আয়না২৪ ডেস্ক
রাজা ছিলেন দ্বিতীয় টলেমী ফিলাডেলফাস। জ্ঞান অন্বেষণে তার ছিল প্রবল আগ্রহ। বই পাগল রাজা হিসেবে তার ছিল বেশ সুখ্যাতি। কে ছিলেন দ্বিতীয় টলেমী ফিলাডেলফাস?
দ্বিতীয় টলেমী ফিলাডেলফাস ছিলেন রানী ক্লিওপেট্রার পূর্বপুরুষ। টলেমীয় বংশের প্রথম ফারাও ছিলেন টলেমী ফিলাডেলফাস। তিনি ছিলেন একজন গ্রীক, মহাবীর আলেকজাণ্ডারের বন্ধু ও সেনাপ্রধান, যিনি আলেকজাণ্ডারের মৃত্যুর পর মিশরে জয় করা সাম্রাজ্যর দায়িত্ব নেন। দ্বিতীয় টলেমী ফিলাডেলফাস পিতার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারসূত্রে মিশরের সম্রাট হন।
টলেমী ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী এবং বেশ ক্ষমতাধর এক রাজা। তবে তার এক বিশেষ শখ ছিল যা তাকে অন্য রাজাদের থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র করে রেখেছে। তার নেশা ছিল বই সংগ্রহের। রাজ্যে ছিল তার বাবার আমলে তৈরী এক মিউজিয়াম, তার ভিতরে এক ছোট্ট মাপের লাইব্রেরী। আলেকজান্দ্রিয়া রাজ-গ্রন্থাগার নামে পরিচিত ছিল এটি। প্রাচীন বিশ্বের বৃহত্তম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাগারগুলোর একটি ছিলো এটি। এটি মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরে অবস্থিত ছিল। ছোটবেলায় পড়াশোনা করতে রাজা এই লাইব্রেরি নিয়মিত ব্যবহার করতেন। এভাবেই রাজার মধ্যে তৈরি হয় বই পড়া ও সংগ্রহের প্রবল নেশা।
খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে মিশরের টলেমি রাজবংশের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি প্রধান শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে এই গ্রন্থাগারটি গড়ে উঠেছিল। টলেমীর রাজত্বকালে এই গ্রন্থাগার স্থায়ী রূপ পায়। তখন এই লাইব্রেরি ব্যাপক সমৃদ্ধি লাভ করে এবং তা হয়ে ওঠে মিশরের ঐশ্বর্য ও ক্ষমতার প্রতীক।
সে সময়ে মিশরে বই লেখা হতো প্যাপিরাস গাছের কান্ডের থেকে তৈরী কাগজের ওপর। আর তা লেখা হতো হাতে। ছাপার পদ্ধতি তখনও এই পৃথিবীতে আবিষ্কৃত হয় নি। রাজার সেই মিউজিয়ামে আসতেন সেই সময়ের জ্ঞানী-গুণী ছাত্র ও শিক্ষক, ইউক্লিড, ইরাটোস্থেনিস মতো অনেক প্রসিদ্ধ ব্যক্তি। তারা আসতেন গ্রীস, রোম, আরব ও আরো বহু দেশ থেকে। লাইব্রেরিতে পড়াশোনা, গবেষণা তো চলতোই, সঙ্গে তৈরি হতো হাতে লেখা বই। এই লাইব্রেরিতেই প্রথম মৃত মানুষের শরীর নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়।
রাজা নিজের রাজ্যের সব মানুষের ব্যক্তিগত সংগ্রহে যেসব ভাল বই ছিল তা জোগাড় করে লাইব্রেরী সাজাতেন, আর বইয়ের মালিককে ফেরত দিতেন নতুন কপি। তা শুধু রাজ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। অন্য দেশ থেকে কেউ তার রাজধানীতে আসলে রাজার সেনারা তাদের কাছে কোনো বই আছে কিনা তা তল্লাশী করে দেখে নিতো। যদি কারো কাছে পাওয়া যেতো, তার কাছ থেকে কিছুদিনের জন্য সেই বই ধার নিয়ে কপি বা নকল তৈরী করে আসলটা রেখে নতুনটা ফেরত দেওয়া হত মালিককে।
মেধাবী কারিগরদের তৈরী বইগুলো সবসময় দেখতে এত সুন্দর হত যে মূল বই না পেলেও তা নিয়ে বই মালিকের কোনো ক্ষোভ থাকতো না। তাছাড়া অসাধারণ কোনো বই হলে রাজা নিজেই কপির সাথে আসলটির জন্য ক্ষতিপূরণ বাবদ অর্থ দিতেন। এভাবে রাজা তার লাইব্রেরীতে অনেক গ্রীক ও রোমান সাহিত্যের মূল বই নিয়ে আসেন।
ধীরে ধীরে রাজার নেশা আরও বেড়ে গেলো। তার মনে হতে লাগলো অন্যান্য ভাষার ও দেশের সাহিত্যও তার লাইব্রেরিতে থাকা দরকার। তিনি শুধু বই খুঁজে আনার জন্যই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিজের বিশ্বস্ত পর্যটক পাঠাতে লাগলেন। রাজার লাইব্রেরী দিনে দিনে সমৃদ্ধশালী হতে লাগলো। আর এসব বইয়ের আকর্ষণে রাজধানীতে পন্ডিত ও গুণীদের আনাগোনাও বাড়তে থাকে। এরকম এক বইসন্ধানী দল রাজাকে খবর দিল প্রাচীন ইহুদী সাহিত্যের। পরবর্তীতে যা ওল্ড টেস্টামেন্ট নামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে।
হিব্রু ভাষায় লেখা ইহুদীদের সেসব ধর্মীয় সম্পদ বিশ্ববাসীর কাছে তখনও অজানা। জেরুজালেমের মন্দিরে ইহুদী পুরোহিত ও পণ্ডিতরা সযত্নে সেগুলো রক্ষা করার দায়িত্বে ছিলেন। এই সংবাদ বইপ্রেমী রাজাকে আরো পাগল করে তুলল। রাজা তো শুধু বই জমাতেন না, তাঁর জ্ঞানও ছিল অগাধ। তিনি সহজেই বুঝে গেলেন এই বই পৃথিবীর এক দুষ্প্রাপ্য সম্পদ, যা তার লাইব্রেরীর রত্ন হতে চলেছে।
জেরুজালেমওর মন্দিরের পুরোহিত ও পণ্ডিতরা রাজার বইটি নকল করে ফিরিয়ে দেবার প্রস্তাব মোটেই মেনে নিলেন না। টাকার প্রলোভনকে তারা অবজ্ঞা করলেন। তাদের পবিত্র বই তারা কিছুতেই আরেকজনের কাছে হস্তান্তর করতে ইচ্ছুক নয়। আর বিদেশে পাঠানো তো দুরস্ত।
তখন রাজা বই পাবার জন্যে এক অদ্ভুত প্রস্তাব দিলেন যা বিশ্বের মানবিকতার ইতিহাসে বিরলতম। মিশরে তখন বিভিন্ন যুদ্ধে বন্দী অনেক ইহুদী দাস ছিল, তারা অনেক বছর ধরে বড়লোক মিশরীয়দের বাড়িতে কাজ করতো। তিনি বইয়ের বদলে মানুষ ফেরত এর প্রস্তাব দিলেন। এরকম ১ লক্ষ ২০ হাজার দাস মুক্ত হয়ে নিজেদের দেশ জেরুজালেম ফিরে যাবে, রাজা কথা দিলেন ।
এর জন্যে দাস মালিকদের দিতে হয়েছিল ৬০০ টালেন্ট যা বর্তমান বাজারে ৬ লক্ষ ইউএস ডলারের সমান। এই প্রস্তাব ইহুদী পুরোহিতরা মেনে নিলেন খুব খুশী মনে এবং সঙ্গে ৭২ জন গ্রীক ও হিব্রু জানা অনুবাদকের ব্যবস্থা করে দিলেন যারা আলেকজান্দ্রিয়া গিয়ে লাইব্রেরিতে অবস্থান করে ঐ বইগুলো অনুবাদ করে দেবেন। ঐ ৭২ পন্ডিতের নামে বইগুলো Septuagint নামে বিখ্যাত হয়, যার অর্থ লাতিন ভাষায় ৭২ (septuagint duo)। বই এর জন্যে মুক্তি পেল লক্ষ মানুষ, যাদের জীবন ছিল মৃত্যুরই নামান্তর।
ফারাও টলেমী ফিলাডেলফাস এর লাইব্রেরি থেকে এই বই তারপর ছড়িয়ে পড়ল সারা পৃথিবীর জ্ঞানী সমাজে। এভাবে ৪ লাখের বেশী বই আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরিতে জমা হলে রাজাকে তাঁর রাজধানীর সবচেয়ে বিখ্যাত দেবমন্দির (দেব সেরাপিস) এ দ্বিতীয় লাইব্রেরী বানাতে হয়।
দুই লাইব্রেরী মিলে প্রাচীন বিশ্বের বিখ্যাত শহর আলেকজান্দ্রিয়ার মোট বই কত ছিল তা আজ আর প্রমাণ করা সহজ নয়। তবে অনেকের মতে, সাত আট লাখ বইয়ে সমৃদ্ধ হয়েছিল এই দুই লাইব্রেরি। প্যাপিরাস কাগজে সুন্দর নির্ভুল হাতের লেখায় সোনার জলের অলংকরণে বই তৈরী কত পরিশ্রমসাধ্য ছিল তা আজকের যুগে অকল্পনীয়। অধিকাংশ বই-ই রাখা হয় প্যাপিরাস স্ক্রলের আকারে। তবে ঠিক কতগুলি স্ক্রল এই গ্রন্থাগারে রক্ষিত ছিল তা জানা যায়নি। এই গ্রন্থাগার পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। যার ফলে বহু স্ক্রল ও বই চিরতরে নষ্ট হয়ে যায়।
কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, মানুষ যত গড়ে তত নষ্ট করে। আলেকজান্দ্রিয়ার ওই অমূল্য সম্পদ পরবর্তীকালে বার বার ধ্বংস করেছে যুদ্ধবাজের দল। এই অগ্নিকাণ্ডের সময় নিয়ে যদিও বিতর্ক রয়েছে, তবু ধারণা করা হয়, ৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জুলিয়াস সিজারের মিশর আক্রমণের সময়, ২৭০ খ্রিস্টাব্দে আরেলিয়ান আক্রমণের সময় এবং ৩৯১ খ্রিস্টাব্দে কপটিক পোপ থেওফিলাসের নির্দেশে আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়।
আজ আর সেই গ্রন্থাগারের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক উন্নতি সাধনে এই বইপ্রেমী রাজার অবদানের কথা ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।