আয়না২৪ ডেস্ক
হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজিবি)। এটি একটি ভয়ঙ্কর উগ্রবাদী জঙ্গি সংগঠন। ১৯৮৯ সালে এই সংগঠনটির প্রতিষ্ঠা করেন যশোরের মনিরামপুরের রহমান ফারুকী নামে এক ব্যক্তি। আর ফারুকীর সহযোগী ছিলেন ভূমিকা পালন করেন ফজলুর রহমান ওরফে খলিল ও সাইফুল্লাহ আকতার নামে দুজন। সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধ শেষে আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তের খোস্ত রণাঙ্গনে জন্ম হয় হরকাতুল জিহাদ বা হুজি নামের এই উগ্র সংগঠনের।
১৯৯২ সালের ৩০ এপ্রিল ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে হুজিবি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে জানান আফগানফেরত যোদ্ধা শফিকুর রহমান। আফগানফেরত আড়াই থেকে তিন হাজার সদস্য প্রাথমিকভাবে এ সংগঠনের সদস্য ছিলেন।
হুজির ভয়াবহতা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একাধিকবার হত্যার চেষ্টা করে হুজি। ১৯৯৯ সালে কবি শামসুর রাহমানকে হত্যাচেষ্টা চালায় এরা; পয়লা বৈশাখ রমনার বটমূলে সিরিজ বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় এই উগ্রবাদীরা। এ হামলায় হুজি সদস্য সুজনসহ ১০ জন নিহত হন। আহত হন অর্ধশতাধিক।
দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, মুফতি হান্নানের বিরুদ্ধে ১৭টি মামলা হয়েছে। দুটির বিচার শেষ হয়েছে। এর মধ্যে সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলার দায়ে মুফতি হান্নানসহ তিন জঙ্গির ফাঁসি গত রাতে কার্যকর হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে হুজির প্রধাননেতা হান্নান অধ্যায়ের সমাপ্তি হল। ২০০১ সালে রমনায় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা মামলায় হান্নানসহ হুজির ৮ জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। হান্নানের বিরুদ্ধে দায়ের করা আরও ১৩টি মামলার বিচার চলছে। দুটির অধিকতর তদন্ত চলছে।
বিভিন্ন সূত্র জানায়, পাকিস্তানকেন্দ্রিক জিহাদি গ্রুপ হরকাতুল মুজাহিদিন (হাম), জয়েশ-ই-মোহাম্মদ, লস্কর-ই-তৈয়বার মতো হুজিবির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অভিন্ন। তালেবান ভাবাদর্শে বিশ্বাসী এ সংগঠন। দেশে হুজিবির কার্যক্রম শুরুর সময় সব সদস্য মাসে ১০ টাকা চাঁদা দিত। তারা ‘মাসিক রহমত’ নামে একটি খেলাফত আন্দোলন পত্রিকা বের করত। পাকিস্তানি লেখকের সম্পাদিত ‘মরণজয়ী’ ও আমিরুল ইসলাম সম্পাদিত ‘আঁধার রাতের বন্দিনী’ তৎকালীন সময়ে হুজিবি জঙ্গিদের উগ্রপন্থায় উদ্বুদ্ধ করতে ভূমিকা রাখে। ২০০৫ সালে সরকার হুজিবিকে নিষিদ্ধ করে। এর সদস্যরা হানাফি মাজহাবে বিশ্বাসী ও দেওবন্দ ধারার কওমি মাদ্রাসা থেকে লেখাপড়া করা। জেএমবির সঙ্গে তাদের পার্থক্য হলো এ সংগঠনের নেতাকর্মীরা আহলে হাদিস বা লা মাজাহাবি (মাজহাববিরোধী) ধারায় বিশ্বাসী।
গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার হিরণ গ্রামের মুসলিম লীগ নেতা নূর উদ্দিন মুন্সীর ছেলে মুফতি আবদুল হান্নান। বিয়ে করেন মাগুরায়। তার দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে। মুফতি হান্নান টুঙ্গিপাড়ায় গওহরডাঙ্গা ও বরিশালের শর্ষিনা মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। এর পর তিনি ভারতের বিহারের দেওবন্দ মাদ্রাসা ও পাকিস্তানের করাচির নিউ টাউন মাদ্রাসায় ভর্তি হন। ১৯৮৭ সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক শিক্ষায় স্নাতকোত্তর পাস করেন। পরের বছর ১৯৮৮ সালে তিনি পাকিস্তানে যান এবং করাচির জামিয়া ইউসুফ বিন নুরিয়া মাদ্রাসায় ফিকাহ শাস্ত্রে ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি সীমান্তবর্তী শহর খোস্তে প্রশিক্ষণ নিয়ে আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধে আহত হয়ে তিনি পেশোয়ারে কুয়েত আল-হেলাল হাসপাতালে ১০ মাস চিকিৎসা নেন। এর পর করাচির ওই মাদ্রাসায় লেখাপড়া শেষ করেন। মুফতি হান্নান ১৯৯৩ সালে দেশে ফেরেন এবং পাকিস্তানভিত্তিক হরকাতুল মুজাহিদিনের হয়ে তৎপরতা শুরু করেন। ওই সময় হান্নান গোপালগঞ্জ বিসিক শিল্পনগরীতে ‘সোনার বাংলা’ নামে সাবান কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছাড়া কোটালীপাড়ায় ঘাঘরকান্দা গ্রামে একটি ক্যাডেট মাদ্রাসাও গড়ে তোলেন। মুফতি হান্নান ১৯৯৪ সালে হুজিবিতে যোগ দেন। তিনি কোটালীপাড়া উপজেলায় প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পান। তার আগেই আফগানফেরত মুজাহিদরা হুজিবি গঠন করেন। নেতৃত্বগুণ, সাহস ও দক্ষতার প্রমাণ দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে মুফতি হান্নান সংগঠনে নেতৃত্বের পর্যায়ে চলে আসেন।
২০০৫ সালের ১ অক্টোবর রাজধানীর বাড্ডা এলাকা থেকে র্যাব মুফতি হান্নানকে গ্রেপ্তার করে। টানা চার মাস তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরপর ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ একাধিক হামলায় সরাসরি জড়িত ছিলেন মুফতি হান্নান। জানা যায়, হামলায় ব্যবহৃত গ্রেনেডের উৎস ছিল পাকিস্তান। ২০১১ সালে আদালতে দেওয়া ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে মুফতি হান্নান জানান, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা পরিকল্পনায় তৎকালীন গোয়েন্দা সংস্থার বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমানসহ হাওয়া ভবন ঘনিষ্ঠ একাধিক রাঘববোয়াল জড়িত। এরপরই ‘জজমিয়া’ নাটকের দৃশ্যপট পাল্টে যায়।
একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর হুজির অধিকাংশ নেতা গ্রেপ্তার হন। এর মধ্যে হুজির কারাবন্দি নেতা মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে আবু জাফর কিছু অনুসারী নিয়ে নতুন সংগঠন গঠনের চেষ্টা করেন। হুজির আরেকটি অংশ নব্য জেএমবি ও এবিটির সঙ্গে যুক্ত হয়। সর্বশেষ গত ৬ মার্চ টঙ্গীতে মুফতি হান্নানকে ছিনিয়ে নেওয়ার অপারেশনে হুজি ও এবিটির জঙ্গিরা অংশ নেয়।