দান নিয়ে কথা উঠলেই এখনো প্রবাদ হিসেবে হাজী মুহাম্মাদ_মহসীনের নামটি অকপটে উচ্চারিত হয়। দানশীলতার জন্য তিনি দানবীর হিসেবে খেতাব পেয়েছিলেন। এজন্য উপমহাদেশের ইতিহাসে তিনি কিংবদন্তী হয়ে আছেন। কিন্তু প্রবাদপ্রতিম এই ব্যক্তির সম্পর্কে বিষদ কিছু এখনো অনেকেরই অজানা। আজ তাঁর সম্পর্কে জানাচ্ছেন অনিন্দ্য আফরোজ।
উপমহাদেশের ইতিহাসের উজ্জ্বল কিংবদন্তী মুহাম্মদ মহসিনের জন্ম ১৭৩২ সালের ৩ জানুয়ারি। পশ্চিমবঙ্গের হুগলীজেলায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। দানের ক্ষেত্রে তুলনাকরতে মানুষ কয়েকশ বছর ধরে তাঁর নামকে দৃষ্টান্ত হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন। দানবীর হিসেবে তিনি বাঙালির কাছে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সমান শ্রদ্ধার পাত্র। ১৮১২ সালে এ ধার্মিক দানবীর হুগলিতে ইন্তেকাল করেন। তাঁকে হুগলির ইমামবাড়ায় দাফন করা হয়।
আরো পড়তে পাড়েন চাণক্যের যাদুকরি নীতিবাক্য
হাজী মহসিন ছিলেন অঢেল সম্পদের মালিক। তিনি অকাতরে এসব সম্পদ বিলিয়েছেন মানুষের কল্যানে।পূর্ব পুরুষদের থেকে মহসিনের খুব ধর্নাঢ্য ছিলেন।সুদূর পারস্য (ইরান) থেকে বঙ্গে আসা তাঁর বাবা হাজী ফয়জুল্লাহ ছিলেন ধর্নাঢ্য জায়গিরদার। মা জয়নব খানমেরও হুগলি, যশোর, মুর্শিদাবাদ ও নদীয়ায় বিপুল জমিজমা ছিল। মহসিনের বোন মন্নুজানের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার হিসেবে বোনের সম্পত্তিরও মালিক হন তিনি।
প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক হলেও তিনি ছিলেন নিরহঙ্কারী ও ধার্মিক। খুবই সহজ-সরল ও সাদামাটা জীবনযাপন করতেন তিনি। মহসিন ছিলেন চিরকুমার। নিজের প্রতিষ্ঠিত ইমামবাড়া প্রাসাদে বসবাস করতেন না। ইমাম বাড়ার পাশে একটি জীর্ণ কুটিরে কাটান তিনি। নিজ হাতে রান্না করে অধীনস্তদের নিয়ে একসঙ্গে বসে খেতেন।
শিক্ষা বিস্তার ও মানবিক কাজে ভূমিকা
ছোটবেলায় মুহাম্মদ মহসিন গৃহশিক্ষকের কাছে বিদ্যার্জন করেন। এরপর তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য যান রাজধানী মুর্শিদাবাদে। পড়াশোনা শেষে তিনি বিদেশ ভ্রমণে যান। সফর করেন মক্কা, মদিনা, কুফা, কারবালা। যান ইরান, ইরাক, আরব, তুরস্ক। দীর্ঘ ২৭ বছর বিদেশ সফর করে তিনি দেশে ফিরেন।
তিনি একাধারে ছিলেন দানবীর অন্যদিকে শিক্ষানুরাগী। তিনি অনেক বিদ্যাপিঠ স্থাপন করে শিক্ষাবিস্তারে অনন্য অবদান রাখেন।ওয়াকফকৃত অর্থ ব্যয় করে তিনি হুগলিতে ‘হুগলি মহসিন কলেজ’ ও ‘চট্টগ্রামের সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে ‘দৌলতপুর মুহসিন মাধ্যমিক বিদ্যালয়’।
বন্যা, খরা, দুর্ভিক্ষের সময় তিনি নিজ অর্থে লঙ্গলখানা ও সরকারি তহবিলে অর্থ দান করেছিলেন মহসিন। ১৭৬৯-৭০ সালে সরকারি দলিল অনুযায়ী, তৎকালীন দুর্ভিক্ষের সময় তিনি অনেক লঙ্গরখানা স্থাপন করেছিলেন এবং সরকারি তহবিলে অর্থ সহায়তা করেন। ১৮০৬ সালে তিনি ‘মহসিন ফান্ড’ নামে একটি তহবিল গঠন করেন তিনি।‘মহসিন ফান্ড’ এর তহবিল থেকে ধর্মীয় কর্মকাণ্ড, পেনশন, বৃত্তি ও দাতব্য কর্মকাণ্ডে ব্যয় করা করা হয়। এছাড়াও মহসিন ফান্ডের অর্থে অসংখ্য দরিদ্র ছাত্রদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়। ঢাকায় অবস্থিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ঘাঁটির নাম বিএনএস হাজী মহসিন। এছাড়াও চট্টগ্রামে বিখ্যাত হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ রয়েছে।
দানবীর, শিক্ষানুরাগী এবং মানবিক এক মহান ব্যক্তি হিসেবে ইতিহাসে দাতা হাজী মুহাম্মদ মহসিনের নাম আজো স্মরণীয় হয়ে আছে।পৃথিবীর অস্বিস্ত যতদিন থাকবে ততদিন তিনি চিরস্মরনীয় থাকবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলের নাম তার স্মরণে রাখা হয়েছে।