আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ভোট ব্যাংক বাড়াতে ইসলামী দলগুলোকে কাছে টানার চেষ্টা করছে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি এই প্রক্রিয়ায় বেশ জোড়ালোভাবে মাঠে নেমেছে।
আওয়ামী লীগ এরইমধ্যে হেফাজতে ইসলামের দাবি মেনে নিয়ে তাদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছে। বিএনপিও নানা কৌশলে হেফাজতকে কাছে টানার চেষ্টা করছে। শুধু হেফাজত নয়, অন্যান্য ইসলামী দলগুলোকেও জোটভুক্ত করার চেষ্টা করছে রাজনৈতিক দলগুলো। ফলে নির্বাচনী রাজনীতিতে নিবন্ধিত, অনিবন্ধিত সব ইসলামী দলের কদর বাড়ছে।
তবে যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে কোনঠাসা হয়ে পড়া জামায়াত নতুন কৌশলে এগুতে চেষ্টা চালাচ্ছে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন দলে নতুন পরিচয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে দলটির নেতা-কর্মীরা।
নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রমতে, আগামী জাতীয় নির্বাচন উপলক্ষে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির নেতৃত্বে পৃথক দুটি জোটসহ মোট চারটি জোট আত্মপ্রকাশ করতে পারে। জাতীয় পার্টি ৫৬টি দল নিয়ে আলাদা জোট গঠন করলেও কয়েকদিনের মাথায় সে জোট ভেঙে যায়। এছাড়া ইসলামী দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে নতুন একটি জোট গঠনের তৎপরতা চলছে।
আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল গণভবনে অনুষ্ঠিত দলের বর্ধিত সভায় জামায়াত-শিবিরের অনুপ্রবেশ প্রসঙ্গে বলেন, পেশিশক্তি বৃদ্ধিতে অনেকেই (আওয়ামী লীগ নেতারা) জামায়াত-শিবির ও বিএনপির নেতা-কর্মী এবং সন্ত্রাসীদের দলে টেনেছেন। শেখ হাসিনা বলেন, এরা এসে দলের ক্ষতি করে, খুন করে।
আওয়ামী লীগ নেতাদের উদ্দেশ্যে দলীয় সভাপতি বলেন, দয়া করে দল ভারী করার জন্য এদের টানবেন না। মামলা থেকে বাঁচতে এবং উন্নয়ন প্রকল্পের ভাগীদার হতে এরা আওয়ামী লীগে যোগ দিচ্ছে। এরা দলের মধ্যে খুন করে। তারা এতটাই শক্তিশালী হয়ে যায় যে, তাদের কনুইয়ের গুঁতায় আমার নেতাকর্মীরা টিকতে পারে না।
আগামী নির্বাচনে সরকারিদলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সম্ভাব্য প্রার্থীর সম্পর্কে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে। দল এবং ব্যক্তি পর্যায়ে চলছে জরিপ। কোন আসনে কয় জন প্রার্থী হতে পারে, কে বেশি জনপ্রিয়, কে বিতর্কিত এসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন তৈরি করা হচ্ছে।
সেইসঙ্গে এলাকায় কোন দলের জনপ্রিয়তা বেশি, কি কারণে জনপ্রিয়তা বাড়ছে কিংবা কমছে, বর্তমান সাংসদেরা এলাকায় জনপ্রিয় না জনবিচ্ছিন্ন এসব বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। তবে ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের আসনগুলোর সম্ভব্য প্রার্থীর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক সূত্র জানায়, জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ইসলামী দলগুলোর কদর বাড়ছে। হেফাজতে ইসলাম (অরাজনৈতিক), খেলাফত মজলিশ, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন, ইসলামী ঐক্যজোটের একটি অংশকে কাছে টানার চেষ্টা করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট। লক্ষ্য আসন্ন নির্বাচনে জোটের শক্তি, সমর্থন ও ভোট বাড়ানো।
সরকারি দল আওয়ামী লীগ সম্প্রতি হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের বিভিন্ন দাবিদাওয়া মেনে নিয়েছে। কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি, দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমান দেওয়া, হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের মামলা শিথিলকরণের প্রতিশ্রুতি এবং সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য অপসারণের দাবিতে ঐকমত্য পোষণের মধ্য দিয়ে (এখনও) অরাজনৈতিক এই সংগঠনটিকে আশাতীত সুবিধা ও মর্যাদা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। বিভিন্ন বাম ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের অভিযোগ হেফজতের দাবি মেনে নিয়ে সংগঠনটির নীতির সঙ্গে আপস ও সমঝোতা করেছে আওয়ামী লীগ। তবে এই অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা।
এদিকে বিএনপি জোট হেফাজতে ইসলামসহ অন্যান্য ইসলামী দলগুলোর সমর্থন পেতেও তৎপরতা চালাচ্ছে। ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলে হেফাজতের অবস্থান কর্মসূচিতে বিএনপির পূর্ণ সমর্থন ও অংশগ্রহণের প্রস্তুতির কারণে এতদিন বিএনপির প্রতি দেশের ধর্মীয় এই বড় সংগঠনটি মৌন সমর্থন ছিলো। তবে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতা (আমির) আল্লাম আহমত শফীর সাক্ষাৎ পরিস্থিতি পালটে দিয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তবে থেমে নেই বিএনপি। আগামী নির্বাচনে হেফাজতের সমর্থন পেতে সাংগঠনিক কিংবা ব্যক্তিগত পর্যায়ে অঘোষিত আলোচনা অব্যাহত রেখেছে বিএনপি।
সূত্র মতে, রাজনীতিতে প্রবেশ নিয়ে হেফাজতে ইসলামের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। শীর্ষ নেতাদের মধ্যে কয়েকজন বর্তমান সরকারের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে একমত পোষণ করছেন। তাদের একটি অংশ আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। বিরোধিতা করছে অপর অংশ।
সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগর হেফাজতের নেতা নূর হোসেন কাশেমী বিএনপি সমর্থিত এবং বিএনপির সঙ্গে তার যোগাযোগ রয়েছে। অপরদিকে ইসলামী ঐক্যজোট এখন আর বিএনপিকে সমর্থন দেয় না। ইসলামী ঐক্যজোটের নেতাদের সঙ্গে ঢাকা মহানগর হেফাজতের মতবিরোধ চলছে। তবে অধিকাংশ ইসলামী সংগঠনের জ্যেষ্ঠ অনেক নেতাই সরকারের উন্নয়নমূলক কাজে সমর্থন করছেন। অভিযোগ রয়েছে, নাশকতা ও বোমা হামলা মামলা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য তারা এই কৌশল নিতে পারে। তাদের ভোট আসলে কোথায় যাবে, তা নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে।
আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ইসলামী দলগুলোর কদর বাড়লেও জামায়াত-শিবির আপাতত কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। যুদ্ধাপরাধ, আন্দোলনের নামে আগুন সন্ত্রাস, বোমাবাজি, হত্যাসহ নানা অভিযোগের কারণে জামায়াত জনমনে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় আপাতত কেউ তাদের কাছে টানছে না। তবে গোয়েন্দা সংস্থার মতে, জামায়াতকে যতই দূরে রাখা হোক নির্বাচনের সময় তারা তাদের পছন্দের জোটকে ভোট দেবে। দলটির নেতাকর্মীরা নতুন করে নানা পরিচয়ে জেলায় জেলায় গণযোগাযোগ করছেন। চলছে বিভিন্ন দলে অনুপ্রবেশের চেষ্টা।
অপর এক সূত্র মতে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিএনপি ছাড়াও আরও ২টি জোট হতে পারে। এর মধ্যে বাম সংগঠন, গণফোরাম, কিশোর শ্রমিক জনতা লীগ, বিকল্পধারা মিলে একটি জোট ও এরশাদের নেতৃত্বে আলাদা জোট। এ নিয়ে এখন হিসাব নিকাশ চলছে। দলগুলো বিভিন্নভাবে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে। টার্গেট আগামী নির্বাচনে জয়লাভ ও সরকার গঠন করা। এই ক্ষেত্রে ছোটখাটো ইসলামী দলগুলো এখন ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা কাকে সমর্থন দেয় তা নিয়ে আলোচনা চলছে।
আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন দিতে সম্ভব্য একাধিক দলীয় প্রার্থীকে চিহ্নিত করেছে বিএনপি। মামলা বা গ্রেপ্তারের কারণে একজন নির্বাচন করতে না পারলে অন্যজনকে প্রার্থী করা হবে।
দলীয় সূত্র জানায়, আসন্ন রমজানে ইফতার পার্টির সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ওয়ার্ড, ইউনিয়ন ও থানা জেলা পর্যায়ে ইফতার পার্টির মাধ্যমে নির্বাচনী আলাপ ও প্রস্তুতি নিয়ে পরিকল্পনা করতে পারে। ফলে রমজানে রাজনৈতিক তৎপরতা জমে উঠবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাই রাজনৈতিক ইফতার পার্টিগুলো গোয়েন্দা সংস্থার কড়া নজরদারিতে থাকবে।