ফাঁসির সেলে বিমর্ষ তাঁরা

জানুয়ারি ১৯, ২০১৭
Spread the love

আয়না২৪ প্রতিবেদন

কারাগারে ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দি হিসেবে  এতোদিন খাটের ওপর তোষক বিছিয়ে, লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমানোর সুযোগ ছিল সাত খুন মামলার অন্যতম আসামি লে. কর্নেল (বরখাস্ত) তারেক সাঈদ মোহাম্মদের। তবে রায়ের পর  পাল্টে গেছে দৃশ্যপট।  তাঁর গায়ে উঠেছে কয়েদির পোশাক। সোমবার তাঁর রাত কেটেছে মেঝেতে শুয়ে-বসে। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে কনডেম সেলে থাকার জন্য তাঁকে দেওয়া হয়েছে তিনটি কম্বল। তা  বিছিয়ে ও গায়ে দিয়ে রাত পার করতে হয়েছেে এই বন্দিকে।

সা্গেঈদকে  আগে  উন্নতমানের খাবার ও  চিকন চালের ভাত দেওয়া হলেও এখন অন্য বন্দিদের মতোই সাধারণ খাবার দেওয়া হচ্ছে। এ মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত নূর হোসেন, লে. কমান্ডার (বরখাস্ত) এম এম রানা, মেজর (বরখাস্ত) আরিফ হোসেনসহ অন্য আসামিদেরও ঠাঁই হয়েছে কনডেম সেলে। তাঁদেরও রাত কেটেছে একইভাবে। এখন   তাঁরা  সবাই  বিমর্ষ।

দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের আইনজীবীরা জানিয়েছেন, আসামিরা উচ্চ আদালতে আপিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। পূর্ণাঙ্গ রায়ের সার্টিফায়েড কপি হাতে পেলেই আপিল করা হবে। ইতিমধ্যে তাঁরা রায়ের সার্টিফায়েড কপি পাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন।

কারা সূত্র জানায়, দণ্ড ঘোষণার পর আদালত থেকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হলে আসামিদের কয়েদির পোশাক পরানো হয়। খাবারদাবারও দেওয়া হয় সাধারণ মানের। সেখানে সবার জন্যই এক ব্যবস্থা। সোমবার রাতে তাঁদের রুই মাছ দিয়ে মোটা চালের ভাত খেতে দেওয়া হয়। গতকাল মঙ্গলবার সকালে দেওয়া হয়েছে দুটো রুটি ও সবজি। দুপুরে দেওয়া হয় সবজি, ডাল আর ভাত। রাতে ভাতের সঙ্গে সবজি, মাছ অথবা মাংস দেওয়া হয়। দুপুরের দিকে এক ঘণ্টার জন্য তাঁদের সেলের বাইরে বের হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। এ সময় তাঁরা গোসল করেন এবং কয়েকজন কিছু সময় সেলের সামনে হাঁটাহাঁটি করেন। সেলের ভেতর গতকাল দিনভর তাঁদের বিমর্ষ অবস্থায় কেটেছে। কখনো বসে, পায়চারি করে কিংবা ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করে তাঁরা সময় কাটিয়েছেন।

সাত খুন মামলায় এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার ২৩ আসামির মধ্যে নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারে রাখা হয়েছে ১৮ জনকে, যাঁদের মধ্যে ১২ জন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামি রয়েছেন গাজীপুরের কাশিপুর কারাগারে। এ মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত ১২ আসামি এখনো পলাতক, যাঁদের মধ্যে ৯ জনই ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত।

কারা সূত্র জানায়, দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে আরিফ হোসেন ও এম এম রানাকে রাখা হয়েছে গাজীপুরের কাশিমপুর-১ কারাগারে। তারেক সাঈদ, নূর হোসেন ও বেলাল হোসেনকে (বরখাস্ত ল্যান্স নায়েক) কাশিমপুর-২ কারাগারে রাখা হয়েছে। রায় ঘোষণা উপলক্ষে সোমবার তাঁদের নারায়ণগঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। রায়ের পর সন্ধ্যার আগে প্রিজন ভ্যানে করে কাশিমপুর কারাগারে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। আরিফ ও রানাকে একই সেলে রাখা হলেও নূর হোসেন, তারেক সাঈদ ও বেলালকে আলাদা সেলে রাখা হয়েছে।

কাশিমপুর কারাগারের এক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের  জানান, সোমবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জ আদালত থেকে প্রিজন ভ্যানে করে তারেক সাঈদ, নূর হোসেন ও বেলালকে কাশিমপুর-২ কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। কিছুক্ষণ পরই তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় কনডেম সেলে। সেখানে তাঁদের সাধারণ পোশাকের পরিবর্তে কয়েদির জন্য নির্ধারিত ডোরাকাটা পোশাক দেওয়া হয়। প্রত্যেককে দেওয়া হয়েছে তিনটি করে কম্বল, একটি থালা ও একটি বাটি।

 কর্মকর্তা আরো জানান, ফাঁসির দণ্ড হওয়ার পর আসামিদের স্বাস্থ্য নিয়ে কারা কর্মকর্তাদের চিন্তা থাকে। অনেকে কারাগারে মুষড়ে পড়েন, রক্তচাপ বেড়ে যায়। এসব কারণে তাঁদের নিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ সতর্ক থাকে। সাত খুন মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তদের কারাগারে নিয়ে যাওয়ার পর সতর্ক ছিলেন কারা কর্মকর্তারা। কনডেম সেলে তাঁদের গতকাল দিনভর বিমর্ষ অবস্থায় কাটাতে দেখা গেছে। এম এম রানার ছোট ভাই গতকাল কারাগারে এসে সাক্ষাৎ করে গেছেন।

কাশিমপুর কারাগার পার্ট-১-এর সিনিয়র জেল সুপার সুব্রত কুমার বালা জানান, সকালে আরিফ হোসেন ও মাসুদ রানাকে নাশতায় আটার রুটি ও গুড়; দুপুরে ভাত, ডাল, মাছ এবং রাতে ভাতের সঙ্গে সবজি, মাছ অথবা মাংস দেওয়া হয়েছে। সেলে দিনভর তাঁদের পায়চারি ও উঠবোস করতে দেখা গেছে। তাঁদের চেহারায় ছিল বিমর্ষ ভাব। তবে সকালে কারাগারের চিকিৎসক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে জানিয়েছেন, তাঁরা সুস্থ আছেন। সকাল ১১টার দিকে রানার ছোট ভাই কারাগারে এসে দেখা করে গেছেন। এটি ছিল তাঁদের রুটিন সাক্ষাৎ।

কাশিমপুর কারাগার পার্ট-২-এর জেলার নাশির আহমেদ বলেন, ‘স্বাভাবিক কারণেই গতকাল আসামিরা বিষণ্ন ছিলেন। আমি কয়েক দফা তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে খোঁজখবর নিয়েছি। ’

কাশিমপুর-২ কারাগারের জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক সাংবাদিকদের বলেন, ‘কারাবিধি অনুযায়ী যেসব সুবিধা দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের পাওয়ার কথা তা-ই দেওয়া হচ্ছে। ’

এ মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ কারাগারে রয়েছেন র‌্যাব-১১-র সাবেক সদস্য হাবিলদার এমদাদুল হক, আরওজি-১ আরিফ হোসেন, ল্যান্স নায়েক হীরা মিয়া, সিপাহি আবু তৈয়ব, কনস্টেবল মো. শিহাব উদ্দিন, এসআই পূর্ণেন্দু বালা ও আসাদুজ্জামান নূর। ইতিমধ্যে তাঁদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে এ কারাগারে আরো রয়েছেন নূর হোসেনের সহযোগী মোর্তুজা জামান চার্চিল, আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দিপু, রহম আলী ও আবুল বাশার। এ ছাড়া বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন করপোরাল (বরখাস্ত) রুহুল আমিন (১০ বছর), এএসআই (বরখাস্ত) বজলুর রহমান (সাত বছর), হাবিলদার (বরখাস্ত) নাসির উদ্দিন (সাত বছর), এএসআই (বরখাস্ত) আবুল কালাম আজাদ (১০ বছর), সৈনিক (বরখাস্ত) নুরুজ্জামান (১০ বছর) ও কনস্টেবল (বরখাস্ত) বাবুল হাছান (১০ বছর)।

নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগার সূত্র জানায়, ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের কারাবিধি অনুযায়ী কয়েদির পোশাক পরানো হয়েছে। সোমবার রাতে তাঁদের সবজি, ডাল, ভাত ও মাছ দেওয়া হয়। গতকাল সকালে রুটি ও গুড় এবং দুপুরে সবজি, ভাত ও ডাল দেওয়া হয়েছে। ফাঁসির রায় ঘোষণার পর থেকেই অনেককে বিপর্যস্ত দেখা গেছে। তাঁদের স্বাস্থ্য নিয়মিতভাবে চেকআপ করা হয়েছে।

নারায়ণগঞ্জ কারাগারের জেলার আসাদুর রহমান  বলেন, ‘ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের আদালত থেকে কারাগারে আনার পর বিধি অনুযায়ী কয়েদির পোশাক পরানো হয়েছে। তাঁদের কনডেম সেলে রাখা হয়েছে। আসামিরা সবাই সুস্থ আছেন। তাঁদের স্বাস্থ্য নিয়মিত চেকআপ করা হচ্ছে এবং তাঁদের প্রতি নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে। ’

সাত খুন মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ওয়াজেদ আলী খোকন জানান, পূর্ণাঙ্গ রায়ের সার্টিফায়েড কপি হাতে পাওয়ার দিন থেকে পরবর্তী সাত দিনের মধ্যে আসামিরা রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারবেন। ইতিমধ্যে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা রায়ের সার্টিফায়েড কপি পাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন।

তারেক সাঈদ, আরিফ হোসেন ও এম এম রানাও আপিল করবেন বলে জানিয়েছেন তাঁদের আইনজীবীরা।   

নারায়ণগঞ্জ বারের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট আব্দুর রশিদ বলেন, ‘আসামিরা এ রায়ে সংক্ষুব্ধ হয়ে থাকলে উচ্চ আদালতে আপিল এবং লিভ টু আপিল করতে পারবেন। আমরা রায়ের কপির জন্য আবেদন করেছি। সেটা পেলেই আপিল করব। ’