আয়না২৪ ডেস্ক
মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা ‘খুব সম্ভবত মানবতাবিরোধী অপরাধের’ শিকার বলে মন্তব্য করেছে জাতিসংঘ। মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর (ওএইচসিএইচআর) থেকে এই কথা বলা হয়েছে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় আসা রোহিঙ্গারা বলছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর হেলিকপ্টার গানশিপও ব্যবহার করেছে। গানশিপ-সেনা-বিজিপি-মগ যুবকদের হামলা, নৃশংসতা, বিভীষিকা তারা ভুলতে পারছে না।
বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে বলা হয়েছে, রাখাইন রাজ্যে সরকারি বাহিনীর নির্যাতনে প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম ঘরছাড়া হয়েছে। কৃত্রিম উপগ্রহে তোলা ছবি বিশ্লেষণ করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে শতাধিক বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য সীমান্তে জড়ো হয়েছে। সেনাবাহিনী ওই রাজ্যে নারী ও শিশুদের ধর্ষণ করছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
বিবৃতিতে ওএইচসিএইচআর বলেছে, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিয়ানমার সরকারের আচরণ মানবতাবিরোধী অপরাধের মতই। বিবৃতিতে গত জুনে প্রকাশিত জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে উপস্থাপিত তথ্য উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ২০১২ সালের সহিংসতার ঘটনার সূচনা থেকে ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিক বলে মেনে নেয়নি, স্বাস্থ্যসুবিধা ও শিক্ষার সুযোগ, এমনকি মুক্তভাবে চলাফেরার সুযোগ থেকেও তাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে।
ওএইচসিএইচআর বলেছে, ‘জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক সংস্থার ওই প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ করা হয়েছিল, তা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে মিয়ানমার সরকার। যা রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতার ধরন মানবতাবিরোধী অপরাধের শামিল বলে গণ্য করার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলেছে।’
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার মুখপাত্র ভিভিয়ান ট্যান গতকাল বুধবার ব্যাংককে বলেন, কমপক্ষে ১০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে। তবে পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে এবং প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়েও বেশি হতে পারে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ৯ অক্টোবর ভোরে রাখাইন সীমান্তে কয়েকটি পুলিশ ফাঁড়িতে সন্ত্রাসী হামলায় ৯ পুলিশসহ ১৪ জন নিহত হয়। মূলত এরপর থেকে সেখানে বিশেষ অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে বিজিপি।
বিভিন্ন সূত্র বলছে, ওই দিনের হামলার পর ১২টি গ্রামের অন্তত ১৮ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে আসেন কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন এলাকায়। তাঁদের একজন লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরের একটি কক্ষে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা যুবক রশিদ উল্লাহ (২৫)। বাড়ি রাখাইনের গজরবিল গ্রামে। ওই কক্ষে গিয়ে দেখা গেল, তাঁর কাঁধ, কোমর, ঊরু ও পায়ের তালুতে একাধিক জখম। চিকিৎসা পাননি। শরীরে থাকা গুলি ও স্প্লিন্টারের যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন। পাশে বসা বড় বোন হামিদা বেগম। কক্ষটিতে গাদাগাদি করে আছেন আরও ২০-২৫ জন রোহিঙ্গা। তাঁরা বললেন, ১৭ নভেম্বর দুপুরে ৮-১০টি গাড়িতে সেনাসদস্যরা গজরবিল গ্রাম ঘিরে ফেলেন। রোহিঙ্গাদের ঘর থেকে বের করে খোলা জায়গায় জড়ো করা হয়। মগরা ঘরবাড়ি থেকে ধান-চালসহ মালামাল লুট করতে থাকে। একপর্যায়ে তিনটি হেলিকপ্টার এসে এলোপাতাড়ি গুলি ও বোমাবর্ষণ করে। এতে ঘরবাড়িতে আগুন ধরে যায়, মগরাও রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়িতে আগুন দেয়। দুই ঘণ্টার নৃশংসতায় লণ্ডভণ্ড হয় গজারবিল, পুয়াংখালী, আমতল্ল্যা, জামবইন্ন্যা, নাকফুরা, কাউয়ারবিল, সিকদারপাড়া, বলিবাজার, পেরাংপুরু, ফাতংজা, নুরুল্লাপাড়া, কাদিরবিলসহ রোহিঙ্গাদের ১২টি গ্রাম।
রশিদ বলেন, তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। গুলিতে মারা যায় রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ, শিশু। মগরা হতাহত রোহিঙ্গাদের টেনেহিঁচড়ে দুটি ঘরে নিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। সেদিন তাঁর মা বেলুজা খাতুন ও স্ত্রী রহিমা খাতুন নিখোঁজ হন। ২৪ নভেম্বর রাতে ছোট ভাই এনায়ত উল্লাহ তাঁকে নিয়ে টেকনাফে পালিয়ে আসেন। সেখান থেকে এই শিবিরে। কয়েক দিন আগে এখানে আশ্রয় নেন তাঁদের আরেক বোন রশিদা বেগম (৩৫)।
রশিদা বলেন, বাইরে বের হলে আটকের ভয়ে এ পর্যন্ত রশিদকে চিকিৎসা করানো হয়নি। কারণ, আটক হলে ফেরত পাঠানো হবে। মিয়ানমারে ফেরার চেয়ে এখানে বিনা চিকিৎসায় মরে যাওয়া অনেক ভালো।
পুয়াংখালী গ্রামের সলেমা বেগম (৪০) বলেন, ১৭ নভেম্বর তাঁদের গ্রামে হেলিকপ্টার গানশিপের গুলিতে ২০-৩০ জন রোহিঙ্গা মারা গেছে।
লেদা শিবিরের আরেকটি ঘরে পাওয়া গেল ডান পায়ে গুলিবিদ্ধ শিশু আবদুর রহমানকে (৬)। পাশে বসা মা আমিনা বেগম (২৮) বলেন, ১৭ নভেম্বর বিকেলে তাঁদের গ্রাম নাইছংপ্রামে হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলিতে স্বামী রহমত উল্লাহ মারা গেছেন, গুলিবিদ্ধ হয় রহমান। ২০ নভেম্বর মামা বদিউর রহমানের সঙ্গে পালিয়ে আসেন টেকনাফে।
হেলিকপ্টার গানশিপের হামলায় আহত কয়েকজন নারী-পুরুষ উখিয়ার কুতুপালং শিবিরে আছেন। তাঁদের কয়েকজন মেডিসিন স্যানস ফ্রন্টিয়ার্সের (সীমান্তবিহীন চিকিৎসক দল) হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। ওই হাসপাতালের বিদেশি চিকিৎসক টমাস ক্রুনিন বলেন, এখানে অনেক রোহিঙ্গা চিকিৎসা নিচ্ছেন ঠিক, কিন্তু এর সংখ্যা বা পরিচয় বলা নিষেধ।
শতাধিক রোহিঙ্গাকে ফেরত: নাফ নদী অতিক্রম করে টেকনাফে প্রবেশের চেষ্টাকালে বিজিবি গতকাল ছয়টি নৌকায় থাকা শতাধিক রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে। রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা দেওয়ায় বিজিবি চারজন দালাল টেকনাফের মোহাম্মদ আমিন, মোহাম্মদ ইব্রাহিম, মোহাম্মদ সেলিম ও উসমানকে আটক করে পুলিশে দিয়েছে। টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আবুজার আল জাহিদ বলেন, রোহিঙ্গা প্রবেশ ঠেকাতে বিজিবি সতর্ক। গত কয়েক দিনে ৭২টি নৌকাসহ ৯৭৬ জন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে।