সফল হওয়ার আগে ব্যর্থ হও তবে

ডিসেম্বর ৯, ২০১৮
Spread the love

রাকিবুল ইসলাম
সফলতার সংজ্ঞা কি? এর উত্তরে একজন বলেছেন, সফলতা হল সাত বার পড়ে গিয়ে আট বার উঠে দাঁড়ানো। পৃথিবীতে ব্যর্থতা ব্যতীত সফলতার কোন নজির নেই। পৃথিবীর সকল সফল ব্যক্তিই এ ব্যর্থতাকে সঙ্গী করে বড় হয়েছেন। উদ্যোক্তা কিংবা রাজনীতিবিদ, সঙ্গীতশিল্পী কিংবা খেলোয়ার, অভিনয় শিল্পি থেকে বিজ্ঞানী- সব ক্ষেত্রেই ব্যর্থতার ভুরি ভুরি উদাহরণ পাওয়া যাবে।  টমাস আলভা এডিসন থেকে আলিবাবার জ্যাক মা, কিংবা কেএফসির প্রতিষ্ঠাতা কর্ণেল স্যান্ডার্স থেকে ম্যাকডোনাল্ডসের রে ক্রক- সবাই তাঁদের জীবনের প্রথম দিকে চরম ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। আজ আমরা রকম কয়েকজনের ব্যর্থতার গল্প জানব-

টমাস আলভা এডিসন

স্কুলের শিক্ষক তাঁকে বলেছিলেন, “লেখা পড়ার জন্য অযোগ্য ব্যক্তি”। তিনি “যথেস্ট” কর্মোদ্যমী না হওয়ার কারনে তার প্রথম দুই চাকরি থেকে বহিস্কার করা হয়। আবার তিনি-ই শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার বৈদ্যুতিক বাল্বের আবিস্কারক। টমাস আলভা এডিসন।

১০০০০ বার চেষ্টার পরে তিনি এ বৈদ্যুতিক বাল্ব আবিষ্কার করতে সমর্থ হন। এক সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন যে তিনি নিজেকে ৯৯৯৯ বার ব্যর্থ ভাবেন কি না। এডিসন এর উত্তরে বলেন- আমি ৯৯৯৯ বার ব্যর্থ হইনি, আমি শিখেছি যে ওই ৯৯৯৯ ভাবে বাল্ব বানানো সম্ভব না।

টমাস আলভা এডিসন শুধু আমেরিকায় ১০৯৩ টি পেটেন্ট এর মালিক। এছাড়াও কানাডা ও ইংল্যান্ডে তাঁর আরও কিছু পেটেন্ট রয়েছে।

জ্যাক মা

বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ কোম্পানী অনলাইন কেনাবেচার সাইট “আলীবাবা”র প্রতিষ্ঠাতা ব্যর্থতার জ্বলন্ত উদাহরণ! জ্যাক মা প্রাইমারি স্কুলে দুবার অকৃতকার্য হন। হাইস্কুলে ৩ বার ফেল করেন তিনি। কলেজে ৩ বার ভর্তি পরীক্ষা দেন, প্রথম দুই বারই বাদ পড়েন।

তৃতীয় বারের চেষ্টায় ভর্তি হওয়ার পরে প্রথম টেস্ট পরীক্ষায় গনিতে ১২০ মার্ক এর মধ্যে ১ নম্বর পান। কোনও রকমে কলেজ শেষ করে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ১০ বার ভর্তির আবেদন করেন, কিন্তু ভর্তি হতে পারেন নি।

হার্ভার্ডে ব্যর্থ চেস্টার পরে তিনি স্থানীয় কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। লেখা পড়ার শেষেই তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সর্বমোট ৩০ টি ইন্টারভিউ দেন কিন্তু কোথাও চাকরি হয় নি তাঁর। পুলিশে আবেদন করেন। ৬ জন আবেদনকারীর মধ্য থেকে পুলিশ ৫ জন কে নিয়োগ দেয়- জ্যাক মা বাদ পড়ে যান। এমনকি বিখ্যাত রেস্টুরেন্ট কেএফসি তে তিনি কাজের জন্য যান। সেখানে ২৪ জনের মধ্য থেকে মা বাদে বাকি ২৩ জনকে নেয়া হয়।

এতবার ব্যর্থ হওয়ার পরে তিনি ভাবেন যে, তিনি যেসব কাজে ব্যর্থ হয়েছেন, সে কাজগুলো হয়ত তাঁর জন্য নয়। এ ভাবনা থেকেই তিনি অনলাইনে বেচা কেনার সাইট “আলীবাবা” প্রতিষ্ঠা করেন।

জ্যাক মা এখন চীনের সবথেকে ধনী ব্যক্তি।৩৫.৭ বিলিয়ন ডলারের মালিক তিনি। প্রতিবছর ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে তিনি অর্থনীতি বিষয়ে অন্যতম বক্তা থাকেন। বেশ কয়েকটি বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেছেন। আলীবাবা বিশ্বের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা দামী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম।

কর্ণেল স্যান্ডার্স

কেএফসির নাম আমরা সবাই জানি। মাঝে-মধ্যেই কেএফসিতে বসে সেলফি তুলি আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করি। কিন্তু এ রেস্টুরেন্টটির প্রতিষ্ঠাতা কর্ণেল স্যান্ডার্স এর প্রথম দিন গুলি মোটেই সুখকর ছিল না। অনেক চড়াই-উতরাই পার করতে হয়েছে তাঁকে।

মাত্র ৫ বছর বয়সে বাবা মারা যাওয়ার পরে স্যান্ডার্স তাঁর তিন ছোট ভাই বোনকে দেখাশোনা শুরু করেন। কাজের জন্য তাঁর মা বাইরে যেতেন। এসময় স্যান্ডার্সকে সকলের জন্য খাবার তৈরি করতে হত। ৭ বছর বয়সেই তিনি এক রকম পাকা রাঁধুনি হয়ে যান। ১০ বছর বয়সে তিনি অন্যের ফার্মে কাজ করা শুরু করেন। তার দুই বছর পরে মা অন্যত্র বিয়ে করলে স্যান্ডার্স আলাদা থাকা শুরু করেন। কয়েকবছর পরে তিনি একটি ফার্মের মালিক হন। চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন রকমের পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।

১৯৪০ সালের দিকে তিনি একটি রেস্টুরেন্ট এর উদ্যোগ নেন কিন্তু শুরুর চার মাসের মাথায়ই আগুন লেগে সবকিছু ভস্মীভূত হয়ে যায়। পরবর্তী দশ বছরে তিনি আরো তিনটি রেস্টুরেন্ট দেন কিন্তু একটিও সফলতার মুখ দেখেনি। ১৯৪৭ সালে তার বিবাহবিচ্ছেদ ঘটায় তিনি কিছুটা একাকিত্বের মধ্যে পড়ে যান।

১৯৫৫ সালে ৬৫ বছর বয়সের স্যান্ডার্স তাঁর রান্নাঘরে বসে বিভিন্ন নতুন রেসিপি তৈরি করার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে তিনি সুস্বাদু “চিকেন ফ্রাই” তৈরি করে ফেলেন। তিনি ভেবে দেখেন যে, আমেরিকার আগে কেউ এ ধরনের মজার “চিকেন ফ্রাই” খায় নি। তিনি ঘর থেকে বের হয়ে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টের কাছে তাঁর এ নতুন রেসিপিটি বিক্রি করার চেষ্টা করেন, কিন্ত ১০০৯ বার পর্যন্ত কেউই তাঁর রেসিপিটি চেখে দেখতে রাজি হন নি।

এক হাজার দশ তম বারে জন্ম হয় কেএফসির।

স্টিভ জবস

স্টিভ জবস ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কুমারী মাতার সন্তান। জবসের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেওয়া তাঁর মাতার পক্ষে সম্ভব ছিল না। জবসের মা চাইতেন তাঁর সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুক। এজন্য তিনি পরবর্তীতে এক আইনজীবী ও তাঁর স্ত্রীর নিকট জবসকে দত্তক দেন।

ওই পরিবার অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছ্বল না হলেও শর্ত অনুযায়ী জবসকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করেন।  বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে ডরমিটরিতে জবসের কোন রুম ছিল না। তিনি বন্ধুদের রুমের মেঝেতে থাকতেন। ব্যবহূত কোকের বোতল ফেরত দিয়ে তিনি পাঁচ সেন্ট করে কামাই করতেন, যেটা দিয়ে খাবার কিনে খেতেন। প্রতি রোববার রাতে তিনি সাত মাইল হেঁটে হরেকৃষ্ণ মন্দিরে যেতেন শুধু একবেলা ভালো খাবার খাওয়ার জন্য।

কিছুদিন পরে মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি তাঁর বন্ধু স্টিভ ওজনিয়াকিকে অ্যাপল কম্পিউটার খোলার উদ্যোগ নেন। কিন্তু তাঁদের কোন অফিস রুম ভাড়া দেয়ার মত পুঁজি ছিল না।এরপরে তিনি তাঁদের বাড়ির গ্যারেজে তাঁদের কোম্পানির কার্যক্রম শুরু করেন।

বর্তমানে অ্যাপল বিশ্বের ইতিহাসে সব থেকে মূল্যবান কোম্পানি যার বাজারমূল্য প্রায় ৭০০ বিলিয়ন ডলার। ২০১১ সালে স্টিভ জবস মারা যাওয়ার পূর্বে ১০ বিলিয়ন ডলারের মালিক ছিলেন।

অপরাহ উইনফ্রে

স্টিভ জবস এর মত অপরাহ উইনফ্রে ও কুমারী মাতার সন্তান ছিলেন। খুব দারিদ্রের মধ্যে তিনি বড় হন। ছেলেবেলার বেশিরভাগ সময় কেটেছে নানীর কাছে। গ্রামে থাকাকালীন সময়ে তিনি গৃহপালিত পশু গুলোর সাথে একাকী কথা বলতেন।

অপরাহ উইনফ্রে ৯ বছর বয়স থেকে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর কিছু নিকটাত্মীয় দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হন। খুব চাপা স্বভাবের মেয়ে হওয়ায় তিনি কাউকে এ বিষয়ে জানান নি। দিন দিন তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে তিনি একা বাড়ি থেকে বের হয়ে যান।

১৭ বছর বয়সে তিনি স্থানীয় একটি সুন্দরী প্রতিযোগিতায় জিতে যান। এরপর একটি রেডিও স্টেশনে চাকরি পান তিনি। মিডিয়ার প্রতি দুর্বলতা চলে আসে তাঁর। তিনি পরবর্তীতে একটি টেলিভিশন চ্যানেলে সংবাদ উপস্থাপিকা হিসেবে চাকরি নেন। কিন্তু কিছুদিন পরেই তাঁকে চাকরি থেকে বহিস্কার করা হয়। কারন- তিনি সংবাদ পড়ার সময়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়তেন।

চাকরি হারিয়ে তাঁর ঠিকানা হয় শিকাগো টেলিভিশনে। সেখানে তিনি একটি টক শো শুরু করেন যা “অপরাহ উইনফ্রে শো” নামে পরিচিত পায়। তাঁর টক শো দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ২০০৬ সাল থেকে ফোর্বস ম্যাগাজিন তাঁকে বেশ কয়েকবার ‘বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী নারী’ হিসেবে অভিহিত করে।

অপরাহ উইনফ্রে এখন কয়েক বিলিয়ন ডলারের মালিক যার মধ্যে তাঁর মিডিয়া ব্যবসা রয়েছে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের।

আব্রাহাম লিংকন

 

১৮০৯ সালে জন্ম নেয়া আমেরিকার এ রাস্ট্রপতিও জীবনে কম বার ব্যর্থ হন নি। ২৩ বছর বয়সে তিনি তাঁর প্রথম চাকরি হারান। তার তিন বছর পরে তার প্রেমিকাকে হারান। তারও তিন বছর পরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের “হাউস অব রিপ্রেজেন্টিভ” এর স্পীকার পদে নির্বাচন করে হেরে যান।

৩৯ বছর বয়সে ভুমি অফিসের কমিশনার নির্বাচনে হারেন তিনি। এরপর দশ বছর পরে যখন তাঁর বয়স ৪৯, তখন তিনি সিনেট নির্বাচনে পরাজিত হন।

ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিকভাবে অনেক ব্যর্থতার পরেও লিংকন হাল ছাড়েন নি।  ১৮৪৬ সালে “হাউস অব রিপ্রেজেন্টিভ” এর স্পীকার নির্বাচিত হন তিনি। সে মেয়াদেই তিনি বহুল আলোচিত দাসপ্রথা বিলুপ্ত করেন যা তাঁকে জনগনের নিকট ব্যাপক জনপ্রিয় করে তোলে।

১৮৬১ সালে ৫২ বছর বয়সে আব্রাহাম লিংকন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তাঁকে ইতিহাসের অন্যতম ক্ষমতাধর ও জনপ্রিয় রাষ্ট্রপতি হিসেবে অভিহিত করা হয়। আমেরিকার পাঁচ ডলারের নোটে তাঁর অবয়ব ছাপানো হয়। তাঁর পুত্রের স্কুলের প্রধান শিক্ষকের নিকট আব্রাহাম লিংকনের চিঠি ঐতিহাসিক মর্যাদা লাভ করে।   

Comments are closed