বিদায় কমরেড বিদায়-লাল সালাম!

নভেম্বর ২৬, ২০১৬
Spread the love

আয়না২৪ প্রতিবেদন

নব্বই বছর বয়সী সংশপ্তক  বিপ্লবী আজ নীরব।  যেন তিনি জীবনের থেকে কিছু সময় চেয়ে নিয়ে  অল্প সময়ের  জন্য ঘুমিয়ে আছেন।  তিনি আর উঠবেন না, হাত নেড়ে কিউবার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করবেন না কিংবা বিশ্বের যে প্রান্তে হোক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠবে না তাঁর  ঝাঝাল কণ্ঠ! এটা  যেন কেউ ই মানতে পারছেন না।  হ্যা, সেই নিয়তি যে মানতেই হয়।কারণ  এই অমোঘ নিয়তি শ্বাশত, চিরন্তন।  মহামতি কাস্ত্রোও তাই মানলেন।২৫ নভেম্বর ফিদেল কাস্ত্রোর ক্লান্ত দেহের অবসান  হয়েছে। ২৬ মধ্যরাতে কিউবার সরকারি গণমাধ্যমে তাঁর বিদায় সংবাদ প্রচারিত হয়। দেশের বর্তমান প্রেসিডেন্ট এবং ফিদেলের ভাই রাউল কাস্ত্রো এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে প্রয়াত নেতার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন। যিনি শুধু কিউবা নয় সারা পৃথিবীর বঞ্চিত মানুষের সংশপ্তক নেতৃত্বের অনুপ্রেরণা ছিলেন।

জলপাই রঙের পোশাক, মুখ ভর্তি দাড়ি,  ঠোঁটে চুরুট, আর খানিকটা আখখেতের লোনা গন্ধমাখা বাতাস— ফিদেল কাস্ত্রো নামের ধারণাটিকে তৈরি করতে গেলে এই উপাদানগুলো লাগবেই। সেই সঙ্গে লাগবে আরও কয়েকটা জিনিস, যা কিউবানরা না-জানলেও বাঙালি জানে। এই বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে ‘কাস্ত্রো’ শব্দটা উচ্চারিত হলেই একসময়ে মুঠিবদ্ধ হয়ে উঠত হাত, হৃদয়ের গোপন বুলেভার্দে আন্দোলিত হত  লাল ঝান্ডা।

44175-004-1aa92245

বিপ্লবী এই মহানায়কের   জন্ম ১৯২৬ সালে কিউবার ওরিয়েন্তে প্রদেশে। কিউবার সেই সময়কার বাতিস্তা একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠেন তরুণ বয়সেই। ১৯৫৩-এ এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়ে কারাবরণ করেন। ১৯৫৫-এ মুক্ত হন। ১৯৫৬ সালে আর্হেনতিনার বিপ্লবী চে গেভারার সঙ্গে মিলিত হয়ে বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেন। ১০৯৬ সালে বাতিস্তা সরকারের পতন ঘটাতে সমর্থ হন কাস্ত্রো ও তাঁর বাহিনী। কিউবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সেই বছরেই শপথ গ্রহণ করেন। ১০৬০ সালেই ঘটে বে অফ পিগস ঘটনা। মার্কিন মদতপুষ্ট আক্রমণকে সাফল্যের সঙ্গে প্রতিহত করার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব বিপ্লবের অন্যতম আইকন হিসেবে তাঁর নাম উচ্চারিত হতে শুরু করে। ১৯৬২-এ তদানীন্তন সোভিয়েত সরকারের সঙ্গে কিউবার মাটিতে সোভিয়েত মিসাইল তৈরির চুক্তিতে আবদ্ধ হলে সমসময়ে ঘটে যাওয়া কোল্ড ওয়ার ঘনীভূত হয়। দ্বিমেরুকরণের বিশ্বরাজনীতির অন্যতম নায়ক হিসেবে কাস্ত্রো একাধারে নিন্দা ও প্রশংসার পাত্র হয়ে ওঠেন সারা বিশ্বে। ১৯৭৬ সালে কিউবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাস্ত্রোকে নির্বাচন করে সেদেশের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি।কাস্ত্রোর এই উত্থানে যে বিশ্বের বামপন্থী আন্দোলন বিশেষ প্রণোদন লাভ করে, তার জ্বাজ্জ্বল্য উদাহরণ সমসময়ের পশ্চিমবঙ্গ। বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায় কিউবার এই বিপ্লবীর নাম। ১৯৬০-এ তাঁর সোভিয়েত ব্লকের সঙ্গে সংযুক্তিকে রুশপন্থী বাঙালি কমিউনিস্টরা যেন নিজের দলে তাঁর যোগদান বলে মনে করছিল। আপসহীনতা, সংগ্রাম আর স্বপ্ন একত্রে মূর্ত হতে থাকে কাস্ত্রো নামক এক আইকনে। ঘোলাটে বাল্‌ব জ্বলা পার্টি অফিসে মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিনের পাশে তিনিও স্থান পেয়ে যান। পাড়ার লাইব্রেরিতে সৌরীন সেনের ‘আখের স্বাদ নোনতা’ পাওয়ার জন্য দীর্ঘ রিকুইজিশন। ঢোলা পাজামা আর লম্বা ঝুলের পাঞ্জাবি পরা এলোমেলো চুল বাঙালি তরুণ তখন জানেন, ‘ঝুটা আজাদি’, নেহরু রেজিমের বঞ্চনা, ক্রমাগত বেকারত্বের সেই জমানায় কাস্ত্রো হয়ে দাঁড়ান সান্ধ্য মুড়ি-তেলেভাজার শরিক, পোস্টার লেখার বিনিদ্র রাতগুলোয় কাস্ত্রোই যেন কাঁধে হাত রাখেন বাঙালি কমরেডদের। বে অফ পিগস-এর সমুদ্রবাতাস এসে ঝাপট মারতে থাকে ধর্মতলার ব্যারিকেডে, শহিদ মিনারের পাদদেশের জনসভায়। পার্টি ভাগ হলেও কাস্ত্রো ভাগ হননি কখনও এই বাংলায়। এমন কী ১৯৭০-এর দশকের সেই সব দামাল দিনগুলোতেও নয়।

article-2307002-04bb1d9c0000044d-867_306x423

 

২০০৮-এ কাস্ত্রো রাজনীতি থেকে অবসর  এই মহান নেতা।   কমিউনিজম থাক, তিনি তো জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনেরও অন্যতম শরিক! বাঙলি যুবকের টি-শার্টে শোভা পেয়েছেন চে। কাস্ত্রো সেই আইকন হননি। তিনি থেকে গিয়েছেন বাঙালির স্মৃতিরেখার এক নিরালা বুলেভার্দেই। সেখানে খুব কম মানুষেরই আনাগোনা। পাতাঝরা হেমন্তের অরণ্যের মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া সেই সড়কে আজ বাঙালি মনে মনে হাঁটছে। কণ্ঠার হাড়ের ওঠানামায় গুমরে উঠবে ‘ইন্টারন্যাশনাল’। নির্জনে হয়েতো মুঠিবদ্ধ হাত উঠে যাবে কপালের পাশে, মৃদুস্বরে অভিবাদন জানিয়ে উচ্চারিত হবে-‘বিদায় কমরেড বিদায়। লাল সালাম তোমায়।’

http://www.history.com/topics/cold-war/fidel-castro/videos/the-cia-plot-to-kill-castro