আয়না ২৪ ডেস্ক
ক্ষমতা নেয়ার আগেই ইউরোপের দিকে ইট ছুড়েছিলেন হবু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রতিক্রিয়ায় পাটকেল ফিরিয়ে দিয়েছেন ইউরোপীয় নেতারা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে ব্রিটেনের বের হওয়া, ন্যাটোকে আক্রমণ এবং শরণার্থী ইস্যুতে জার্মান নীতির সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মুখ খুললেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলান্দ ও জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল।
রোববার ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টাইমস এবং জার্মান সংবাদপত্র দ্য বিল্ডে ট্রাম্পের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। এতে তিনি ন্যাটোকে ‘সেকেলে ও অকার্যকর’ বলে উল্লেখ করেন। মার্কেলের কড়া সমালোচনা করে তিনি বলেন, সিরিয়ার শরণার্থীদের জন্য জার্মানির সীমান্ত উন্মুক্ত করে দিয়েছেন মার্কেল। তার এই সিদ্ধান্ত ‘বিপর্যয় সৃষ্টিকারী’। ব্রেক্সিটের প্রশংসা করে ট্রাম্প বলেন, ব্রিটেনের পর আরও অনেক দেশ ইইউ থেকে বেরিয়ে যাবে। এর মধ্য দিয়ে তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের পতনের দিকে ইঙ্গিত করেছেন।
ইউরোপের বিষয়ে ট্রাম্পের এমন মনোভাব ভালোভাবে নেননি ইইউ নেতারা। প্রথম মুখ খোলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ওলান্দ। স্থানীয় সময় সোমবার প্যারিসে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেন হার্টলিকে সম্মানসূচক ‘লিজিয়ন অব অনার’ পদক প্রদানের অনুষ্ঠানে তিনি ট্রাম্পের উদ্দেশে বলেন, ‘ইউরোপের করণীয় নিয়ে বাইরের কারও উপদেশ দেয়ার দরকার নেই। আমরা ট্রান্স-আটলান্টিক সহযোগিতা বৃদ্ধির পক্ষে।
তবে তা অবশ্যই স্বার্থ ও মূল্যবোধ মেনে করতে হবে।’ দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ম্যানুয়েল ভলসের মতে, ট্রাম্পের এমন দম্ভোক্তি ইউরোপের সঙ্গে ‘যুদ্ধ ঘোষণার’ শামিল। অন্যদিকে বার্লিনে জার্মান চেম্বার অব কমার্সে দেয়া এক বক্তব্যে অ্যাঞ্জেলা মার্কেল বলেন, ‘ইইউ নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারে। ইউরোপীয়রা নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই গড়তে পছন্দ করেন।’
ট্রাম্পের এমন মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেছেন বিদায়ী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের কোনো দেশের রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে এভাবে সরাসরি কথা বলা উচিত নয়। মিত্র দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা তার দায়িত্ব।’
ন্যাটো নিয়ে ট্রাম্পের বক্তব্যে পূর্ব ইউরোপীয়ান ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোতে বেশ উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের ক্রিমিয়া দখলে নেয়া ও ইউক্রেনে তার হস্তক্ষেপের বিষয়ে এমন আতংক আরও জোরালো হয়েছে
ট্রাম্প বলেছেন, অনেক আগেই আমি বলেছি ন্যাটোতে সমস্যা আছে। তার মধ্যে এক নম্বর সমস্যা হল- এটা অচল সংগঠন। কারণ, এটা গঠন করা হয়েছে অনেক বছর আগে। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ও শীতল যুদ্ধের সময়ের দিকে ইঙ্গিত করে এমন কথা বলেন। দ্বিতীয় কারণ হিসেবে তিনি বলেন, অনেক দেশের যে পরিমাণ অর্থ দেয়ার কথা ছিল তারা তা দিচ্ছে না।
যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জার্মানির উদার অভিবাসন নীতির তীব্র সমালোচনা করাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যেসব কথা বলেছেন তার পাল্টা জবাব দিয়েছেন ইউরোপীয় নেতারা। ট্রাম্পের বক্তব্যের জবাবে জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল বলেছেন, নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে পারবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ বলেছেন, কী করতে হবে সে বিষয়ে বাইরের কোনো উপদেশের দরকার নেই (ইউরোপের)। বিবিসি, এএফপি, দ্য গার্ডিয়ান।
এক সাক্ষাত্কারে লন্ডন টাইমস ও জার্মান পত্রিকা বিল্ডসকে ট্রাম্প বলেছেন, অবৈধ শরণার্থীদের জার্মানিতে ঢুকতে দিয়ে চ্যান্সেলর মার্কেল বিপর্যয় ঘটানোর মতো ভুল করেছেন। অন্য লোককে নিজের দেশে ঢুকে সব ধ্বংস করার সুযোগ দেওয়া উচিত নয়। একই সাক্ষাত্কারে ট্রাম্প ন্যাটো সামরিক জোটকে ‘সেকেলে’ বলে মন্তব্য করেন। পাশাপাশি ইউরোপের অভিবাসী ইস্যুটি ইইউ থেকে ব্রিটেনের বের হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ট্রাম্পের ভাষায়, আপনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের দিকে তাকান। এটা আসলে জার্মানি। প্রকৃতপক্ষে এটা জার্মানির একটা বাহন। এজন্য আমি মনে করি, যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে আসাটা ছিল একটা খুবই স্মার্ট সিদ্ধান্ত। আমার বিশ্বাস অন্যরাও বেরিয়ে যাবে। আমার মনে হয়, একসঙ্গে থাকাটা খুব সহজ হবে না।
এর উত্তরে মার্কেল বলেছেন, আমরা নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারি। ট্রাম্পের বিষয়ে বলেন, তিনি আবারও নিজের অবস্থান স্পষ্ট করলেন। আর আমার অবস্থানও কারও অজানা নয়। এছাড়া ন্যাটো বিষয়ে ট্রাম্পের মন্তব্যের সমালোচনা করে জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফ্রাঙ্ক ওয়াল্টার স্টেইনমার বলেছেন, শুধু ইইউ পররাষ্ট্রমন্ত্রীই নন, ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো পররাষ্ট্রমন্ত্রীদেরও এখনই সচেতন হওয়া উচিত।
২০১৫ সালে প্রায় ৮ লাখ ৯০ হাজার অভিবাসী জার্মানিতে প্রবেশ করে। এদের অধিকাংশ সংঘাতের কারণে সিরিয়া থেকে পালিয়ে আসে। ব্রেক্সিট ইস্যু নিয়েও কথা বলেন ট্রাম্প। ট্রাম্প এ ব্যাপারে যুক্তি তুলে ধরে বলেন, অবৈধ অভিবাসী প্রবেশে সীমান্ত খুলে দেওয়ার কারণে ব্রিটেনের জনগণ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে ভোট দেন।
ব্রাসেলসে ন্যাটো সেক্রেটারি জেনারেল জেন্স স্টোলেবার্গের সঙ্গে পরামর্শের পর জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফ্রাঙ্ক-ওয়াল্টার স্টেইনমিয়ের বলেন, ট্রাম্পের মন্তব্য জোটের মধ্যে উদ্বেগ ও আশঙ্কা তৈরি করেছে। এখন আমাদের পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ খেয়াল রাখতে হবে। ট্রাম্পের মন্তব্যের জবাব দিয়েছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদও।
তিনি বলেছেন, কী করতে হবে সে বিষয়ে বাইরের কোনো উপদেশের দরকার নেই (ইউরোপের)। ট্রান্স আটলান্টিক কো-অপারেশন চালিয়ে নেওয়ার জন্য ইইউ প্রস্তুত আছে, তবে তা হতে হবে পারস্পরিক স্বার্থ ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে। প্যারিসে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী রাষ্ট্রদূতকে ‘লিজিয়ন অব অনার’ সম্মানে ভূষিত করা কালে তিনি এসব কথা বলেন। ফ্রান্সের সাবেক প্রধানমন্ত্রী সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিবিদ ম্যানুয়েল ভালাস বলেছেন, ট্রাম্পের মন্তব্য ইউরোপের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিও ট্রাম্পের মন্তব্যের সমালোচনা করেছেন। সিএনএনকে তিনি বলেন, খোলাখুলি বললে আমার মনে হয়েছে, অন্য দেশের রাজনৈতিক বিষয়ে এ রকম সরাসরিভাবে কথা বলা যুক্তরাষ্ট্রের একজন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের পক্ষে বেমানান। এর জন্য প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ট্রাম্পকে জবাব দিতে হবে এবং তাতে সম্পর্ক যা দাঁড়াবে তার দায়ও ট্রাম্পকে নিতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন ট্রাম্প।