স্নিগ্ধা মনি মিতু
প্রেম-ভালোবাসা হল পবিত্র একটি বিষয়। অনেক সাধ ও আকাঙ্ক্ষার একটি ব্যাপার হচ্ছে ভালোবাসা। সব মানুষই জীবনে কারো না কারো প্রেমে পরেন। যেমন প্রথম দর্শনে রোমিওর প্রেমে পড়েছিলেন জুলিয়েট। চলুন তাহলে শোনা যাক এরকম কিছু প্রেমকাহিনী-
শিরি ফরহাদ
পারস্য শহরের খসরু নামের এক যুবক স্বপ্নে দেখেন, তার দাদা প্রথম খসরু এসে তাকে বলছেন, তাঁর জন্য চারটি উপহার তিনি নিয়ে এসেছেন। তার ভাগ্যে জুটবে পরমা সুন্দরী এক স্ত্রী যার নাম হবে শিরিন, চমৎকার এক ঘোড়া যার নাম শাবদিজ, দক্ষ এক গায়ক যার নাম বারবাদ, আর বিশাল এক রাজ্য যার নাম পারস্য। আদতে খসরু তখন আক্ষরিক অর্থেই পারস্যের রাজপুত্র ছিলেন।
খসরু এই স্বপ্নের কথা তাঁর কাছের এক বন্ধু- শাপুরকে বলেন। এরপর শাপুর অনেক খোজ খবর নিয়ে দেখলেন যে পাশের রাজ্য আর্মেনিয়ার রাজকুমারী হলেন সেই শিরিন।
বেশ কয়েকবার নাটকীয়ভাবে খসরু আর শিরিনের সাক্ষাৎ বিঘ্নিত হয়। সর্বশেষ খসরুর পিতা মারা যাওয়া ও রাজ্য বেদখল হওয়ায় তিনি পার্শ্ববর্তী আরেক রাজার নিকট সাহায্যপ্রার্থী হন। রাজকুমারীকে বিয়ে করার শর্তসাপেক্ষে রাজা খসরুকে সাহায্য করেন। এর কিছুদিন পরেই খসরুর সাথে মারিয়াম নামের সেই রাজকুমারীর বিয়ে হয়।
এদিকে শিরিন খোঁজ করছিলেন পাহাড় থেকে প্রাসাদ পর্যন্ত সরাসরি কোনো তরল পরিবাহক সুড়ঙ্গ বানাবার জন্য কাউকে, যেন তিনি সহজে দুধ আনাতে পারেন। এজন্য তিনি ফরহাদ নামের এক ভাস্করকে ঠিক করেন।
ফরহাদ ছিল বেশ পটু একজন ভাষ্কর। রাজকুমারী শিরিনের সাথে সাক্ষাৎ করতে এলে প্রথম দর্শনেই ফরহাদ প্রেমে পড়ে যান শিরিনের। তাকে খুশি করতে দুধের ছোটখাট খাল বানিয়ে ফেলেন তিনি প্রাসাদের কাছে। খুশি হয়ে শিরিন তাকে তার কানের দুল উপহার দেন।
ফরহাদ শিরিনকে নিয়ে কবিতা আর প্রেমপত্র লিখতে শুরু করলেন। তার এই প্রেমের খবর চাউড় হয়ে গেল রাজ্যজুড়ে।
কিন্তু এ খবর খসরুর কানে পৌঁছালে ভীষণ রেগে গেলেন তিনি। যে করেই হোক ফরহাদকে সরাতেই হবে রাস্তা থেকে। ফরহাদকে তিনি তলব করলেন বেহিস্তান পাহাড়ের পাথর কেটে সিঁড়ি নির্মাণের জন্য, যদি করতে পারে এ কাজ, তবে ফরহাদ শিরিনকে বিয়ে করতে পারবেন- খসরুর কোনো আপত্তি থাকবে না। মোটামুটি অসম্ভব কাজ, যার মানে তাকে দূরে থাকতে হবে শিরিন থেকে। তবে এ কাজ শুরু করবার আগে পাহাড় খোদাই করে ফরহাদ শিরিনের চেহারা বানিয়ে ফেলেন।
কাজ চলাকালীন ফরহাদের কাছে খসরু দূত পাঠিয়ে জানালেন, শিরিন মারা গেছেন। ফরহাদ এ কথা শুনে মনের কষ্টে সে পাহাড় থেকে লাফ দিয়ে মারা যান। কিন্তু খসরু ইচ্ছে করে তাকে মিথ্যা সংবাদ দিয়েছিলেন। আসলে শিরিন মারা যাননি, ছিলেন বহাল তবিয়তেই।
পরবর্তীতে খসরুর সাথেই শিরিনের বিয়ে হয়। তবে প্রেমের জন্য আত্মত্যাগ ও শিরিনের প্রতি গভীর প্রেম শিরি ও ফরহাদকে একই সুতায় গেঁথে রেখেছে।
রোমিও ও জুলিয়েট
নিঃসন্দেহে রোমিও এবং জুলিয়েটের প্রেমের আখ্যান দুনিয়ার অন্যতম বিখ্যাত প্রেম কাহিনী। যেন ভালোবাসার অপর নাম রোমিও-জুলিয়েট।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, রোমিও আর জুলিয়েটের পরিবারের মধ্যে শত্রুতার সম্পর্ক ছিল। দুটি ভিন্ন পরিবারের পূর্ববর্তী রেষারেষি, বংশীয় অহংকার ভেদ করে দুজন তরুণ-তরুণী প্রথম দর্শনে প্রেমে পড়ে যায়। পরবর্তীতে পরিবারের শত বাঁধা উপেক্ষা করে নানা নাটকীয়তার মাঝে তারা বিয়ে করে।
বিয়ের ক’দিন বাদেই দুর্ভাগতের ছায়া নেমে এল রোমিওর জীবনে। এক ঘটনার রেশ ধরে জুলিয়েটের ভাইয়ের হাতে মারা যায় রোমিওর সব থেকে কাছের বন্ধু। আর আত্বরক্ষা করতে গিয়ে রোমিও হত্যা করে ফেলেন জুলিয়েটের ভাইকে।
সেসময়ে রাজ্যে রাজার আদেশ ছিল যে রাজপথে কেউ দাঙ্গা-হাঙ্গামার সৃষ্টি করলে তাঁকে মৃত্যুদন্ড দিবেন। অবশ্য সবকিছু শুনে রাজা রোমিওকে নির্বাসন দন্ড দিলেন।
রোমিওর হাতে টিবল্টের মৃত্যু ও তার পরিণতিতে রোমিওর নির্বাসন দণ্ডের খবর শুনে যার-পর-নাই ভেঙে পড়ল জুলিয়েট। নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়ে সর্বদাই সে কাঁদতে লাগল। বাবা, মা, বাড়ির সবাই নানাভাবে বোঝালেন তাকে—তা সত্ত্বেও জুলিয়েটের চোখের জল বাঁধা মানল না।
একমাত্র মেয়ের এরূপ অবস্থা দেখে তাঁর বাবা বেশ উদ্বিঘ্ন হয়ে উঠলেন। জুলিয়েটের বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। পরিবারের সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ঘর-দোর সাজানো, রাতারাতি জুলিয়েটের জন্য গহনা গড়ানো, এ সবই হয়ে গেল।
একগুঁয়ে বাপের সিদ্ধান্ত শুনে খুবই মুশকিলে পড়ে গেল জুলিয়েট। সে ভেবে পেল না কীভাবে এই বিপদ থেকে মুক্তি পাবে। শেষমেশ তার মনে পড়ল এক সন্ন্যাসী লরেন্সের কথা—যিনি তাদের বিয়ে দিয়েছিলেন। একদিন সবার অলক্ষ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে চলে গেল সন্ন্যাসীর আস্তানায়। সন্ন্যাসীকে সব কথা বলে তার পরামর্শ চাউল সে।
সবকথা শোনার পর সন্ন্যাসী তাকে বললেন, ‘দেখ, বাবার অবাধ্য হয়ো না। কাউন্ট প্যারিসকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাও তুমি। ও নিয়ে কান্না-কাটি করোনা। ফুলের তৈরি একটা ওষুধ আমি তোমায় দিচ্ছি। তুমি সেটা সাবধানে রেখে দিও। এটা যেন অন্য কারও হাতে না পড়ে। যে দিন তোমার বিয়ে হবে, তার আগের দিন রাতে এই ওষুধটা খেয়ে তুমি শুয়ো। এই ওষুধের প্রভাবে খুব শীঘ্র ঘুমিয়ে পড়বে তুমি—তখন মৃতের সমস্ত লক্ষণ দেখা দেবে তোমার দেহে। পরদিন সকালে তোমাকে দেখে সবাই ধরে নেবে তুমি মারা গেছ। তখন বাধ্য হয়ে তোমার বাবা বিয়ে বন্ধ করে তোমার মৃতদেহ গির্জায় পাঠিয়ে দেবেন কবর দেয়ার জন্য। গির্জার ভেতর ক্যাপুলেটদের একটা নিজস্ব ঘর আছে। পারিবারিক নিয়ম অনুযায়ী তোমার মৃতদেহ কমপক্ষে একদিন রাখা হবে সেখানে। আমি যে ওষুধটা তোমায় দিচ্ছি তার মেয়াদ চব্বিশ ঘণ্টা। এর অর্থ রাত ফুরোবার আগেই ক্যাপুলেটদের সেই কক্ষে ঘুম ভেঙে যাবে তোমার। ঘুম ভেঙে গেলেই দেখবে তোমার কাশে বসে আছে রোমিও। তোমার জ্ঞান ফিরে এলেই রাতারাতি তোমায় মান্টুয়ায় নিয়ে যাবে রোমিও। নিশ্চিন্তে সেখানে ঘর বাঁধতে পারবে তোমরা। আমি এখনই একজন বিশ্বস্ত লোককে মন্টুয়ায় রোমিওর কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি। রোমিওর যা যা করণীয় তাকে আগে থেকেই বলে আসবে সে। আশা করি এবার তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারবে।’
যে দিন তার বিয়ে হবে তার আগের রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে তার ঘরের জানালার কাছে এসে দাঁড়াল জুলিয়েট। রোমিওর সাথে প্রথম পরিচয়ের রাতে যে গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে রোমিও সারারাত তার সাথে কথা বলেছিল, সে দিকে তাকিয়ে বহুক্ষণ দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। তারপর ধারেকাছে কাউকে দেখতে না পেয়ে সন্ন্যাসী প্রদত্ত ওষুধটা খেয়ে ফেলল সে। একটু বাদেই বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ বাদেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল সে।
পরদিন সকালে জুলিয়েটকে ডাকতে এসে ধাই দেখতে পেল মড়ার মতো নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে পড়ে আছে জুলিয়েট। কাছে গিয়ে সে দেখল তা নিশ্বাস-প্রশ্বাস বইছে না, বুকের ধুকপুকুনি নেই, চোখের মণি ওপরে উঠে গেছে। ভয় পেয়ে তৎক্ষণাৎ খবর দিল জুলিয়েটের বাবা-মাকে। তারা এসে মেয়ের অবস্থা দেখে বেজায় ঘাবড়ে গেলেন। সাথে সাথেই জুলিয়েটের বাবা চাকরকে পাঠিয়ে ডাক্তারকে ডেকে আনলেন। জুলিয়েটকে ভালোভাবে পরীক্ষা করে ডাক্তার জানালেন বহু আগেই মৃত্যু হয়েছে। ডাক্তারের কথা শুনে বাড়িময় কান্নার রোল উঠল। বাড়ির সবাই বুক চাপড়ে কাঁদতে লাগল। তারা স্বপ্নেও ভাবেনি এমন সর্বনাশ ঘটে যেতে পারে।
মেয়ের দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে তার মৃতদেহটিক ফুলে সাজিয়ে কবর দেবার জন্য গির্জায় পাঠিয়ে দিলেন জুলিয়েটের বাবা-মা। পারিবারিক প্রথা অনুযায়ী জুলিয়েটের মৃতদেহটি একদিন সমাধি ক্ষেত্রে রাখার ব্যবস্থা করা হল।
সন্ন্যাসী লরেন্সও চুপচাপ বসে ছিলেন না। একজন বিশ্বস্ত লোককে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে তাকে পাঠিয়েছিলেন মান্টুয়ায় রোমিওর কাছে। কথা ছিল সেই লোক রোমিওকে সব কিছু খুলে বলবে এবং জুলিয়েটের মৃতদেহ সমাধিকক্ষে রাখা হলে সে রোমিওকে সেখানে নিয়ে আসবে। সন্ন্যাসী লরেন্স জানতেন জুলিয়েট যে ওষুধ খেয়েছে তার মেয়াদ কখন শেষ হবে। তিনিও রাতের বেলা সেখানে চলে আসবে যাতে ঘুম ভেঙে জুলিয়েট দেখে তাকে আর রোমিওকে। এরপর জুলিয়েটকে ভেরোনার সীমান্ত পার করিয়ে মান্টুয়ায় পৌঁছে দেবার দায়িত্ব তারই।
অথচ রোমিওর দুর্ভাগ্য এমনই যে সন্নাসীর লোক পৌঁছাবার আগেই ভেরোনা ফেরত অন্য এক লোকের মুখে জানতে পারল জুলিয়েট মারা গেছে। জুলিয়েটের বাবা-মা তার বিয়ে ঠিক করেছিল কাউন্ট প্যারিসের সাথে। কিন্তু বিয়র নির্দিষ্ট দিনে ভোরের আলো দেখার সুযোগ হয়ে ওঠেনি জুলিয়েটের। আগের রাতেই মারা গেছে সে। জুলিয়েটের মৃত্যুর কথা শুনে মন ভেঙে গেল তার। সে স্থির করল আত্মহত্যা করবে। এক ওঝার কাছ থেকে মারাত্মক বিষ সংগ্রহ করে ভেরোনায় এসে পৌঁছাল সে। অনেক খোঁজ করেও সন্ন্যাসী লরেন্সের লোক খোঁজ পেন না রোমিওর।
আবার রোমিওর মত ঠিক একই অবস্থা হয়েছে কাউন্ট প্যারিসের- যার সাথে জুলিয়েটের বিয়ের কথা ছিল। জুলিয়েটের অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ে করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল প্যারিস। এবার জুলিয়েটের মৃত্যু-সংবাদ শুনে সে যেন সত্যিই পাগল হয়ে গেল। পরদিন সকালেই জুলিয়েটকে সমাধি দেওয়া হবে শুনে তাকে এক ঝলক দেখার জন্য সে রাতেই কাউন্ট এসে হাজির সেই সমাধিক্ষেত্রে।
কিন্তু নিয়তি কী নিষ্ঠুর! তিনি আসার কিছু আগেই রোমিও এসেছে সেখানে। সমাধিক্ষেত্রে ঢোকার আগে সে চারপাশে খুঁজে দেখছিল সেখানে কেউ পাহারা দিচ্ছে কিনা।
কাউন্ট প্যারিস সমাধিকক্ষে প্রবেশ করে তলোয়ার বের করে ঝাঁপিয়ে পড়লেন রোমিওর উপর। সাথে সাথে রোমিও পালটা আক্রমণ করল কাউন্টকে। কিন্তু তলোয়ারবাজিতে তার সাথে মোটেই পাল্লা দিতে পারলেন না কাউন্ট প্যারিস। কিছুক্ষণ বাদেই তিনি রক্তাক্ত দেহে লুটিয়ে পড়লেন সমাধিকক্ষের দোরগোড়ায়। জুলিয়েটের নামটা কোনওমতে আউড়ে চিরকালের মতো নীরব হয়ে গেলেন তিনি।
শত্রু নিধনের পর রোমিও প্রবেশ করলেন জুলিয়েটের সমাধিকক্ষে। সেখানে ঢুকে মোমবাতির মৃদু আলোয় দেখতে পেলেন সামনেই একটা কফিনে শুয়ে আছে জুলিয়েট—প্রাণের স্পন্দন নেই শরীরে। সন্ন্যাসীর দেওয়া ওষুধের প্রভাব তখনও কাটেনি। জ্ঞান ফিরে আসতে দেরি আছে। কিন্তু রোমিও তো জানে না সন্ন্যাসীর দেওয়া ওষুধের কথা। তাই সে ধরে নিল জুলিয়েটের মৃত্যু হয়েছে। ওঝার দেওয়া বিষের শিশিটা বের করে শেষবারের মতো জুলিয়েটের ঠোঁটে চুমু খেল রোমিও। তারপর শিশির পুরো বিষটা ঢেলে দিল নিজের গলায়। বিষের জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে কিছুক্ষণ বাদেই জুলিয়েটের কফিনের পাশে শেষ নিশ্বাস ফেলল রোমিও।
ওষুধের প্রভাব কেটে যাবার পরই চোখ মেলে তাকাল জুলিয়েট। কফিনের বাইরে বেরিয়ে সে দেখল বরফ-ঠাণ্ডা মেঝের উপর শুয়ে আছে রোমিও। বহুবার ডেকেও তার কোনও সারা পেলনা জুলিয়েট। সন্দেহ হতে রোমিওর নাকের সামনে হাত নিয়ে দেখলে নিশ্বাস-প্রশ্বাস বইছে না। ঠিক সে সময় তার নজরে এলো মেঝের উপরে পড়ে রয়েছে একটা শিশি। শিশিটা কুড়িয়ে নিয়ে শুঁকতেই তীব্র গন্ধে তার নাক জ্বলে যেতে লাগল। শিশিতে যে তীব্র বিষ ছিল এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হল জুলিয়েট। রোমিওর কোমরের খাপ থেকে ছোরাটা বের করে সজোরে নিজের বুকে বসিয়ে দিল জুলিয়েট। দু-একবার ছটফট করে চিরকালের মতো নিশ্চল হয়ে গেল তার দেহ।
সবশেষে, দুই পরিবারের শত্রুতার জেরে এবং ভুল বোঝাবুঝি জনিত কারণে বিষপানে আত্মহত্যা করে এই প্রেমিক যুগল।
তাই পৃথিবীতে যখনই প্রেমের জন্য ত্যাগ- তিতিক্ষার কথা বলা হয়, সবার আগেই উঠে আসে এই তরুণ যুগলের নাম! তরুণ এ যুগলের ভালবাসার জন্য মৃত্যুবরণ আজো পৃথিবীর মানুষকে একই আবেগে নাড়া দেয়।
লাইলী মজনু-
স্বর্গীয় প্রেমের প্রতীক মানা হয় এই লাইলি-মজনু জুটিকে।
অনেক অনেক কাল আগে আরবের বনু আমির বেদুইন গোত্রের এক মহান শাসক ছিলেন, একজন সায়িদ। ধন-দৌলত তার এতটাই বেশি ছিল যে তাকে আরবের ধনাঢ্য সুলতানদের একজন বিবেচনা করা হতো। হাতেম তাঈ এর মতোই তার দানশীলতা আর প্রজাবাৎসল্যের কথা দিগ্বিদিক ছড়িয়ে পড়ে।
একদিন ঘর আলো করে তার স্ত্রী জন্ম দিলেন এক পুত্রসন্তান। মুক্তোর মতো ত্বক, গালগুলো যেন গোলাপ দিয়ে রাঙানো। তার শরীর থেকে আলো বেরিয়ে যেন ঘর আলোকিত করে ফেলছে। মনের আনন্দে শিশুর বাবা তার ধনসম্পদ বিলাতে শুরু করলেন। প্রজাদের মনেও আজ আনন্দ।
দু’সপ্তাহের মাথায় শিশুটির নাম রাখা হলো কায়েস। বাবার নাম আল-মুলাওয়াহ হওয়াতে শিশুটির পুরো নাম হলো কায়েস ইবন আল-মুলাওয়াহ।
বড় হবার সাথে সাথে তার সৌন্দর্য যেন ক্রমান্বয়ে বাড়তে লাগলো। যখন তার বয়স সাত তখন প্রথম দাড়ির আভাস দেখা গেল চেহারায়। তাকে মক্তবে পাঠানো হলো পড়ালেখার জন্য। শীঘ্রই মক্তবের সেরা ছাত্র হয়ে উঠল কায়েস।
বিভিন্ন গোত্রের সম্ভ্রান্ত সব পরিবার থেকে মেয়েরাও মক্তবে পড়তে আসত। কিন্তু একদিন নতুন এক মেয়ে এসে যোগ দিল তাদের সাথে। কায়েসের মনে হলো, এত সুন্দর মেয়ে সে আগে দেখেনি কখনো। তাদের বয়স অবশ্য তখনো দশও পেরোয়নি।
মেয়েটির নাম লায়লা, বাংলায় যার মানে ‘রাত্রি’। লায়লা আল-আমিরিয়া (কিংবা, লায়লা বিনতে মাহদি)। লায়লা যেন উলুবনে ছড়ানো এক মুক্তা। সাইপ্রাস গাছের মতো ছিপছিপে দেহ। মায়াকাড়া হরিণীর মতো তার চোখজোড়া। তার এক অলস দৃষ্টিতেই যেন হাজারো হৃদয় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। সত্যিই, কাজল দেয়া লায়লার চোখের এক পলক যেন পুরো দুনিয়াকে করে দিতে পারে ছারখার। তার লাস্যময়ী চেহারা যেন আরবের আকাশের চাঁদ, কিন্তু হৃদয় ছিনিয়ে নেয়ার বেলায় সে যেন পারস্যের ডানাকাটা পরী। ঘন কালো চুলের খোপে তার মুখ যেন প্রদীপের মতো উজ্জ্বল, কাকের মতো কালো সেই চুল যেন তার রাত্রিময় নামই মনে করিয়ে দেয়। আর কোকিলের কন্ঠে যখন লায়লার কথা শোনা যায়, তখন মনে হয়, এ-ও কি সম্ভব? এত সুন্দর হতে পারে কারো কণ্ঠ? তবে তো সূর্যও পশ্চিম দিক দিয়ে ওঠা খুব সম্ভব। যে দুধে সে চুমুক দেয়, সেটিও যেন গোলাপী হয়ে ওঠে তার ঠোঁটের পরশে। কে সেই ভাগ্যবান মানুষটি যে কি না পাবে টানা টানা কামনার চোখের এ মেয়েটিকে, যার গালের ঐ ছোট তিলটিও যেন পুরো দুনিয়ার যেকোনো কিছু থেকে সুন্দর? শুধু সুন্দর না, অসম্ভব সুন্দর।
তো সেই প্রথম দিন থেকেই লায়লার প্রেমে হাবুডুবু খেতে লাগলো কায়েস। সেই ছোট বয়স থেকেই, বাল্যপ্রেম যাকে বলে। তখন থেকেই সুন্দর সুন্দর কবিতা লেখা শুরু করল লায়লাকে নিয়ে, আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে সেই কবিতা আবৃত্তি করতে থাকত। এককথায় পুরো পাগল হয়ে গেল লায়লার জন্য। লোকে তাকে কায়েস না ডেকে তাই ডাকতে লাগলো ‘মাজনুন’ বা দিওয়ানা, পাগল। বাংলায় আমরা বলি, মজনু।
একদিন মজনু গিয়ে লায়লার বাবার কাছে গিয়ে লায়লাকে বিয়ে করতে চাইলো। কিন্তু লায়লার বাবা সাথেই সাথেই না করে দিল। এতিনি নিজের মেয়ের বিয়ে ঠিক করলেন পাশের গ্রামের এক বয়স্ক লোকের সাথে।
রাগে, দুঃখে আর শোকে মজনু তার পরিবার ত্যাগ করল, জঙ্গলে চলে গেল। সেখানে গিয়ে হিংস্র জীবজন্তুর সাথে দিন কাটাতে লাগলো। সেখানে বসে বসেই সে লায়লাকে নিয়ে তার কবিতা লিখত।
লায়লাকে জোরপূর্বক বিয়ে করতে হলো সেই বুড়ো লোকটিকে। ঘর-সংসার সে করতে থাকলো বটে, কিন্তু বুড়ো মন পায়নি তার। মন তার মজনুর জন্যই কাঁদত। কিন্তু সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে হিসেবে ভালো মেয়ে সেজেই স্বামীর ঘর করতে থাকলো লায়লা।
লায়লার বিয়ের খবর মজনুর কাছে যখন পৌঁছালো, সে আরো পাগল হয়ে গেল। তখনও সে বাবা-মায়ের কাছে ফিরতে নারাজ। তার বাবা-মা প্রতিদিন তার জন্য খাবার সাজিয়ে রাখত বাগানবাড়িতে, এই আশায় যে একদিন তাদের ছেলে ফিরে আসবে। কিন্তু মজনু রয়ে গেল জঙ্গলেই।
বহু বছর পর, মজনুর বাবা-মা দুজনেই মারা গেল।খবর শুনে দুঃখে ভারাক্রান্ত মজনু কোনোদিন শহরে ফিরবে না মৃত্যুর আগে সে কসম কাটলো।
কয়েক বছর পর, লায়লার স্বামী মারা গেল। তখন লায়লা আশা করছিল, অবশেষে সে তার মনের মানুষের সাথে মিলিত হতে পারবে। আমৃত্যু কাছে থাকতে পারবে দুজনে। কিন্তু বেদুইন রীতি বলে, বিধবাকে অন্তত দু’বছর ঘর থেকে বের না হয়ে শোক পালন করতে হবে। কীভাবে আরো দু’বছর মজনুকে না দেখে থাকবে লায়লা? তার অনুভব হচ্ছিল, পুরো এক জীবন মজনুকে না দেখে আছে সে, কীভাবে আরো দু’বছর পারবে? সেই দুঃখে লায়লা মারা গেল নিজের বাড়িতেই।
লায়লার মৃত্যুর খবর বনে জঙ্গলে থাকা মজনুর কাছে পৌঁছালো। সাথে সাথেই সে লায়লার কবরের জন্য রওনা দিল। সেখানে পৌঁছে সে কাঁদতেই থাকলো, যতক্ষণ পর্যন্ত না মৃত্যু তাকেও হরণ করল।