আয়না২৪ ডেস্ক
ইউরোপজুড়ে শরণার্থী সংকটের বিষয়টি চতুর্থ বছরে পড়ল। কিন্তু ইউরোপের তীরে হাজির হওয়া জনমিতিতে আসছে ব্যাপক পরিবর্তন। এখন পর্যন্ত ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পাড়ি জমানো শরণার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হলেন সিরীয়রা। এর পরেই আছেন আফগান, ইরাকি, ইরিত্রিয়ান ও সাব-সাহারার আফ্রিকানেরা। কিন্তু এখন যারা ঝুঁকিপূর্ণ সমুদ্রপথে ইউরোপে পাড়ি দিচ্ছেন, এদের মধ্যে এককভাবে বাংলাদেশীরাই বেশি বলে খবর দিয়েছে বৃটিশ দৈনিক ইন্ডিপেনডেন্ট।
পত্রিকাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের প্রথম তিন মাসে মাত্র একজন বাংলাদেশী ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে পৌঁছেছিলেন। অথচ, এ বছর একই সময়ে পৌঁছেছেন ২৮০০ জনেরও বেশি বাংলাদেশি।
ভূমধ্যসাগরে নৌকা থেকে যেসব অভিবাসন-প্রত্যাশীকে উদ্ধার করা হয়, তারা ত্রাণকর্মীদের জানিয়েছেন ঢাকা থেকে দুবাই বা তুরস্ক এবং সেখান থেকে লিবিয়ায় যেতে তারা প্রত্যেকে ১০ হাজার ডলার (৮ লাখ টাকারও বেশি) দিয়ে থাকেন পাচারকারীদের। লিবিয়ায় চলমান সহিংসতা ও দুর্দশার মধ্যে শেকড় গজাচ্ছে শক্তিশালী মানবপাচারকারী চক্রগুলো।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) বলেছে, ইউরোপে যাওয়ার নতুন পথ আবিষ্কৃত হয়েছে। এর ফলে ইতালিগামী অভিবাসনপ্রত্যাশীদের জনমিতিতে বিরাট পরিবর্তন এনেছে। এতদিন ধরে ইতালিতে এসব আশ্রয়প্রার্থীদের মধ্যে সাব-সাহারান আফ্রিকানদের প্রাধান্য ছিল। তবে আইওএম’র ফ্লাভিও দি গিয়াকোমো বলেন, ‘যে জিনিসটি সত্যিই পরিবর্তিত হচ্ছে, তা হলো অভিবাসীদের জাতীয়তা ও বাংলাদেশ থেকে আসা অভিবাসীদের সংখ্যা। গত বছরের মার্চের শেষ নাগাদ মাত্র ১ জন বাংলাদেশি ইতালিতে এসেছিলেন। এ বছরের একই সময়ে এই সংখ্যা ২৮৩১-এ দাঁড়িয়েছে।’
ইতালির সিসিলি ও আপুলিয়ার তীরে নিয়ে যাওয়া কিছু অভিবাসী বলেন, তাদেরকে লিবিয়ায় নিয়ে যাওয়ার আয়োজন করেছে একটি ‘এজেন্সি’। ৩-৪ হাজার ডলারের (২৪০০০০-৩২০০০০ টাকা) বিনিময়ে এই এজেন্সি তাদেরকে একটি ভিসার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
আইওএম’র একজন মুখপাত্র বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে তারা প্রথমতো দুবাই বা তুরস্কে যায়। সেখান থেকে তারা লিবিয়ায় পৌঁছে বিমানে। বিমান থেকে তাদের সঙ্গে একজন ‘চাকরিদাতা’ সাক্ষাৎ করে তাদের নথিপত্র নিয়ে যান।’
ইন্ডিপেনডেন্টের খবরে বলা হয়, এই চর্চা উপসাগরীয় আরব দেশগুলো ও লিবিয়ার জোরপূর্বক শ্রমবাজারে বেশ সাধারণ। এক্ষেত্রে পাচারকারীরা আগে অভিবাসীদের আটকে রাখে। এরপর দেশে তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে টাকা আদায় করে। নয়তো তাদেরকে জোরপূর্বক শ্রম বা পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করে।
ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়া কিছু বাংলাদেশি লিবিয়ায় ৪ বছর থেকেছেন। অন্যরা কয়েক মাস ছিলেন। আইওএম’র জড়ো করা তথ্য মতে, বাংলাদেশি অভিবাসীরা লিবিয়ায় পৌঁছতে ১০ হাজার ডলার (৮ লাখ টাকা) পরিশোধ করে পাচারকারীদের। এরপর আরো ৭০০ ডলার (প্রায় ৬০ হাজার টাকা) ব্যয় করতে হয় ইউরোপগামী নৌকায় চড়তে।
উত্তর আফ্রিকা থেকে ইতালিতে আসার পথ বর্তমান দুনিয়ায় সবচেয়ে শ্বাপদসঙ্কুল পথের একটি। কেবল এ বছরই প্রায় ১১০০ মানুষ ডুবে, শ্বাসকষ্টে বা ঠাণ্ডায় মারা গেছেন।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) জ্যেষ্ঠ লিবিয়া গবেষক হানান সালাহ বলেন, ২০১১ সালে লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধ দানা বাঁধার আগে দেশটি ছিল বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের অন্যতম গন্তব্য। তিনি বলেন, ‘আর এখনকার কথা বলতে গেলে, আমি যতদূর জানি দুবাই থেকে ত্রিপোলি বা লিবিয়ার কোথাও সরাসরি ফ্লাইট নেই। বেশিরভাগ বিদেশি লিবিয়ায় প্রবেশ করেন ত্রিপোলির মিতিগা বিমানবন্দর দিয়ে। তবে তার আগে পার্শ্ববর্তী তিউনিশিয়ার তিউনিসে ট্রানজিট হয়। আমাদের কাছে রিপোর্ট আছে যে, কিছুক্ষেত্রে বিদেশি নাগরিকদের নথিপত্র আটকে রাখা হয়। আর তাদেরকে একটি ‘স্লিপ’ দেয়া হয়। এটি হতে পারে তাদের কাছ থেকে জোরপূর্বক টাকা আদায়ের পথ।’
লিবিয়ার গৃহযুদ্ধের পর দেশটি এখন অসংখ্য সশস্ত্র ও জঙ্গি গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে। বিভিন্ন বন্দিশিবিরে অভিবাসীদের আটকে রাখার কাজে বিভিন্ন চক্র এসব সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে সমন্বয় করে। এই বন্দিশিবিরে বন্দি বাংলাদেশিদের সঙ্গে দেখা করেছেন হানান সালেহ। কিছু বাংলাদেশি আবার রেস্তরাঁ বা নির্মাণ খাতে কাজ করেন।
এইচআরডব্লিউ’র উপসাগরীয় গবেষক নিকোলাস ম্যাকগিহান বলেন, ঢাকা থেকে দুবাইয়ের পথ ‘বিবেকহীন রিক্রুটমেন্ট এজেন্ট’দের কাছে অনেক পরিচিত। তিনি বলেন, ‘এই এজেন্ট আসলে চরম দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসার গল্প শোনায়। সাধারণত তরুণরা এসব কথায় গলে যায়। হয় তারা নিজেরা স্বেচ্ছায় রাজি হয়, অন্যথায় পরিবার চালানোর চাপে। তাদের কাছে স্বপ্ন বেচা হয়। আর এই স্বপ্ন প্রায়ই বেশ তিক্ততায় রূপ নেয়। সেটা উপসাগরীয় দেশেই হোক আর এখানেই হোক।’
ম্যাকগিহান বলেন, ‘অজ্ঞতা ও প্রতারণা’র মিশেল এখানে মূল অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। তিনি আরো বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো মানুষকে বাইরে পাঠাতে পারলেই খুশি যদি তারা দেশে রেমিট্যান্স পাঠায়।’
চ্যাথাম হাউজের এশিয়া প্রোগ্রামের জ্যেষ্ঠ ফেলো গবেষক গ্যারেথ প্রাইস বলেন, ইউরোপ খুব উচ্চমূল্যের গন্তব্য। যদি কেউ একটি পথ আবিষ্কার করে ফেলে, তখন মানুষের যোগান এমনিতে মানবপাচারের বাজার তৈরি হয়ে যায়।’ তিনি বলেন, যেসব অভিবাসী মানবপাচারকারীদের দেখানো পথে নামেন, তাদের বৈধভাবে ইউরোপের ভিসা পাওয়ার সামর্থ্য থাকে না। কারণ, এক্ষেত্রে প্রায়ই তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে যথেষ্ট অর্থ থাকতে হয়।
প্রসঙ্গত, গেল বছর ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও তুরস্কের মধ্যে এক বিতর্কিত চুক্তির আওতায় তুরস্ক ইউরোপগামী সমুদ্রপথ বন্ধ করে দেয়। ফলে লিবিয়াই এখন ইউরোপগামী শরণার্থীদের শেষ অবলম্বন।