বাহারি রঙের ফুলের মনমাতানো সৌরভে মোহিত হতে চান? পুষ্প সুড়ঙ্গপথে হারাতে চান অবাক মুগ্ধতায়? আবিস্কার করতে চান সৌন্দর্যের নতুন অর্থকে? তাহলে আপনাকে স্বাগত জানাই উইস্টেরিয়ার জগতে।
উইস্টেরিয়া এক ধরনের ফুলগাছ, এটি উইস্টেরিয়া ফুজি ফ্লাওয়ার নামেও পরিচিত। উইস্টেরিয়া বিখ্যাত তার বিচিত্র রং আর মোহনীয় সৌরভের কারণে। এটি সাধারণত সাদা, বেগুনি, নীল আর গোলাপি রঙের হয়ে থাকে। অপূর্ব সুন্দর এই ফুলের দেখা মেলে চীন, জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলে। রোদে জন্মানো এর স্বভাব হলেও উইস্টেরিয়া কখনো কখনো ছায়াতেও জন্মায়। বসন্তকালে সাধারণত উইস্টেরিয়া পরিপূর্ণ সৌন্দর্য নিয়ে ধরা দিলেও গ্রীষ্মেও কখনো কখনো এটি ফুটতে দেখা যায়। গাছ কিংবা দেয়ালের গা বেয়ে ঝুলতে থাকা উইস্টেরিয়ায় সুসজ্জিত বসন্ত শীতের রুক্ষতার শেষে নিঃসন্দেহে প্রকৃতির অনন্য উপহার। এরকম কোনো বসন্ত অবলোকন করতে হলে আপনাকে যেতে হবে উইস্টেরিয়ার স্বর্গ জাপানে।
আশিকাগা উইস্টেরিয়া ফ্লাওয়ার পার্ক
জাপানে উইস্টেরিয়া দর্শনের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট স্থান হচ্ছে আশিকাগা উইস্টেরিয়া ফ্লাওয়ার পার্ক। ২০০৯ সালে সিএনএন এর জরিপে পৃথিবীর সেরা নয়টি স্বপ্নের গন্তব্যের একটি নির্বাচিত হয় এই পার্কটি। ৮২,০০০ বর্গ মিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই পার্কটিতে রয়েছে ৩০০ প্রজাতির উইস্টেরিয়া, যা পার্কটিকে করেছে অসাধারণ।
এই পার্কে বেড়াতে গেলে আপনার মনে গেঁথে থাকবে এর ৮০ মিটার দীর্ঘ উইস্টেরিয়ার সুড়ঙ্গ। সুড়ঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে উপরে তাকালে চোখে পড়বে চোখ ধাঁধানো সুন্দর ফুটন্ত উইস্টেরিয়ার রাশি, যার জাদুময় পরশে আপনি হারাবেন স্বপ্নময় কোনো জগতে। এই পার্কের আরেকটি দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য হচ্ছে, ১৫০ বছর বয়স্ক বিশাল ছড়ানো একটি উইস্টেরিয়া বৃক্ষ। এই গাছকে প্রায়ই বিখ্যাত ‘অ্যাভাটার’ মুভির ‘The Tree of Souls’ এর সাথে তুলনা করা হয়।
কাওয়াচি ফুজি গার্ডেন
এটি ইদানিং সোশাল মিডিয়ার সৌজন্যে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে এবং ভ্রমণ তালিকার সেরা দশটি স্থানে উঠে এসেছে। এই বাগানটি মূলত ব্যক্তি মালিকানাধীন। শুধু উইস্টেরিয়ার মৌসুমে এটি সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
১০,০০০ বর্গ মিটার এলাকার এই বাগানে রয়েছে ২২ প্রজাতির ১৫০টি উইস্টেরিয়া গাছ। বাগানটির বিশেষত্ব এর ২২০ মিটার দীর্ঘ সুড়ঙ্গে। প্রথম দেখায় এর নজরকাড়া সৌন্দর্যে আর মনোমুগ্ধকর ঘ্রাণে বিমোহিত হবেন। সুড়ঙ্গ ধরে হাঁটতে শুরু করলে, মনে হবে যেন হেঁটে বেড়াচ্ছেন অনিন্দ্যসুন্দর কোনো রূপকথার রাজ্যে। দর্শনার্থীরা এখানে এসে অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করেন।
ফুজিনো উশিজিমা
জাপানের কাশুকাবেতে অবস্থিত ২০,০০০ বর্গ মিটার এলাকার ফুজিনো উশিজিমায় রয়েছে বিচিত্র আকার ও প্রকারের উইস্টেরিয়া। এখানকার উইস্টেরিয়া গাছগুলোর বয়স ১,০০০ বছরের বেশি। এখানে জন্মানো উইস্টেরিয়া গুচ্ছগুলো সবচেয়ে বেশি লম্বা হয়ে থাকে। প্রায় ২ মিটার পর্যন্ত দীর্ঘ হয় এখানকার উইস্টেরিয়া। জাপানের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ১৯২৮ সালে এই বাগানটি ‘প্রাকৃতিক গুপ্তধন’ হিসেবে তৈরি করে। পরে ১৯৯৫ সালে সাংস্কৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ আইনে আবারও বাগানটির সংস্কার করা হয়। আইরিস, রডোডেনড্রন আর প্রায় পাঁচশ’ বছরের পুরনো পাইন গাছে আচ্ছাদিত লেক আর ছোট ছোট দ্বীপ ফুজিনোকে আরও বেশি আকর্ষণীয় করেছে।
কেমিডো তেনজিন মঠ
আপনি যদি টোকিওতে উইস্টেরিয়ার সৌন্দর্য্য মন ভরে দেখতে চান, তাহলে আপনাকে যেতে হবে জাপানের ঐতিহ্যবাহী উইস্টেরিয়ার বাগিচা কেমিডো তেনজিন মঠে। জাপানের রাজাদেরও এখানে উইস্টেরিয়া দেখতে আসার ইতিহাস রয়েছে।
এখানকার কিংবদন্তীতুল্য উইস্টেরিয়াগুলো নানা শিল্পকর্মের উপাদান যুগিয়েছে। উইস্টেরিয়ার মৌসুমে এখানে লাল তাইকো ব্রিজের উপরে ফুটন্ত উইস্টেরিয়া অপরূপ সুন্দর দৃশ্যের অবতারণা করে। উইস্টেরিয়ার ঝোপগুলোর নিচে থাকা শান্ত সমাহিত পুকুরের পানিতে ফুলের প্রতিবিম্ব পড়ে, যা একমাত্র কেমিডোতেই দেখা যায়।
কাসুগা মঠ
পবিত্র কাসুগা গ্র্যান্ড মঠের সামনে লাগানো উইস্টেরিয়া গাছগুলো ৮০০ বছরের পুরনো। এখানকার উইস্টেরিয়া বিখ্যাত এর দীর্ঘ পুষ্পপল্লবের কারণে। এখানকার উইস্টেরিয়া গুচ্ছ এতই লম্বা হয় যে, প্রায় মাটি স্পর্শ করে ফেলে। এজন্য এই উইস্টেরিয়াগুলোকে বলা হয়, ‘Sanazuri-no-Fuji’ অর্থাৎ মাটিস্পর্শী উইস্টেরিয়া। মঠের লাল চূড়ার পাশে উজ্জ্বল বেগুনী রঙের উইস্টেরিয়া গুচ্ছের কারুকাজের দৃশ্য সত্যিই অসাধারণ। মঠের পাশেই রয়েছে মেনিয়ো বোটানিক্যাল পার্ক। এটিও একটি উইস্টেরিয়ার স্বর্গোদ্যান।
পার্কটির দক্ষিণে ২০ প্রজাতির ২০০টি উইস্টেরিয়া গাছ বসন্তে অপূর্ব রং আর ঘ্রাণ নিয়ে প্রস্ফুটিত হয়। এই উইস্টেরিয়ার বাগানে শান্তভাবে চড়ে বেড়ায় হরিণের দল।
শিরাই ওমাচি ফুজি পার্ক
সানিন অঞ্চলে উইস্টেরিয়া দেখার আদর্শ স্থান হচ্ছে শিরাই ওমাচি ফুজি পার্ক। ১৫০টি উইস্টেরিয়া বিথীতে ছাওয়া ৫০০ মিটার দীর্ঘ, ৪ মিটার প্রশস্ত বীথিকুঞ্জ এই পার্কের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এই গগনবিহারি ফুলের পাশ দিয়ে হাঁটার সময় এর অতুলনীয় সৌন্দর্যে আর জাদুকরী সৌরভে বিস্ময়ে বিমোহিত হওয়াটাই হতে পারে আপনার জীবনের অন্যতম সেরা অভিজ্ঞতা।
ভাবছেন, এখনই জাপানের টিকিট বুক করবেন কিনা!
না, এখন নয়। জাপান যেতে চাইলে অবশ্যই বসন্তকালে উইস্টোরিয়ার মৌসুমে যাবেন। সুবাসিত উইস্টেরিয়ার সুড়ঙ্গে ভ্রমণ নিঃসন্দেহে আপনার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় মুহূর্ত হয়ে থাকবে। আর যারা জাপান যেতে পারছেন না, তারা হতাশ হবেন না। হয়তো স্বপ্নময় উইস্টেরিয়া টানেলে চক্কর দেয়া হবে না, বৈচিত্র্যময় উইস্টেরিয়ার বর্ণিল রুপ আস্বাদন করা হবে না, কিন্তু ঘরে বসেও আপনারা প্রাণভরে টেনে নিতে পারেন উইস্টেরিয়ার মিষ্টি ঘ্রাণ!
কীভাবে? বাসার বাগানে চাষ করে!
হ্যাঁ, উইস্টেরিয়া বুনো হলেও একে বাসায় চাষ করা যায়। তাই আপনার বাগানে বা বাসার দেয়ালেও শোভা পেতে পারে উইস্টেরিয়া। তবে এজন্য আপনাকে বেশ ভালোই অর্থ খরচ করতে হবে। তাতে কী! জাপানের টিকিটের চেয়ে তো সেই খরচ অবশ্যই কম!
চীনা, আমেরিকান আর জাপানি উইস্টেরিয়ার মধ্যে আমেরিকান উইস্টেরিয়া একটু কম বাড়ে বলে এরা বাসায় চাষোপযোগী। তবে জাপানি বা চীনা উইস্টেরিয়াও পাওয়া যায় চাষের জন্য। অবশ্য আমেরিকান উইস্টেরিয়ার ফুলের গুচ্ছ অপেক্ষাকৃত কম দীর্ঘ হয়। তারপরও এদের এশীয় বোনদের তুলনায় সৌন্দর্য্যে বা সুগন্ধে ঘাটতি পড়ে না। বেশিরভাগ উইস্টেরিয়া মিষ্টি ঘ্রাণের হলেও, কিছু প্রজাতির উইস্টেরিয়া থেকে ঝাঁঝালো ঘ্রাণও পাওয়া যায়। তাই আপনাকে জানতে হবে কোন কোন প্রজাতির ঘ্রাণ মিষ্টি হয়। এখন বলবো মিষ্টি ঘ্রাণের কিছু উইস্টেরিয়া প্রজাতির কথা।
Wisteria brachybotryrs ‘murasaki kapitan’ (Silky Wisteria)
তীব্র সুগন্ধীযুক্ত চমৎকার ফুলের উইস্টেরিয়া এটি। বসন্তের শেষে সবুজ পাতার আড়ালে বেগুনী-নীলের অসাধারণ এবং নাটকীয় পুষ্পপ্রদর্শনী আপনাকে মুগ্ধ করবে। ১০-২৫ ফুট লম্বা হয় এই উইস্টেরিয়া গাছ।
Wisteria brachybotrys ‘okamaya’
হালকা সবুজ পাতা আর বেগুনী বর্ণের সুগন্ধী এই প্রজাতির উইস্টেরিয়া ফোটে বসন্তের শেষে। এটি ১০-২০ ফুট লম্বা হয়।
Wisteria brachybotrys ‘shiro-kapitan’
তুষারশুভ্র রঙের সাথে মিষ্টি গন্ধের এই ফুলটি আপনি নির্দ্বিধায় আপনার বাগানে স্থান দিতে পারেন। ১০-৪০ ফুট উচ্চতার এই প্রজাতি অবশ্যই আপনার বাগানকে সমৃদ্ধ করবে।
Wisteria floribanda
এটি জাপানি সুগন্ধী উইস্টেরিয়া। হালকা গোলাপি রঙের ফুল উৎপন্নকারী এই প্রজাতি ১০-৩০ ফুট লম্বা হতে পারে।
Wisteria sinensis
এটি চীনা উইস্টেরিয়া। এর সাদা রঙা মটরশুঁটি আকৃতির ফুল তীব্র সুগন্ধীর হয়ে থাকে।
এবার আসা যাক কীভাবে উইস্টেরিয়া চাষ করবেন সে ব্যাপারে।
উইস্টেরিয়া শক্ত, লতানো ধরনের বৃক্ষ। তাই এটি চাষ করতে হলে আপনাকে গাছের পাশে লাঠি, দড়ি বা তার দিতে হবে যাতে করে উঠে যাওয়ার জন্য গাছটি অবলম্বন খুঁজে পায়। এর কাণ্ড সুদৃশ্য এবং কুণ্ডলিত হয়। তাই এর আশেপাশে কোনো গাছ রাখবেন না। তাহলে সেটিকেও পেঁচিয়ে ধরবে। সব ধরনের মাটিতেই উইস্টেরিয়া জন্মে। এটি উজ্জ্বল সূর্যালোকে স্বাচ্ছেন্দ্যে বাড়তে পারে, অল্প ছায়া থাকলেও সমস্যা হয় না। উইস্টেরিয়ার বীজও দেখতে সুন্দর হয়।
তবে সাবধান! এত সুন্দরেও কিছু ‘কিন্তু’ আছে! উইস্টেরিয়া বীজের সংস্পর্শে এলে কখনো কখনো অসুস্থও হয়ে যায় মানুষ, যেমন- মাথা ঘোরা, ডায়রিয়া, বমিভাব হওয়া ইত্যাদি।
তাহলে,আপনার বাসার সৌন্দর্যবর্ধন করতে এবং রঙিন ফুলেল সৌরভে মন হারাতে, আপনিও চাষ করতে পারেন উইস্টেরিয়া। শুধু চীনা, জাপানি বা আমেরিকানদের নয়, উইস্টেরিয়ার সৌন্দর্য আর ঘ্রাণে অনাবিল আনন্দে ছেঁয়ে যাক আপনার মনও।