আয়না২৪ ডেস্ক
ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়ী হয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টি। ৪০৩ আসনের বিধানসভায় এখনও পর্যন্ত ৩১০টি আসন পেয়েছে বিজেপি। অন্যদিকে বিদায়ী সরকার পরিচালনা করত যে সমাজবাদী পার্টি, তারা কংগ্রেস দলের সঙ্গে জোট গড়ে পেয়েছে মাত্র ৫৪টি আসন।
এছাড়াও উত্তরাখন্ড রাজ্যেও বিপুলভাবে জয়ী হয়েছে বিজেপি। অন্যদিকে পাঞ্জাব আর মনিপুরে জয়ী হয়েছে কংগ্রেস দল।
গোয়া বিধানসভা ত্রিশঙ্কু অবস্থায় রয়েছে – কংগ্রেস আর বিজেপি কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় নি। সরকার গড়তে তাদের এখন নির্ভর করতে হবে দুটি আঞ্চলিক দলের ওপরে।তবে ভারতের রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনটি ছিল বিজেপির কাছে এসিড টেস্ট।
প্রথমত নোটবাতিলের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পরে এই প্রথম বড় নির্বাচনের মুখে পড়েছিল দলটি। এছাড়াও নরেন্দ্র মোদির কার্যকালের তিনবছর পেরিয়ে আসার পরে এই ভোট হলো। মোদির অবস্থান এই নির্বাচনে আরও শক্ত হল বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
সকাল আটটায় ভোট গণনা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই যখন প্রাথমিক ট্রেন্ড আসতে শুরু করে, তখনই বোঝা যাচ্ছিল উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টি আর কংগ্রেসের জোটকে পেছনে ফেলে খুব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে বিজেপি। বেলা আরও কিছুটা বাড়তেই যখন আনুষ্ঠানিক ফল ঘোষণা শুরু হয়, তখন দেখা যায়, বিজেপি ওই রাজ্যে একরকম সুইপ করেছে অর্থাৎ বিরোধী দলগুলিকে ধরাশায়ী করে দিয়েছে।
কীভাবে এই বিপুল জয় পেল তারা? জানতে চেয়েছিলাম উত্তরপ্রদেশে বিবিসি-র সংবাদদাতা সমীরাত্মজ মিশ্রর কাছে – যিনি গত কয়েকমাস ধরে গোটা ভোট প্রক্রিয়ার খবরাখবরের জন্য সারা রাজ্যে ঘুরেছেন।
মিশ্রর কথায়, “উত্তরপ্রদেশে যে জাতি-ধর্মের অঙ্ক কাজ করে, সেটাই এবার বিজেপির এত আসন পাওয়ার মূল কারণ। তাদের চিরাচরিত যে বর্ণ হিন্দু ভোট, সেটা তো দখলে রাখতে পেরেইছে, এর সঙ্গে অন্যান্য হিন্দু জাতি – যাদের পিছিয়ে থাকা জনজাতি বলা হয়ে থাকে, তাদের ভোটও এবার গুছিয়ে ঘরে তুলতে পেরেছে বিজেপি। ৬-৭ মাস ধরেই তারা এই কাজটা করেছে।”
“সমাজবাদী পার্টির মূল ভিত্তি যে যাদব গোষ্ঠী, তারা ছাড়া অন্যান্য গোষ্ঠীর সমর্থন পেয়েছে বিজেপি – এমন সব গোষ্ঠীগুলিও এবার বিজেপিকে ভোট দিয়েছে, যারা আগে কখনও সমাজবাদী, কখনও বহুজন সমাজপার্টিকে সমর্থন করত। এই হিন্দু ভোট একত্রীকরণ করেই এত আসনে জয় পেয়েছে বিজেপি,” বলছিলেন লখনৌতে সমীরাত্মজ মিশ্র।
এই নির্বাচনকে মনে করা হচ্ছিল ৫০০ আর হাজার টাকার নোট বাতিলের যে ঘোষণা নরেন্দ্র মোদি নভেম্বরে করেছিলেন, তার ওপরে একটা গণভোট।
কোটি কোটি মানুষ – বিশেষ করে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, মধ্যবিত্ত, ছোট ব্যবসায়ী, কৃষক – এদের ব্যাপক হয়রানি পোহাতে হয়েছে গত কয়েক মাসে।
কিন্তু রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও ভোটবিশেষজ্ঞ সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী বলছিলেন, নোটবাতিলের সেই ঘোষণার কোনো কুপ্রভাব বিজেপির ওপরে পড়েনি।
“নোটবাতিলটা কোনো নির্বাচনী ইস্যুতে যে রূপান্তরিত হয়নি, সেটা দেখা যাচ্ছে। এর একটা কারণ বোধহয় নরেন্দ্র মোদি সরকারের প্রধান আর দলের নেতা হিসাবে উন্নয়নের যে মডেল সামনে আনছেন, সেটাতে মানুষ আস্থা রাখছেন। দ্বিতীয়ত, নোট বাতিল করার স্বপক্ষে যে যুক্তিগুলো সরকার দিয়েছিল, যেমন কালো টাকার কারবারীদের নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি, সেটাকে মানুষ মেনে নিয়েছেন, নিজেদের অনেক অসুবিধায় পড়তে হলেও,” বলছিলেন সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী।
৪০৩ আসনের বিধানসভায় প্রায় ১২০টি আসন এমন রয়েছে, যেখানে মুসলমান ভোটারের সংখ্যা ২০%র থেকে বেশি – অর্থাৎ সেখানে মুসলমানরাই নির্ণায়ক শক্তি বলে মনে করা হয়। এইরকম আসনগুলির অনেকগুলিতেই বিজেপি এবার ভালো ফল করেছে।
বিভিণ্ন গণমাধ্যমে এটাকে মুসলমানদের মধ্যে বিজেপির জনপ্রিয়তা বাড়ার একটা ইঙ্গিত বলে মন্তব্য করা হচ্ছে। কিন্তু বিবিসির সংবাদদাতা সমীরাত্মজ মিশ্র বলছেন, “মুসলমানপ্রধান এলাকাগুলিতে বিজেপি যে ভালো ফল করেছে, তার কারণ হল মুসলমান ভোট ভাগ হয়ে গেছে – কিছু অংশ গেছে সমাজবাদী-কংগ্রেস জোটের দিকে, কিছু পেয়েছে বহুজন সমাজ পার্টি। এর পেছনে অন্য কোনো সমীকরণ দেখাটা ঠিক হবে না।”
এই ভোট এমন একটা সময়ে হলো, যেটা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নরেন্দ্র মোদির কার্যকালের প্রায় তিনবছর হতে চলেছে।
২০১৯ সালে লোকসভার নির্বাচন। তার আগে বিজেপি বাড়তি মনোবল যেমন পেল, তেমনই হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলিও এবার তাদের নিজস্ব এজেন্ডা পূরণ করার মতো রাজনৈতিক জায়গা পাবে বলে মন্তব্য করছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক রজত রায়।
রায়ের কথায়, “হিন্দুত্ববাদীরা, বিশেষ করে রামমন্দিরের কট্টর সমর্থক যারা সংঘ-পরিবারে আছেন, তারা এবার নতুন উত্তরপ্রদেশ সরকার আর মোদির ওপরে চাপ সৃষ্টি করবে যাতে আইন করে হোক বা যে করেই হোক, অযোধ্যায় এবার রামমন্দিরটা বানাতেই হবে। এটা উত্তরপ্রদেশে একটা নতুন আন্দোলনের ক্ষেত্র তৈরি হবে আগামী দিনে।” উত্তরপ্রদেশের ভোটের ফলাফল সংসদীয় রাজনীতিতেও বিজেপিকে সুবিধাজনক অবস্থানে নিয়ে গেল।
সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় বিজেপি এখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ দল নয়। তাই নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকারের আনা অনেক বিলই সেখানে আটকিয়ে যায়। কিন্তু রাজ্য বিধানসভাগুলিতে নবনির্বাচিত বিজেপি সদস্যদের ভোটে যতজন সংসদ সদস্য রাজ্যসভায় পাঠাতে সক্ষম হবে ওই দলটি, তার ফলে উচ্চকক্ষের সেই সংখ্যার ভারসাম্য বিজেপির অনুকূলে অনেকটাই চলে যাবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।