অনিন্দ্য আফরোজ
মানব কল্যানে পৃথিবীতে অনেক বিজ্ঞানীর জন্মেছেন। তাঁদের উদ্ভাবন মানুষের জীবন-যাপনকে সহজ ও সাবলীল করে দিয়েছে। বিজ্ঞানকে কীভাবে মানুষের কল্যাণে আরও বেশি বেশি করে কাজে লাগানো যায়– এসব নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করেই কেটে যায় তাদের জীবন।এদের মধ্যে এমন কয়েকজন বিজ্ঞানী আছেন, যাদের অসাধারণ চিন্তাশক্তি ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা দিয়ে আমাদের পৃথিবীটাকেই বদলে দিয়েছেন।
পৃথিবী ও মানব ইতিহাসকে বদলে দেওয়া এমন এক বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন। ব্রিটিশ এই প্রকৃতিবিদ তার ‘বিবর্তনবাদ ও প্রাকৃতিক নির্বাচন’ সংক্রান্ত মতবাদ দিয়ে আমাদের চারপাশের জীবন ও জগত সম্পর্কে ধারণাটা পালটে দিয়েছেন।শিখিয়েছেন সম্পূর্ণ নতুনভাবে নিজেকে দেখতে।
জন্ম ও গবেষণা
কালজয়ী বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের জন্ম ইংল্যান্ডে, ১৮০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। ডারউইনের সব গবেষণাকেই বিজ্ঞানের জগতে খুব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। তবে এই প্রতিভাধর বিজ্ঞানীর সবচেয়ে বড় গবেষণা ছিল, প্রাকৃতিক নির্বাচন নিয়ে। এর মূল কথা হচ্ছে- পৃথিবীর সমস্ত প্রাণী প্রজাতিই একই পূর্বপুরুষের কাছ থেকে এসেছে এবং সময়ের সঙ্গে বিবর্তিত হয়েছে।
আরো পড়তে পারেন দুনিয়া পাল্টে দেওয়া দার্শনিক অ্যারিস্টটল
বিবর্তনবাদ
তবে এর মূল সূত্রটি কিন্তু ভীষন মজার। যখন সময়ের সঙ্গে প্রাণীর পরিবর্তন ঘটে, সেই পরিবর্তনকে তিনি বিবর্তন নামে অভিহিত করেছেন।বিবর্তনের সময় প্রাণীর যে বৈশিষ্ট্যগুলো তার পরিবেশের সঙ্গে মিলে যায় কিন্তু সেগুলো থেকে যায় আর যে গুলো হারিয়ে যায় যেগুলোর তেমন দরকার হয়না। নিশ্চয়ই কঠিন লাগছে কথাটা? আসুন তাহলে সহজ করে বলি। ধরুন, আপনার বাড়িতে একটা দাবার কোট আছে কিন্তু ফুটবল খেলার জায়গা নেই। তাহলে এই সূত্র অনুযায়ী আপনার শারীরিক শক্তির বিকাশের তুলনায় বুদ্ধির বিকাশ বেশি হবে। আরও সহজ করে বললে, আপনাকে যদি একটা ইট সরাতে বলা হয়, সেটা আপনি হাত দিয়ে না সরিয়ে কীভাবে অন্যভাবে করা যায় এটা ভাবতে বসবেন। কেননা আপনার বৈশিষ্ট্যটিই যে হারিয়ে গেছে।
বিজ্ঞানী ডারউইন কিন্তু শুধু তাঁর এমন প্রাকৃতিক নির্বাচন বিষয়ক মতবাদ দিয়েই ক্ষ্যান্ত হননি। তিনি বিস্তারিত গবেষণার মাধ্যমে তার এই যুগান্তকারী তত্ত্বের স্বপক্ষে শক্ত প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। সেটা করার জন্যে পাঁচ বছর ধরে ‘এইচএমএস বিগল’ নামের একটি নৌ জাহাজে গবেষণা করেছেন। মূলত, এই গবেষণাকালে তিনি সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বিভিন্ন দেশ এবং জনশূন্য দ্বীপগুলোতে যেতেন। মতবাদ তো শুধু দিলেই হবে না তার পক্ষে প্রমাণ এবং যুক্তিও তো দেখাতে হবে। বিভিন্ন ভূখণ্ডের ঘুরে ঘুরে তিনি এসব প্রমাণ ও তথ্য সংগ্রহ করতেন। সমুদ্রযাত্রায় বিজ্ঞানী ডারউইন বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যে পরিপূর্ণ ব্রাজিল, চিলি, অস্ট্রেলিয়া, ফকল্যান্ড দ্বীপ ও গালাপাগোস-এসব দ্বীপ ভ্রমণ করেন।
১৮৫৯, ২৪ নভেম্বর। ওই দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত হলো তাঁর যুগান্তকারী গ্রন্থ ‘প্রজাতির উৎপত্তি’ (Origin of Species)। মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে বইটির প্রথম সংস্করণের এক হাজার ২৫০টি কপি বিক্রি হয়ে গেল।তখন বিশ্বজুড়ে তীব্র বিতর্কের ঝড় ওঠে এ বই ও মতবাদ নিয়ে। কোনো গ্রন্থকে ঘিরে এমন বিতর্ক এর আগে হয়নি। কিছুদিনের মধ্যে বইটি সমগ্র ইউরোপ তথা পৃথিবীতে পরিব্যাপ্ত হয়ে মানুষের চিন্তা জগতে তুমুল আলোড়ন তোলে। বিজ্ঞানিদের মাঝে তুমুল সাড়া পড়ে। সবার মধ্যে এনিয়ে এমন ধারণা জন্মালো যে, পৃথিবীতে একটি নতুন বৈপ্লবিক চিন্তার অভ্যুদয় হয়েছে। কি গভীর অনুভূতির সঙ্গে লেখক তাঁর আলোচ্য বিষয়কে বোঝাতে চেয়েছেন এই গ্রন্থে। পড়তে গেলে বিস্ময় জাগে এটি বিজ্ঞানের বই, না গীতিময় কোনো কাব্যগ্রন্থ!
বলতে গেলে লেখকের জীবনভর করা এমন গবেষণা কেবল গবেষণা ছিল না। ছিল এক অনাবিষ্কৃত নতুন পৃথিবী আবিষ্কার।তিনি ‘অন দ্যা অরিজিন অব স্পেসিস (প্রজাতির উৎপত্তি)’ গ্রন্থে তিনি প্রাকৃতিক নির্বাচন মতবাদ সংক্রান্ত যাবতীয় গবেষণাকে বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এত জায়গা ঘুরে ঘুরে যে তথ্যগুলো পেয়েছেন তাঁর নতুন এই মতবাদকে সমর্থন করে। এখন চাইলেই কেউ বলতে পারবেন না ডারউইনের মতবাদ সঠিক ছিল না। এই বইটিকে জীবের উৎপত্তি ও বিকাশ সংক্রান্ত গবেষণার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে ধরা হয় বর্তমান জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে।
অন্যান্য গবেষণা
তাঁর অন্যান্য কাজগুলোর মধ্যে আরো আছে, ‘দ্যা এক্সপ্রেশন অব ইমোশনস ইন ম্যান অ্যান্ড অ্যানিম্যালস (মানুষ ও প্রাণীসমূহের আবেগীয় অভিব্যক্তি)’, ‘দ্যা ডিসেন্ট অব ম্যান, অ্যান্ড সিলেকশন ইন রিলেশন টু সেক্স (মানুষের ক্রমোন্নয়ন ও লৈঙ্গিক নির্বাচন)’, ‘দ্যা পাওয়ার অব মুভমেন্ট ইন প্ল্যান্টস’ এবং ‘দ্যা ফর্মেশন অব ভেজেটেবল মৌল্ড থ্রু দ্যা অ্যাকশন অব ওয়ার্মস’।
প্রকৃতি বিজ্ঞানী ডারউইন তাঁর বিবর্তনবাদ তত্ত্ব দিয়ে আমাদের যুগ যুগের প্রচলিত বৈজ্ঞানিক, ধার্মিক ও দার্শনিক মতবাদকে নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। এজন্য তাঁর এই তত্ত্ব ভীষণ আলোচিত-সমালোচিত হয়েছিল।শিক্ষিত সমাজের অধিকাংশ মানুষ বিবর্তনবাদকে গ্রহণ করে নিলেও, আজও অনেকে এই ধারণার সত্যতাকে চ্যালেঞ্জ করেন।
আরো পড়তে পারেন শামস তাবরিজির অজানা প্রেমের রসায়ন
শেষ বয়স
ডারউইন শেষ বয়সে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। তবু তিনি নিজের গবেষণা চালিয়ে যান। পাশাপাশি নিজের ধারণাগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে থাকেন। একইসঙ্গে বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায়ও নতুন নতুন ধারণার উৎপত্তি ঘটান।
ডারউইন যেমন বিজ্ঞান নিয়ে ভাবতেন তেমনি সমাজ নিয়েও ভাবতেন। সমাজকে খারাপ প্রথা থেকে দূরে রাখতে চাইতেন তিনি। তাই দাস প্রথা নিয়ে মানুষ যখন সোচ্চার, তখন সেই সোচ্চার-প্রতিবাদীদের পাশে তিনিও দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘আমি দেখতে পাচ্ছি মানুষ ধীরে ধীরে দাসত্বের বিরুদ্ধে কিভাবে সোচ্চার হয়ে উঠছে। ব্রিটেনের জন্য এটা কতই না গর্বের ব্যাপার হবে যদি সে প্রথম ইউরোপিয়ান দেশ হিসেবে এই প্রথাকে বিলুপ্ত করতে পারে।’
জীবনভর বিজ্ঞান সাধনার পর মহান প্রতীভাধর এই বিজ্ঞানী ১৮৮২ সালের ১৯ এপ্রিল ৭৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।