• Home  / 
  • ঐতিহ্য  / 

বাউফলের মৃৎশিল্পী বিশ্বেশ্বর পাল পেলেন জাতীয় সম্মাননা

জানুয়ারি ২১, ২০১৮
Spread the love

 

বিশেষ প্রতিবেদক
বাউফলের বিশিষ্ট মৃৎশিল্পী বিশ্বেশ্বর পাল বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের আজীবন সম্মাননা পেলেন। শনিবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজাউর রহমান সম্মেলন কক্ষে শিল্পীর হাতে এক লক্ষ টাকা, সার্টিফিকেট ও সম্মাননা তুলে দেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি , বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের সভাপতি চন্দ্র শেখর সাহা। বিশ্বেশ্বর পালের জাতীয় সম্মাননা লাভে , মৃৎশিল্প সম্মেলন ও সম্মাননা, বরিশাল ও চারুকলা বরিশাল অভিনন্দন জানিয়েছেন।

বাংলার মৃৎশিল্পে, ঐতিহ্যবাহী ধারা থেকে নানা নিরীক্ষাধর্মী ও আধুনিক ধারার কাজে যে কয়েকজন মৃৎশিল্পী নিবেদিতপ্রাণ, তারমধ্যে অন্যতম বিশ্বেশ্বর পাল অন্যতম। তাঁর জন্ম পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার মদনপুরা গ্রামে, ১৯৫২ সালের ৩রা জানুয়ারী।পিতা অর্শ্চুতানন্দন পাল ও মাতা সৌদামিনী পাল ও ঐতিহ্যবাহী ধারার গুণী শিল্পী ছিলেন। বিশ্বেশ্বর পাল ও তাঁর পরিবারের পরম্পরাগত শিল্প‘বাউফলের মৃৎশিল্প’আজ শুধু নিজ এলাকা নয় বাংলাদেশের অন্যতম উৎকৃষ্ট মৃৎশিল্প হিসেবে ইতোমধ্যে সর্বত্র সমাদৃত হয়েছে। দেশ ছাড়িয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসব মৃৎশিল্প সামগ্রী বিদেশেও রপ্তানি হয়ে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছে।

বিশ্বেশ্বর পাল কয়েক পুরুষ ধরে বাউফলের প্রত্যন্ত গ্রাম মদনপুরায় বসবাস করছেন। নদী বাহিত পলল মাটি ও সহজ যোগাযোগ এই অঞ্চলকে মৃৎশিল্পের আদর্শ স্থানে পরিণত করেছে। এই অঞ্চলের মদনপুরা, বিলবিলাস ও বগাকে ঘিরে শতাধিক মানুষ ঐতিহ্যবাহী হাড়ি-পাতিল, গৃহসামগ্রী ও মাছধরার মৃৎউপকরণ তৈরির পাশাপাশি টিসেট, ডিনার সেট, ফুলদানি, কলমদানি,আগরদানি, মশারকয়েল দানি, নানা প্রকার পট সহ বিভিন্ন ধরণের আধুনিক এবং নাগরিক গৃহস্থালী ও গৃহসজ্জার দৃষ্টিনন্দন সামগ্রী তৈরি করে চলছেন অনবদ্য দক্ষতায়।

এসব সামগ্রীর একটি প্রধান অংশ ঢাকার বিভিন্ন শোরুমে শোভা পাচ্ছে যা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান হয়ে বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও মেলায়ও নিয়মিত যাচ্ছে। বাউফলের এই মৃৎসামগ্রীর প্রাচুর্যের মূলে রয়েছে বিশ্বেশ্বরপাল ও তাঁর বড়ভাই রাজ্যেশ্বরপালের ঐকন্তিক প্রচেষ্টা ও নিজ সম্প্রদায়ের মানুষকে উন্নত মৃৎসামগ্রী তৈরিতে নেয়া নানা উদ্যোগ; বিশেষত দেশীয় ভেষজ উপদান ব্যবহার করে কালো রঙ করা মৃৎসামগ্রী বাংলাদেশে তিনিই প্রথম প্রচলন করেন। নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব রঙ ও এর উজ্জ্বলতা, ডিজাইনের অভিনবত্ব ‘বাউফলমৃৎসামগ্রী’কে দেশের অন্যতম মৃৎশিল্প ঐতিহ্যের ব্রান্ডে পরিণত করেছে।

স্বাধীনতার প্রাক্কালে, ১৯৬৯ সালে বিশ্বেশ্বর পাল ও তার বড়ো ভাই রাজ্যেশ্বর পাল সম্পূর্ণ ব্যাক্তিগত উদ্যোগে বরিশাল নগরীর অশ্বিনী কুমার হলের সামনে বাউফলের মৃৎসামগ্রী বিক্রির চেষ্টা করেন। সে সময়ে এই উদ্যোগ পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিতও হয়। বিশ্বেশ্বর পালি বভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প (বিসিক) আয়োজিত উন্নত মৃৎসামগ্রী বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন ও পরবর্তীতে তিনি বাউফলে বিভিন্ন মৃৎপরিবারের মধ্যে অর্জিতজ্ঞান ও কলাকৌশল ছড়িয়ে দেন। ফলে উন্নতমৃৎসামগ্রী তৈরিতে এই অঞ্চলের আলাদা বৈশিষ্ট্য তৈরি হয় যা সকলের নজর কাড়ে। বাউফল হয়ে ওঠে উন্নত মৃৎশিল্প তৈরীর এক জনপদে।
১৯৮৪ সালে‘কোর দি জুট ওয়ার্কস’এর মাধ্যমে বিশ্বেশ্বরপাল ও তাঁর পরিবারের তৈরি উৎকৃষ্ট মৃৎসামগ্রী প্রথম দেশের বাইরে রপ্তানি হয়, যা এই অঞ্চলের উন্নত মৃৎসামগ্রী তৈরি ও এই ধারা বজায় রাখার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান হয়ে মৃৎ ঐতিহ্যের এই বিদেশ যাত্রা আজও অব্যাহত রয়েছে।

বিশ্বেশ্বর পাল দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে বাংলা একাডেমি মেলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ আয়োজিত জয়নুল মেলা, সোনারগাঁ লোককারুশিল্প জাদুঘর আয়োজিত মেলা এবং বরিশালে মৃৎশিল্পী সম্মেলন ও মেলায় অংশগ্রহণকরে সম্মাননা লাভ করেছেন।

এ ছাড়া তিনি ১৯৭৬ সালে পটুয়াখালিতে অনুষ্ঠিত কৃষি ও শিল্প প্রদর্শনীতে সম্মাননা লাভ করেন।
১৯৯৩ সালে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর কতৃক সেরা মৃৎশিল্পী সম্মাননা লাভ করেন,বাংলা ১৪২০ সালে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) কতৃক ‘কারুগৌরব’পুরষ্কারে সম্মানিত হয়।  এছাড়া ২০১৬ সালে, মৃৎশিল্পে সারাজীবনের অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ ‘মৃৎশিল্পী সম্মেলন ও সম্মাননা, বরিশাল’ কতৃক আজীবন সম্মাননা লাভ করেন।

বিশ্বেশ্বর পাল প্রাতিষ্ঠানিক ধারায় স্কুলের প্রচলিত গন্ডিশেষ করতে পারেন নি। কিন্তু বৃত্তিমূলক ধারায়, তাঁর বংশ পরস্পাগত, প্রিয় মৃৎশিল্পের নতুন নতুন নিরীক্ষার মাধ্যমে মৃৎশিল্পকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। গড়ে তুলেছেন মদনপুরা মৃৎশিল্প সমিতি। ২০১৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন নিসার হোসেন বিশ্বেশ্বর পালের বাড়িতে গিয়ে মৃৎসামগ্রী তৈরিতে তাঁর অবদান দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে তাকে মৃৎসামগ্রী বিষয়ে কর্মশালায় আমন্ত্রণ জানান।

বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকারের সচিব, মন্ত্রী , বেলজিয়ামের রাস্ট্রদূতসহ বিভিন্ন গুরত্বপূর্ণ ব্যাক্তি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিশ্বেশ্বর পালের অন্যতম উদ্যোগ মদনপুরা পালপাড়া পরিদর্শন করে এর ভূয়সী প্রশংসা করেন। এ ছাড়া পটুয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যক্রম ও গবেষণার কাজেও ছাত্রদের বিভিন্ন শিক্ষা ও গবেষণা মূলক কাজে তিনি এগিয়ে এসেছেন। তাঁর ২ ছেলেও বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেছেন। বড়ো ছেলে তরুণ কুমার পাল ও ছোটো ছেলে শিশির কুমার পালও বাউফলের মৃৎশিল্পেরঐতিহ্য ও আধুনিকতার ধারা অব্যাহত রাখতে ক্রাফটস ভিলেজ লিমিটেড সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।
বিশ্বেশ্বর পাল বলতে গেলে জ্ঞান হওয়ার আগে থেকেই যুক্ত হয়ে পড়েন মৃৎশিল্পের বিভিন্ন পেশাগত কাজে যা অর্ধশতাব্দী পেড়িয়ে জীবনসায়াহ্নেও অব্যাহত রেখেছেন।