আয়না২৪ প্রতিবেদন
বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্য বনবিবি পূজা। বননির্ভর জনগোষ্ঠীর আবহমান সংস্কৃতির এক অনবদ্য বিশ্বাসের সংস্কৃতি হল মা বনবিবির পুজা। মা বনবিবিকে নিয়ে রচিত দক্ষিণ বাংলার অতি জনপ্রিয় পালাগান ‘দুখে যাত্রা’ তারই এক অনন্য দৃষ্টান্ত। বাদাবনের রক্ষাকর্তা হিসেবে মা বনবিবিকে আরাধনা ও পূজা অর্চনা করেন হিন্দু মুসলিম, নারী-পুরুষসহ সব শ্রেণি ও পেশার মানুষ। দেশের সুন্দরবন সংলগ্ন দক্ষিণাঞ্চলের নানা স্থানে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সাথে মা বনবিবি পূজা পালিত হয়। এ পূজাকে কেন্দ্র করে বনবিবি মেলা বা পালা গান দেখা যায় যত্রতত্র।
বনজীবীরা মোম-মধু, মাছ-কাঁকড়া, গোলপাতা ও কাঠসহ নানা ধরনের সম্পদ আহরণে যত্রতত্র সুন্দরবনে প্রবেশ করেন। সুন্দরবনে, হিংস্র বাঘ, কুমির, সাপ, কামটসহ নানা বিপদের হাত থেকে পরিত্রাণের আশায় তাঁরা মা বনবিবিকে স্মরণ করেন। তাদের বিশ্বাস মা সহায় থাকলে জঙ্গলে তাদের কোন বিপদ হবে না।
ঐতিহাসিক সতীশ চন্দ্র মিত্রের যশোর খুলনার ইতিহাসে উল্লেখ আছে, বনবিবি বেরাহিম নামের এক আরব দেশীয় কন্যা। বেরাহিমের স্ত্রী গুলান বিবির যšণায় অতীষ্ঠ হয়ে সুন্দরবনে পরিত্যাক্ত হন। সেখানেই তার গর্ভে বনবিবি ও শাহাজঙ্গুলীর জন্ম হয়। এরপরই লোক বিশ্বাসে তাদের অবস্থান অনেকখানী শক্ত হয়। ‘বনববিরি পাঁচালি বা পালা গান দুখে যাত্রায় উল্লেখ আছে অনেক আগে সুন্দরবনের পাশের গ্রামের এক গরিব মায়ের শিশু ছেলেকে নিয়ে সুন্দরবনে মধু করতে যায় ধনা চাচা ওমনা চাচা নামের দুই ব্যবসায়ী। দুখেকে মা বলেন, ‘বনে আমার মতো তোর আর এক মা রয়েছে। কোনো বিপদে পড়লে তাকে ডাকবি।’ সেইসময় বনে গাজী কালু নামে এক আউলিয়া থাকতেন। দক্ষিণ রায় এর সাথে (বাঘবেশী অপশক্ত) গাজী কালুর সখ্যতা ছিল। এক রাতে দক্ষিণ রায় ধনা মনাকে স্বপ্ন দেখান। তাদের দুই ভাইকে প্রচুর ধন সম্পদ ও মধুর লোভ দেখান। বিনিময়ে শিশু ছেলে দুখেকে তার জন্য উৎসর্গ করতে বলেন। তা না হলে নৌকা ডুবিয়ে দেওয়ার ভয় দেখান। ধনে আর মনে লোভে পড়ে দুখেকে বনে ফেলে নৌকা নিয়ে চলে যায়। দুখে তার মায়ের কথামত সেই বনের মাকে স্মরণ করলে মা বনবিবি এসে বাঘরুপি দানব দক্ষিণ রায় এর হাত থেকে দুখেকে রক্ষা করেন। কুমিরের পিঠে বসিয়ে তাকে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেন। এভাবেই বনবিবি সুন্দরবননির্ভর জনগোষ্ঠী তথা সকলের কাছে দেবীর মর্যাদা পায়। বিশ্বাস, ভক্তি, আরাধনা ও অর্চনায় পূজিত হতে থাকে সর্বত্রই।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের জেলেখালী, হরিনগর, চুনকুড়ি, রমজাননগর ইউনিয়নের কালিঞ্চি গ্রামে, বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের পানখালী গ্রামে, কৈখালী ইউনিয়নের গোলাখালী গ্রামসহ সুন্দরবন সংলগ্ন কয়েকটি স্থানে বাংলা মাঘ মাসের ১ তারিখে বনবিবি পূজা ও মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
উপজেলার জেলেখালী গ্রামে মা বনবিবির পূজা পালিত হয় মহ ধুমধামের সাথে। “আগে এ বনবিবি মেলা উপলক্ষে যাত্রা, পুতুলনাচ, নাগরদোলাসহ নানা গ্রামীণ আনন্দ আয়োজন দেখা যেত। এখন আর আগের মত জাঁকজমকপূর্ণভাবে এ পূজা পালিত হয় না। এক বেলার মধ্যেই পূজা বা মেলা শেষ-” বললেন পূজা কমিটির প্রধান আয়োজক সতীশ কুমার মন্ডল। তিনি আরও জানান, আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে গ্রামের নীলকান্ত ফকির সুন্দরবনের একমাত্র ফকির (গুণমান) হিসেবে এলাকা অতি জনপ্রিয় ছিল। তিনি স্বপ্নে মা বনবিবির আশাবাড়ী প্রাপ্ত হন। সুন্দরবনের বাঘ, কুমির, দানব দৈত্যের হাত তার ভক্তদেরর ক্ষার জন্য মা বনবিবি যে লাঠি ব্যবহার করেন সেটিই হল আশাবাড়ী। সেই আশাবাড়ীকে স্বযতেœ, ভক্তি ও শ্রদ্ধার সাথে পূজা করে চলেছেন সেই শুরু থেকে।
মেলায় গিয়ে দেখা যায় পুরোহিতবিহীন পূজায় আগের মত সেই আমেজ না থাকলেও হাজারো ভক্ত ও দর্শনার্থীর ভিড়ে মুখরিত হয়ে পূর্ণভুমিতে রূপান্তরিত হয়েছে। গ্রামের বিলের মধ্যে অবস্থিত স্থায়ী বনবিবি মন্দিরের মধ্যে নতুন রূপে মা বনবিবি, শাহাজঙ্গুলি, দক্ষিণ রায়, গাজী কালু, দুখে, ধনা আর মনার আবক্ষ তৈরি করা হয়েছে। রয়েছে মায়ের হাতে সেই আশাবাড়ী। মেলাকে কেন্দ্র করে মুড়ি, মুড়কি, বাতসা, মিষ্টি, ধুপ, ধুনো, নানা ধরনের খেলনা, চা বিস্কুট, নানা বর্ণের ভাজা ও শাখার দোকানসহ সাজানো হয়েছে নানা ধরনের দোকান।
দোকানিরা মিষ্টির পশরা সাজিয়ে রেখেছেন নানা ধরনের মিষ্টি দিয়ে। সেই মিষ্টি কেউবা মায়ের পায়ে নিবেদন করছেন, কেউবা আনন্দভরে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন বাড়িতে। মায়ের আবক্ষ মাথায় নিয়ে মন্দিরের চারপাশ প্রদিক্ষণ শেষে বাতসার ডালি নিয়ে মানতের হরিলুঠ এর প্রসাদ সংগ্রহ করেন উপস্থিত শিশু, কিশোর ও আবাল, বৃদ্ধ সকলেই। শত বছরের প্রাচীন এই বনবিবি মেলায় শ্যামনগর উপজেলার সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষের সমাগম দেখা যায়। কেউ এসেছেন শির্নি দিতে, এখানে কেউ বা এসেছেন মানত দিতে, কেউ এসেছেন মায়ের কাছে সন্তান লাভের আশায়, কেউ বা এসেছেন মাকে সন্তুষ্টি করতে মুরগি উৎসর্গ করতে, আবার কেউ এসেছেন বাদ্যযন্ত্রসহ প্রতিমা মাথায় নিয়ে। প্রাচীন এই বনবিবি মেলাকে টিকিয়ে রাখার জন্য নিতে হবে সমন্বিত উদ্যোগ তাহলে রক্ষা পাবে এই প্রাচীন ঐতিহ্য।
সুন্দরবনের হিংস্র বাঘ, কুমির, সাপ, কামটসহ নানা দানব দৈত্য ও বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেন মা বনবিবি। সুন্দরবন ও সুন্দরবননির্ভর মানুষের রক্ষাকবজ বনবিবিকে পূজা ও আরাধনা করেন হিন্দু, মুসলিম সকলেই। গ্রামীণ লোকসংস্কৃতির বিশ্বাস আর ভক্তির দেবী বনবিবি পূজার ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখার জন্য স্থানীয়দের পাশাপাশি নিতে হবে সরকারি ও বেসরকারী উদ্যোগ।