সালমান শাহর মৃত্যু হত্যা না আত্মহত্যা?

জানুয়ারি ১৪, ২০১৭
Spread the love

আয়না২৪ ডেস্ক

বাংলাদেশী সিনেমার একসময়ের জনপ্রিয় নায়ক সালমান শাহ আত্মহত্যা করেন নাকি তাঁকে খুন করা হয় সেই বিষয়টি ২০ বছরেও পুরোপুরি মীমাংসা হয়নি । চার দফা তদন্তের পরেও এই মৃত্যু রহস্যের ধূয়াসা  কাটেনি।তাই এতো বছর পর পুনরায়  র শুরু হয়েছে তদন্ত। এবার তদন্তভার দেওয়া হয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই)।
নতুন তদন্তকারীরা নেমেছেন টুকরো টুকরো আলামত, ইশারা মিলিয়ে ২০ বছর আগের মৃত্যুমুহূর্তটি পুনর্নির্মাণের কাজে। তাঁরা স্বীকার করছেন, অত্যন্ত কঠিন হবে এ কাজ। কেননা গত ২০ বছরে অনেক আলামতই আর অবিকৃত নেই। অনেককেই আর সাক্ষ্যের জন্য পাওয়া যাবে না।
সিনেমার জগতে সালমান শাহ নামে পরিচিত হলেও নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় এই অভিনেতার পুরো নাম শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন। তাঁর অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর থানা-পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ, সিআইডি, র‍্যাব একে একে মামলাটির তদন্ত করে। মাঝখানে ১৫ বছর ধরে চলেছে বিচার বিভাগীয় তদন্তও। সব কটি তদন্ত প্রতিবেদনেই এটিকে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিবার তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়ার পর পরিবারের আপত্তির (নারাজি) মুখে তদন্ত সংস্থা পরিবর্তন হয়েছে।
পিবিআইয়ের ঢাকা মহানগরের বিশেষ পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ গত শুক্রবার সাংবাদিকদের  বলেন, গত ৬ ডিসেম্বর মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই কাজ শুরু করেছেন তাঁরা। এর মধ্যেই তদন্ত কর্মকর্তা সিলেটে সালমানের মা নীলা চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলে এসেছেন। অন্যান্য কাজও শুরু হয়ে গেছে।

১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সকালে রাজধানীর নিউ ইস্কাটন গার্ডেন এলাকায় ভাড়া বাসায় পাওয়া যায় অভিনেতা সালমান শাহর লাশ। বাংলা সিনেমায় তাঁর জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি তখন মধ্যগগনে। স্ত্রী সামিরা হক পুলিশকে জানান, সকালবেলা ড্রেসিংরুমে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় সালমানের দেহ তাঁরা শনাক্ত করে দেহটি নামিয়ে আনেন।

সালমান শাহকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। সালমানের বাবা কমর উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী রমনা থানায় অপমৃত্যুর মামলা করেন। ২০০২ সালে মারা যান সালমান শাহর বাবা।

অপমৃত্যুর ওই মামলায় বলা হয়েছে, ঘটনার দিন সকাল সাড়ে নয়টার দিকে গ্রীনরোডের নিজ বাসা থেকে ইস্কাটনে সালমানের ভাড়া বাসায় ছেলের সঙ্গে দেখা করতে আসেন কমর উদ্দিন। সালমানের ব্যক্তিগত সহকারী আবুল ও তাঁর স্ত্রী সামিরা তাঁদের বলেন, ‘সালমান রাত জেগে কাজ করেছে। এখন তাঁকে ঘুম থেকে ডাকা যাবে না।’ তিনি প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষা করে বাসায় ফিরে আসেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সেলিম নামের একজন ফোন করে জানান, সালমানের কী যেন হয়েছে। সালমানের বাবা, মা ও ভাই ওই ফ্ল্যাটে ছুটে যান। গিয়ে শয়নকক্ষে সালমানের নিথর দেহ দেখতে পান তাঁরা।

সালমানের মা নীলা চৌধুরী  বলেন, সালমানের মৃত্যুর দিনই অনেকটা পরিবারের অজান্তে সালমানের বাবা কমর উদ্দিন চৌধুরীর স্বাক্ষর নিয়ে রমনা থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা করে পুলিশ। সেই মামলার তদন্ত চলছিল। এর মধ্যে ১৯৯৭ সালে রিজভি আহমেদ নামের একজন অন্য এক মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে আদালতে জবানবন্দিতে স্বীকার করেন, সালমান শাহকে হত্যা করে আত্মহত্যার ঘটনা সাজানো হয়েছে এবং তিনি (রিজভি) নিজেও সেই হত্যায় জড়িত ছিলেন। সালমানের বাবা কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে আদালতে নালিশি হত্যা মামলা করেন। আদালত দুটি অভিযোগ একসঙ্গে তদন্তের নির্দেশ দেন।

তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, ঘটনাস্থলের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত এমন কয়েকজন যেমন, সালমানের বাসার গৃহকর্মী মনোয়ারা ও ডলি, সালমানের সহকারী আবুল হোসেন খান, সালমানের ফ্ল্যাটের নিরাপত্তারক্ষী আবদুল খালেক, ফ্ল্যাটের ব্যবস্থাপক নূরউদ্দিন জাহাঙ্গীর, লিফটম্যান আবদুস সালাম এবং সালমানের ফ্ল্যাটের আশপাশের বাসিন্দাদের কারও জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়নি।

সালমানের মা নীলা চৌধুরীর অভিযোগ, সেলিম নামে যে ব্যক্তি সালমানের মৃত্যুর খবর পরিবারকে জানাল, তারই জবানবন্দি নেওয়া হয়নি কোনো তদন্তে। মরদেহ সিলিং ফ্যান থেকে নামানোর প্রত্যক্ষদর্শী কারও জবানবন্দি নেওয়া হয়নি। আর ১৫ বছর ধরে চলা বিচার বিভাগীয় তদন্তে কেবল সালমান পরিবারের চার সদস্যের জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। ভালো করে তদন্ত না করেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সালমানের মৃত্যু আত্মহত্যাজনিত’। কিন্তু কী কারণে সালমান আত্মহত্যা করেন তার ব্যাখ্যা নেই কোনো তদন্ত প্রতিবেদনে।

মামলার তদন্তে যুক্ত ছিলেন র‍্যাবের এমন একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সম্প্রতি  বলেন, ‘তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ে পুলিশের কিছু সাধারণ গাফিলতি থাকতে পারে। কিন্তু ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন ও অন্য সব সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে এটা স্পষ্ট যে সালমান আত্মহত্যা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর পরিবার বিষয়টি মেনে নিচ্ছে না।’

এ বিষয়ে মামলার তদন্ত তদারককারী কর্মকর্তা সিআইডির তৎকালীন বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল হান্নান খান  বলেন, ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীদের জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছিল কি না তা আমার মনে নেই। তদন্ত একটা চলমান প্রক্রিয়া। পুনরায় তদন্তে দোষের কিছু দেখি না।

মা নীলা চৌধুরী বলেন, কমরউদ্দিন ঘটনার দিন সালমানের সঙ্গে দেখা করতে গেলেও তাঁকে দেখা করতে না দেওয়া অত্যন্ত সন্দেহজনক।

এ নিয়ে সম্প্রতি কথা হয় চলচ্চিত্র পরিচালক বাদল খন্দকারের সঙ্গে, যিনি ওই দিন সালমানের বাসায় গিয়েছিলেন। বাদল খন্দকার বলেন, ছবির কাজের শিডিউল নিতে তিনি সকালে সেখানে গেলে বাসার নিচে দারোয়ানেরা তখন বলাবলি করছিল, সালমান রাতেই ফাঁস দিয়ে মারা গেছেন। এরপর সালমানের বাসায় গিয়ে তিনি দেখেন, ড্রেসিংরুমে সালমানের মরদেহ পড়ে আছে। সালমানের বাবা-মাকে এ খবর দেওয়া হয়নি জানতে পেরে তিনি সেলিম নামের চলচ্চিত্রের একজন প্রডাকশন ম্যানেজারকে সালমানের বাসায় খবর দিতে বলেন।

 সালমানের তখনকার সহকারী আবুল হোসেন খান  বলেন, ওই দিন শুক্রবার বেলা ১১টায় ঘুম থেকে উঠে পানি ও চা পান করে ড্রেসিংরুমে ঢোকেন সালমান। পরে সালমান জুমার নামাজ পড়তে যাবেন কি না তা জানার জন্য ওই রুমের দরজায় টোকা দিয়ে আবুল হোসেন বুঝতে পারেন, দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। পরে সালমানের স্ত্রী সামিরা চাবি দিয়ে দরজা খুলে দেখতে পান, সালমানের দেহ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছে। রশি কেটে তাঁর দেহ নামানো হয়।

সালমানের বাসার লিফটম্যান আবদুস সালামের সঙ্গেও ওই বাসার নিচে কথা হয়। সালাম  বলেন, ‘ইস্কাটন প্লাজার এই বাসায় ২৯ বছর ধরে কাজ করছি। ঘটনার দিন সকালে শুনতে পারি, সালমান ভাই আত্মহত্যা করেছেন। এর বেশি কিছু আমি জানি না।’

সালমানের বাসা থেকে পুলিশ একটি সুইসাইড নোট বা আত্মহত্যার চিঠি উদ্ধার করে।

চিঠিতে লেখা আছে, ‘আমি চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরিয়ার, পিতা-কমর উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, ১৪৬/৫, গ্রীনরোড, ঢাকা-১২১৫ ওরফে সালমান শাহ এই মর্মে অঙ্গীকার করছি যে আজ অথবা আজকের পরে যেকোনো দিন মৃত্যু হলে তার জন্য কেউ দায়ী থাকবে না। স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে, সুস্থ মস্তিষ্কে আমি আত্মহত্যা করছি।’

এই চিঠিতে কারও স্বাক্ষর ছিল না। তবে সিআইডির হস্তবিশারদেরা পরীক্ষা করে বলেছেন, এটা সালমান শাহের হাতের লেখা।

কিন্তু সালমানের মা নীলা চৌধুরী এই চিঠি নিয়ে গুরুতর সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা ওকে ইমন নামেই ডাকতাম। অথচ চিঠিতে ইমন নামের কোনো অস্তিত্ব নেই। ও থাকে ইস্কাটনের বাসায়। কিন্তু ঠিকানা লেখা আছে আমাদের বাসার। সালমান শাহ নামটিও ঠিকানার পরে লেখা।’

চিঠির ভাষার আনুষ্ঠানিক ভঙ্গি নিয়ে প্রশ্ন তুলে নীলা চৌধুরী আরও বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি আত্মহত্যা করার আগে এ রকম মামলা লেখার স্টাইলে এত গুছিয়ে বাবার নাম, ঠিকানা উল্লেখ করে চিঠি লেখে বলে আমার জানা নেই। এখানেই আমার ঘোরতর সন্দেহ।’

নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, সালমানের ফ্ল্যাট থেকে দুটি ছোট বোতলে (ভায়েল) ভরা তরল পাওয়া যায়। সিআইডির রাসায়নিক পরীক্ষক মুহাম্মদ আবদুল বাকী মিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই বর্ণহীন তরলে ‘লিগনোকেইন হাইড্রোক্লোরাইড’ পাওয়া গেছে, চিকিৎসকেরা যেটি লোকাল অ্যানেসথেসিয়ার (স্থানীয় চেতনানাশক) কাজে ব্যবহার করেন।

সালমানের মৃত্যুর বিষয়ে তিনটি সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনে কোনোটিতেই এই রাসায়নিকের ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই।

এ বিষয়ে সিআইডির তখনকার পুলিশ সুপার আবদুল হান্নান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানুষ অজ্ঞান করার এই রাসায়নিক আলামত জব্দ করেছিল ডিবি পুলিশ। কে এটি সালমানের বাসায় নিয়ে আসে, তা বলতে পারব না।’

নীলা চৌধুরীর আইনজীবী মাহফুজ মিয়া ও ফারুক আহম্মেদ  বলেন, সালমানের বাসায় চেতনানাশকের উপস্থিতির রহস্য বের করা গেলে সালমানের মৃত্যুর আসল রহস্য উদ্‌ঘাটিত হবে।

এ বিষয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সালমানের স্ত্রী সামিরা হককে পাওয়া যায়নি। তাঁর বাবা শফিকুল হক হীরার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সম্প্রতি  বলেন, ‘সালমান আত্মহত্যা করেছেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। ডিবি ও সিআইডি তদন্ত করে আদালতে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনও দিয়েছে। সালমানের মৃত্যুর পর ওই বাসা ছিল সালমানের পরিবারের দখলে। তারাই এই অ্যানেসথেসিয়ার শিশি ওই বাসায় রেখে ফাঁসানোর চেষ্টা করেছে।

সূত্র- প্রথম আলো