বিশেষ প্রতিবেদক
শিক্ষা জীবনের শুরু থেকে শেষ অবধি তিনি ছিলেন ব্যর্থ ছাত্র। এরপর কর্মজীবনে এসেও সেই ব্যর্থতার রেশ তাঁকে বইতে হয়েছে পদে পদে। একটি চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরেছেন তিনি। চাকরি না পেয়ে দুই বছর বেকার আর দুর্বিষহ জীবন কাটাতে হয়েছে তরুণকে। সেই ব্যর্থ মানুষটিই পরবর্তীতে হয়ে উঠেছিলেন পৃথিবীর সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানী।
তিনি আলবার্ট ইনস্টাইন। আপেক্ষিকতার তত্ত্ব কারও অজানা নয়। সবাই না বুঝলেও এই তত্ত্বের কথা এখন একটা বাচ্চাও জানে। ১৯০৫ সালের কথা। এই বছরেই আইনস্টাইন তাঁর বিখ্যাত এই তত্ত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর এই অবিস্মরনীয় তত্ত্বের ফলে বিংশ শতাব্দীতে মানুষের চিন্তা জগতে এক দুর্দান্ত গতি এনে দিয়েছে। রহস্যময় প্রকৃতিকে আরও ভালোভাবে বুঝতে-বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে এই তত্ত্ব। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও সেই তত্ত্বের প্রভাব মোট্মেেই অনুজ্জ্বল হয়নি। বরং আরও প্রখর হয়েছে।
আপেক্ষিকতা তত্ত্বের জনকখ্যাত বিখ্যাত এই বিজ্ঞানী জন্মেছিলেন জার্মানির উলম শহরে ১৮৭৯ সালের ১৪ মার্চ।
জীবন
জার্মানির ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে বিখ্যাত দানিয়ুব নদী। সেই সুন্দর নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠা মনোরম শহর উলম। এই শহরেই এক মধ্যবিত্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। বাবা হেরম্যান আইনস্টাইন সেখানে স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করতেন। ১৮৭৯ সালের ১৪ মার্চ। এই দম্পতির ঘর উজ্জল করে এক ফুটফুটে শিশু। দুজনে শখ করে ছেলের নাম রাখেন আলবার্ট। বাবার নাম যুক্ত হল সেই নামের সঙ্গে। এরপর পুরো নাম হল আলবার্ট আইনস্টাইন। কে জানতো সেই আলবার্ট নামের শিশুটিই একদিন পৃথিবীকে বদলে দেওয়ার তত্ত্ব আবিষ্কার করবে।
ছেলেবেলা
জন্মানোর মাত্র ছয় সপ্তাহ পর আইনস্টাইনের বাবা- মা শিশু আলবার্টকে নিয়ে জার্মানির আরেক শহর মিউনিখে যান। সেখানে হেরম্যান একটা তড়িৎ যন্ত্র নির্মাণ কারখানা তৈরি করেন। তাঁর ব্যবসা ভালই জমল। হেরম্যান সারাদিন তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন আর বাড়ির সব সামাল দেন স্ত্রী পলিন। দেখতে দেখতে জুনিয়র আইনস্টাইন বড় হতে থাকেন।যখন তার বয়স তিন কি চার। সে সময় বিস্ময়কর এই শিশু হাতে পায় এক আশ্চর্য জিনিস। জিনিসটা ছিল একটি ‘ম্যাগনেটিক কম্পাস’। শিশু আলবার্ট যতই সেটাকে দেখে ততই বিস্মিত হতে থাকে। অদৃশ্য এক শক্তির প্রভাবে কীভাবে যন্ত্রটার কাঁটা পরিবর্তন হচ্ছে তা দেখে তার বিস্ময়ের ঘোর আর কাটে না। শিশু মনে বদ্ধমূল হয় এই ধারনা যে, নিশ্য়ই এতে কোনও এক অদৃশ্য রহস্য লিুকায়িত আছে। সে থেকেই আলবার্টের মধ্যে সব সময় অদৃশ্য শক্তির প্রতি প্রবল আকর্ষণ।
মাত্র ছয় বছর বয়সেই সেই আলবার্ট বেহালায় হাত রাখেন। বাজাতে শেখেন। তবে বেহালায় খুব একটা মনোযোগ ও আগ্রহ ছিল না তার। । শিশু বয়সে আরেকটা জিনিস মুগ্ধ করেছিল তাকে। সেটা হল ইউক্লিডে ‘এলিমেন্ট’ নামে একটা জ্যামিতি বই। এই বই তার এতই আগহের ছিল যে একে ‘পবিত্র ছোট জ্যামিতির বই’ নাম দিয়েছিল শিশু আলবার্ট। আসলে এই বইটিই তাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিল।
এতকিছুতেও ছেলেকে নিয়ে বাবা মায়ের চিন্তার অন্ত ছিল না। কারণ তখন আলবার্টের বয়স ৯। ওই বয়সী অন্য বাচ্চারা যখন ভালভাবে কথা বলতে শিখে যায় তখনও খুদে এই শিশু ঠিকমত কথাই বলতে পারত না। ১৮৮১ সালের কথা। আইনস্টাইনদের ঘরে আসে আরেক নতুন অতিথি। বোন মারিয়া মাজা। আস্তে আস্তে বোন মাজা বড় হয়ে ওঠে। আলবার্ট খেলার সঙ্গী পান। তবে খেলার ফাঁকে ফাঁকে ছোট্ট আলবার্টের জাগতে শুরু করে মনে নানা প্রশ্ন । এর অধিকাংশই ছিল নহস্যভেদী বিজ্ঞানের। যখন তার বয়স পনেরো তখনও আলবার্ট আ্ইনস্টাইন বিদ্যালয়ে যাওয়ার যোগ্য হয়ে ওঠেনি। অথচ তার সমবয়সী সব শিশুরা বিদ্যালয়ে যায়। এজন্য চিন্তায় পড়ে যান বাবা-মা। বিদ্যালয়ে ভর্তির উপযোগী করার জন্যে তাকে বাড়িতেই পড়ানো শুরু হয়। ওই সময় অনেকেই মনে করতেন আইনস্টাইন আসলে অটিস্টিক।
তোমাকে দিয়ে কিছুই হবে না
আলবার্ট ক্যাথলিক অ্যালিমেন্টারি স্কুলে ভর্তি হয়ে তার আনুষ্ঠানিক অ্যাকাডেমিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। এ সময় ধর্ম- কর্মের প্রতি বেশ আগ্রহ তৈরি হয় তা। কিন্তু বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করতে করতে তার সে আগ্রহে ভাটা পড়ে। এ জন্য ক্যাথলিক স্কুল কর্তৃপক্ষের অপ্রিয় হয়ে পড়ে আলবার্ট। এক শিক্ষক বিরক্ত হয়ে তাকে বলেই বসলেন একদিন যে, “তোমাকে দিয়ে কিছুই হবে না।”
কিন্তু শিক্ষকেরা একথা বললেও তিনি দমে যাননি কিংবা ভুব বেশি সিরিয়াসও হননি। তিনি তার অজানাকে জানার ধ্যানে মগ্ন ছিলেন সব সময়। কারও কোনও কথা গায়ে মাখেননি, প্রতিক্রিয়াও দেখাননি। আর বিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় কিশোর আইনস্টাইন নানা ধরনের মজার মজার যন্ত্রপাতি বানিয়ে সবাইকে তাক লাগাতেন। গণিতে আর বিজ্ঞানে তার দখল ছিল দুর্দান্ত। বিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় অনেক কঠিন গণিতের সমাধান করে দিত নিমিষেই। কিন্তু অ অন্যান্য বিষয়ে একেবারেই কাঁচা। এজন্য প্রতিবছর গণিত ও পদার্থ বিজ্ঞান বিষয় বাদে অন্য সব বিষয়ে টেনেটুনে পাশ করতেন আবার কখনও ঝেড়ে ফেল করেন। এজন্য প্রথম বিদ্থেযালয় থেকে তাকে সনদ ছাড়াই বের হয়ে যেতে হয়। এরপর চলে যান সুইজারল্যান্ডে। সেখানে জুরিখে এডজেনোসিস পলিটেকনিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। মুলত এটা ছিল একটি বিশ্ববিদ্যালয় । তার কোন রকম কোনও সনদ না থাকলেও মেধা বিবেচনা করে তাকে এখানে ভর্তির সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তবে তাকে শর্ত দেওয়া হয় যে তিনি ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই ভর্তি করা হবে।
কিন্তু দেখা গেল তিনি পদার্থ বিজ্ঞান আর গণিতে ভাল করেছেন। কিন্তু ফরাসি ভাষা, রসায়ন আর জীব বিজ্ঞানে ফেল করেছেন। গণিতে ভাল করার জন্যে তাকে পলিটেকনিকে ভর্তি করা হয়। তবে সাধারণ স্কুলের পর্যায়গুলো তাকে পার করে আসতে বলা হয়। অবশ্য পরবর্তীতে তিনি একটা বিশেষ বিদ্যালয়ে সেগুলো অধ্যয়ন করেন। ওইসময় জার্মানির নাগরিকত্বও ত্যাগ করেন আইনস্টাইন। সুইডেনে গিয়ে তিনি নাগরিত্বের আবেদন করেন।
দুই বছর বেকারঃ
১৯০০ সালের কথা। আইনস্টাইন ইটিএইচ থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। স্নাতক হওয়ার পর অনেক খোঁজাখুঁজি করেন তিনি শিক্ষকের চাকরি জন্য। কিন্তু শিক্ষকতার চাকরি তাঁর জোটেনি। দুই বছর ধরে উপায়হীন আইনস্টাইন বেকার থাকেন। তারপর একটা পেটেন্ট ফার্মে সহকারী পরীক্ষকের চাকরী পেলেন। তবে শর্ত ছিল, পূর্ণ দক্ষতা অর্জন না করা পর্যন্ত তাঁকে পদোন্নতি দেওয়া হবে না।
১৯০৬ সালের কথা। আইনস্টাইন কথা রাখলেন এবার। বাধ্য হয়ে পেটেন্ট ফার্ম তাঁকে পরীক্ষক পদোন্নতি দেয়। ১৯০৮ সালে তিনি যোগ দেন বার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে ১৯১১ সালে জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। এর কিছুদিন পরেই তিনি চার্লস ইউনিভার্সিটি অফ প্রাগে অধ্যাপকের পদ গ্রহণ করেন।
কর্মে উজ্জল
১৯০৫ সালের কথা। পেটেন্ট কার্যালয়ে কর্মরত থাকাকালে আইনস্টাইন একটি বিজ্ঞান সাময়িকীতে চারটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন। বিষয়গুলো হল “আলোক তড়িৎ ক্রিয়া” “ব্রাউনীয় গতি” “তড়িৎ গতি বিজ্ঞান” আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব আবিস্কার ও ভর শক্তি সমতুল্যতার জন্য বিখ্যাত E=mc² সূত্র। এই চারটি তথ্য প্রকাশ হওয়ার পর আইনস্টাইন আর পেছনে ফেরেননি। এর কিছূদিনের মধ্যে তিনি জগৎবিখ্যাত বিজ্ঞানীদের নজরে চলে আসেন।
আজ সেই ব্যর্থ আইনস্টাইন ছাড়া বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাস লেখাই যায় না। তিনি বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী বিজ্ঞানীদের ব্যক্তিদের একজন। আপেক্ষিকতার তত্ব ছাড়াও বিজ্ঞান জগতে বেশকিছু উল্লেখযোগ্য তত্ত্ব তাঁর আছে।
বিখ্যাত থিওরি
আইনস্টাইনের বহুমখিী অবদানের মধ্যে তাঁকে স্মরনীয় করেছে থিওরি অফ রিলেটিভিটি। এই থিওরি মানুষের সনাতন চিন্তা চেতনাকে পাল্টে দিয়েছে। এরপলে মানুষের নিত্যদিনের সনাতন ভাবনাগুলো থমকে দাঁড়ায়। কেউ যদি থিওরি অফ রিলেটিভিটি জানে, তাহলে তিনি অনুভব করতে পারেন চারপাশের জগৎটা কত রহস্যাবৃত।
এই থিওরি মূল কথা হল, দুনিয়ার কোনও কিছুই স্থির নয়, সবকিছুই গতিশীল। আর এই গতির কারণেই দৈর্ঘ্য, ভর, সময়, অবস্থান সবই আপেক্ষিকতার নিগড়ে বাঁধা । পৃথিবীটাও সূর্যটাকে ঘিরে অনবরত ঘুরছে। পৃথিবী যেমন প্রতি ১ সেকেন্ডে ২৯ দশমিক ৮ কিলোমিটার বেগে সূর্যের চারদিক আবর্তন করে। আবার একটা চলন্ত ট্রেনে চেপে কেউ যখন কোথাও যায় তখন ওই ট্রেনের পাশ দিয়ে যখন আরেকটা ট্রেনে যায় তখন দুটি ট্রেন যায় একটি আরেকটি বিপরীতে। যদিও ব্যক্তিকে বহনকারী ট্রেনটা চলছে তবু তার নিজেকে এবং ট্রেনটাকে স্থির মনে হয়। আবার অন্যকে বহনকারী ট্রেনটিও ব্যক্তি ও তার ট্রেনটাকে স্থির মনে করেন। আসলে এই ব্যাপারটাই হচ্ছে আপেক্ষিকতা।
লেখা পড়লেই আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব সম্পর্কে পুরো জেনে বা বুঝে যাবেন কেউ সেটা কিন্তু একদমই সত্য নয়। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, এখানে আপেক্ষিক তত্ত্বের ধারণা দেওয়া হয়েছে মাত্র। এ সম্পর্কে আরও বিশদভাবে জানতে এ বিষয়ে আরও বেশি পড়াশোনা ও অনুধাবনের প্রয়োজন আছে।
আরও মজা
এই থিওরির আরও কয়েকটা মজার বিষয় আছে। যেমন কোন গতিশীল মানুষের হাতে যে ঘড়ি থাকবে তার ঘড়িটি একজন সমুদ্রগামী মানুষের হাতের ঘড়ির থেকে আস্তে চলবে। থিওরির বলে যে কোনও গতিশীল বস্তুর সময় তুলনামুলক কম গতিশীল বস্তুর তুলনায় কম দ্রুতগামী হয়। আবার গতিশীল সবকিছুরই দৈর্ঘ্য স্থির (দাঁড়ানো) বস্তুর তুলনায় কমতে থাকে। থিওরি অনুযায়ী ভর আর শক্তি বলে আলাদা কিছু নেই। এটা হল কোনও কিছু পরিবর্তিত হয় কেবল গতির ফলেই। অর্থাৎ কোনও বস্তুর ভর আলোর বেগের সঙ্গে বর্গের গুনফলই হল শক্তি।
আলো চলবে উল্টো দিকেঃ
আবার ধরেন, আপনি একটা রকেটের ছাদে করে আলোর থেকেও বেশি বেগে যাচ্ছেন। এসময় আপনার হাতে একটা চার ব্যাটারীর টর্চও আছে। আপনি আপনার টর্চটা জ্বালাতেই আলো ১৮৬০০০ মাইল/সেকেন্ড বেগে যেতে শুরু করলো। কিন্তু আপনি যেহেতু আলোর থেকেও বেশি বেগে যাচ্ছেন তাই আলো কিন্তু আপনার সামনে যেতে পারবে না বরং আপনার সাপেক্ষে টর্চের আলো বের হয়েই পিছন দিকে যেতে থাকবে। টর্চ জ্বালিয়ে আলোকে কখনো পিছনে যেতে দেখেননি বলে আপনার কাছে অবাক লাগতেই পারে।
বিপদও আছে
নিউক্লিয়ার বোমার কে জানেন। এটা খুব ভয়ংকর বোমা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এ ধরনের দুটি বোমা জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বিস্ফোরিত হয়েছিল। যার ধ্বংসযজ্ঞ আজও ভোলার নয়। এই বোমা কিন্তু তৈরি হয়েছিল আইনস্টাইনের বিখ্যাত ভর শক্তি রূপান্তর সূত্রের ধারণা থেকে। এই সূত্র ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা সামান্য পরিমাণ ভর থেকে বিশাল শক্তি উৎপন্ন করেছি্লেন। তত্ত্বটি আগে গাণিতিক ম্বেযাথটে দেখানো হলেও পরীক্ষার মাধ্যমে তা সফলভাবে প্রমানিত হয়েছে ওই বোমা নিক্ষেপের পর এর ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যদিয়ে।
এই বিজ্ঞানীর ‘থিওরি অফ রিলেটিভিটি’ খুব চমকপ্রদ তত্ত্ব। এই তত্ত্ব নতুন নতুন ভাবনাকে জন্ম দেয়।