‘শান-বাঁধানো ফুটপাথে
পাথরে পা ডুবিয়ে এক কাঠখোট্টা গাছ
কচি কচি পাতায় পাঁজর ফাটিয়ে হাসছে।
ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত’।
বসন্ত ঋতু নিয়ে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের এই কবিতাটি বাঙালী সমাজে খুবই জনপ্রিয়। কবিতাটির প্রতিটি ছত্রে বসন্ত আগমনের গভীর তাৎপর্য আর এর প্রতি জীবের সুগভীর আকাংখা মূর্ত হয়ে উঠেছে যেন।ষড়ঋতুর কালচক্রে বসন্তই হলো শেষ ঋতু। বসন্তের আগমন ঘটে ফুলে-ফলে বর্ণিল প্রকৃতি নিয়ে। প্রকৃতির এই রূপ-লাবণ্য মানব মনেও যেন অন্য রকম দোলা দিয়ে যায়। এখন প্রশ্ন হলো কীভাবে ছয় ঋতুর মধ্যে বসন্ত ঋতুর রাজা বনে গেল? জানাচ্ছেন অনিন্দ্য ্আফরোজ।
মূলত, বসন্ত যতটা প্রকৃতি ও মানব হৃদয়ে বর্ণিল ও মূর্ত হয়ে ধরা দেয় অন্য কোনো ঋতু এমন করে প্রকৃতি ও মানুষের অনুভূতিকে অতটা আলোড়িত করে না। আর এই বৈশিষ্ট্যির কারণেই বাংলা কিংবা অন্য ভাষার কবিতা, সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি স্থান পেয়েছে বসন্তের রূপ, সৌন্দর্য এবং প্রভাব। বসন্ত ঋতুকে নিয়ে অসংখ্য কবিতা, সাহিত্য এই ঋতুকে আরো মোহনীয় করে তুলেছে। মূলত, কাব্য, সাহিত্যে ঋতু বসন্তের রূপ-সৌষ্ঠব এতোটাই প্রাধান্য পেয়েছে যে কালক্রমে বসন্ত ঋতুর গৌরব উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে সর্বত্র। এরমধ্যে সংস্কৃত কবিরা যেমন আছেন, তেমনি বিলেতি কবিরা আছেন এবং আছেন বাঙালি কবিরাও। মূলত বসন্তকাল বিশ্ব সাহিত্যের অঙ্গণে যতটা বেশি স্থান দখল করে আছে অন্য কোনো ঋতু অতটা দখল করতে সক্ষম হয়নি।আর এই গৌরবই তাকে কালক্রমে ঋতুর রাজার আসনে অভিষিক্ত করেছে। পশ্চিমা বিশ্বে বসন্ত যেন প্রাণ ফিরিয়ে দেয় প্রকৃতিকে। শীতকালে তুষার আচ্ছাদিত বনানী-জনপদ, ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া অবস্থা, বৃক্ষগুলোর নিষ্পত্র, কঙ্কালসার অবস্থা হয়ে যাওয়ার পর বসন্ত আসে আশির্বাদের মতো।প্রাণ সঞ্চার হয় প্রকৃতি ও মানুষের জীবনে।আর বাংলাদেশে বসন্ত আসে পাতাঝরা দিন, আর কিশলয় নিয়ে। আসে দখিণা বাতাসের ধূলি-ধূসরিত এক মধুময় আবেশ নিয়ে। যদিও চৈত্র্যের পাতাঝরা নির্জন দিনগুলোও বেশ উপভোগ্য।
বসন্তের সময়সীমা
জীববৈচিত্র্য ও প্রকৃতিতে ঋতুগত প্রভাব ব্যাপক। বাংলায় সাধারণত ছয়টি ঋতুর প্রাধান্য দেখা যায়, যেমন- গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। শীত ঋতু পৌষ-মাঘের পর প্রতৃতিতে নতুন রূপের আহবান নিয়ে বর্ণিল সাজে আসে বাংলা শেষ দুই মাস ফাল্গুন ও চৈত্র। এই দু মাস মিলেই বসন্ত ঋতু। বাংলার প্রকৃতি ও বাঙালী মননের খুব কাছের ঋতু বসন্তকাল।
‘বেণুবন মর্মরে দখিন বাতাসে, প্রজাপতি দোলে ঘাসে ঘাসে।’
বসন্ত এমন এক ঋতু যার গভীরে যেমন শীতল হাওয়ার রুক্ষতা আর্দ্রতা শুষে নেয় তেমনি আচমকাই প্রকৃতি তার দখিণ দুয়ার উন্মুক্ত করে দেয় গোটা প্রকৃতি। না-শীতল, না-বর্ষণমুখর কিংবা গ্রীষ্মের লু হাওয়া নয়, এলোমেলো নরম দখিণা হাওয়া মনপ্রাণে শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়।
‘রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোকে-পলাশে’ বসন্তের ফুল নিয়ে বহু গান-কবিতা আছে এমন। কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, অশোক, রক্তকাঞ্চন, কুসুম, গাঁধা, দেবদারু, নাগেশ্বর, পলকজুঁই, পলাশ, মহুয়া, মাদার, রুদ্রপলাশ, শাল, শিমূল, স্বর্ণশিমূল, ক্যামেলিয়া, হিমঝুরি, কত ফুলে ফুলে রঙিন হয়ে হয়ে বন-বনানী। প্ইরকৃতি যেন ফুলে-ফলে ভরা যৌবনা হয়ে ওঠে বসন্তের ছোঁয়ায়।
‘ফাল্গুনে বিকশিত কাঞ্চন ফুল/ ডালে ডালে পুঞ্জিত আম্রমুকুল’- বাঙালীর কাছে প্রিয় ফল ফলের নাম হলো আম। রসালো আম গ্রীষ্মকালীন ফল। বসন্তকালে আমগাছের শাখায় শাখায় ভরে ওঠে মুকুল । নবমঞ্জরিতে ভারাক্রান্ত আমগাছ গর্ভবতীর ন্যায় ন্যুব্জ হয়ে যায়, মৌমাছি গুঞ্জরণে মুখর থাকে বনানী। ভ্রমররা মনের আনন্দে আম্র মঞ্জুরির মধু পানে মত্ত থাকে ভ্রমর। যব, গম, সরিষা খেতে ফুলে-ফলে ভরে ওঠে মাঠ।
‘কুহু কুহু শোনা যায় কোকিলের কুহুতান/ বসন্ত এসে গেছে, বসন্ত এসে গেছে’- সুকণ্ঠি কোকিলের কুহুতান আকুল করে মনপ্রাণ। কোকিল যেন বসন্ত ঋতুর অনন্য প্রতীক। কোকিলের ডাকে ‘বসন্ত জাগ্রত হয় দ্বারে।’ বনে বনে রঙ-বেরংয়ের প্রজাপতির আনাগোনায় আরো বর্ণিল হয়ে ওঠে প্রকৃতি। অলির গুঞ্জনে মাতোয়ারা হয় প্রকৃতি।
বসন্ত উৎসব:
‘ওহে গৃহবাসী, দ্বার খোল্, লাগল যে দোল/ স্থলে- জলে. বনতলে, লাগল যে দোল/ দ্বার খোল্, দ্বার খোল্’- কবির এমন আহ্বান কি উপেক্ষা করা যায়! হাতের সব কাজ ফেলে শামিল হতে ইচ্ছা হয় উৎসবে। ফাগুনের পূর্ণিমা তিথিতে দোলযাত্রা উৎসব হয়। আবিরে আবিরে রাঙিয়ে যাওয়া, রঙের খেলা, বাঙালির সংস্কৃতির এক অমলিন ঐতিহ্য আজো।
বসন্ত পঞ্চমী
বিদ্যা ও সঙ্গীত-সংষ্কৃতির দেবী সরস্বতীর আরাধনাকে কেন্দ্র করে একটি অন্যতম উৎসব পালিত হয় এই বসন্তে। হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পূজা আয়োজিত হয়। তিথিটি বসন্ত পঞ্চমী নামেও পরিচিত। উত্তর ভারত, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, নেপাল ও বাংলাদেশে সরস্বতী পূজা উপলক্ষে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে আয়োজন হয় এই উৎসব।এই বসন্তেই আয়োজন হয় পশ্চিমা বিশ্বের আরেক আয়োজন ও উৎসব বিশ্ব ভালবাসা দিবস বা ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’।
চৈত্র্য-সংক্রান্তি
চৈত্র্য মাস বাঙালীদের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মাস। বাঙলা বছরের প্রথম মাস বৈশাখে বাঙালী ব্যবসায়ীরা হালখাতা অর্থাৎ নতুন খাতা খুলে নতুন বছরের হিসাব সূচনা করে। এজন্য পুরোনো বছরের হিসাব-নিকাষ শেষ করেন এই মাসে। আবার শেষ বছরেরৈ এই সময়ে চৈত্র্য সংক্রান্তিতে বাঙালী ঐতিহ্যের নীল নৃত্য প্রদর্শন হয় গ্রামে গ্রামে। পুরানো কালকে বিদায় দিয়ে নতুন বছরে সংকট কেটে সুখ ও সমৃদ্ধির আশায় শিবের আরাধনা বা শিবের গাজন অনুষ্ঠিত হয়। চৈত্র শেষে শিবের গাজন উৎসবই হল নীল পূজা।
‘আহা, আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে/ এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়…- বসন্ত ঋতুর বৈচিত্র্যে বিভোর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন এমন মধুর বাণী। বলা যায়, বসন্ত আসে প্রতৃতির শূন্যতাকে ভরিয়ে দিতে আশির্বাদের মতো।ফুলে, ফলে, পুরণোকে ঝেড়ে ফেলে নবপত্র পল্লবে প্রতৃতিকে নতুন করে সাজাতে। এজন্যেই কবিতায়, সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে বসন্তের ঐশ্বর্য । আর এতেই কালক্রমে বসন্ত পেয়েছে ঋতুর রাজার স্বীকৃতি। বৈশাখে নতুন বছরের আনন্দে বাঙালী মননকে রাঙিয়ে প্রকৃতি থেকে বিদায় নেয় ঋতুরাজ বসন্ত।
বসন্তকাল অনুচ্ছেদ
কখনো বা চাঁদের আলোতে কখনো বসন্ত সমীরণে সেই ত্রিভুবনজয়ী, অপার রহস্যময়ী আনন্দ-মুরতিখানি জেগে ওঠে মনে
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আসে বসন্ত ফুল বনে সাজে বনভূমি সুন্দরী; চরণে পায়েলা রুমুঝুমু মধুপ উঠিছে গুঞ্জরি
– কাজী নজরুল ইসলাম
বসন্ত এলো এলো এলো রে পঞ্চম স্বরে কোকিল কুহরে মুহু মুহু কুহু কুহু তানে
– কাজী নজরুল ইসলাম
ফাগুন, হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দানঃ তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দানঃ আমার আপনহারা প্রাণ; আমার বাঁধন ছেঁড়া প্রাণ
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে। তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে। তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা, বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে।
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তোমার প্রজাপতির পাখা আমার আকাশ-চাওয়া মুগ্ধ চোখের রঙিন স্বপন মাখা । তোমার চাঁদের আলোয় মিলায় আমার দুঃখ-সুখের সকল অবসান
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ফাগুনের রঙে রেঙেছো তুমি, না বলা কথা আজ বলবো আমিঃ হৃদয়ের ডাক শুনবে কি তুমি?
– সংগৃহীত
ফাল্গুনে শুরু হয় গুনগুনানী, ভোমরাটা গায় গান ঘুম ভাঙানি
– ফররুখ আহমেদ
কি কর শ্বশুর মিছে খেটে ফাল্গুনে এঁটে পোত কেটে বেড়ে যাবে ঝাড়কি ঝাড় কলা বইতে ভাংগে ঘাড়।
– খনা
কারও কারও জীবনে বসন্ত নিভৃতে আসে বাইরে প্রকাশ পায় না। তার আমেজে সে নিজেই পুলকিত হয়।
– জন ফ্রেচার
আমাকে পাবে না খুঁজে, কেঁদে কেটে মামুলি ফাল্গুনে
– হেলাল হাফিজ
হয়তো ফুটেনি ফুল রবীন্দ্রসঙ্গীতে যত আছে, হয়তো গাহেনি পাখি অন্তর উদাস করা সুরে বনের কুসুমগুলি ঘিরে। আকাশে মেলিয়া আঁখি তবুও ফুটেছে জবা, দূরন্ত শিমুল গাছে গাছে, তার তলে ভালোবেসে বসে আছে বসন্ত পথিক
– নির্মলেন্দু গুণ
একঝাক পাখি এসে ঐকতানে , গান গায় এক সাথে ভোর বিহনে, অচানক দুনিয়াটা আজব লাগে, আড়মোড়া দিয়ে সব গাছেরা জাগে, লাল নয় কালো নয় সবুজ পাতা, জেগে ওঠে একরাশ সবুজ পাতা
– ফররুখ আহমেদ
হে কবি! নীরব কেন-ফাল্গুন যে এসেছে ধরায়, বসন্তে বরিয়া তুমি লবে না কি তব বন্দনায়?
– সুফিয়া কামাল
আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো
– জহির রায়হান