ছোটপর্দার জনপ্রিয় মুখ ফারহান আহমেদ জোভান। তিন বছর আগেও তাকে কেউ চিনতো না। কিন্তু এখন তিনি সবার প্রিয় মডেল ও অভিনেতা জোভান। এখন তাকে নাটক-বিজ্ঞাপনে অভিনয় করানোর জন্য অনেক নির্মাতাদের শিডিউল হাতে অপেক্ষা করতে হয়!
বর্তমানে বেশ কিছু ধারাবাহিক নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন জোভান। তার অভিনীত বেশ কয়েকটি সিরিয়াল প্রচার হচ্ছে নানা টিভি চ্যানেলে। পাশাপাশি তিনি কাজ করেছেন দেশের বিভিন্ন বড় সব বিপণন প্রতিষ্ঠানের পণ্যের বিজ্ঞাপনে। তার অভিনীত প্রায় কাজই দর্শক সমাদৃত। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা জোভান কথা বললেন বিনোদন বিভাগে তার ব্যস্তময় জীবন ও কাজের নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে-
প্রশ্ন : ব্যস্ততা নিয়ে বলুন…
জোভান : আমার যাবতীয় ব্যস্ততা এখন অভিনয়কে ঘিরে। বেশ কিছু সিরিয়ালের কাজ করছি। এরমধ্যে দেশ টিভিতে ‘নাইন অ্যান্ড অ্যা হাফ’, এনটিভিতে ‘হাউজ ৪৪,’ মাছরাঙা টিভিতে ‘নয় ছয়’ প্রচারিত হচ্ছে। আর নতুন ধারাবাহিক শুরু করলাম মাবরুর রশিদ বান্নাহ’র ‘ব্যাকবেঞ্চারস’।
পাশাপাশি ঈদের কাজ শুরু হয়েছে। বাড়তি ব্যস্ততা। এবার বেশ কিছু একক নাটক নিয়ে থাকছি ভিন্ন ভিন্ন চ্যানেলে। এরইমধ্যে শেষ করেছি পলায়ন বিদ্যা, হতাশা চর্চাকেন্দ্র, প্রেমিক আবশ্যক, লাভ ইউ টার্ন। আরো বেশ কিছু নাটকের শুটিং বাকি আছে। তারমধ্যে পুরান ঢাকার গল্পে লিওনেল রাকিন ভাইয়ের ‘পিং পং’ নামের খুব মজার একটি স্ক্রিপ্টে কাজ করবো। নাটকটিতে আমার বিপরীতে সাবিলা নূর থাকবেন। সবি মিলিয়ে আসছে ঈদে দর্শক আমার প্রায় ডজন খানেক নাটক-টেলিছবি দেখতে পাবেন।
প্রশ্ন : সম্প্রতি একটি মিউজিক ভিডিওতে কাজ করেছেন। কেমন অভিজ্ঞতা হলো?
জোভান : দারুণ। ভিডিওটি খুবই সুন্দর হয়েছে। শাওন গানওয়ালার কন্ঠে গাওয়া ‘ইচ্ছে মানুষ’ শিরোনামের গানটিও বেশ শ্রুতি মধুর। গান ও ভিডিও মিলিয়ে বেশ উপভোগ্য হবে। এটি আমার দ্বিতীয় মিউজিক ভিডিও। নির্মিত হয়েছে প্রক্ষাগৃহের ব্যানারে। এখানে আমার সহশিল্পী নাদিয়া। মিউজিক ভিডিওটিতে আমি এবং নাদিয়া স্বামী-স্ত্রীর ভূমিকায় হাজির হবো। গানটি খুবই চমৎকার। গানের মিউজিক ভিডিওটিতে একটি রোমান্টিক গল্প আছে। শিগগিরই ভিডিওটি প্রকাশ পাবে বলে শুনেছি।
প্রশ্ন : সর্বশেষ আপনার অভিনীত ‘মোমেন্টস’ শর্টফিল্মটিতে কাজ করে কেমন সাড়া পেলেন?
জোভান : এই ক’বছরের ক্যারিয়ারের অন্যতম সফল একটি কাজ ছিল ‘মোমেন্টস’ শর্টফিল্মটি। বিলিভ ইট অর নট, বাট ইটস ট্রু দ্যাট- আমি কাজের সময় কিংবা কাজ করার আগে একটিবারের জন্য ভাবিনি যে ‘মোমেন্টস’ এতটা সুপারহিট হবে। ভিকি জাহেদের রচনা ও পরিচালনায় স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচিত্রটির প্রোডাকশন হাউজ মোশন ভাস্কর নির্মাণ করেছে। আমার শিল্পী ছিল অনামিকা সরকার। গেল মার্চের ২৯ তারিখ এটি প্রকাশ হয়। আজ পর্যন্ত প্রায় ৩৫ লাখ বার দেখা হয়েছে। দারুণ উচ্ছ্বাস কাজ করছে মনের ভিতর। আমাদের দেশের কোনো শর্টফিল্ম এত বার দেখা হয়েছে কিনা সেটা আমার জানা নেই। আমি জানি, ফরেন কান্ট্রিগুলোতে শর্ট ফিল্মের অনেক কদর আছে। আমি মনে করি ধীরে ধীরে আমাদের দেশেও এই প্রচলনটা হবে। বিশেষ করে চারপাশের মানুষ আমার এই কাজটি নিয়ে এত প্রশংসা করেছে যে আমি খুব আশাবাদী। নিজের অভিনয় নিয়েও আমি আশাবাদী। আসলে এসব প্রশংসা থেকেই অনুপ্রেরণা কাজ করে যে আমি কিছু একটা করতে পারবো।
প্রশ্ন : তাহলে তো আগামীতে নতুন শর্ট ফিল্মে দেখা যাবে?
জোভান : অবশ্যই। ভালো গল্প ও নির্মাণের নিশ্চয়তা পেলে আমি সবসময়িই শর্টফিল্মে কাজ করবো। কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো ‘মোমেন্টস’র পরিচালকের আরো একটি ছবিতে কাজ করা হবে। স্ক্রিপ্ট হাতে পেয়েছি। মনে হচ্ছে এই কাজটি আরও ভালো হবে। সত্যি খুবই ভালো একটি গল্প আসছে এবারের শর্টফিল্মে। আমার বিপরীতে কে থাকবেন সেটা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। বিস্তারিত জানা যাবে আরো কিছুদিন পর।
প্রশ্ন : আপনি যে নাটকগুলোতে কাজ করেন সেগুলো বলা যায় প্রায় সবই শহুরে চরিত্রের আদলে। কেন বলুন তো?
জোভান : আসলে এটা নির্মাতারাই ভালো বলতে পারবেন। তারা পাবলিক রেসপন্স ভালো দেখে আমাকে কাজে নেন। এই ব্যাপারটা আমিও অনুধাবন করেছি। তবে আমি চাই সব ধরণের গল্প ও চরিত্রে কাজ করতে। বিশেষ করে আমার খুব ইচ্ছে আছে আমি বরিশালের ভাষায় একটি নাটকে কাজ করবো। কারণ আমার নানুর বাড়ি বরিশাল।
প্রশ্ন : একজন দর্শক হিসেবে আজকালকার নাটক-টেলিছবিগুলো আপনি কীভাবে মূল্যায়ণ করবেন?
জোভান : প্রথমেই বলবো খুব ভালো। নাটকে গল্পের মানে হয়তো কিছু আক্ষেপ আছে দর্শকের। তবে সেগুলোকে নির্মাণের মুন্সিয়ানায় যে রুপটা দেয়া হচ্ছে তার প্রশংসা করতেই হবে। সময়ের সাথে সাথে মানুষের চিন্তা এবং রুচিরও পরিবর্তন হচ্ছে। তার সাথে তাল মিলিয়ে বদলেছে নাটক-টেলিছবির গল্প, নির্মাণ ও সংলাপ। এমনকী অভিনয়ের ধরণেও এসেছে পরিবর্তন। আজকাল তরুণ জেনারেশনদের নিয়ে যেসব নাটক নির্মিত হচ্ছে সেগুলো মানুষ গ্রহণ করছেন। আবার সব নাটক যে ভালো হচ্ছে তাও কিন্তু ঠিক না। অনেক নাটক আছে যেগুলোতে জোর করে মানুষ হাসানো হচ্ছে। ভালো কাজের ভিতর খারাপ কাজও হচ্ছে। সেগুলো সম্পর্কে গণমাধ্যম, শোবিজ- সবাই অবগত। তাই আমার কিছু বলার নেই। আমি শুধু বলবো, যেটা ভালো সেটাই ঠিকে থাকবে।
প্রশ্ন : আপনি অনন্য মামুন পরিচালিত ‘অস্তিত্ব’ ছবিতে অভিনয় করেছেন। আগামী ৬ মে ছবিটি মুক্তি পাচ্ছে। এ বিষয়ে বলুন..
জোভান : অস্তিত্ব ছবিতে কাজ করাটা অনেকটা হুট করেই হয়ে গেছে। এটি অটিস্টিক শিশুদের গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে। ছবিতে আমি নুসরাত ইমরোজ তিশার ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছি। অস্তিত্ব ছবিতে কাজ করেছি তার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে এ ছবির গল্প এবং স্ক্রিপ্ট। যখন আমার হাতে আসে আমি চিত্রনাট্যটা তখন মনযোগ দিয়ে পড়ি। কয়েকবার পড়েছি। অসাধারাণ লেগেছিল। প্রতিবারই পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। আসলে স্ক্রিপ্টটা পড়ে এত ভালো গেলেছিল যে আর না করতে পারিনি। ছবিতে আমার চরিত্রের ব্যাপ্তি ছোট হলেও আমার বিপরীতে একজন নায়িকা আছে এবং এবং গানও আছে। অস্তিত্ব খুব সুন্দর একটি ম্যাসেজ নিয়ে আসছে। পরিচালক থেকে শুরু করে ছবিটির সঙ্গে জড়িত আমাদের প্রত্যেকের অনেক প্রত্যাশা ‘অস্তিত্ব’ নিয়ে।
প্রশ্ন : চলচ্চিত্রে নিয়মিত হওয়ার ইচ্ছে আছে?
জোভান : অবশ্যই আছে। আমি চলচ্চিত্রে কাজ করাটা অনেক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখি। কারণ এখানে হিউজ পরিমাণে দর্শক আছেন। একটি সিনেমায় কাজ করে অনেক মানুষের কাছে যাওয়া যায়, অনেক মানুষের ভালোবাসা পাওয়া যায়। আমিও চলচ্চিত্রে প্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন দেখি।
প্রশ্ন : চলচ্চিত্রে কাজের ভাবনা নিয়ে আরো কিছু বলুন…
জোভান : চলচ্চিত্রে কাজ করার আগে আমি ছবির গল্প এবং চিত্রনাট্য দেখবো-বুঝবো। আমি চরিত্র থেকে দর্শকরা ভিন্ন এবং নতুন কি পাবেন সেটা আগে দেখবো। হোক সেটা ছোট কিংবা বড় চরিত্র। আর একটা বিষয় বলে রাখছি- আমাদের দেশে কিছু বাণিজ্যিক ঘরানার ছবি নির্মিত হয় যেগুলোতে আমার আমার কাজের ইচ্ছে নেই। আমি ওইসব ছবির জন্য প্রস্তুত না। আমি চাই মৌলিক গল্পের ছবিতে কাজ করবো। তাছাড়া আমাদের দেশে এখন অনেক মেধাবী নির্মাতারা ছবি নির্মাণ করছেন। অনেক ভালো ছবি তৈরি হচ্ছে। সেসব ছবিতে কাজ করার ইচ্ছে আছে।
প্রশ্ন : এবার একটু শুরুর গল্প শুনি। অভিনয়ে আসা হলো কীভাবে?
জোভান : আমি অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে আজকে এই স্থানে এসেছি। ছেলেবেলা থেকেই প্রিয় মানুষদের অভিনয় দেখে দেখে মনের মধ্যে অভিনয়ে ইচ্ছে তৈরি হতো। খুব কষ্ট হতো ভেবে যে আমি কোনোদিন অভিনয় করতে পারব না। কারণ আমার জন্য কোনো সুযোগ ছিলো না। অভিনয় করার একটা প্রবল আগ্রহ সবসময় ফিল করতাম। কিন্তু কোনো কূলকিনারা পাচ্ছিলাম না। সময়টা ছিল ২০১১ সাল। বেশ কিছু অ্যাজেন্সিতে ছবি জমা দিয়ে রেখেছিলাম। হঠাৎ একদিন অডিশনের জন্য কল করা হলো পরিচিত এক বিজ্ঞাপন নির্মাতার অফিসে। তখন আমি মনে করেছি এই বুঝি কপাল খুলল! কিন্তু অডিশন দিতে গিয়ে হতাশ হয়ে ফিরেছি। এরপর ২০১৩ সালের মাঝামাঝি আরো প্রায় দুই ডজন টিভি বিজ্ঞাপনে অডিশন দিয়েছি। কিন্তু প্রতিবারই শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছে। তবে এরমধ্যে বেশ কিছু বিজ্ঞাপনে সাইড আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করেছি। অবশেষে ২০১৩ সালের শেষের দিককার কথা। অডিশন দিতে দিতে এতটাই নিরাশ হয়েছিলাম যে পরে আর ডাক পেয়েও যেতাম না। কিন্তু একদিন বন্ধু সিয়াম জোর করে নিয়ে গেলো একটি নাটকের অডিশনে। গিয়ে দেখি অনেক প্রতিযোগী। প্রথম দিন সিয়ামকে বাছাই করা হলেও আমাকে খালি হাতে ফিরে আসতে হয়।
কিন্তু কয়েক দিন বাদে আবারো ডাক আসে এবং সেবারই প্রথম বলার মতো একটা কাজ জোটে। আতিক জামানের ‘ইউনিভার্সিটি’ ধারাবাহিকে প্রথম অভিনয় করি। নাটকটি প্রচারের পর থেকে সবাই আমাকে প্রশংসা করেছে। এরমধ্যে কয়েকটি বিজ্ঞাপনেও কাজ করা হয়ে গেল। কিন্তু সেগুলো খুব ভালো হয়নি। এরপর বাংলালিংকের ‘আমি ঘুরি সারা বাংলাদেশ’ নামের একটি বিজ্ঞাপনে কাজ করি। ওটা দিয়েই বাজিমাত! বলা চলে এই বিজ্ঞাপনটি আমার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট। এরপর তো ছুটে চলছিই প্রতিষ্ঠার পথে। সুযোগটা যখন পেয়েছি, কিছু ভালো কাজ করে সবার অন্তরে থেকে যেতে চাই।
প্রশ্ন: এখনো পর্যন্ত আপনার অভিনীত উল্লেখযোগ্য কিছু নাটকের নাম বলুন…
জোভান : ঝালমুড়ি, হাউজ নম্বর ৪৪, নাইন অ্যান্ড আ হাফ সিরিয়ালগুলো ছাড়াও রয়েছে ব্রাদার্স, ট্রিপটিন, শর্টফিল্ম মোমেন্টস, পুরান ঢাকার বাখরখানি নামের খন্ড নাটকগুলো। আর গেল ভালোবাসা দিবসের ‘শত ডানার প্রজাপতি’ আমাকে নতুন করে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। আরো অনেক ভালো ভালো কাজ করেছি যেগুলোর কোনোটার গল্প ভালো ছিল, কোনোটার আবার চরিত্র। তাছাড়া আমার আপকামিং কাজগুলোও খুব ভালো হবে বলে আশা করছি।
প্রশ্ন : নিজের ভাল-মন্দ দিক…
জোভান : আমার ভালো দিক হচ্ছে আমি অনেক ধৈর্য্যশীল। আমি ধৈর্য্যশীল বলেই আজ এতোদূর আসতে পেরেছি। তা না হলে কোনোদিনও এখানে আসা সম্ভব হতো না। তবে এর পেছনে অবশ্যই সকলের সার্পোট ছিল। আর খারাপ দিক হচ্ছে আমি নিজের পরিবারকে একদমই সময় দিতে পারিনা। আর ইদানিং এত ব্যস্ততা বেড়ে গেছে যে পরিবার থেকেও মা-বাবা সবাই ভালোভাবে নিচ্ছেন না ব্যাপারটা। ভাবছি নতুন করে কিছু প্ল্যান করে পরিবারের জন্য সময় রাখতে হবে।
প্রশ্ন : আপনার লেখাপড়া এবং পরিবার সম্পর্কে বলুন….
জোভান : ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে (ইউআইইউ) বিবিএ-তে পড়ছি। গ্রাজুয়েশন শেষ হতে তিনটি সেমিস্টার বাকি আছে। তবে আমার ইচ্ছে আছে এমবিএ করবো দেশের বাইরে গিয়ে। আর পরিবারে আমার বাবা-মা আছেন এবং ছোট একটা বোন আছেন। বাবা আমেরিকাতে থাকেন। মায়ের পরে তাই বাড়িতে আমিই মুরুব্বী।