আয়না ২৪ প্রতিনিধি
‘জঙ্গি আস্তানা’ সন্দেহে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রাজধানীর আশকোনায় হাজিক্যাম্পের কাছে ‘সূর্য ভিলা’ নামের একটি বাড়িতে প্রায় ১৬ ঘণ্টা অভিযান চালায়। গতকাল শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টা থেকে শুরু হওয়া এই অভিযান চলে আজ শনিবার বিকেল পৌনে চারটা পর্যন্ত।
গতকাল রাত ১২টার দিকে অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) ছানোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের তিনটি গাড়িতে করে ৩০-৩৫ জন ঘটনাস্থলে যান। এ সময় দাঙ্গা পুলিশের ছিলেন ৪০ জন। আর পুলিশের উত্তরা বিভাগের তিনটি গাড়িতে করে পুলিশ সদস্যরাও সেখানে যান। ‘নব্য জেএমবির শীর্ষ এক নেতার’ সন্ধান করছিল কাউন্টার টেররিজম ইউনিট।
শুরুতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ‘সূর্য ভিলা’ বাড়ির পাশের একটি বাড়িতে তল্লাশি চালান। এরপর তাঁরা নিশ্চিত হন, ‘সূর্য ভিলা’ বাড়িতে ‘জঙ্গি আস্তানা’ আছে। এরপর রাত সাড়ে ১২টার তাঁরা ওই বাড়িটি ঘিরে ফেলেন। রাত চারটার দিকে সোয়াত দল সেখানে যোগ দেন। ভোর পাঁচটার দিকে ঘটনাস্থলে যান পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। পরে ঘটনাস্থলে এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, বাড়িটিতে ‘নব্য জেএমবির শীর্ষ এক নেতা’ রয়েছেন। এ ছাড়া নারীসহ একাধিক জঙ্গি রয়েছেন। জঙ্গিদের কাছে শক্তিশালী গ্রেনেড রয়েছে। তাদের আত্মসমর্পণ করতে বলা হচ্ছে। তবে তারা শরীরে গ্রেনেড বেঁধে প্রতিরোধের ঘোষণা দিচ্ছে।
সকাল সাড়ে নয়টার দিকে দুই শিশুকে নিয়ে দুজন নারী আত্মসমর্পণ করেন। পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, প্রথম দফায় ওই বাড়ির নিচতলার বাসা থেকে চারজন আত্মসমর্পণ করেন। এই চারজন হলেন মিরপুরের রূপনগরে পুলিশের অভিযানে নিহত জঙ্গি ও সাবেক মেজর জাহিদের স্ত্রী জেবুন্নাহার শীলা, তাঁর মেয়ে এবং পলাতক জঙ্গি মুসার স্ত্রী তৃষ্ণা ও তাঁর মেয়ে। তাদের মাইক্রোবাসে করে ঘটনাস্থল থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
যে বাড়ি ঘিরে অভিযান চালানো হয় সেই বাড়ির মালিকের বড় মেয়ে জোনাকি রাসেল দুপুরে সাংবাদিকদের বলেন, গত ১ সেপ্টেম্বর মো. ইমতিয়াজ আহমেদ পরিচয় দিয়ে একজন নিচতলার বাসাটি দেখতে আসেন। তখন ওই ব্যক্তি নিজেকে অনলাইন ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দেন এবং বলেন যে বাসায় তিনি, তাঁর স্ত্রী ও এক বাচ্চা থাকবে। মাঝেমধ্যে স্ত্রীর বোন এসে থাকবেন। ১০ হাজার টাকায় তিনি বাসাটি ভাড়া নেন। ৩ সেপ্টেম্বর পরিবার নিয়ে তিনি সেখানে ওঠেন। বাসা ভাড়া দেওয়ার পর তিনি বেশ কয়েকবার ওই বাসায় গেছেন। বাসায় ল্যাপটপ, খাট, ড্রেসিং টেবিল, ফ্রিজ দেখেছেন। তিনি বলেন, ‘উনারা কখনো বের হতেন না। বাসায় ওঠার সময় বাচ্চার বয়স ছিল ৪০ দিন।’ কেন বের হন না?—জানতে চাইলে বলতেন, হিজড়ারা বাচ্চা দেখলে টাকা চায়। সে কারণে বের হন না। তিনি বলেন, ‘মাঝে মাঝে দুজন নারী ওই বাসায় আসতেন। জিজ্ঞেস করলে বলতেন, মা ও এক আত্মীয়। গ্রামের বাড়ি থেকে এসেছেন।’
দুপুরে এডিসি ছানোয়ার হোসেন বলেন, ওই বাসায় আরও তিনজন ছিল। তাদের বের হওয়ার জন্য পুলিশ এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় দিয়েছিল। বারবার তাদের হ্যান্ডমাইকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তারা তাতে সাড়া দেয়নি। দুপুর সাড়ে ১২টার একটু পরে নিচতলা বাসার দরজা খুলে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন এক নারী। কীভাবে ওই ‘জঙ্গি’ নারী বিস্ফোরণটি ঘটিয়েছেন, উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, প্রথম দফায় ওই বাড়ির নিচতলার বাসা থেকে চারজন আত্মসমর্পণ করেন। আরও তিনজন ওই বাসায় ছিল। তিনি নিজে ওই বাড়ির গাড়ি পার্কিংয়ের পিলারের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন জানিয়ে বলেন, দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তিনি দেখতে পানে বোরকা পরা একজন নারী বাঁ হাতে একটি মেয়েশিশুকে ধরে বাসার দরজা খুলে বাইরে এসেছেন। ওই দুজন পার্কিংয়ের দিকে আসছিলেন। তখন তিনি তাঁদের দাঁড়াতে বলেন। বারবার বলেন হাত তুলতে। কিন্তু ওই নারী দাঁড়াননি। তিনি শিশুটিকে সঙ্গে নিয়ে সামনে দিকে হাঁটতে শুরু করেন। একপর্যায়ে বাঁ হাতে শিশুটিকে ধরে রেখে ডান হাত ওপরের দিকে তোলার মতো ভঙ্গি করেন। তবে তখন তিনি কোমরে রাখা বিস্ফোরকে চাপ দেন। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ ঘটে। ওই নারীর মৃত্যু হয়। বিস্ফোরণে আহত এক শিশুকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তখনো বাড়ির ভেতরে আজিমপুরে পুলিশের অভিযানে নিহত জঙ্গি তানভীর কাদেরির ছেলে ছিল বলে ধারণা করা হয়।
পরে ছানোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, নারীটি জনৈক জঙ্গি সুমনের স্ত্রী। শিশুটি জনৈক জঙ্গি ইকবালের মেয়ে। তবে এই দুই জঙ্গি সম্পর্কে তিনি বিস্তারিত কিছু জানাননি।
বেলা তিনটার দিকে এক ব্রিফিংয়ে মনিরুল ইসলাম বলেন, গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানো জঙ্গি নারী মারা গেছেন। ভেতরে থাকা আরেক ‘জঙ্গি’ বিস্ফোরক ও গুলি ছুড়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও পাল্টা গুলি করেছে। এরপরে ভেতর থেকে আর কোনো শব্দ আসেনি। ভেতরে থাকা ‘জঙ্গি’ জীবিত না মৃত, তা নিশ্চিত নয় পুলিশ।
অভিযান চালানো বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল এক কিশোর সবজিবিক্রেতার। সবজি বিক্রির জন্যই ওই বাড়িতে যেত সে। পুলিশকে ওই কিশোর জানায়, এই বাড়ির আনুমানিক ১৩/১৪ বছর বয়সের এক কিশোরের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। ছেলেটি তার নাম শহীদ বলে জানায়। শহীদ বিভিন্ন সময় তাকে অস্ত্র দেখাত। তাকে জিহাদে অংশে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে শহীদ বলত, ‘তোমারও বোমা বানানো শেখা উচিত, অস্ত্র চালাতে পারা উচিত। আমি এসব পারি।’ পুলিশ ধারণা করছে, শহীদ নামের ওই কিশোরের আসল নাম আফিফ কাদরী। সবজিবিক্রেতা ওই কিশোরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যায় পুলিশ।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেলা সোয়া তিনটার দিকে ঘটনাস্থলে যান। পরে বিকেল পৌনে চারটার দিকে ঘটনাস্থলে তিনি সংবাদ ব্রিফিং করে বলেন, আশকোনায় জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে চালানো অভিযান পরিসমাপ্তি ঘোষণা করা হয়েছে। এই অভিযানে চারজন আত্মসমর্পণ করেছেন। নিহত হয়েছেন দুজন। নিহত দুজনের মধ্যে একজন নারী জঙ্গি সুমনের স্ত্রী। আহত অবস্থায় একটি শিশু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে। ওই বাসার ভেতরে অসংখ্য তাজা গ্রেনেড, বোমা পড়ে আছে। অভিযান পরিসমাপ্ত হলেও ভেতর থেকে এগুলো পরিষ্কার করার ও আলামত সংগ্রহের কাজ চলবে।
ওই জঙ্গি আস্তানার ভেতর থেকে আলামত সংগ্রহ ও বিপজ্জনক বস্তু সরানোর কাজটি বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে স্থগিত করা হয়। আগামীকাল রোববার আবার তা শুরু হবে বলে জানান কাউন্টার টেররিজমের দুই উপকমিশনার (ডিসি) মইদুল ইসলাম খান ও প্রলয় কুমার জোয়ার্দার। তাঁরা বলেন, ভেতরে এক কিশোরের লাশ পড়ে আছে। ভেতর থেকে গ্যাসের গন্ধ বের হচ্ছে। বিদ্যুৎ নেই। ভেতরে বিস্ফোরক থাকায় অন্ধকারে কাজ চালানো ঝুঁকিপূর্ণ। তাঁরা আরও বলেন, বাড়িটি পুলিশ ঘিরে রেখেছে। বাইরে পড়ে থাকা দুটি বোমা নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। ভেতরে আরও পাঁচ-ছয়টি গ্রেনেড থাকতে পারে বলে তাঁরা ধারণা করছেন।