়েছে। মঙ্গোলিয়রা আসাম, মনিপুর, বিহার, গঙ্গা নদী তীরবর্তী অঞ্চল, উত্তর ভারত ও উত্তর-পুর্ব ভারত হতে আরাকানে অনুপ্রবেশ করে। আর্যরাও কপিলাবস্তু, দেবদাহ ও কনিঙ্ক, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরবর্তী অঞ্চল ও উত্তর ভারত হতে আরাকানের প্রবেশ করে বসতী স্থাপন করেন। ইন্দো-এরিয়ান গ্র“প সুদূর পথ পরিক্রমন করে বারবার গঙ্গা থেকে কালাদান এবং কালাদান থেকে গঙ্গাতে এসে যুদ্ধে লিপ্ত হত। যুদ্ধে বিজিত দল পালিয়ে গেলে সেখানেই নতুন রাষ্ট্র বর্তমান আরাকান রাজ্য গঠন করেন।

আরাকানী বলতেই রাখাইনকে বুঝায়। আরাকান শব্দটি রাখাইন শব্দের বিকৃতি রূপ, রাখাইন/ রাখাইং/ রাখাং/ রাকাং/ আরকান/ আরাকান । আরাকান বাংলাদেশের দক্ষিন-পুর্ব সীমান্তে মায়ানমারের অন্তর্গত একটি প্রদেশ যা রাখাইন ষ্টেট নামে পরিচিত। সাগর, নদী ও পাহাড় ঘেরা পাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি রাখাইন প্রদেশ। ঞযব অংরধ নামে পরিচিত। এখানে ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে ২৭ জানুয়ারী পর্যন্ত বর্তমান বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে স্থায়ী ভাবে রাখাইনেরা বসবাস করেছিল। অনেক যুদ্ধ বিগ্রহের পর মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের অধীনস্থ বাংলার সুবেদার শায়েস্তাখান আরাকানীদেরকে যুদ্ধে পরাজিত করে চট্টগ্রাম দখল করে এর নাম দেন ইসলামাবাদ। তাঁর জৈষ্ঠ্য পুত্র প্রধান সেনাপতি উমেদ খান ২৭ জানুয়ারী
চট্টগ্রাম দুর্গে বিজয়ী বেশে প্রবেশ করেন। অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে রাখাইনেরা পরবর্তীতে তাদের রাজ্য পুনরুদ্ধার করে। কিন্তু ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে আরাকানের রাজনৈতিক অবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে পড়ে যায়। যার ফলে রাখাইন ইতিহাসে বিদ্রোহ, পাল্টা বিদ্রোহ, হত্যা ও ক্ষমতা দখলের দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বার্মার (মায়ানমার) আলাঙ্গপায়া বংশের বর্মীরাজ বোধপায়ার (১৭৮২-১৮১৯) রাখাইন ইতিহাসের শেষ রাজা থামাদাকে হত্যা করে আরাকান রাজ্য দখল করে নেয়। ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দে রাখাইনদের পিতৃভূমি আরাকান ভূ-খন্ডটি কুরুক্ষেত্রে পরিণত হলে সদ্য স্বাধীনতা লুপ্ত আরাকানে রেমব্রে, মেংঅং, সেনডোয়ে, ক্যাউ-ফ্রো অঞ্চল থেকে স্বাধীনচেতা তেমেনগ্রী প্যো অং, উ ঘং গ্রী এবং উ অংক্য চৌধূরীর নেতৃত্বে ১৫০টি রাখাইন পরিবার ৫০টি নৌযান যোগে পিতৃভূমির মায়া ত্যাগ করে বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউ অতিক্রম করে দক্ষিণ বাংলায় জনবসতি হীন বন্য অরন্যময় দ্বীপাঞ্চল উপকূলীয় এলাকায় বসতি স্থাপন করে। সে সময় এ অঞ্চলের বেশিরভাগ এলাকায় বাঘ, ভল্লুক, কুমির ইত্যাদি ভয়ানক জন্তুতে ভরপুর ও বসবাসের অনুপযোগী ছিল। রাখাইনরা সব ভয়ানক জীব জন্তুর সাথে জীবন বাজী রেখে অসীম সাহসের সঙ্গে তীব্র লড়াই করে অনাবাদি পতিত এলাকা সমূহকে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সুজলা-সুফলা, শষ্য-শ্যামলা আবাদযোগ্য ভূমিতে পরিণত করে। রাখাইনদের আÍ-ত্যাগের মহিমায় আজ এতদাঞ্চলে সোনালি ফসল ক্ষেত, মাঠ ভরা সবুজ শস্য। অনাবাদী ভূমিকে আবাদি ভূমিতে রূপান্তর করে যুগান্তরী পরিবর্তন করেছে দেশে দক্ষিণাঞ্চলে সমুদ্র কল্লোলিত শেষ প্রান্তকে। রাখাইনরা মূলত কক্সবাজার, রামু, মহেশখালী, চকরিয়া, সাতকানিয়া, উখিয়া, টেকনাফ, বরগুনা, পটুয়াখালী, খেপুপাড়া, পার্বত্য জেলা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, আমতলী, গলাচিপা এলাকায় বর্তমানে রাখাইনেরা বসবাস করে আসছে। এখানে বসবাসকারী মোট পরিবারের সংখ্যা- ১৬,৮৮২, জনসংখ্যা ১,৫০,০০০। (তথ্য সূত্র: রাখাইন ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন)। খ্রিষ্টপুর্ব ৩৩২৫ অব্দথেকে দক্ষিন-পুর্ব এশিয়ার কালাদান নদীর তীরে গড়ে উঠা সু-সভ্য রাখাইন জাতির উত্থান-পতনের ইতিহাস, বৈচিত্রময় সংস্কৃতি ও লোকাচার, সংস্কার, বিশ্বাস, সামাজিক পটভূমি স্বল্প সময়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। 


 বিভিন্ন সময়ে উদ্ধারপ্রাপ্ত শিলালিপি ও স্তম্ভ, পুঁথি ও গুহা দেয়ালে উৎকীর্ন লেখা সমূহ থেকে ধারণা করা যায় যে, রাখাইন প্রে তথা খ্রিস্ট্রিয় চতুর্থ শতকের আগে সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে ব্রাহ্মলিপি ব্যবহার করত, কিন্তু কালক্রমে এর ব্যবহার বিলুপ্তি ঘটে। ছয় শতকের প্রারম্ভে এসে সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে রাখাইন ভাষা ব্যবহার করে। রাখাইন সাহিত্যিকদের মধ্যে প্রথমে উল্লেখ করতে হয় তৎকালিন চকরিয়া (সুরতন) এর আরাকান রাজকুমারী চপ্রেঞো (সুবর্ণা দেবী)। ৬০১ সালে তৎকালিন সামাজিক প্রেক্ষাপট, রাজনৈতিক চেতনা আর ঐতিহাসিক ঘটনার ওপর ভিত্তি করে রাজকুমারী চপোক্রো (সুবর্ণা দেবী) “ছিঙকেঙমিংটেঙ” নামে বিরহ গীতিকাব্য রচনা করে রাখাইন সাহিত্যে অনন্য সৃষ্টি হিসাবে বিবেচিত হয়। সুবর্ণা দেবী হারবাঙ গ্রামের আলয়ে বসে এ বিরহ গীতিকাব্য রচনা করেছিলেন। বিরহ গাঁথাটিতে তৎকালীন আর্থ-সামাজিক অবস্থার চিত্র পরিস্ফুটিত  হয়েছে।