আয়না২৪ প্রতিবেদন
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং আসামে গিয়ে ঘোষণা করেছেন বড়জোর আগামী দেড় বছরের মধ্যে ওই রাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত ‘সম্পূর্ণ সিল’ করে দেওয়া হবে।
অবশ্য সীমান্ত সিল করা মানে যে দেওয়াল তোলা নয় – বরং কাঁটাতারের বেড়া এবং প্রযুক্তির প্রয়োগে সীমান্তকে নিশ্ছিদ্র করে তোলা, সে কথাও বলেছেন তিনি।খবর বিবিসির।
তবে আসামে বিদেশি অনুপ্রবেশ নিয়ে বিতর্কের পটভূমিতে কেন্দ্রীয় সরকারের এই বক্তব্য নেহাতই একটি রাজনৈতিক ঘোষণা বলে অনেকে ধারণা করছেন। পাশাপাশি সীমান্ত সিল করা যদি সম্ভবও হয়, তাতে কী উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে তা নিয়েও অনেকেরই সংশয় আছে।
মাসকয়েক আগেই আসামে প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি-র সরকার – যে রাজ্যে বাংলাদেশিদের কথিত অনুপ্রবেশ সম্ভবত সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ইস্যু।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং সোমবার সেই আসামের রাজধানী গুয়াহাটিতে দলীয় কর্মীদের সামনে ভাষণ দিতে গিয়েই সীমান্ত পুরোপুরি সিল করার কথা বলেন।
মি সিং বলেন, “সীমান্ত যে কোনওভাবে সুরক্ষিত রাখতেই হবে। আর সে জন্যই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আসামের সঙ্গে বাংলাদেশের যে প্রায় সোয়া দুশো কিলোমিটার সীমান্ত আছে সেটাকে আমরা সম্পূর্ণ সুরক্ষিত করব – আর এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে সে কাজ শেষ করা হবে।”
“এর জন্য যেখানে কাঁটাতারের বেড়া দিতে হবে সেখানে বেড়া দেওয়া হবে, আর যেখানে নদীনালার জন্য বেড়া দেওয়া যাবে না সেখানে অন্য প্রযুক্তি কাজে লাগানো হবে। কিন্তু সীমান্ত পুরো সিল করার সর্বাত্মক চেষ্টা হবে”, বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
সীমান্ত সিল করা মানে যে দেওয়াল তুলে দিয়ে লোকের যাতায়াত বন্ধ করা নয় – এমন কোনও ভুল ধারণা না রাখতেও তিনি অনুরোধ জানিয়েছেন।
তবে আসামে রাজনৈতিক দলগুলো মুখে যাই বলুক – সীমান্ত পুরোপুরি সিল করে অনুপ্রবেশের ইস্যুকে পাকাপাকি বন্ধ করার সাহস এতদিন কোনও দলই দেখাতে পারেনি, বলছিলেন আসাম নাগরিক অধিকার সুরক্ষা সমিতির প্রধান উপদেষ্টা হাফিজ রশিদ চৌধুরী।
তিনি বিবিসিকে বলেন, “বর্ডার সিল করার কথা তো বহুদিন ধরেই হচ্ছে, কিন্তু স্রেফ রাজনৈতিক কারণে সেটা এতদিন করা হয়নি – বরং ইস্যুটা জিইয়ে রাখা হয়েছে। আমরা বরাবর বলে এসেছি আগে সীমান্ত সিল করে তারপর নিয়ম অনুযায়ী রাজ্যে বিদেশিদের চিহ্নিত করা হোক। অথচ কোনও দলই সীমান্ত সিল করেনি, শুধু রাজনৈতিক বিবৃতি দিয়ে গেছে।”
অতীতে যখন কেন্দ্রে অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্ব ছবছর বিজেপি-র সরকার ছিল, কিংবা মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বে দশ বছর কংগ্রেস দিল্লির ক্ষমতায় ছিল – তারা কেউই যে সীমান্ত সিল করার ব্যাপারে উৎসাহ দেখায়নি, মি চৌধুরী সে কথাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন।
তা ছাড়া আসাম-বাংলাদেশ সীমান্তের চরিত্রই এমন, সেটি পুরোপুরি সিল করা বেশ কঠিনও। তবে আসল চ্যালেঞ্জটা যত না টেকনিক্যাল, তার চেয়েও বেশি রাজনৈতিক ও ধর্মীয় – বলছিলেন কাছাড় কলেজের অধ্যাপক ও সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট জয়দীপ বিশ্বাস।
অধ্যাপক বিশ্বাস বলছেন, “এটা ঠিকই যে একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চল আছে যেখানে নদীটাই সীমানা। কুশিয়ারা নদীর এপারে যেমন করিমগঞ্জ, ওপারে জকিগঞ্জ। কিংবা ব্রহ্মপুত্রের এপারে ধুবড়ি, ওপারে কুড়িগ্রাম। সেখানে সীমান্ত সিল করা কঠিন ঠিকই – তবে পাহারা অবশ্যই বাড়ানো যেতে পারে। কিন্তু তাতে লাভটা কী হবে, সেই উত্তর আমার জানা নেই!”
“আর তার কারণ হল, সীমান্তে ফাঁকফোকর থাকলেও তা তো এখনও উন্মুক্ত পড়ে নেই – সেখানে পাহারা নেই এমন তো নয়। আসলে দলে দলে লোক সীমান্ত পেরিয়ে এখানে ঢুকে পড়ছে, এই মিথটাই হল আসামে রাজনীতির চালিকাশক্তি। সব দলই এই গল্পটা বাঁচিয়ে রাখতে চায় এবং বিজেপিও তার ব্যতিক্রম নয়।”
“বিজেপি আসায় তাতে শুধু একটা ধর্মীয় অনুষঙ্গ যোগ হয়েছে – বাংলাদেশ থেকে দলে দলে মুসলিমরা আসছে, একটা প্যান-ইসলামিক নকশা কাজ করছে এগুলো বলা শুরু হয়েছে। দল হিসেবে তারা চিরকালই তাই সীমান্ত সিল করার কথা বলত … কিন্তু যখন তারা রাজ্যের ক্ষমতায় ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে এ কথা বলছেন, তখন এমনি বলার সঙ্গে তার একটা তাৎপর্যগত ফারাক তো থাকেই”, বলছিলেন জয়দীপ বিশ্বাস।
তিনি আরও বলছিলেন, সীমান্ত সিল করার পাশাপাশি রাজনাথ সিং যেহেতু আসাম চুক্তির ছ-নম্বর দফা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে অসমিয়াদের স্বার্থরক্ষার কথা বলেছেন – তাতে ওই রাজ্যে যারা অসমিয়া নন, তাদের সাংবিধানিক অধিকার নিয়েও উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
ফলে সীমান্ত শেষ পর্যন্ত সিল হোক বা না-হোক, রাজ্যের বিশেষত বাংলাভাষী মুসলিমদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ তাই থাকছেই।