বিশেষ প্রতিনিধি
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্রাযমের বদৌলতে রানু মণ্ডলের নামটা পুরো নাম রানু মারিয়া মণ্ডল। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোনোদিন গান না শিখলেও নামীদামী শিল্পীদের গান হুবহু গেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাড়া ফেলেন এই রানু। সেই রানাঘাটের রানু এখন আর ঘরকুনো কোনো শিল্পী নয়। এখন তিনি ভারতের প্রধান সব সেংবাদ মাধ্যমের খবর হয়ে উঠছেন। মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাসট্রিতে প্লেব্যাক করে সাড়া ফেলে দিয়েছেন। গায়িকা হিসেবে নিজের জায়গাটা পাকাপোক্ত করে তুলছেন। আসুন জানি সেই রানুর কথা।
রানু মণ্ডল মেন্টর হিমেশ রেশমিয়ার তত্ত্বাবধানে একের পর এক গান গেয়ে যে রেকর্ড গড়ছেন। খবরের শিরোনামে এখন একটাই নাম ‘রানু মণ্ডল’। মুম্বইয়ের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে প্লে-ব্যাক গায়িকা হিসেবে এবার বোধহয় নিজের জায়গাটা পাকাই করে ফেললেন তিনি। কারণ হিমেশের পর সোনু নিগম এবং অস্কারজয়ী সংগীতকার এ আর রহমানও নাকি তাঁর সঙ্গে গান রেকর্ড করার উৎসাহ দেখিয়েছেন। আর তাই বোধহয় এবার পাকাপাকিভাবে মুম্বাইয়ের বাসিন্হদা হতে চলেছেন রানু। কিনতে চলেছেন ফ্ল্যাটও।
বার বার কলকাতা-মুম্বাই যাতায়ত করতে করতে বেজায় বিরক্ত রানু। কারণ, অল্প দিনের মধ্যেই একাধিকবার কলকাতা থেকে মুম্বাই যাতায়াত করা বেশ ক্লান্তিকরও। আর তাই এবার আরব সাগরের তীরে মায়া নগরীতেই পাকাপাকিভাবে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিতে মরিয়া রানু। তাঁর কথায়, “বার বার ফ্লাইটে করে মুম্বাই যাওয়া ভীষণ বিরক্তিকর। তাই এবার মুম্বাইতেই নিজের একটা বাড়ি বানাতে চাই।”
এর আগে খবর মিলেছিল রানুর গানে মুগ্ধ হয়ে সালমান খান তাঁকে ৫৫লাখের একটা ফ্ল্যাট উপহার দিয়েছেন। কিন্তু দিন কয়েক পর খবর চাউর হতেই সালমান ঘনিষ্ঠরা সে খবর উড়িয়ে দিয়েছেন।
এই রানু দিন কয়েক আগেই বলিউডের জনপ্রিয় সংগীতকার হিমেশের সঙ্গে ৩ নম্বর গানের রেকর্ডিংয়ের কাজ সম্পন্ন করেছেন। আর তাই মূল ধারার গণমাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই সুরসম্রাজ্ঞী কদর বেশ। প্রায় প্রতিদিনই কোনও না কারণে শিরোনামে আসছেন রানু। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও আলোচনা-পর্যালোচনার অন্ত নেই।
‘তেরি মেরি কাহানি’র পর বাংলার রানুকে দিয়ে আরও দুটি গান রেকর্ড করিয়ে ফেলেছেন হিমেশ রেশমিয়া। তার মধ্যে একটি ‘আদত’ এবং অন্যটি ‘আশিকি মে তেরি’। যা রীতিমতো হিট। তবে শ্রোতাদের শুধু একটাই আক্ষেপ, ‘গোটা গানটা কবে শুনতে পাওয়া যাবে?’ কারণ, আগের দুটো গানের ক্ষেত্রে শুধু কয়েক সেকেন্ডের টিজার দেখার সৌভাগ্যই মিলেছে। আর এতেই রানুকে নিয়ে জোয়ার ভাঙা উচ্ছ্বাস সবার মধ্যে। অতঃপর পুরো গান শোনার আশায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় রয়েছেন সবাই। তবে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে হিমেশ প্রযোজিত এবং অভিনীত ‘হ্যাপি হার্ডি অ্যান্ড হির’ মুক্তি পাওয়া পর্যন্ত। কারণ এই ছবিতেই ব্যবহৃত হবে রানুর গাওয়া তিনটি গান। এতো ব্যস্ততার জন্য মায়া নগরীতেই এবার বাসস্থান গড়তে চলেছেন রানু।
কে এই রানু
পুরো নাম রানু মারিয়া মণ্ডল। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা রানু মণ্ডল। ১৯৬৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগর জেলার কার্তিকপাড়া গ্রামে তাঁর জন্ম। বাবা আদিত্য কুমার। তিনি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ছিলেন। একেবারেই শৈশবেই মা–বাবাকে হারান রানু মণ্ডল। বড় হন অন্যের বাড়িতে। দারিদ্র্যের কারনে স্কুলে যাওয়া হয়নি। সুরেলা কণ্ঠ, পরিষ্কার উচ্চারণ আর সরলতাই হলো রানুর সম্পদ।রানু স্পষ্ট উচ্চারণে বাংলায় কথা বলেন । টুকটাক ইংরেজিও বলতে পারেন।
ভিডিও সাক্ষাৎকারে ছোটবেলার স্মৃতিচারণা করে রানু মণ্ডল বলেন, ‘এক শীতে পাড়ার ছোটরা পিকনিকে যাচ্ছে। কিন্তু আমাকে পিকনিকে নেওয়ার মতো কেউ নেই। মন খারাপ করে পিকনিকের বাসের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। শুনলাম মাইকে বাজানো হচ্ছে গানটা, “এক প্যায়ার কা নাগমা হ্যায়…”। পিকনিকে না যেতে পারলেও বাস থেকে বাজানো গানটা মনে ধরে যায়। সেই থেকে গান শুনলে আমি সব ভুলে যাই।’
মা–বাবা হারানো রানুর মন খুব খারাপ থাকত সব সময়। দুঃখ-কষ্ট বলার, শোনার মতো কেউ ছিল না তাঁর। এজন্য ক্যাথলিক চার্চে গিয়ে একা একা কাঁদতেন, প্রার্থনা করতেন। আক্ষেপ করে ঈশ্বরের কাছে বলতেন, সবার মা–বাবা আছে, তাঁর নেই! ছোটবেলা থেকেই দুঃখ-কষ্ট-দারিদ্র্য আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ছিল তাঁর। ।এসব ভুলে থাকার জন্যই গান গাইতেন। রাস্তায়, মানুষের বাসায় রেডিওতে গান শুনে শুনে গান মুখস্থ করতেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই তাঁর। মানুষের রেডিওই হলো তাঁর সংগীতের গুরু।
বিয়ে
রানুর বয়স যখন মাত্র ১৩ বছর, তখর তাঁর বিয়ে হয়। সে আরেক কাহিনি।বিয়েতে তিনি রাজি ছিলেন না। অনেকটা জোর করেই বাবুর্চি স্বামীর সঙ্গে তাঁকে বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়েছিল। এ নিয়ে থানায় অভিযোগ করেন। কিছু না করতে পেরে শেষ পর্যন্ত সংসার শুরু করেন। কিন্তু তাতে কপাল ফিরল না। স্বামীর আর্থিক অবস্থা মোটেই ভালো ছিল না। বেকার স্বামীর সংসার চালাতেন রানু। মানুষের বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজ করে সংসার চলতো। একসময় শুরু করেন ছোট্ট ব্যবস। ফেরি করে বিস্কুট বিক্রির এই ব্যবসা শুরুর পর পুনরায় কপাল পুড়ল। স্বামী মারা গেল রানুর। বিধবা, নিঃসঙ্গ রানু ল খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে বিস্কুট বিক্রি করতেন, গান শোনাতেন। ভালো গাইয়ে হিসেবে রানু পরিচিতি পান। সবাই পাগলি বলে ডাকতেন। বলতেন, ‘লতাকণ্ঠি রানু পাগলি’। এভাবে গান গেয়ে, মানুষের টুকটাক কাজ করে এক হাজার টাকার মতো জমান। কিন্তু দুভার্গ্য, একদিন সেই টাকাও চুরি যায়। এতে পোড়া কপাল রানুর কষ্ট আরও বাড়ে। মানুষের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে খাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। ঘুরতে ঘুরতে খিদে পেলে খাবারের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেন; যদি কেউ দয়া করে খাওয়ায় দুমুঠো।
এভাবে ভবঘুরের মতো বয়ে যাচ্ছিল রানুর জীবন।তাঁর দিন কাটছিল রানাঘাট রেলস্টেশনে । রোদে পুড়ে, বৃষ্টি ভিজে। অভাব–অনটনে এক সময় মানসিক ভারসাম্যও হারান কিছুটা।তখন অনেক কিছুই আর মনে করতে পারতেন না। তবে গানগুলো ঠিকই মুখস্থ ছিল রানুর। অনায়াসে গেয়ে ফেলেন ‘পান্না কি তামান্না হ্যায় কে হিরা মুঝে মিল যায়ে’ ও ‘এক প্যায়ার কা নাগমা হ্যায়’, ‘লাগ যা গালে’র মতো জনপ্রিয় গানগুলো।
একদিন সেখানে অতীন্দ্র চক্রবর্তী নামের এক যুবক রানু মণ্ডলের গান শুনে মুগ্ধ হলেন। সঙ্গে সঙ্গে মুঠোফোনে ভিডিও করেন। সেই ভিডিও ফেসবুকে আপলোড করেন। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে রানুর সেই ভিডিও। । অল্প সময়ের মধ্যে সেই ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়। বিশ্বের কাছে পৌঁছে যায় লতাকণ্ঠি রানু মণ্ডলের সুরেলা গান।
এরপর সেই রানুর এগিয়ে চলার শুরু। সবকিছু যেন গল্পের মতো, সিনেমার মতো বদলে যায়। রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্ম থেকে তিনি পৌঁছে যান বিমানবন্দরে। উড়লেন উড়োজাহাজে। গেলেন মুম্বাই। প্লে-ব্যাক হরো। প্লে-ব্যাকের আগে রানু কে পারলারে নেওয়া হল। পায়ের নখ থেকে মাথার চুল—সবকিছুই সাজসজ্জা করে তাঁকে ঝকঝকে করা হলো।
রানু স্বপ্নেও ভাবেননি তাঁর গান এভাবে সবাইকে মুগ্ধ করবে, এভাবে লটারি পাওয়ার মতো ভাগ্য বদলে যাবে। তবে তাঁর ভাগ্যে হয়তো লেখা ছিল এমনটাই। রানাঘাটের স্টেশনের ভবঘুরে জীবন থেকে মুম্বাইয়ের রেকর্ডিং স্টুডিও—রানুর কাছে এ যেন সবই স্বপ্নের মতো।
রানু মণ্ডল যেন বনে-বাদাড়ে ফোঁটা অলক্ষ্যের বুনোফুল। দূ স্বামী, সন্তান, ঘর—সব হারিয়ে গেলেও তাঁর জীবনে রয়ে গেছে শুধু গান। তাঁর সুমধুর কণ্ঠ, তাঁকে আজ তারকা খ্যাতি দিয়েছে। রানুর এই এগিয়ে চলায় খুশী রানু ভক্তরাও।