আয়না২৪ প্রতিবেদন
বোরো মৌসুমে নতুন চাল বাজারে আসতে শুরু করলে চালের বাজার চড়া। কমছে না চালের দাম। এমনকি অন্য বছরের তুলনায় এবার দাম আরো বেশি। দুই সপ্তাহের ব্যবধানেই কেজিতে দাম বেড়েছে ৩ থেকে ৫ টাকা। এক মাসে দামে পার্থক্য হয়েছে ৫ থেকে ৭ টাকা। চালের দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধির কারণ হিসেবে মিল মালিকদের কারসাজিকে দায়ী করছেন খুচরা ও পাইকারি েচাল ব্যবসায়ীরা।
তারা বলছেন, বোরোর নতুন চাল আসতে শুরু করলেও গত বছরের তুলনায় কেজিপ্রতি ৮-৯ টাকা বেশি দরে সরবরাহ করা হচ্ছে। নতুন চালের সরবরাহ পুরোদমে শুরু হলে দাম কমবে বলে আশা করছেন তারা। তবে চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, হাওর অঞ্চলের বোরো ফসল তলিয়ে যাওয়ায় চালের বাজারে প্রভাব পড়বে।
অন্যদিকে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, অনিয়মিত বাজার মনিটরিং, বাজার সিন্ডিকেট, অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে যেসব আইন-কানুন রয়েছে তা কার্যকর না হওয়ায় চক্রগুলো ভোক্তাদের জিম্মি করে দাম বাড়ার মতো সাহস পাচ্ছে। ফলে চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পরও ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে সেই সুফল পাচ্ছে না ভোক্তা সাধারণ। গত কয়েক মাসে প্রতিকেজি মোটা চালের দাম বেড়েছে ৮ থেকে ১০ টাকা। ৫০ কেজির বস্তাপ্রতি বেড়েছে ৫০০-৬০০ টাকা।
জানা গেছে, ধানের বাম্পার ফলন হওয়ায় গত বছর ২৩ টাকা দরে ধান এবং ৩২ টাকা দরে চাল ক্রয় করে সরকার। একই সঙ্গে সরকার ৯২০ টাকা দর বেঁধে দিলেও কৃষক মৌসুমের শুরুতে বেচতে বাধ্য হয়েছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা মণ দরে। আর এই সুযোগটা নিয়ে ধান মজুত করেন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী।
এদিকে চলতি মৌসুমে ধান ও চালের সরকারি ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এবার ৭ লাখ টন ধান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এতে প্রতি কেজি ধানের ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২৪ টাকা। অন্যদিকে ৮ লাখ টন চাল কেনা হবে সরকারিভাবে। এজন্য প্রতি কেজি চালের দাম ধরা হয়েছে ৩৪ টাকা ।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, চলতি মৌসুমে প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে ২২ ও চালে ৩১ টাকা খরচ হবে। উৎপাদন খরচ মাথায় রেখেই সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে । তাদের মতে, এক মণ ধানে চাল হয় ২৬ কেজির বেশি। আর অটোমেশিনে হয় ৩০ কেজির কাছাকাছি। এই হিসাবে ৩১ টাকা ক্রয়মূল্য ধরা হলে এক বস্তা (৫০ কেজি) চালের দাম আসে এক হাজার ৫৫০ টাকা। আর সরকার নির্ধারিত মূল্য ধরা হলে দাম আসে এক হাজার ৭০০ টাকা। সে হিসেবে প্রতি কেজি চালের মূল্য ৫৫ থেকে ৬০ টাকা যাওয়ার কোনো কারণ নেই। তারপরেও দাম কেন বাড়ছে, এর কোনো জবাব নেই কারও কাছেই। আবার সরবরাহের কোনো ঘাটত্ও নেই বাজারে।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ও ট্রেডিং করপোরেশন বাংলাদেশের (টিসিবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত কয়েক বছর ধরে মোটা চালের প্রতি কেজি চালের দাম ৩১-৩৭ টাকার মধ্যে ওঠানামা করলেও বর্তমানে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে তা গড়ে ৪২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত এক বছরে চালের দাম বেড়েছে ১৭ শতাংশ পর্যন্ত। গত এক বছরে ভোগ্যপণ্যের বাজারে যেসব জিনিসের দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে তা হলো মোটা চালের।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের বাজার দরে সরু চালের দাম কেজিপ্রতি ৫০ থেকে ৫৬ টাকা, মাঝারি চালের দাম ৪২ থেকে ৪৬ টাকা, আর মোটা চালের দাম দেয়া আছে ৪০ থেকে ৪২ টাকা এবং সুগন্ধি চালের দাম ৮০ থেকে ৮৫ টাকা। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৫ সালে মোটা চালের গড় মূল্য ছিল ২৮.৬৭ টাকা, মাঝারি চালের ৩৫.৫৪ টাকা এবং সরু চালের গড় মূল্য ছিল ৪৩.৬৬ টাকা।
টিসিবির বাজার দরে পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সরু চালের দাম ৪৮ থেকে ৫৬ টাকা, মাঝারি চালের দাম ৪৪ টাকা থেকে ৪৮ টাকা, মোটা চাল বিক্রি হচ্ছিল ৪০ টাকা থেকে ৪২ টাকা। এদিকে ২০১৬ সালের একই দিনে সরু চালের দাম ছিল ৪৪ টাকা থেকে ৫৫ টাকা, মাঝারি চালের ৪০ টাকা থেকে ৪৪ টাকা এবং মোটা চালের দাম ছিল ৩২ টাকা থেকে ৩৪ টাকা। দেখা যায়, গত বছরের তুলনায় এবার সরু চালের দাম বেড়েছে ৫.০৫ শতাংশ, মাঝারি চালের দাম বেড়েছে ৯.৫২ শতাংশ এবং মোটা চালের দাম বেড়েছে ২৪.২৪ শতাংশ। তবে টিসিবির বাজারদরের সঙ্গে প্রকৃত বাজারদরের পার্থক্য রয়ে গেছে। টিসিবি’র দরে সরু চালের দাম সর্বোচ্চ ৫৬ টাকা বলা থাকলেও বাজারে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে এই চাল।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চার মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে চালের দাম। গত বছরের ২৯ শে ডিসেম্বর প্রতি কেজি মোটা চাল ৩৪-৩৭ টাকায়, চলতি বছরের ২৯শে জানুয়ারি ৩৬-৩৮ টাকায়, ২৮শে ফেব্রুয়ারি ৩৭-৩৮ টাকায় ও গতকাল ৩৭-৩৯ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা দেখা গেছে, মাঝারি মানের চালের ক্ষেত্রেও। গত বছরের ২৯শে ডিসেম্বর প্রতি কেজি মাঝারি মানের চাল ৩৮-৪২ টাকায়, চলতি বছরের ২৯শে জানুয়ারি ৩৮-৪৩ টাকায়, ২৮শে ফেব্রুয়ারি ৩৯-৪৩ টাকায় ও গতকাল ৪০-৪৪ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তবে ব্যবসায়ীদের দাবি, প্রকৃতপক্ষে আরো বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে চাল।
কাওরান বাজারের চাল বিক্রেতা আতিক জানান, পাইকারিতে বেশি হওয়ার কারণে খুচরা বাজারে দাম বেড়ে যাচ্ছে। আর সরকারি হিসাবের সঙ্গে চালের প্রকৃত বাজারদরের পার্থক্য ৫-৮ টাকা। এভাবে চালের দাম বৃদ্ধির কারণে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ।
দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে কারওয়ান বাজারের চাল বিক্রেতা রায়হান জগলু জানান, চালের দাম বৃদ্ধির পেছনে মূল কলকাঠি নাড়েন চালকল মালিকরা। তিনি বলেন, মিল মালিকরা নাকি মাঠ পর্যায় থেকে ধান কিনতে পারছেন না। মালিকরা মৌসুম শেষ হওয়ার অজুহাত দেখাচ্ছেন। তিনি জানান, ৫০ টাকা কেজিতে চাল কিনলাম। বিক্রি করতে হবে ৫২ টাকায়। এর মধ্যে রয়েছে পরিবহন খরচ। আমাদেরও খুব বেশি লাভ হবে না। কিন্তু আগের চাল দোকানে আছে।
চালের দাম বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে সূত্রগুলো জানায়, কৃষকের ঘর থেকে ধান চলে যাওয়ার পর ফড়িয়াদের মাধ্যমে সেগুলো যায় মিল মালিকদের হাতে। বাজারের বেশির ভাগ ধান মিল মালিকদের হাতে যাওয়ার পর মিল মালিকরা সেগুলো গুদামজাত করে রেখে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। এতে ধানের দাম বেড়ে যায়। আর ধানের দাম বাড়ানোর পর তারা চালের দামও বাড়ায়। মিল পর্যায়ে দাম বাড়ার পর পাইকারি থেকে খুচরা পর্যায়ে আসতে যত হাত বদল হয় ততবার দাম বাড়ে। মূলত এভাবেই চালের দাম বেড়ে যাচ্ছে।
আড়তদারেরা জানায়, পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন মোকামে প্রতি কেজি মিনিকেট চাল ৪৫-৪৮ টাকায় বিক্রি হলেও এর সঙ্গে পরিবহন খরচ, মজুর, সংরক্ষণ ও স্থানীয় পরিবহন খরচের কারণে দাম বেড়ে যাচ্ছে আরো ৪-৫ টাকা। পাবনা থেকে ১৫ টন বা ৫০ কেজি ওজনের ৩০০ বস্তা চাল ঢাকায় আনতে ট্রাক ভাড়া পড়ছে ১৫ হাজার টাকা। এতে কেজিপ্রতি পরিবহন খরচ পড়ছে ১ টাকা। মজুর, দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, কর্মচারীদের বেতন ও অন্য খরচের সঙ্গে রাজধানীর ব্যবসায়ীদের মুনাফা যোগ করলে প্রতি কেজি চালের দাম দাঁড়ায় ৫৫ টাকা।
রাজধানীর পাইকারি ও খুচরা বাজারে দেখা গেছে, পাইকারি বাজারে নিম্নমানের নাজিরশাইল চালের বস্তা ২৪৫০ টাকার বদলে ২৫৫০ টাকা হয়েছে। আর খুচরা বাজারে ৫০ টাকার নিম্নমানের নাজিরশাইল ৫৩ টাকা হয়েছে। এছাড়া খুচরা বাজারে স্বর্ণা চাল ৪৩-৪৪ টাকা, পারিজা চাল ৪৪-৪৫ টাকা, উন্নতমানের মিনিকেট ভালো ৫৪-৫৬ টাকা, বিআর আটাশ চাল ৪২-৪৪ টাকা, উন্নতমানের নাজিরশাইল চাল ৫৫-৫৬ টাকা, বাসমতি চাল ৫৮-৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ রাজধানীর পাইকারি বাজারে গত এক মাসের ব্যবধানে বস্তাপ্রতি গড়ে চালের দাম বেড়েছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। আর খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি বেড়েছে ৩ থেকে ৪ টাকা।
পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, ধান এখন কয়েকজন অটোমিল মালিকদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তারা ইচ্ছামতো দামে চাল বাজারে ছাড়ছেন। বাজার ওঠা-নামা মূলত অটো মিলারদের ওপর নির্ভর করছে। উচ্চ শুল্কায়নের কারণে বর্তমানে ভারত থেকে চাল আমদানি বন্ধ রয়েছে। এ সুযোগে দাম বাড়াচ্ছেন মিল মালিকেরা। আর এতে সাধারণ ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে চালের বাজার।