বিখ্যাত ছয় খোজার গল্প

সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৭
Spread the love

আয়না২৪ ডেস্ক

পুরুষাঙ্গ বা শুক্রথলী কিংবা দুটোই কেটে ফেলে একজন পুরুষকে খোজা বা নপুংসক বানানো ইতিহাস বেশ পুরনো। নিজেদের অপূরণীয় এই শারীরিক ক্ষতিকে মেনে নিয়েও এমন ব্যক্তিদের মাঝে এমন কিছু মানুষও আছেন, যারা তাঁদের ব্যক্তিগত  কাজকর্মের মাধ্যমে নিজেদের  স্মরণীয় রেখেছেন পৃথিবীতে। তেমনই ছয়জন খোজার কাহিনীর  পড়ুন এই লেখায়।

থমাস করবেট

আজ যেসব মানুষকে নিয়ে আলোচনা করা হবে, তাদের সবাইকে ইচ্ছার বিরুদ্ধেই খোজা করা হয়েছিলো। তবে এদের মাঝে একেবারেই ব্যতিক্রম খমাস করবেট কারণ তিনি যে স্বেচ্ছায়ই খোজা হয়েছিলেন!

সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায় করবেটের স্ত্রী। ভালোবাসার মানুষটির মৃত্যু তাকে ভীষণভাবে পীড়া দেয়। কিন্তু কিছুদিন পর এক অদ্ভুত বিষয় খেয়াল করেন তিনি। শারীরিক চাহিদা কিছুতেই দমাতে পারছেন না তিনি। এমনকি এ চাহিদা মেটাতে পতিতালয়ে যাবার দুর্দমনীয় ইচ্ছাও জেগে উঠেছিলো তার মনে। এমন পাপ কাজ করতে কিছুতেই মন সায় দিচ্ছিলো না করবেটের। ওদিকে শরীরও যেন মানতে চাইছিলো না পাপ-পূণ্যের বিভেদ।

থমাস করবেট

এমন দোটানায় পড়ে এক বিচিত্র কাজ করে বসলেন করবেট। হাতে একজোড়া কাঁচি তুলে নিলেন তিনি, চালিয়ে দিলেন সোজা নিজের অণ্ডকোষ বরাবর! শুনতে একেবারেই অবিশ্বাস্য ও অদ্ভুত শোনালেও ঠিক এ কাজটিই করেছিলেন তিনি। এরপর তিনি অংশ নেন এক প্রার্থনা সভায়। সেখানে রাতের খাবার শেষ করে চিকিৎসকের কাছে গিয়ে ক্ষতের চিকিৎসা নেন তিনি।

অবশ্য নিজেকে নিজে খোজা করার মতো কাজের জন্য কিন্তু মানুষ তাকে মনে রাখে নি। মানুষ তাকে মনে রেখেছে আরো বিরাট পরিসরের এক কাজের জন্য। মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের খুনীর নাম জন উইল্কিস বুথ। আর এই বুথকেই শেষ করে দিয়েছিলেন থমাস করবেট! প্রেসিডেন্ট লিঙ্কনকে খুন করার পর পালিয়ে এক শস্যাগারে আশ্রয় নেয় বুথ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে নির্দেশ ছিলো তারা যেন বুথকে যেভাবেই হোক জীবিত ধরে আনে। এজন্য ভেতরে থাকা বুথকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছিলো তারা। ওদিকে করবেট দেখেন, দেয়ালের ফুটো দিয়ে তিনি ঠিকই বুথের দেহটা দেখতে পাচ্ছেন। তাই আর দেরি না করে খুনীর দেহটা লক্ষ্য করে গুলি চালান করবেট। আর এতেই ভবলীলা সাঙ্গ হয় বুথের।

 পথিনাস

খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে মিশরের সবচেয়ে প্রভাবশালী খোজা ছিলেন পথিনাস। রোমান নথিপত্রে তাকে একজন খলনায়ক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে রোমের সেই নথিগুলো পক্ষপাতদুষ্ট ছিলো বলেও শোনা যায়।

ফারাও ত্রয়োদশ টলেমীকে আপন বোন ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছিলেন তিনি। রোমান রিপাবলিকের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতা পম্পে দ্য গ্রেট জুলিয়াস সিজারের সাথে যুদ্ধে হেরে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি পালিয়ে যান মিশরে। মিশরে পৌঁছানোর পর শিরশ্ছেদের মাধ্যমে তাকে হত্যা করা হয়। অনেকেই মনে করেন, এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে পথিনাসের হাত ছিলো। পথিনাস যে ভালোই ক্ষমতাধর ছিলো, তা বোঝা যায় সিজার মিশরে আসার পর। সেখানে সবার সামনে সিজারকে উপহাসের পাত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। সিজার সেটা মুখ বুজে সহ্যও করে নেন। কিন্তু পরবর্তীতে যখন সিজারকে হত্যার ষড়যন্ত্রে পথিনাসের নাম এলো, তখন আর তিনি চুপ করে থাকতে পারলেন না। তার নির্দেশেই পথিনাসকে পরপারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। 

 স্পোরাস

সম্রাট নিরো

 স্পোরাসের কাহিনী শুনে ছেলেটিকে বেশ দুর্ভাগাই মনে হতে পারে। সম্রাট নিরোর এক স্ত্রী ছিলো, যার নাম স্যাবাইনা। অন্তঃসত্ত্বা স্যাবাইনার উপর একবার মারাত্মক ক্ষেপে যান সম্রাট। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে স্ত্রীর তলপেটে ক্রমাগত লাথি মেরে যেতে থাকেন তিনি, যতক্ষণ না স্যাবাইনা মারা যায় ততক্ষণ। এরপর যখন মেয়েটি আসলেই মারা গেলো, যখন সম্রাটের রাগের মাত্রা কমে এলো, তখন তার পরিতাপের শেষ রইলো না। রাগের মাথায় তিনি যে আসলে নিজের কত বড় ক্ষতি করে ফেলেছেন তা তিনি তখন বুঝতে পারলেন। কারণ সম্রাট নাকি সত্যি সত্যিই স্যাবাইনাকে ভালোবাসতেন (এ কেমন ভালোবাসা)!

স্যাবাইনা

তখন তো আর স্যাবাইনাকে ফিরিয়ে আনার উপায় নেই, ওদিকে নিরো স্যাবাইনাকে ফিরিয়ে আনতে বদ্ধ পরিকর। তাই তিনি এমন এক কাজ করে বসলেন, যা শুনলে বিস্ময়ে চোখ কপালে উঠতে বাধ্য। সম্রাট প্রথমে একটি ছেলেকে খুঁজে বের করলেন, যার সাথে সদ্যমৃত স্ত্রীর চেহারার বেশ মিল রয়েছে। ছেলেটির নাম ছিলো স্পোরাস। স্পোরাসকে ধরে এনে খোজা করে দিলেন সম্রাট! এবার স্পোরাসকে সম্রাজ্ঞীর পোশাক পরানো হলো, বেশ জাঁকজমকপূর্ণ এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তাকে বিয়ে করে নিলেন সম্রাট নিরো। তখন থেকেই স্পোরাসকে স্যাবাইনা বলে ডাকতেন নিরো! ক্ষমতাবান মানুষের অদ্ভুত খেয়াল বলে কথা।

সম্রাট খুন হবার পর রক্ষীবাহিনীর প্রধান পাণিপ্রার্থনা করেছিলেন স্পোরাসের। সেই কমান্ডারের মৃত্যুর পর সম্রাট ওথোর সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে স্পোরাস। ক্ষমতার স্বাদ অবশ্য খুব বেশি দিন উপভোগ করা সম্ভব হয় নি ওথোর পক্ষে। মাত্র মাস তিনেক পরেই আততায়ীর হাতে নিহত হন তিনি।

এরপর সম্রাটের আসন অলঙ্কৃত করতে আসেন ভিটেলিয়াস। তিনি অবশ্য আগের সম্রাটদের মতো স্পোরাসের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন না। বরং স্পোরাসকে অপমান করতে প্রাচীন রোমের আপামর জনতার সামনে দিয়ে তাকে হাঁটিয়ে নেয়ার আদেশ দিলেন। এমন অপমান সহ্য করা সম্ভব হলো না স্পোরাসের পক্ষে। তাই জনতার সামনে অপমানিত হবার আগেই আত্মহত্যা করে বসে সে, ইতি টেনে দেয় নিজের দুঃখগাঁথা সেই জীবনের। অনেক ইতিহাসবেত্তাই মনে করেন, মৃত্যুর সময় স্পোরাসের বয়স বিশ বছরেরও কম ছিলো।

আলেসান্দ্রো মোরেশি

ক্যাস্ট্রাটি বলতে বিশেষ একধরনের পুরুষ শিল্পীগোষ্ঠীকে বোঝানো হতো, ছোটবেলাতেই যাদেরকে খোজা করে ফেলা হয়েছিলো। এ খোজাকরণের ফলে হরমোনগত যে পরিবর্তন ঘটতো, তাতে তারা অনেক উচ্চকণ্ঠে গান গাইতে পারতো।

এককালে অনেক জায়গাতেই নারীদের অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ ছিলো না। বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সঙ্গীতও ছিলো সেগুলোর মাঝে অন্যতম। সেসব অনুষ্ঠানে উঁচু গলায় বিভিন্ন গান গাইতে তাই দরকার পড়তো ক্যাস্ট্রাটিদের। ভ্যাটিকানও তাদের উপর নির্ভরশীল ছিলো।

তৎকালে অনেক বাবা-মা চাইতেন তাদের ছেলেরা যেন বড় হয়ে বিখ্যাত ক্যাস্ট্রাটি হয়। এজন্য শৈশবেই সন্তানের খোজাকরণের কাজটি সেরে রাখতেন তারা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, যারা খোজা হচ্ছে, তাদের সবাইকে তো আর ক্যাস্ট্রাটি হিসেবে নিয়োগ দেয়া সম্ভব হতো না। তাই যারা বাদ পড়তো, তারা ছিলো আসলেই বেশ দুর্ভাগা। কালক্রমে সেসব জায়গায় নারীদের আগমনের মাধ্যমে বন্ধ হয় ক্যাস্ট্রাটি নামক অমানবিক এ সঙ্গীতশিল্পী বানানোর প্রথা।

মোরেশি

ক্যাস্ট্রাটি সম্প্রদায়ের সর্বশেষ সদস্য ছিলেন আলেকসান্ত্রো মোরেশি। তার গাওয়া গানটি রেকর্ড করাও আছে। এটাই ক্যাস্ট্রাটিদের গানের একমাত্র রেকর্ড। একবার শুনে দেখতে পারেন। অজানাকে জানা এবং দুঃখবোধের এক অদ্ভুত অনুভূতিতে আক্রান্ত হবেন আপনি!

 পিটার অ্যাবেলার্ড

মধ্যযুগীয় খোজাদের মাঝে বেশ বিখ্যাত এক নাম পিটার অ্যাবেলার্ড, কারণ মূলত ভালোবাসা বিষয়ক। তৎকালে হেলোইসের সাথে তার প্রেমের সম্পর্কের কথা ছড়িয়ে পড়েছিলো দূর-দূরান্তে।

পিটার অ্যাবেলার্ড ছিলেন যুক্তিবিদ্যায় বেশ পারদর্শী এক শিক্ষক। একবার পড়াশোনা ঠিকমতো চালিয়ে নেয়ার জন্য হেলোইস নাম্নী এক তরুণীর গৃহশিক্ষকের প্রয়োজন দেখা দিলো। হেলোইসের আঙ্কেল তখন অ্যাবেলার্ডকে ঠিক করে দিলেন হেলোইসের লেখাপড়ার দিকটা দেখার জন্য। কিন্তু অ্যাবেলার্ড আর হেলোইস আস্তে আস্তে একে অপরের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়তে শুরু করেন। একসময় তাদের সম্পর্কের ফলাফল হিসেবে জন্ম নেয় একটি ছেলে। এরপর বিয়ে করে নেয় তারা দুজন।

তাদের এ সম্পর্ককে ঠিক ভালোভাবে নেন নি হেলোইসের আঙ্কেল। ক্রোধান্বিত হয়ে তিনি সদলবলে হামলা চালান অ্যাবেলার্ডের চেম্বারে, তাকে ধরে কোনো কথা না শুনেই খোজা করে দেন! এরপর তাদের পাঠিয়ে দেয়া হয় আলাদা দুটি আশ্রমে। বাকি জীবন সেখানে থেকেই একে অপরের সাথে চিঠি আদান-প্রদান করে ভালোবাসা বিনিময় করে গেছেন তারা।

৬) কাই লুন

প্রাচীন চীনের রাজ্য পরিচালনাতে খোজারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো। বংশবিস্তারের কোনো ক্ষমতা না থাকায় সম্রাটকে হটিয়ে নতুন রাজবংশ প্রতিষ্ঠার ভয় অন্তত খোজাদের কাছ থেকে ছিলো না। এজন্যই মূলত সম্রাটগণ তাদের উপর এতটা বিশ্বাস রাখতেন।

খোজা সংগ্রহের জন্য খুব ছোটবেলাতেই তাদেরকে পরিবারের কাছ থেকে নিয়ে এসে খোজা করে দেয়া হতো। এত ছোট বেলাতে আনার ফলে সম্রাটের প্রতি তাদের আনুগত্যের কোনো কমতি হতো না। ৭৯-১০৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করা সম্রাট হে’র শাসনামলের সম্ভ্রান্ত খোজা ছিলেন কাই লুন। তৎকালে রাজ্যব্যবস্থা পরিচালনার জন্য প্রচুর লেখালেখির দরকার পড়তো। কিন্তু আজকের দিনের মতো কাগজ তখন অতটা ব্যাপকাকারে ব্যবহৃত হতো না। এজন্য দামি সিল্ক কিংবা বাঁশের কচি ফালির উপর সেগুলো লিখে রাখা হতো। কাগজ যে এক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, সে সত্যটা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন কাই লুন। তাই তিনি বৃহৎ পরিসরে কাগজ উৎপাদনের ব্যবস্থা করেন।

কাগজের এ জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিকরণে তার বিপুল অবদানের কারণে অনেকে তাকে কাগজের উদ্ভাবক ভেবে ভুল করে থাকেন। তবে হে’র মৃত্যুর পর পরিস্থিতি যেন একেবারেই পাল্টে গেলো। নতুন সম্রাট তার পূর্বপুরুষদের মতো খোজাদের উপর এতটা নির্ভরশীল হতে চাইলেন না। তিনি বরং ক্ষমতাশীল খোজাদের বন্দী করতে চাইলেন। এমন অপমানিত হওয়ার চাইতে মৃত্যুকে শ্রেয় মনে করে তাই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন কাই লুন।