অনিন্দ্য আফরোজ
লাইলি-মজনুর অমর প্রেমের ইতিবৃত্ত সবার জানা। কিন্তু এই আলোচিত প্রেমের বিষয়ে বিস্তারিত আমাদের অনেকের কাছেই আজও অজানাই রয়ে গেছে। লাইলি-মজনু বা লায়লা-মজনুর এই প্রেমের কাহিনীটা আসলে কী। কিংবা কীভাবে তাদের প্রেমের শুরু, কী ছিল তাদের পরিণতি- সেসব খুঁটিনাটি বিষয়গুলো নিয়ে আজও আমাদের আগ্রহের শেষ নেই।
শেক্সপিয়ারের রোমিও-জুলিয়েট বিশ্বের মানুষের কাছে যতটা জনপ্রিয়, উপমহাদেশে লাইলি-মজনু এই প্রেম কাহিনী কিন্তু সে রকমই এক জনপ্রিয় ও প্রচলিত। তবে সেক্সপিয়র রোমিও-জুলিয়েট যত বহুল পঠিত ও পাঠকের হৃদয়ে গেঁথে গেছে, লাইলি-মজনুর এই প্রেম উপাখ্যান আসলে ততটা পঠিত হয়নি। চলুন আজ জেনে নেওয়া যাক সেই অমর প্রেমের আদ্যোপান্ত ।
লাইলি-মজনু
প্রাচীন আরব দেশে বনু আমির বেদুইন গোত্রে এক মহান শাসক ছিলেন । তিনি এতোটাই ধনবান ছিলেন যে তাঁকে আরবের সবচেয়ে ধর্নাঢ্য সুলতান বিবেচনা করা হতো। তিনি ছিলেন প্রজাবাৎসল এবং দানবীর। মহান এই আরব শাসকের সুকীর্তি র কথা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। তাই তাঁর হৃদয় ছিল দুঃখ-বেদনাক্রান্ত । এতো ধন-দৌলত দিয়ে তিনি করবেন যদি তার পরবর্তী প্রজন্ম না থাকে। এই কষ্ট তাঁকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। এজন্য তিনি দিন-রাত সৃষ্টিকর্তার কাছে মোনাজাত করতেন একটি সন্তানের আশায়। অবিরাম প্রার্থনার পর সৃষ্টিকর্তা তাঁর প্রার্থনা এক সময় মঞ্জুর করলেন।
একদিন ঘর আলোকিত করে করে তাঁর স্ত্রী জন্ম দিলেন এক ছেলে। শিশুটি এতোটাই সুশ্রী ছিল যেন তার শরীর থেকে আলোর জ্যোতি বের হয়ে গোটা প্রাসাদ আলোকিত করে তুলেছিল। সুলতান তাঁর সন্তানের জন্মে এতোটাই আনন্দিত হলেন যে তিনি নিজের প্রভূত ক্ষমতা ও ঐশ্বর্য কে তুচ্ছ মনে হচ্ছিল। সন্তান জন্মের খুশিতে তিনি তাঁর ধনসম্পদ বিলাতে শুরু করলেন। প্রজাদের মনেও ব্যাপক খুশি ও আনন্দের উদ্রেক হল।
শিশুর যত্নে একজন দক্ষ সেবিকা রাখা হলো। প্রতি মুহূর্তে যেন তার ওপর নজর রাখা হয় সে জন্য প্রাসাদে ব্যাপক নজরদারি রাখা হল। কারো কুনজর থেকে রক্ষার জন্য তার কপালে টিপ দিয়ে দেওয়া হলো।
কায়েস এরপর সপ্তাহ দুয়েকের মাথায় শিশুটির নাম রাখা হলো কায়েস। বাবার নাম আল-মুলাওয়াহ হওয়াতে শিশুটির পুরো নাম হলো কায়েস ইবনে আল-মুলাওয়াহ। এই কায়েস ইবনে আল-মুলাওয়াহ এই গল্পের নায়ক।
বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কায়েস ইবনে আল-মুলাওয়াহর সৌন্দর্য যেন আরো প্রস্ফূটিত হতে লাগলো। যখন তার বয়স সাত তখন প্রথম দাড়ির আভাস দেখা গেল চেহারায়। তাকে মক্তবে পাঠানো হলো পড়াশোনার জন্য। শিগগিরই মক্তবের সেরা ছাত্র হয়ে উঠল শিশু কায়েস।
এই মক্তবে শুধু ছেলেরা নয়, মেয়ে শিশুরাও একসঙ্গে পড়াশোনা করতো। বিভিন্ন গোত্রের সম্ভ্রান্ত সব পরিবার থেকে মেয়ে শিশুরা এই মক্তবে আসত। কিন্তু একদিন নতুন এক মেয়েশিশু এসে যোগ দিল তাদের সঙ্গে। কায়েসের মনে হলো, এত সুন্দর মেয়ে সে আগে কখনো দেখেনি। কায়ের ও সহপাঠী মেয়ে মিশুর বয়স তখনো দশ পেরোয়নি।
অপরূপ মেয়ে শিশুটির নাম লায়লা বা লাইলি। বাংলায় এর অর্থ ‘রাত্রি’। লায়লা আল-আমিরিয়া (কিংবা, লায়লা বিনতে মাহদি)। লায়লা যেন অপরূপ সুন্দরের প্রতিভূ। ছিপছিপে দেহ, হরিণীর মতো চোখ। মায়াবী দৃষ্টিতে যেন হাজারো হৃদয় মোহিত হয়। সত্যিই, কাজল দেয়া লায়লার চোখের এক পলক যেন পুরো দুনিয়াকে করে দিতে পারে ছারখার। ঘন কালো কেশের খোপে তার মুখমণ্ডল যেন চাঁদের মতো স্নিগ্ধ, মোহন।
প্রথম দিন থেকেই লায়লার প্রেমে হাবুডুবু খেতে লাগলো কায়েস। কিশোর কায়েস তখন থেকেই কবিতা লেখা শুরু করে লায়লাকে নিয়ে, আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে সেই কবিতা আবৃত্তি করতো। কেউ শুনতে না চাইলে পারলে যাকে তাকে দাঁড় করিয়ে শোনাতো। লায়লার প্রেমে মত্ত, দিওয়ানা হয়ে যায় কিশোর কায়েস। এজন্য লোকে তাকে কায়েস না ডেকে ‘মাজনুন’ বা দিওয়ানা, পাগল ডাকতে শুরু করে। বাংলায় সেই মাজনুনই হয়ে গেল‘ মজনু’ নামে খ্যাত। কায়েসের এই অবুজ প্রেমে সাড়া দেয় লায়লাও। সেও গভীর প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকে।
লায়লার প্রেমে মশগুল মজনু একদিন হাজির হয় লায়লার বাবার কাছে। সে লায়লাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু লায়লার বাবা সঙ্গে সঙ্গে তা নাকচ করে দেন। লায়লার বাবার মনোভাব ছিল এই পাগল ছেলের কাছে মেয়েকে তুলে দেওয়া মানে খুব অপমানের। কারণ, লোকে তাকে মাজনুন ডাকে। তিনি নিজের মেয়ের বিয়ে ঠিক করলেন পাশের গ্রামের এক বয়স্ক লোকের সঙ্গে।
রাগে, দুঃখে আর শোকে মজনু তার পরিবার ত্যাগ করল। নিরুদ্দেশ হয়ে জঙ্গলে চলে গেল। সেখানে গিয়ে হিংস্র জীবজন্তুর সঙ্গে দিন কাটাতে লাগল। নির্জন বনে বসেই সে লায়লাকে নিয়ে তপস্যা করতো আর কবিতা লিখত।
এদিকে লায়লাকে জোরপূর্বক বিয়ে দেওয়া হলো সেই বয়স্ক লোকটির সঙ্গে। বাধ্য হয়ে লায়লা তার স্বামীর ঘরে গেল এবং ঘর-সংসার করতে থাকল, কিন্তু লায়লার হৃদয় পড়ে ছিল মজনুর হৃদয়ে। তার হৃদয় সারাক্ষণ কেবল মজনুর জন্যই কাঁদত। কিন্তু বাধ্য হয়ে স্বামীর ঘর করতে থাকলো লায়লা।
এদিকে যখন মজনু তার প্রেমিকা লায়লার বিয়ের খবর জানতে পারে, তখন সে আরো উন্মক্ত হয়ে উঠলো। এরপর সে আর বাবা-মায়ের কাছে ফিরতেও রাজি হয়নি। ছেলে ফিরে আসবে এই আশায় বাগানবাড়িতে তার বাবা-মা প্রতিদিন মজনুর জন্য খাবার সাজিয়ে রাখত। কিন্তু মজনু স্বেচ্ছা বনবাসীই রয়ে গেল।
মাঝে মাঝে কিছু পথিক দেখা পেত মজনুর, তারা জানাতো মজনু একা একাই কবিতা আবৃত্তি করে, বালুতে কাঠি দিয়ে কবিতা লিখতো।
একমাত্র ছেলের স্বেচ্ছা নির্বাসনের দুঃখে বহু বছর পর, মজনুর বাবা-মা মারা যান। লায়লা নিজে সে খবর পাঠাতে চাইলো মজনুর কাছে, কিন্তু কাকে দিয়ে পাঠাবে? শেষমেষ এক বুড়ো লোককে অনুরোধ করে রাজি করায়। বুড়ো রাজি হল, যদি পরে কোনোদিন দেখা পায় মজনুর, তবে লায়লার পাঠানো খবর জানাবে তার প্রিয় মজনুকে।
সেই বৃদ্ধ লোকটি ঠিকই একদিন মজনুর দেখা পেলেন। তিনি লায়লার পাঠানো তার বাবা-মায়ের মৃত্যুর খবর মজনুকে জানান। বাবা-মায়ের প্রয়াণের কথা শুনে দুঃখে ভারাক্রান্ত মজনু ভেঙে পড়লো। এরপর সে সিদ্ধান্ত নেয় কোনোদিন সে আর েনিজ শহরে পিরে যাবে না।
এভাবে কয়েক বছর কাটে। মজনু বনে-বাদাড়ে পাগলের বেশে ঘুরতে থাকে। কয়েক বছর যেতে না যেতে লায়লার বৃদ্ধ স্বামী মারা যান।বৃদ্ধ স্বামীর মৃত্যু লায়লার মনে কিছুটা স্বস্তি আনে। সে আশা করছিল, অবশেষে সে তার মনের মানুষকে কাছে পাবে। আমৃত্যু কাছে থাকতে পারবে দুজন। কিন্তু বেদুইন রীতি অনুযায়ী তাকে অন্তত দুবছর ঘর থেকে বের না হয়ে স্বামীর শোক পালন করতে হবে।কিন্তু কীভাবে আরো দুবছর সে প্রাণপ্রিয় মজনুকে ছাড়া থাকবে? তার হৃদয় উন্মাতাল মজনুর জন্য। মনে হচ্ছিল পুরো এক জীবন মজনু তার চোখের আড়ালে। অস্থির মন মানছিল না। এভা ছটফট করতে করতে সেই দুঃখে লায়লা মারা গেল ।
প্রিয়তমা লায়লার দুঃসহ মৃত্যুর খবর অনেকদিন পরে মজনুর কাছে পৌঁছালো। খবর শুনেই মজনু লায়লার কবরের উদ্দেশে রওয়ানা দেয়। সেখানে পৌঁছে সে কেভল কাঁদতেই থাকলো, যতক্ষণ পর্যন্ত না তাকেও মৃত্যু হরণ না করলো ততদিন মজনু সেখানে কেবল কাঁদলো। ক্রমে অভূক্ত, অনাহার আর দুঃখে, জড়ায় ক্লান্ত মজনুর দেহটা নিস্তব্দ, নিথর হতে থাকে। একদিন ঠিকই তার মনোবাসনা পূর্ণ হলো। লায়লার কবরের ওপর পড়ে রইল তার প্রিয় মজনুর মজনুর নিথর দেহ।
“আমি এ দেয়াল পেরোই, সে দেয়াল পেরোই
এ দেয়ালেও চুমু খাই, সে দেয়ালেও
কিন্তু ভেবো না এ ঘর আমার হৃদয় ছিনিয়েছে
ছিনিয়েছে এ ঘরে যে থাকতো সে”
আরবি ভাষায় এই অমরপ্রেম গাঁথাকে ‘লায়লা ওয়া মাজনুন’ বলা হলেও ফারসিতে এই কাহিনীর নাম ‘লেইলি-মজনুন’। সেখান থেকেই বাংলায় এর নামকরণ হয় লাইলি-মজনু।
১১৪১ সালে জন্ম নেওয়া পারস্যের কবি নিজামি গনজবি অমর ও মর্ম ন্এতুদ এই প্রেমগাঁথার কবিতাটি রচনা করেন। ১২০৯ সালে ফারসি ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি নিজামি গনজবি বিদায় নেন পৃথিবী থেকে, কিন্তু রচনা করেন আরেকটি বিখ্যাত কাহিনী। আমরা সেটিকে শিরি-ফরহাদ প্রেমকাহিনী হিসেবে পরিচিত। শিরি-ফরহাদ প্রেমকাহিনী আরো ঘটনাবহুল, বেদনাবিধূর।
লােইলি-মজনুর এই প্রেম কাহিনী আজও অমর হয়ে আছে সারা পৃথিবীতে। সাহিত্য বিচারে এই কাহিনী এক অনন্য স্থান দখল করে আছে বিশ্ব সাহিত্যে। ব্রিটিশ কবি বায়রন লাইলি-মজনুর কবিতাকে প্রাচ্যের ‘রোমিও-জুলিয়েট’ আখ্যায়িত করেছিলেন। তবে এই কবিতা লেখার অনেক আগে থেকেই, প্রায় নবম শতক থেকেই উপকথা আকারে এ গল্প ছোট ছোট রূপে মানুষের মুখে মুখে ফিরতো। ইরানি ‘আখবার’-এ, সেটিকেই কবিতায় রূপ দেন কবি নিজামি। এ কাজের জন্য তিনি সবগুলো মৌখিক উপকথা সংগ্রহ করেছিলেন। এরপর নিজামির কবিতা অবলম্বনে আরো অনেক ফারসি কবি তাদের নিজেদের সংস্করণ রচনা করেন। এরমধ্যে আমির খসরু দেহলভী (১২৯৯), জামি (১৪৮৪) রয়েছেন। লাইলি-মজনু নিয়ে মক্তবি শিরাজি, হাতেফি আর ফুজুলির সংস্করণগুলো তুরস্ক ও ভারতীয় উপমহাদেশে বেশ জনপ্রিয়। লাইলি-মজনুর কাহিনী নিয়ে ইরানে ৫৯টি সংস্করণ পাওয়া যায়। আর শিরি-ফরহাদের কাহিনী অবলম্বনে ৫১টি ও ইউসুফ-জুলেখার ১৬টি সংস্করণ রয়েছে।
ভারতে এমন উপকথাও প্রচলিত আছে যে, লাইলি-মজনু মারা যায়নি, বরং তারা নিজেদের দেশ ছেড়ে ভারতের রাজস্থানে চলে এসেছিল। আর সেখানেই তারা মৃত্যুবরণ করে। ভারতে এমন বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে, লাইলি-মজনুর মাজার রাজস্থানের অনুপগড়ে অবস্থিত।
তবে লাইলি-মজনুর কাহিনী নিয়ে প্রকাশিত সংস্করণেগুলোতে তাদের প্রেম, মৃত্যু নিয়ে নানা কতা প্রচলিত আছে। একটি সংস্করণ বলছে, তাদের প্রেম এতোটাই প্রখরতা পেয়েছিল যে, মজনুকে যখন এই প্রেমের জন্য নির্যাতন করা হতো তখন লাইলির শরীর থেকে থেকেও রক্ত ঝরত। এমনকি লায়লাকে বিয়ে করার জন্য মজনু লায়লার ভাই তাবরেজকে খুন করেছিল। কারণ লায়লার ভাই তাবরেজ এই বিয়ের ঘোরবিরোধী ছিল। আর তাবরেজকে খুনের অপরাধে পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয় মজনুর। তাই মজনু দণ্ড থেকে রক্ষা পেতে পালিয়ে গিয়েছিল। আবার লায়লার প্রেমের কথা জানবার পর মজনুকে মারবার জন্য লায়লার বয়স্ক স্বামী মজনুর খোঁজে বনে যায়। দেখা পায়। সেখানে তাদের মধ্যে যুদ্ধ করে। এসময় লাইলির স্বামী মজনুর বুকে তলোয়ার ঢুকিয়ে দিলে , তখন স্বামীর বাড়িতে থাকা লাইলি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। দুজনে একইসঙ্গে মারা যায়। এরপর দুজনকে পাশাপাশি কবরস্থ করা হয়েছিল।
পুরান কথার প্রবাদ অনুযায়ী কথিত আছে, লাইলি-মজনুর বাবা তাদের জন্য প্রার্থনা করেন। উপকথা অনুযায়ী, তারা দুজন বেহেশতে মিলিত হবে এবং সেখানেই তাদের বিবাহ হবে।
লাইলি-মজনু কিংবা রোমিও-জুলিয়েট, সেলিম-আনারকলি কিংবা অ্যান্থনি-ক্লিওপেট্রা এসব প্রেম কাহিনী আজও সারা পৃথিবীতে অমর হয়ে আছে। প্যারিস-হেলেন, অর্ফিয়াস-ইরিডাইস, অডিসিউস-পেনেলোপি, শাহজাহান-মমতাজ, ট্রয়লাস-ক্রেসিডাই ্বএসব প্রেম কাহিনীই-বা কম কি। পৃথিবী যত দিন আাছে ইতিহাসের এসব উপকথার গল্পগুলো সারা বিশ্বের মানুষের কাছে প্রেম, অমরত্ব আর ভালবাসার মহিমাকে বিলাতে থাকবে।