বই- দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম: নিক্সন, কিসিঞ্জার অ্যান্ড দ্য ফরগটেন জেনোসাইড
লেখক- গ্যারি জে বাস
প্রকাশকাল- জানুয়ারি ০১, ২০১৩
পৃষ্ঠা- ৫৪৪
অর্জন- ১. পুলিতজার পুরস্কার (২০১৪) ২. লিওনেল গেলবার পুরস্কার, আর্থার রস বই অ্যাওয়ার্ড ফর গোল্ড মেডেল (২০১৪), রবার্ট এইচ. ফেরেল শ্রেষ্ঠ বই ২০১৪, বেরনার্ড বই অ্যাওয়ার্ড সহ আরও অনেক।
পটভূমি
আলোচিত বইটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন স্নায়ুযুদ্ধকেন্দ্রিক বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের ধরন এবং অন্যান্য বৃহত্ শক্তির ওপর এর প্রভাব নিয়ে তথ্যবহুল একটি উপস্থাপনা। বর্তমানে ভারতীয় কূটনীতিককে ‘অপদস্থ’ করার কূটনৈতিক টানাপোড়েন বাদ দিলে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো সম্পর্ক পার করছিল। ২০০৭ সালে তত্কালীন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক বিষয়ে আন্ডার সেক্রেটারি নিকোলাস বার্নস ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নিয়ে আশাবাদী মন্তব্য করেছিলেন:
The rise of a democratic and increasingly powerful India is a positive development for U.S. interests. Rarely has the United States shared so many interests and values with a growing power as we do today with India. By reaching out to India, we have made the bet that the future lies in pluralism, democracy, and market economics.১
যদিও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত সে সময়েই ব্যাপারটি অনুধাবন করে নিক্সনকে ভারতের প্রতি মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সে পথে হেঁটেছে অনেক পরে। বর্তমান বাস্তবতায় চীনকে ‘ঠেকাতে’ ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র হয়ে উঠেছে অন্যতম মিত্র। কিন্তু ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই মিত্রতাও বেশি দিন টিকে থাকা সম্ভব নয়। ভারত তার অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে যখন বহির্মুখী সম্প্রসারণ ঘটাতে চাইবে, তখন এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব বাধতে বাধ্য। ইতিমধ্যে ভারতের বিদেশবিষয়ক (পূর্বাঞ্চলীয়) মন্ত্রণালয়ের সচিব শ্রীঅনিল ভাদভা দক্ষিণ চীন সাগরে আরও মনোযোগী হওয়ার ঘোষণা দিয়ে সেই ইঙ্গিতই দিয়ে রাখছেন।২ মোদ্দা কথা, পুতুল রাষ্ট্র ছাড়া সব দেশ তাঁদের জাতীয় স্বার্থের কথা মাথায় রেখেই পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করে এবং শত্রু-মিত্র বাছাই করে, যা স্বার্থ হাসিল না হওয়া পর্যন্ত টিকিয়ে রাখে। যত দিন অন্য কোনো পক্ষের আঘাতের সম্ভাবনা থাকে, তত দিন তা টিকিয়ে রাখাই একমাত্র নীতি।
এই বাস্তবতায় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর গ্যারি জে বাসের দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম: নিক্সন, কিসিঞ্জার অ্যান্ড দ্য ফরগটেন জেনোসাইড গ্রন্থটি সে সময়ের ঘটনা জানার ক্ষেত্রে এবং যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক বিশ্লেষণে অসাধারণ ভূমিকা রাখবে। এর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে তত্কালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের ভূমিকা এবং এদের সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্বপূর্ণ কিছু দিক উঠে এসেছে। হোয়াইট হাউসে তত্কালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও তাঁর নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের মধ্যকার কথোপকথনের অডিও টেপ, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে সাম্প্রতিক প্রকাশিত গোপন দলিলপত্র এবং সে সময়ে যেসব মার্কিন ও ভারতীয় নাগরিক ঘটনার সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের সাক্ষাত্কারের ওপর ভিত্তি করে এই বইটি লেখা হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য বইপত্র ও মাধ্যম ব্যবহূত হয়েছে।
১৯৭১ সালে স্নায়ুযুদ্ধকালীন দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পাশ্চাত্য তত্ত্বের মোহভঙ্গ ঘটিয়েছিল সাময়িকভাবে হলেও। উদারনীতিবাদের অন্যতম রাজনৈতিক আবিষ্কার হলো গণতান্ত্রিক শান্তি তত্ত্ব (democratic peace theory)। এর মূল কথা হলো, গণতান্ত্রিক দেশগুলো কখনো একে অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয় না। কিন্তু ১৯৭১ সালে বিশ্বের দুই বড় গণতন্ত্র ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক বিচ্যুতি ছিল গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতা থেকে বিচ্যুত করে সামরিক স্বৈরশাসক ইয়াহিয়ার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার অপচেষ্টাকে প্রাণপণ সমর্থন দেওয়া।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যে স্নায়ুযুদ্ধের আদর্শভিত্তিক প্রচারণার অংশ ছিল না, তা যুক্তরাষ্ট্রের সে সময়ের নীতিতে পরিলক্ষিত হয়। যদিও স্বাধীন হলে বাংলাদেশ সোভিয়েত অক্ষে ঢুকে যাবে বলে ভীতি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের, কিন্তু আদর্শগতভাবে গণতন্ত্রকে সমর্থন তারা করেনি। বিশ্ব যখন পুঁজিবাদী উদার গণতান্ত্রিক অংশ ও সাম্যবাদী অগণতান্ত্রিক অংশে বিভক্ত এবং যাবতীয় নীতি-রাজনীতি ও অন্যায়-অনাচার এই আদর্শিক লড়াই দিয়ে জায়েজ করা হচ্ছিল, তখন বাঙালিদের গণতান্ত্রিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত করে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক নিরস্ত্র মানুষ হত্যা ও ধর্ষণের রাজনীতিকে সমর্থন দেওয়া এবং অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করা যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগত বড় রকমের স্খলন নিঃসন্দেহে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভূ-রাজনীতিই ছিল নীতিনির্ধারণে সবচেয়ে বড় নিয়ামক। আদর্শিক বা মানবিক দিকগুলো কোনো ভূমিকাই রাখেনি। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আঁতাত আদর্শিক দিকে ভ্রুক্ষেপ না করার একটি অনন্য উদাহরণ। গণতান্ত্রিক ভারতকে সমর্থন না দিয়ে পাকিস্তানের পৈশাচিক সামরিক সরকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ সমর্থন এবং তা রক্ষার্থে সব ধরনের নৃশংসতাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া তার সাক্ষ্য বহন করে। বাংলাদেশের জনগণের ওপর মানবেতিহাসের অন্যতম বর্বরোচিত হামলা হোয়াইট হাউসের কর্ণধারদের ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছিল।
পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মূল্যবোধ এবং পররাষ্ট্রনীতিরও অংশ। তা সত্ত্বেও গণতন্ত্র ধূলিসাত্ করার অপচেষ্টায় সহায়তা করে যুক্তরাষ্ট্র তার পররাষ্ট্রনীতির দ্বৈত নীতিকে প্রমাণ করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই নিজের সুবিধামতো স্বৈরাচারী শাসককে ক্ষমতায় বসতে সাহায্য করেছে অথবা গণতান্ত্রিক সরকারকে উত্খাত করেছে। আবার যেখানে প্রয়োজন হয়েছে সেখানে গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে হস্তক্ষেপ করেছে। সবকিছু তার স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে। এই তালিকা বেশ বড়। ঠিক এ জন্যই সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের গণতন্ত্রের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মায়াকান্না দেখলে যে কারও সন্দেহ হওয়াটাই স্বাভাবিক। বর্তমানে সিরিয়ায় একই ধরনের ঘটনায় আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে ফিরে এসেছে। মধ্যপ্রাচ্যে বাছাইকৃত দেশগুলোতে গণতন্ত্রের কথা বললেও সৌদি আরবের মতো বড় রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে কখনো এতটুকুও উচ্চবাচ্য করেনি যুক্তরাষ্ট্র।
ইয়াহিয়াকে অকুণ্ঠ সমর্থন দেওয়ার পেছনে প্রেসিডেন্ট নিক্সন প্রধান কারণ হিসেবে চীনের সঙ্গে আঁতাত করার যুক্তি তুলে ধরেছিলেন। ইয়াহিয়ার মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার চীনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন, যা কূটনীতিবিদ্যায় ‘ব্যাক চ্যানেল ডিপ্লোমেসি’ নামে খ্যাত। তত্কালীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঠেকাতে চীনকে পাশে পাওয়া ছিল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য পরম বিজয়ী ঘটনা। এখানে দেখা যায়, কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন আর চীনের মধ্যেও আদর্শের কোনো মূল্য দেওয়া হয়নি। জাতীয় স্বার্থ আর সে সময়কার ভূ-রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশই এসব সিদ্ধান্তের নিয়ামক ছিল। যে কারণে চীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতা করে। ভারতের সঙ্গে ১৯৬২ সালের সীমান্ত যুদ্ধের রেশ তো ছিলই। ১৯৭১ সালের ৬ জুলাই কিসিঞ্জার দিল্লিতে গিয়ে প্রতিজ্ঞা করে এসেছিল যে ভারতের বিরুদ্ধে চীনের যেকোনো ধরনের পদক্ষেপে যুক্তরাষ্ট্র সাড়া দেবে না। কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধ বাধার পর তিনিই চীনকে ভারত সীমান্তে সেনা মোতায়েনের জন্য চাপ দেন। কিন্তু চীন বাস্তবতা বিবেচনা করেই সেই প্ররোচনায় সাড়া দেয়নি। অবশ্য ভারত চীনের দিক থেকে আক্রমণের ব্যাপারটি মাথায় রেখেই তার সামরিক অভিযান শীতকালে পরিচালনা করে। সুতরাং, তাত্ত্বিকভাবে যুদ্ধের অনিশ্চয়তা বা কুয়াশা (ফগ অব ওয়্যার)৩ থাকার পাশাপাশি আবহাওয়ার দিক দিয়েও হিমালয়ের তুষারপাতের কারণে চীনের জন্য ব্যাপারটি কঠিন হয়ে পড়ে।
ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে বিবেচনা করলেও দীর্ঘস্থায়ী নীতি গ্রহণে যুক্তরাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছিল। বিশাল ভূখণ্ডের অধিকারী ভারতকে তারা কাছে টানার চেষ্টা করতে পারত। এমনকি দিল্লিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে ভারতের প্রতি ঝোঁকা। কিন্তু ইয়াহিয়ার সঙ্গে নিক্সনের ব্যক্তিগত ‘বন্ধুত্বের’ কারণে তিনি অন্ধভাবে পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়ে গেছেন। চীনের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে পারাটা কিসিঞ্জারের একটি বড় কূটনৈতিক সাফল্য নিঃসন্দেহে, কিন্তু তার মানবিক মূল্য দিতে হয়েছিল বাংলাদেশের জনগণকে।
যুক্তরাষ্ট্র প্রথম দিকে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকলেও শেষ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষার্থেই মনোনিবেশ করে। তাদের ধারণা ছিল, ভারত এই সুযোগে পাকিস্তান দখল করে দক্ষিণ এশিয়ায় একক প্রভাববলয় তৈরি করবে। যা-ই হোক, তাদের সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছিল। অবশ্য ইন্দিরা গান্ধী ভেবেছিলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বেলুচিস্তানসহ অন্য অংশগুলোতেও বিদ্রোহ শুরু হবে এবং এভাবে পাকিস্তান ভেঙে যাবে। তাই পাকিস্তান দখলের চেষ্টা করে ‘আগ্রাসী’ অপবাদ নিতে চাননি।
বইজুড়ে নিক্সন-কিসিঞ্জার যেসব বীভত্স ভাষায় ভারতীয়, বাঙালি এবং বিশেষ করে ইন্দিরা গান্ধীকে গালিগালাজ করেছেন, তার হুবহু বর্ণনা রয়েছে। উনিশটি অধ্যায়ে মুখবন্ধসহ মোট ৫২৪ পৃষ্ঠা রয়েছে বইয়ে। বিভিন্ন আঙ্গিক থেকে দেখার চেষ্টা করায় এই বইয়ে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে বেশ কয়েকবার। যে জন্য ঘটনার সময়ানুসারে বর্ণনা করা সম্ভব হয়নি। পুরো বইটি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বড় ধরনের ব্যর্থতার স্বাক্ষর বহন করে এবং মার্কিন কূটনীতিকদের দেশের পররাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর অনবদ্য বর্ণনা বলা যায়। অবশ্য এতে করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির শিক্ষণীয় দিক কী হতে পারত বা পরবর্তী সময়ে কী ধরনের ভূমিকা রেখেছিল, তার কোনো বিশ্লেষণ এখানে নেই। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণ দলিল-দস্তাবেজ গবেষকেরা দেখতে পারেন না। কিসিঞ্জারের ব্যক্তিগত অনুরোধের কারণে লাইব্রেরি অব কংগ্রেস সেসব গুরুত্বপূর্ণ দলিল কাউকে দেখার অনুমতি দেয় না। গ্যারি বাস অনেকবার চেষ্টা করেও কিসিঞ্জারের সাক্ষাত্কার নিতে পারেননি।
১.
মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র তার পাকিস্তান নীতির ব্যাপারে স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকেই বাধার সম্মুখীন হয়। দিল্লির রাষ্ট্রদূত, ঢাকার কনসাল জেনারেল, ওয়াশিংটন ও পশ্চিম পাকিস্তানেরও মধ্যম সারির কূটনীতিকেরা যুক্তরাষ্ট্রের নীতির বিরোধিতা করে। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড ও দিল্লিতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিংকে দায়িত্ব থেকে অপসারণ করে নিক্সন প্রশাসন।
বইটিতে একটি ব্যাপার লক্ষণীয়, বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের এককভাবে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। একটি অধ্যায় রয়েছে মুক্তিবাহিনীর ওপর। কিন্তু সেখানে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনায় কীভাবে ভারতীয় সাহায্য-সহায়তা কাজে দিয়েছিল, তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ রয়েছে। মূলত ভারতের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে পাকিস্তান ভেঙে দেওয়ার যে অভিযোগ উঠেছিল এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে ভারত কীভাবে সেসব অভিযোগ খণ্ডন করার চেষ্টা করেছে, তার একটা বিশ্লেষণ এই অধ্যায়। ভারতের সহযোগিতা নিঃসন্দেহে ছিল। কিন্তু এতে করে মুক্তিবাহিনীর নিজস্ব ভূমিকা কোনোভাবেই ম্লান হয় না। সাধারণ বাঙালিরা যুদ্ধে আনাড়ি হওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানের আধুনিক একটা সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এই ধরনের একটি বইয়ে মুক্তিবাহিনী আরও বিস্তৃত প্রশংসার দাবি রাখে। জিল্লুর রহমান খান তাঁর দ্য থার্ড ওয়ার্ল্ড ক্যারিশমাট: শেখ মুজিব অ্যান্ড দ্য স্ট্রাগল ফর ফ্রিডম গ্রন্থে মুক্তিবাহিনীর সাহসিকতা, নৈপুণ্য ও আক্রমণের তীব্রতার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে:
By July 1971, the Bengali liberation forces became more organized and trained, and they could now carry out guerilla operations against the Pakistani army from within as well as without…During the 1971 monsoon, a tremendous increase in guerilla operation in different areas of Bangladesh made the Pakistani forces react negatively…In short, the increased insurgency of the Bangladesh regular forces and the freedom fighters angered the Pakistani army so much so that they took recourse to the scorched-earth policy to wipe out the last strongholds of resistance in Bangladesh and, in the process, they only succeeded in alienating more people.৪
এ ছাড়া কুলদীপ নায়ার তাঁর আত্মজীবনী বিয়ন্ড দ্য লাইনস-এ বলেন যে ভারতের সহায়তার তুলনায় বাংলাদেশের জনগণ ও মুক্তিবাহিনীর ভূমিকাই ছিল মুখ্য:
In comparison to India’s contribution, the role of the people of Bangladesh and the Mukti Bahini was greater. I have no doubt that they would have won their independence on their own…The Bangladeshis would have found it difficult without India’s support and it would have taken them somewhat longer but their determination and capacity to suffer should never be underestimated.৫
এসব যুক্তির মানে এই নয় যে মুক্তিবাহিনীর ভূমিকার মূল্যায়নের জন্য কোনো ধরনের পক্ষপাতিত্ব নিতে বলা হচ্ছে। মাঝামাঝি একটা অবস্থানে থেকে বা অ্যারিস্টটলের ‘গোল্ডেন মিন’৬ অনুযায়ী ব্যাখ্যা করা সম্ভব, যেটা বাংলাদেশের বা পাকিস্তানের কোনো লেখকের পক্ষে কঠিন হতে পারে।
যেখানে ভারত নভেম্বর পর্যন্ত যুদ্ধে জড়াতে রাজি নয়, সেখানে এই পুরো সময়টা পাকিস্তানিদের আধুনিক মারণাস্ত্র মোকাবিলা করাটা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অসামান্য কৃতিত্ব। সেটি লেখক তেমন তুলে আনেননি। উনি ভারতের সাহায্য-সহযোগিতা কী দেওয়া হয়েছিল, সেটা নিয়ে আবিষ্ট ছিলেন। ধীরে ধীরে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনীর মধ্যে ভুল বোঝাবুঝিরও সৃষ্টি হয়। এর কারণ ছিল ভারত যেসব সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা বাস্তবায়ন করছিল না। এমনকি ভারতের অভ্যন্তরেই ‘ধীরে চলা’ নীতির তীব্র সমালোচনা হচ্ছিল এবং ইয়াহিয়া হত্যাযজ্ঞ শুরু করার আগেই কেন ভারত ব্যবস্থা নিল না, সে ব্যাপারেও সমালোচনা এসেছিল। এমনকি, হিন্দু ডানপন্থী জনসংঘ পাকিস্তানের মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দু যুদ্ধ শুরু করার দাবি জানায়।
আরেকটি ব্যাপার হলো, লেখক শিশুদের মুক্তিবাহিনীতে যোগদানে আপত্তি করতে চেয়েছেন বলে মনে হয়। কিন্তু এটা নিয়মিত যুদ্ধ ছিল না। আর অসম যুদ্ধে এমন হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
২.
নিক্সন ভারতকে পছন্দ করতেন না বেশ কিছু কারণে, যার তথ্য-উপাত্ত এখানে পাওয়া যায়। হেনরি কিসিঞ্জার ছিলেন নিক্সনের প্রধান পরামর্শক, নিরাপত্তা উপদেষ্টা। তিনিই নিক্সনের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রভাবশালী ভূমিকা রেখেছিলেন। কিসিঞ্জার বাস্তবভিত্তিক ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির (realpolitik) ব্যাপারে ছিলেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। নীতি-নৈতিকতা বা মানবিক মূল্যবোধের স্থান তাঁর রাজনৈতিক আদর্শে খুব কমই দেখা গেছে। স্নায়ুযুদ্ধকেন্দ্রিক বিশ্ব রাজনীতিতে কিসিঞ্জার তাঁর দুই নায়ক মেটারনিখ ও ক্যাস্টলারেঘের মতো ক্ষমতার ভারসাম্য ও বৃহত্ শক্তির ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছিলেন। তিনি মনে করতেন, কোনো নীতি সঠিক কি বেঠিক, তা নির্ধারিত হবে নিজ দেশের অভ্যন্তরীণ বাস্তবতা দ্বারা।আ ওয়ার্ল্ড রেস্টোরড গ্রন্থে তিনি মন্তব্য করেন, ‘A nation will evaluate a policy in terms of its domestic legitimization, because it has no other standard of judgement.’৭ অন্যভাবে যার অর্থ দাঁড়ায়, নিজ দেশের স্বার্থই শেষ কথা। স্বাভাবিকভাবেই নিজ দেশের স্বার্থে অন্যায় করলে সেটার বৈধতা পেতে সমস্যা হয় না। সুতরাং, কোনো নীতি বাস্তবায়নে অন্য দেশে মানবতা লঙ্ঘিত হলো কি হলো না, সেটা ভাবনার বিষয় হতে পারে না।
কিসিঞ্জারকে আমলাতন্ত্রের সঙ্গে অবিরত সংগ্রাম করতে হয়েছে। তিনি মোটেও আমলাতন্ত্রকে পছন্দ করতেন না। পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে প্রেসিডেন্টের পর তিনিই ছিলেন দ্বিতীয় ব্যক্তি এবং এই সুবাদে আমলাতন্ত্রকে পাশ কাটিয়েই তিনি পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাঁর কাছে ভারত-পাকিস্তান তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। এই বইয়ের লেখক মন্তব্য করেছেন, কিসিঞ্জার দক্ষিণ এশিয়ার চেয়ে মেটারনিখের অস্ট্রিয়া সম্পর্কে অনেক বেশি জানতেন। তা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কিসিঞ্জারের মূল লক্ষ্য ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং চীনের সঙ্গে সম্পর্ক শুরু করা।
বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতের প্রতি নিক্সনের ব্যক্তিগত আক্রোশ যেমন বড় ভূমিকা রেখেছে, তেমনি ভারতের জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের নামে সোভিয়েতপ্রীতি ঘিয়ে আগুন দিয়েছে। কিসিঞ্জার নিক্সনের তুলনায় কম ভারতবিদ্বেষী হলেও তাঁরা দুজনেই চিরাচরিত লিঙ্গ ভেদাভেদ টেনে এনেছেন। ইয়াহিয়া সম্পর্কে তাঁরা বলেন, ‘He was a man’s man. He wasn’t some women running a country’ (পৃষ্ঠা ২)। এর মাধ্যমে ইন্দিরাকে নারী বলে খাটো করার মানসিকতাও ফুটে ওঠে।
পাকিস্তান নীতির পেছনে নিক্সনের বড় প্রণোদনা ছিল চীনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন—কথাটি সত্য নয়। এই বইয়ে দেখা যায়, নিক্সন প্রশাসন ফ্রান্স, রোমানিয়া ও পোল্যান্ডের মাধ্যমেও চীনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেছিল। কিসিঞ্জার রোমানিয়ার বর্বর স্বৈরশাসক নিকোল চসেস্কুর কাছেও এ ব্যাপারে সহযোগিতা চান। ইয়াহিয়া অত্যুত্সাহী হয়ে চীনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে সহায়তা করে। রোমানিয়াও এই ব্যাপারে অনেক দূর এগিয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকেই গুরুত্ব দেয়। এ ব্যাপারে উইনস্টন লর্ড, কিসিঞ্জারের বিশেষ সহকারী এবং পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী (ক্লিনটন প্রশাসন) মনে করেন, পাকিস্তানপ্রীতি ছিল সম্পূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক হিসাব। ‘It was geopolitical. Indians on the Russian team, so we’ll put Pakistan on our team. To say we tilted toward Pakistan because of the opening to China is an oversimplification. We might have done that anyway’ পৃষ্ঠা ১০৯।
কংগ্রেস, স্টেট ডিপার্টমেন্ট, মিডিয়া, জনমত—সবকিছু উপেক্ষা করে নিক্সন-কিসিঞ্জারের স্বৈরাচারী নীতি-কৌশল বিশ্লেষণে ব্যক্তিক পর্যায়ের বিশ্লেষণ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তিগত অহমও অনেকাংশে ভূমিকা রেখেছে। বার্টন মনে করেন, ‘Self-esteem is a deep instinctual need that is an integral part of being human and cannot be compromised or denied without a fierce struggle.’৮ যে জন্য শেষ পর্যন্ত ইয়াহিয়াকে গুরুত্ব দিয়ে যান নিক্সন। তা না হলে তাঁর নিজের নীতি ব্যর্থ হবে বলেই তিনি এমনভাবে ইয়াহিয়াকে আঁকড়ে ছিলেন।
ঘরে-বাইরে পাকিস্তানপ্রীতির ব্যাপারে নিক্সনকে সতর্ক করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি তাতে পাত্তা দেননি। পাকিস্তান ও ভারতের ওপর অবরোধ থাকা সত্ত্বেও আইন ভঙ্গ করে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করে, যা এডওয়ার্ড কেনেডির মতে পাকিস্তানের সর্বমোট অস্ত্রশস্ত্রের ৮০ শতাংশ। এভাবেই পৃথিবীর গর্বিত গণতন্ত্র আইন ভঙ্গ করে পাকিস্তানের বর্বর স্বৈরাচারকে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে মারণাস্ত্র দিয়ে সহায়তা করেছে। হোয়াইট হাউসের জ্যেষ্ঠ সহযোগী হ্যারল্ড সোন্ডার্স বলেছিলেন, ভূ-রাজনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত পশ্চিম পাকিস্তানের ৬০ মিলিয়নকে ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তান ও ভারতের ৬০০ মিলিয়নের পাশে থাকা। কিন্তু কিসিঞ্জার আগের অবস্থানে অনড় থাকেন। আবার ইয়াহিয়াকে অযোগ্য জেনেও ভূ-রাজনৈতিক কারণে সমর্থন দিয়ে যান। ইয়াহিয়া সম্পর্কে কিসিঞ্জারের পাকিস্তান ভ্রমণ শেষে মূল্যায়ন দেখলেই বোঝা যায় যে ইয়াহিয়াকে তিনি কোনোভাবেই যোগ্য মনে করতেন না। মূল্যায়নটি ছিল এ রকম:
‘It is my impression that Yahya and his group would never win any prizes for high IQs or for the subtlety of their political comprehension. They are loyal, blunt soldiers, but I think they have a real intellectual problem in understanding why East Pakistan should not be part of West Pakistan.’ পৃষ্ঠা ১৭০।
এটি সত্য যে চীনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনাম যুদ্ধের দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পায় এবং স্নায়ুযুদ্ধে জয়লাভ করে। কিন্তু সেই আনন্দে কিসিঞ্জার উদ্বেলিত হয়ে ইয়াহিয়ার হিন্দু নিধনের সঙ্গে তাঁর ভ্রমণকে যেভাবে তুলনা করে কৌতুক করেন, তা নিম্ন রুচিবোধের আদর্শ পরিচায়ক: ‘Yahya hasn’t had such fun since the last Hindu massacre!’
নীতিনির্ধারণে কিসিঞ্জারের ব্যক্তিগত প্রভাব ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কিসিঞ্জারের মনোজগতে গণহত্যা, শরণার্থী ও অস্তিত্ব হারানোর মতো সব অভিজ্ঞতাই ছিল। হিটলারের ইহুদি নিধনের শিকার হয়ে কিসিঞ্জার যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। শালিত (১৯৯৪) মন্তব্য করেন, ‘After the Nazi Holocaust, the threat of extermination for many Jews takes on enormous emotional and psychological significance, and they have the threat of annihilation built into their psyche.’৯ এই বাস্তবতা কিসিঞ্জারের বেলায়ও প্রযোজ্য।
পুরো সংকটকে ঘিরে লেখক মন্তব্য করেছেন যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ইয়াহিয়ার শরণার্থী ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সমঝোতাই শুধু যুদ্ধ এড়াতে পারে। কিন্তু তত দিনে যে পরিমাণ জল গড়িয়েছিল উপমহাদেশে, তাতে এটি কতটুকু যুক্তিযুক্ত, সে ব্যাপারে তেমন তথ্য-উপাত্ত তিনি উপস্থাপন করেননি। এ ছাড়া লেখক সে সময়কার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির জন্য কেবল নিক্সন ও কিসিঞ্জার এবং তাঁদের কিছু অনুসারীকে দায়ী করতে চেয়েছেন বলে মনে হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে তার আগে-পরেও খুব ব্যতিক্রম কিছু চোখে পড়ে না।
বইটিতে লেখক যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তান নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেননি, সেটি হলো পাকিস্তানকে শেষ সময় পর্যন্ত সমর্থন দেওয়া এবং সব বর্বরতাকে না দেখার ভান করার পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক হিসাব। মিত্রদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা ছিল জরুরি। পাকিস্তানের ব্যাপারে যদি তারা এগিয়ে না আসত, তাহলে স্নায়ুযুদ্ধকালে মিত্রদের আস্থা ধরে রাখা কঠিন হতো।
৩.
ব্রিটিশদের কলমের কারসাজিতে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র জন্ম নেয় ১৯৪৭ সালে। ধর্মের নামে দুটি দেশ গঠন শুধু উপমহাদেশের এক অদ্ভুত মানচিত্রই সৃষ্টি করেনি, সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে একটি রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করে রাষ্ট্রের এক নতুন মডেল আবিষ্কার করা হয়েছিল। এই বইয়ে লেখক পাকিস্তান রাষ্ট্রকে cartographic oddity নামে আখ্যায়িত করেছেন। পাকিস্তান নিয়ে একটি প্রচলিত কৌতুক ছিল এমন: যে তিনটি জিনিস পাকিস্তানকে একত্র রেখেছে, তা হলো ইসলাম, ইংরেজি ভাষা ও পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস (PIA); এর মধ্যে শেষটিই সবচেয়ে শক্তিশালী। কিসিঞ্জার দিল্লি ভ্রমণে গেলে হাকসার পাকিস্তান রাষ্ট্রের অসাড়তা সম্পর্কে কিসিঞ্জারকে বলেন, ‘If religion could provide a basis for creating Nation-states, Europe would probably still have the holy Roman Empire’ পৃষ্ঠা-১৬২।
ধর্মের ভিত্তিতে জাতি-পরিচয় নির্ধারণ করে এই অঞ্চলের মানুষের আরও যেসব পরিচয় রয়েছে, যেমন পেশা, শ্রেণী, ভাষা, সংস্কৃতি, সামাজিক মূল্যবোধ ইত্যাদি, সেগুলোকে অস্বীকার করা হয়েকছিল। এটিকে অমর্ত্য সেন বলেছেন unique and choiceless identity১০, যার মাধ্যমে মানুষকে তার নিজের আত্মপরিচয় বাছাইয়ের সুযোগ দেওয়া হয় না। এরপর অবশ্য হান্টিংটন সভ্যতার দ্বন্দ্ব (Clash of Civilization) তত্ত্ব দিয়ে সেটাকে প্রমাণ করতে চেয়েছিল, যার বাস্তবায়ন বুশ ও আল-কায়েদা মিলে সম্পন্ন করার দীর্ঘ প্রকল্প নিয়েছিল, যা এখনো বিদ্যমান। কিন্তু বাংলাদেশ হান্টিংটনের এই তত্ত্বের বিরুদ্ধ তত্ত্ব হিসেবে প্রমাণিত। মুসলিমপ্রধান দেশ হয়েও তুলনামূলকভাবে অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ রয়েছে এখানে। ডেভিড লিউজ তাঁর ২০১১ সালে প্রকাশিত গ্রন্থে বলেন, ‘Bangladesh continues to serve as an important antidote to Samuel Huntington’s (1993) warning of a so-called clash of civilizations between the east and the west.’১১
এই ধরনের দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তান নামে যে রাষ্ট্রটি জন্ম নেয়, তার দুই অংশের মধ্যে শোষণ ও বৈষম্য থাকারই কথা। কারণ, এখানে ধর্মীয় পরিচয় ছাড়া অন্য কোনো উপাদান দিয়ে নিজেদের একক সত্তা ভাবার উপায় ছিল না। আলোচিত গ্রন্থে লেখক পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যকার বিভাজন এবং পূর্বাংশের ওপর যে ধরনের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শোষণ জারি করা হয়েছিল এবং তার ফলে সমাজে যে অস্থিরতা বিরাজ করছিল, সে বর্ণনা তুলে ধরেছেন। কিন্তু সেসবের সম্পূর্ণ বর্ণনা দেওয়া সম্ভব হয়নি।
বাঙালিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর চরমতম আঘাতটা আসে ১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বর, যখন ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। বিভিন্ন মার্কিন মানবিক সহায়তা প্রদানকারী এজেন্সির মতে দুই লাখ ৩০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়, কিন্তু স্টেট ডিপার্টমেন্টের হিসাব অনুযায়ী তা পাঁচ লাখ ছিল। ঘূর্ণিঝড়ের পর পাকিস্তান রাষ্ট্র একধরনের গাঁজাখুরি নির্লিপ্ততা দেখায়। পূর্ব বাংলায় তখন প্রচুর সহায়তা দরকার ছিল, যার বেশির ভাগ বিদেশি রাষ্ট্রগুলো প্রদান করে।
৪.
আর্চার ব্লাড পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর পৈশাচিকতার অন্যতম সাক্ষী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবিস্মরণীয় ভূমিকা মানবতার এক মূর্ত প্রতীক। ব্লাড নিক্সন প্রশাসনের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে মার্কিন নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর পৈশাচিক হামলা শুরু হয়। ব্লাড ওয়াশিংটনকে বারবার নৃশংসতার এবং পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার নামে নিরস্ত্র বাঙালি নিধনের বর্ণনা টেলিগ্রাম করে পাঠিয়েছেন। কিন্তু ওয়াশিংটন কর্ণপাত করেনি। ব্লাড পরবর্তীকালে ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘The silence from Washington was deafening, suggesting to us that less credence was being given to our reporting than to the Pakistani claims that little more was involved than a police action to round up some “miscreants” led astray by India.’ (পৃষ্ঠা ৬৯)। ব্লাডের তারবার্তা কিসিঞ্জারের সহকারীদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া ফেলেছিল। কিসিঞ্জারের অসাড়তায় তাঁরাও মর্মাহত হন।
ব্লাডসহ ঢাকা কনস্যুলেটের অন্য সদস্যরা ওয়াশিংটনের নীতির বিরোধিতা করে তারবার্তা পাঠান, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট, ইউনাইটেড স্টেটস ইনফরমেশন সার্ভিসের সদস্যরাও সই করেন। সবাই নিজেদের পেশাজীবনে নেতিবাচক প্রভাব আসতে পারে জেনেও এই তারবার্তা পাঠান। ৬ এপ্রিল ব্লাড সবচেয়ে তীব্র তারবার্তা পাঠান, যেটিকে লেখক বলছেন, ‘The confidential cable, with the blunt subject line of “Dissent from U.S. Policy toward East Pakistan” was probably the most blistering denunciation of U.S. foreign policy ever sent by its own diplomats.’ পৃষ্ঠা ৭৭। লেখক আর্চার ব্লাডের ওপর একটি সম্পূর্ণ অধ্যায়জুড়ে আলোচনা করেছেন। বইয়ের শিরোনামটিও এই কূটনীতিকের পাঠানো তারবার্তাকে ইঙ্গিত করে ব্লাড টেলিগ্রাম করা হয়েছে। ব্লাড মার্কিন নীতির বিরোধিতা করায় পেশাজীবনে উন্নতি করতে পারেননি। তাঁকে ঢাকা থেকে সরিয়ে ওয়াশিংটনে অধস্তন এক পদে বসানো হয়। কিসিঞ্জার পরবর্তীতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে যাওয়ায় তাঁকে যোগ্যতা অনুযায়ী উচ্চপদ থেকে বঞ্চিত করা হয়।
কিসিঞ্জার নিক্সনকে পীড়াপীড়ি করেন যেন তিনি ইয়াহিয়ার ওপর কোনো চাপ প্রয়োগ না করেন। তিনি ভাবতেন, বাঙালিরা চারিত্রিকভাবেই বামপন্থী। তিনি বলেন, ‘Mr. President, if we get in there now, we get West Pakistan turned against us, and … the Bengalis are going to go left any way. They are by nature left.’ পৃষ্ঠা ৮৭।
এদিকে ব্লাডের টেলিগ্রাম বন্ধ করার অনেক চেষ্টা চালায় পাকিস্তানিরা। কিসিঞ্জার নিজেও ব্লাড টেলিগ্রাম গোপন রাখতে চান। ২৫ মার্চ রাতের হত্যাযজ্ঞের ব্যাপারে জেনেও নিক্সন-কিসিঞ্জাররা সেটা থামাতে বা কমাতে কোনো পদক্ষেপ নেননি। ব্লাডের টেলিগ্রামের কোনো প্রত্যুত্তরও আসেনি। বাধ্য হয়ে ব্লাড Selective Genocide শব্দ ব্যবহার করে। তিনি দিল্লিতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিংয়ের কাছ থেকে পূর্ণ সমর্থন পেয়েছিল এবং কিটিং নিজেও বর্বরতার ঘটনা বর্ণনা করে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিল। কিসিঞ্জার ও নিক্সন সবকিছুর পর বাঙালিদের ওপরই দোষ চাপিয়ে দেন। দেশ চালাতে ইয়াহিয়ার যে সমস্যা হচ্ছিল, তার জন্য তাঁরা বাঙালিদের দায়ী করেন। কিসিঞ্জার মনে করতেন, ঐতিহাসিকভাবেই বাঙালিদের শাসন করা কঠিন।
পাকিস্তানি শাসকেরা গণমাধ্যমকে নীরবতা পালন করতে বাধ্য করে। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমানে রূপসী বাংলা) বিদেশি সাংবাদিকদের আটকে রাখা হয়। ভুট্টো করাচি ফিরে গিয়ে গণহত্যাকে সমর্থন করে ঘোষণা দেন: ‘By the grace of God Pakistan was at last been saved’ (পৃষ্ঠা ৫৩)। এর পর থেকে স্বাধীন বাংলার কথা যে বলত বা আওয়ামী লীগ করত, তাদের জন্য পাকিস্তানিরা একটা কোড নাম ব্যবহার করত, ‘Sent to Bangladesh’, যার মানে হলো বিচার ছাড়া হত্যা করা।
৫.
এদিকে ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ওপর হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দানা বাঁধতে থাকে। ইন্দিরা গান্ধী শুরু থেকেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। লেখক ভারতীয় সাহায্য-সহযোগিতার বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। শুরুতে ভারতীয় জেনারেল মানেকশ যুদ্ধে জড়াতে বাদ সাধেন এবং কৌশলগতভাবে শীতকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেন। কিন্তু তত দিন অন্যান্য সহযোগিতা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। মে মাসের দিকে এসে জোরালোভাবেই সমর্থন দেওয়া শুরু করে ভারত। ভারতীয় নীতিনির্ধারকেরা মুক্তিবাহিনীর বীরত্বে ও সাহসিকতায় মুগ্ধ ছিলেন এবং সে জন্যই সহযোগিতা করতে বেশি আগ্রহী ছিলেন। কারণ, সহযোগিতা বৃথা যাওয়ার সম্ভাবনা কম ছিল।
শরণার্থী সমস্যা ভারতের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা নিয়ে আসে। ভারত নিজেই যেখানে তার জনসংখ্যাকে খাদ্য, বাসস্থান, চিকিত্সা ইত্যাদি দিতে পারছিল না, সেখানে বাড়তি এই বিশাল জনসংখ্যা একধরনের বিপর্যয় ডেকে আনে। পাকিস্তানের নীতিই ছিল হিন্দুদের এখান থেকে বিতাড়িত করা। তাদের ধারণা ছিল, হিন্দুরাই বঙ্গবন্ধুর পেছনে মূল ইন্ধনদাতা। ভারতে শরণার্থীদের মধ্যেও বেশির ভাগই ছিল হিন্দুধর্মাবলম্বী। ভারত বুঝতে পেরেছিল যে পাকিস্তান পদ্ধতিগতভাবে হিন্দুদের বিতাড়িত করেছে, কিন্তু ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেধে যাওয়ার ভয়ে গান্ধী এই তথ্য প্রকাশ করতে চায়নি। ভারতের নীতিনির্ধারকেরা বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে মানতে নারাজ ছিলেন। শরণার্থী সমস্যাকেই আসল কারণ হিসেবে দেখিয়ে ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
গান্ধীর সচিবালয়ে অনেকেই অনেক মতামত তুলে ধরেন। কেউ কেউ বলেন সীমান্ত বন্ধ করে দিতে, কেউ বলেন শুধু হিন্দুদের ঢুকতে দেওয়া হোক, কেউ কেউ হিন্দুদের ভারতে নিয়ে ভারতীয় মুসলমান বিনিময়ের প্রস্তাবও দেন। বাঙালিদের জন্য ভারতীয়দের মধ্যে যাঁরা জোরালোভাবে অবদান রেখেছেন, জয়প্রকাশ নারায়ণ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ভারতীয় বাঙালিরা ক্রমবর্ধমানভাবে ভারত সরকারকে চাপ দিতে থাকে বাংলাদেশের সহযোগিতায় ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। এদিকে নিউইয়র্ক টাইমস-এর সিডনি শ্যানবার্গ শরণার্থীদের মানবেতর জীবন নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। যে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল শরণার্থী ক্যাম্পগুলোয়, তার চিত্র তুলে আনেন। যেখানে দেখা যায়, দৈনিক গড়ে ৩০ থেকে ৪০ জন মারা যেত শুধু কলেরাসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়ে।
৬.
চীনে মাও নেতৃত্বাধীন শাসকেরা বুর্জোয়া শক্তির ঘোর বিরোধী ছিল এবং গণতান্ত্রিক ভারতকে শত্রু জ্ঞান করত। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের স্মৃতি তখনো সতেজ। বেইজিংয়ে ভারতীয় কূটনীতিকেরা বলেছিলেন যে চীন ভারত নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। কেননা, এত বড় ভূখণ্ড আর জনসংখ্যা নিয়ে ভারত চীনের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। এই বইয়ে লেখক মনে করেন, চীন নিজেও তাইওয়ান ও তিব্বতে (এখন জিনজিয়াংও এই তালিকায়) বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে ক্ষুব্ধ, তাই পূর্ব পাকিস্তানে এই ধরনের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ আন্দোলনের ঘোর বিরোধী ছিল এবং ভারতকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলানোর জন্য ভর্ত্সনাও করে (পৃষ্ঠা ১৩৪)। কিন্তু বাস্তবে চীনের যে নীতি, কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা, সেটি সামান্যই অবদান রেখেছে। আগেই বলেছি যে নীতিবাক্য কোনোভাবেই কোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতিতে প্রভাব ফেলেনি। ফেব্রুয়ারি ২০১৪ থেকে শুরু হওয়া ইউক্রেন সংকটে রাশিয়া তার সেনাবাহিনী পাঠিয়েছে সেখানে। স্বাভাবিকভাবেই সেটি অন্য দেশের অভ্যন্তরে হস্তক্ষেপ। কিন্তু চীন এ ব্যাপারে রাশিয়াকে দ্ব্যর্থ সমর্থন দিয়েছে। ভূ-রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে চীনকে তা দিতে হয়েছে।১২ হস্তক্ষেপ না করার নীতি কিন্তু এখানে টেকেনি।
সব বিবেচনায় চীন পাকিস্তানের পাশে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেই থেমে থাকেনি, অস্ত্রশস্ত্র দিয়েও সহায়তা করেছে এবং যুদ্ধ লাগলে পাকিস্তানের সহায়তায় এগিয়ে আসার কথা বলে। বাংলাদেশ বিষয়ে ভারত একাকী হয়ে পড়ে। চীনা ভীতিই ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সামরিক চুক্তি করতে উদ্যোগী করে। পাকিস্তানের ওপর বাংলাদেশ বিষয়ে চাপ প্রয়োগ করতে ভারতীয় মন্ত্রী-কর্মকর্তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দ্বারে দ্বারে ঘোরেন, কিন্তু কেউ সাড়া দেয়নি। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সদস্যদেশগুলোর মধ্যে যুগোস্লাভিয়া ছাড়া বাকিরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে। মধ্যপ্রাচ্যের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে হতাশাজনক। সৌদি আরব, মিসর ও লিবিয়ার স্বৈরাচারেরা পাকিস্তানি স্বৈরাচারে এতটাই মুগ্ধ ছিল যে বাঙালিদের মৃত্যুযন্ত্রণা আর হাহাকার মধ্যপ্রাচ্যের মরুর তাপকে অতিক্রম করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। ইরানের শাহ সরকারের ভূমিকাও ছিল একই রকম।
যুক্তরাষ্ট্রের চীনা সমঝোতার ফলে ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তি করার জন্য তাড়াহুড়ো করে এবং ৯ আগস্ট ১৯৭১ সালে শান্তি, বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি সই করে, যার মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে যে-ই আক্রান্ত হোক না কেন, অন্য দেশ যথাযথ পদক্ষেপ নেবে বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যা আলোচনায় আসতে পারত, তা হলো সোভিয়েত ইউনিয়নও চীন-যুক্তরাষ্ট্র সমঝোতায় ভীত হয় এবং চীনের বিরুদ্ধে এই ধরনের চুক্তি করার প্রয়োজন বোধ করে। কারণ, কয়েক বছর আগেই চীনের সঙ্গে তার সীমান্ত সংঘর্ষ বাধে। উইলিয়াম বার্নডস বলেন,
‘‘The announcement that President Nixon would visit Peking surprised and frightened the hyper suspicious Soviet leadership, for the trip seemed to them to portend the transformation of their previous nightmares of Sino-American collusion into reality. To Soviet leaders quickly journeyed to wide variety of countries to demonstrate their own dynamism and to show that their foreign policy had won friends for the USSR.’১৩
সোভিয়েত ইউনিয়ন সে সময় পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে দুর্বল অবস্থানে ছিল এবং চাইলেই বাংলাদেশ বিষয়ে তাত্ক্ষণিক অবস্থান নিতে পারত না। তা ছাড়া অপর্যাপ্ত বৃষ্টিতে ১৯৬৬-৬৭ সালে ভারতে প্রায় দুর্ভিক্ষাবস্থা ও ১৯৬৭ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের পরাজয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের ব্যাপারে সতর্ক হয়ে যায়।
৭.
গান্ধী ওয়াশিংটন থেকে ৫ নভেম্বর বৈঠক শেষে ফেরার পর এটা নিশ্চিত হয়ে যায় যে ভারত সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। এমন অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান যা ভেবেছিল যে চীন যুদ্ধে জড়াবে, সেটি হয়নি, যুদ্ধ শুরুর পরেও না। চীন সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা ও জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতি চুক্তির পক্ষে ভোট দেওয়া পর্যন্ত নিজেকে সীমিত রাখে। লেখক যেভাবে বলতে চেয়েছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের চীনা নীতি এখানে ব্যর্থ হয়েছে, তা পুরোপুরি ঠিকও নয়। স্নায়ুযুদ্ধ বিজয় ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য এবং সে জায়গায় চীনের সঙ্গে সমঝোতা যথার্থ অবদান রেখেছে।
২১-২২ নভেম্বর ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম বিমানযুদ্ধ সংঘটিত হয় পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে। একে অপরকে দোষারোপ করে যুদ্ধ শুরু করার জন্য। কিন্তু কৌশলগতভাবে এই শুরুটা ভারতের জন্য সুবিধা করে দেয়। এত দিনে শীতকাল পড়ে গেছে, হিমালয়ের তুষারপাতের কারণে ভারতীয় সীমান্তে চীন তার সেনাসমাবেশ করতে পারবে না এবং মৌসুমি বৃষ্টিপাত তত দিনে বন্ধ হয়ে গেছে, যা ভারতীয় সেনাদের অভিযানে সুবিধা করে দেবে। কিসিঞ্জার এই যুদ্ধকে ভারতের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে অপমান করার সোভিয়েত পরিকল্পনা বলে আখ্যায়িত করেন এবং জাতিসংঘের সনদ ও আমেরিকার নীতির প্রতি আঘাত হিসেবে বিবেচনা করেন। তবে যুক্তরাষ্ট্র যে এসব নীতি অনেকবার লঙ্ঘন করেছে এবং এখনো করে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে তিনি চুপ ছিলেন।
৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান পশ্চিম সীমান্তে বিমান হামলা চালায়। ইয়াহিয়া ২৯ নভেম্বর ভারতের যুদ্ধের প্রস্তুতি না জেনেই হামলার পরিকল্পনা করে। এতে করে ভারত তার সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগাতে আর দেরি করেনি। এদিকে কিসিঞ্জার ও নিক্সন ঘটনা না জেনেই নিশ্চিত হয় যে ভারতই যুদ্ধ শুরু করেছে, যদিও পাকিস্তানই ওই দিন বিমান হামলা চালায়। কিন্তু বইয়ে লেখক ব্যাখ্যা করেননি, কেন নিক্সন প্রশাসন ভারতের যুদ্ধের প্রস্তুতি এবং ‘যুদ্ধ বাধানো’র পরিকল্পনা জানার পরও ইয়াহিয়াকে জানায়নি এবং হামলা করার মতো অদূরদর্শী পরিকল্পনা করতে নিষেধ করেনি। যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ বন্ধ করতে শত চেষ্টার পরও পারেনি, যে জন্য কিসিঞ্জার মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং নিক্সন তাঁকে মনোরোগ চিকিত্সক দেখানোর কথাও ভাবেন। এটি তাহলে কার কৌশলগত ব্যর্থতা?
ভারত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ হস্তক্ষেপ করার আগেই পূর্ব সীমান্তে যুদ্ধ শেষ করতে চায় এবং এ জন্য তারা আট দিনের মধ্যে ঢাকা দখল নেওয়ার পরিকল্পনা করে। যদিও আট দিনে সম্ভব হয়নি, তবু এত তাড়াতাড়ি সম্ভব হয়েছিল পাকিস্তানি সেনাদের অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি মোকাবিলা না করে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মুক্তিবাহিনীই সেসব ক্ষেত্রে পাকিস্তানি সেনাদের যুদ্ধে নিমজ্জিত রেখেছিল। ভারতীয় সেনা এবং মুক্তিবাহিনী যখন ঢাকা দখল করে ফেলে এবং দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলে, তখন নিক্সন-কিসিঞ্জাররা উর্দুভাষী বিহারি, যারা পাকিস্তানিদের সহায়তার মাধ্যমে বাঙালিদের হত্যা ও নির্যাতনে সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল, তাদের মানবিক দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ করে। নিক্সন প্রশাসনের মানবতাবোধ বাঙালিদের বেলায় অদৃশ্য থাকলেও শেষ সময়ে তাদের এ মহানুভবতা প্রশংসার দাবি রাখে! যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বিজয় ও ভারতের সাফল্য ঠেকাতে তখন নিরাপত্তা পরিষদের দ্বারস্থ হয়। নিরাপত্তা পরিষদে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে তিনবার ভেটো দিয়ে আটকে দেয়।
নিক্সন-কিসিঞ্জার শেষ দিকে এসে চিন্তিত হয়ে পড়েন। তাঁরা মনে করেন, ভারত শুধু বাংলাদেশ স্বাধীন করেই ক্ষান্ত হবে না, সে তার চিরশত্রু পাকিস্তানকেই ধ্বংস করে দেবে। তখন পশ্চিম পাকিস্তানকে বাঁচানোই তাদের মূল লক্ষ্য হয়ে পড়ে বলে লেখক দাবি করেন। সিআইএ নিশ্চিত করে যে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করতে হলে চীনের দুই মাসের মতো সময় লেগে যাবে। আসলে চীন যুদ্ধে জড়ালে আরও বড় আকারের যুদ্ধ বেধে যেত, যেখানে নিশ্চিতভাবেই সোভিয়েত ইউনিয়নকে আসতে হতো এবং তখন যুক্তরাষ্ট্রকেও সরাসরি যুদ্ধে নামতে হতো।
পাকিস্তান যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক অস্ত্র অবরোধের আওতায় ছিল, তাই ইরান ও জর্ডানের মাধ্যমে পাকিস্তানকে অস্ত্র সহযোগিতা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। পাকিস্তানকে সহযোগিতা করতে তারা অনায়াসে যুক্তরাষ্ট্রের আইন ভঙ্গ করে চলে। ভারত আশ্বস্ত করতে চেয়েছে যে তাদের বাংলাদেশের বা পশ্চিম পাকিস্তানের জায়গা দখল করার কোনো পরিকল্পনা নেই এবং স্টেট ডিপার্টমেন্টের বিশ্লেষকেরাও তা আশ্বস্ত করেছেন, কিন্তু তার পরও যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম পাকিস্তানকে যেন ধ্বংস করতে না পারে, সেই অজুহাতে সপ্তম নৌবহর পাঠায় বঙ্গোপসাগরে। লেখক বলতে চেয়েছেন যে যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম পাকিস্তান রক্ষার্থে শেষ পর্যন্ত সপ্তম নৌবহর পাঠায়। কিন্তু স্টেট ডিপার্টমেন্টের আশ্বাস না শোনা ও চীনকে যুদ্ধে প্ররোচিত করার চেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার কৌশল হিসেবেই প্রতীয়মান হয়, যার যথেষ্ট প্রমাণ এই বইয়ে পাওয়া যায়। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র সর্বশেষ অস্ত্র ব্যবহারে মনোযোগী হয়। যদি সোভিয়েত ইউনিয়ন ১২ ডিসেম্বরের মধ্যে ভারতকে না থামায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করবে বলে হুমকি দেয় (পৃষ্ঠা ৩০৫)। কিসিঞ্জার ভয় পেতে থাকে যে এই যুদ্ধের মাধ্যমে ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন এলে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা চিরকালের জন্য নষ্ট হবে:
‘If the outcome of this is that Pakistan is swallowed by India, China is destroyed, defeated, humiliated by Soviet Union, it will be a change in the world balance of power of such magnitude, that the United States security would be damaged for decades and may be forever.’ (পৃষ্ঠা ৩০৭)।
সোভিয়েত ইউনিয়নও আশ্বস্ত করে যে পশ্চিম পাকিস্তান ধ্বংস করার ইচ্ছা ভারতের নেই। চীন জানত যে ভারতের বিরুদ্ধে সেনাসমাবেশ করা মানে চীনের সীমান্তে সোভিয়েত ইউনিয়নের ১০ লাখ সেনা জড়ো করতে প্ররোচনা দেওয়া। চাপের মুখে ভারত কাশ্মীরে তাদের দাবি করা অংশের দখল নেওয়া থেকেও বিরত থাকে। যখন পূর্ব সীমান্তে জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণে রাজি হন, তখন ভারত পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তান দখলের সুযোগ থাকার পরও এককভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। এতেই কিসিঞ্জার ‘বিজয়ী’ হাসি হাসেন। তিনি বলেন, ‘We have turned disaster into defeat.’ (পৃষ্ঠা ৩২৪)।
শেষ কথা
বইয়ের শেষে লেখক বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী অবস্থা নিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিয়ে শেষ করেছেন। তিনি ১৯৭১ সালের নির্মম ও বর্বরোচিত কর্মের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষমা চাওয়ার কথা বলেন।
তবে ভারত যে শুধু মানবিক কারণেই বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করে, ব্যাপারটি এমন নয়; ভূ-রাজনৈতিক কৌশলই মূল নিয়ামক ছিল। ইন্দিরার নিজের দেশে মানবাধিকারের অবস্থা দেখলে সেটি পরিষ্কার হবে। মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, কাশ্মীর, পশ্চিমবঙ্গ, ১৯৮৪ সালে পাঞ্জাবে এবং জরুরি অবস্থা চলাকালে দেশব্যাপী তার মানবাধিকার রেকর্ড নিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছিল। বাংলাদেশে এই গণহত্যা বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া ও গণতন্ত্র রক্ষায় পশ্চিমবঙ্গে ভারতীয় জণগণের কাছ থেকে যেমন চাপ ছিল, তেমনি ভূ-রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে তাঁর প্রধান শত্রু পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করে দক্ষিণ এশিয়ায় একক আধিপত্য বিস্তারের এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করতেও চাননি গান্ধী। তাই ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে পাকিস্তান ভেঙে যাওয়া জরুরি ছিল।
শরণার্থী সমস্যা নিঃসন্দেহে বড় ভূমিকা রেখেছে। তা ছাড়া ভারতীয় জনগণের বাংলাদেশের মানুষের জন্য মানবতাবোধ ও সংহতি অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। ভারত চাইলেই বাংলাদেশের এই সংকটকে এড়িয়ে যেতে পারত না। পশ্চিমবঙ্গে এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে আরেকটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ঘটুক, সেটাও চাননি ইন্দিরা গান্ধী। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, ভারতের রাজনীতির সব পক্ষ থেকেই বাংলাদেশের জনগণের পাশে দাঁড়ানোর জন্য জোর দাবি ওঠে। ডানপন্থী ও বামপন্থী থেকে শুরু করে সব অংশই একই দাবি তোলে।
জাতীয় স্বার্থ ছাড়া কোনো দেশ তার নীতি ঠিক করতে পারে না। ভারতও পারেনি। সেই স্বার্থের মাধ্যমে কোনো দেশের স্বার্থহানি হবে, আবার কোনো দেশের স্বার্থ রক্ষা পাবে। যে দেশের স্বার্থ রক্ষা পাবে, তার সঙ্গেই বন্ধুত্ব হবে। ভারতীয় সহায়তার মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার পথ অনেক সহজ হয়ে যায় এবং পাকিস্তানি শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটে। ভারতের এই বন্ধুসুলভ সহযোগিতায় বাংলাদেশের মানুষ চিরকাল কৃতজ্ঞ। পাশাপাশি এটাও সত্য যে বন্ধুত্ব এমন একটি সম্পর্ক, যার পরীক্ষা আজীবন দিতে হয়। বিপদে বন্ধুর উপকারে এসে পরে আবার ক্রমাগত নির্দয় আচরণ করতে থাকলে বন্ধুত্ব টিকে থাকার কথা নয়। পারস্পরিক মর্যাদা ও সম্মানের ভিত্তিতেই বন্ধুত্ব হয়। এই বাস্তবতা বুঝে মেনে নেওয়ার সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করবে ভারত-বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের গতি প্রকৃতি।