আজ থেকে ১০০ বছর আগে ১৯১৭ সালের অক্টোবর মাসে রুশ দেশে যে বিপ্লব ঘটেছিল তা পৃথিবীকে চমকে ও বদলে দিয়েছে। একদিক দিয়ে নয়, বহুদিক দিয়ে। পরিবর্তন ঘটিয়েছে চিন্তায়, দৃষ্টিভঙ্গিতে, রাজনীতি, সংস্কৃতি, সমাজ ব্যবস্থায়, মানবিক সম্পর্কে এবং মানচিত্রে।
বহুকাল ধরে মানুষ সাম্য, মৈত্রী, ইনসাফের যে সমাজের স্বপ্ন দেখে এসেছে, অক্টোবর বিপ্লব সেই স্বপ্নকেই বাস্তবায়ন করার কাজ করেছে এবং তার মধ্য দিয়ে মানুষকে দিয়েছে আশা ও অগ্রযাত্রার পথের দিশা। ‘মুক্ত মানুষের মুক্ত সমাজ’ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় অক্টোবর বিপ্লব মানব সভ্যতায় সূচনা করেছিল এক নতুন যুগের। বস্তুত, মার্কসবাদী তত্ত্ব ও মতাদর্শকে ধারণ করে অক্টোবর বিপ্লব পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ে নতুন মাত্রা যোগ করে, সৃষ্টি করে বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের এক নতুন আন্তর্জাতিকতা। শতাব্দী পার হয়ে যাচ্ছে কিন্তু ওই বিপ্লবের ঐতিহাসিক তাৎপর্য এক বিন্দুও মলিন হয় নি, বরং বর্তমান বিশ্বের গাঢ় অন্ধকারের পটভূমিতে তা আরও উজ্জ্বল ও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
রাশিয়ার শ্রমিক-কৃষক মেহনতী মানুষ লেনিন ও বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিল। ‘রুটি-জমি-শান্তি’ সেøাগানকে সামনে রেখে শ্রমিক-কৃষক-জনতার লালবাহিনী রাশিয়ার তৎকালীন অন্তর্বর্তীকালীন বুর্জোয়া সরকারকে উৎখাত করে এক নতুন ধরনের সভ্যতা ও সংস্কৃতির সূচনা করেছিল। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, সমস্ত ক্ষমতা ধনিক শ্রেণির পার্লামেন্টের হাতছাড়া হয়ে চলে গিয়েছিল তৃণমূল থেকে নির্বাচিত মেহনতী ও শোষিত-নিপীড়িত মানুষের প্রতিনিধিদের ‘সোভিয়েত’-এর কাছে। পুঁজিবাদী পথের বিপরীতে সমাজতান্ত্রিক পথে অগ্রসর হওয়ার লক্ষ্যে মেহনতী মানুষের অভূতপূর্ব জাগরণ ও সৃষ্টিশীল শক্তির প্রকাশকে বিশ্ববাসী অপার বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করেছিল।
প্রতিষ্ঠিত শোষণ ও নিপীড়নমূলক রাষ্ট্র কাঠামোটিকে ভেঙে অক্টোবর বিপ্লব যে নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলো তার ফলে অনেকগুলো পুরানো ধারণা ভেঙে গেলো। সাম্য, মৈত্রী, স¦াধীনতা ও গণতন্ত্রের নতুন অর্থ উন্মোচিত হলো। এই বিপ্লব বুঝিয়ে দিল যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রথম শর্ত হচ্ছে দার্শনিক ইহজাগতিকতা ও রাজনৈতিক ধর্মনিরপেক্ষতা। মানুষকে শেখালো যে গণতন্ত্র কখনোই গণতান্ত্রিক হবে না যদি না নাগরিকদের ভেতর অধিকার ও সুযোগের সাম্য থাকে, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটে এবং সর্বত্র প্রকৃত জনপ্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। নারী পুরুষের সম্পর্ক ও বিবাহের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করলো স্বাভাবিক ও সমান অধিকার। নারী মুক্তি ছাড়া যে সামাজিক মুক্তি সম্ভব নয় তা দেখিয়ে দিলো। প্রমাণ করলো যে মানুষের ভেতর যে সৃষ্টিশীলতা আছে তাকে অবমুক্ত করা গেলে আপাত অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। বিপ্লব জানিয়ে দিল যে মানুষের ইতিহাস শ্রেণী সংগ্রামেরই ইতিহাস এবং সভ্যতা এগোয় মেহনতী মানুষের শ্রমের কারণেই। অবসান ঘটালো পুঁজির অমানবিক দাসত্ব ও দুঃশাসনের। বিপ্লব ব্যক্তিমালিকানার জায়গায় পর্যায়ক্রমে নিয়ে এলো সামাজিক মালিকানাকে।
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন পুঁজিবাদী বিশ্বের একের পর এক আক্রমণের মুখে টিকে থেকে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হয়েছে। বিপ্লবের পরপরই ধনিক শ্রেণীর সন্ত্রাসবাহিনী নানা ধরনের অন্তর্ঘাতমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে মেহনতী মানুষের বিজয়কে নস্যাৎ করতে চেয়েছে। ধনিক ব্রিটেন, ফ্রান্স, আমেরিকাসহ ১৬টি দেশ সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেছে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধ্বংস করার জন্য। চেষ্টা করা হয়েছে লেনিনকে হত্যা করার। তবু মেহনতী মানুষের প্রচেষ্টা ও বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগে সোভিয়েত ইউনিয়ন টিকে গেছে এবং সারা বিশ্বের মেহনতী মানুষের কাছে এক অফুরন্ত প্রেরণার উৎসে পরিণত হয়েছে। সারা বিশ্বের মেহনতী মানুষেরা সেসময়ে নবগঠিত সোভিয়েত রাষ্ট্রের প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। ১৯৩০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণ করে তাই বিস্ময়াভিভূত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘রাশিয়ার চিঠি’তে লেখেন, ‘রাশিয়ায় এসেছিÑনা হলে এ জন্মের তীর্থদর্শন অত্যন্ত অসমাপ্ত থাকত।’ তাঁর মতে রাশিয়া তাদের কর্মকাণ্ডে সাধারণের কাজ, সাধারণের চিত্ত, সাধারণের স্বত্ব বলে একটা অসাধারণ ‘সত্তা সৃষ্টি করতে নেমে গেছে।’
সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বকে একের পর এক বিস্ময় উপহার দিয়েছে। বিশ্বে সর্বপ্রথম নারীদের ভোটাধিকার, শিক্ষায় সমান সুযোগ, সমমজুরী নিশ্চিত করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েতের নারীরা পুরুষদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণে অংশ নেয়, এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রেও তারা বীরত্বের সাথে ভূমিকা রাখে। জারের আমলে যেখানে রাশিয়ায় স্বাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ২০%, সেখানে ১৯৩৭ সালের মধ্যে শতভাগ স্বাক্ষরতা নিশ্চিত করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯১৩ সালে যেখানে গড় আয়ু ছিল মাত্র ৩৫ বছর, পরবর্তীকালে সোভিয়েত আমলে তা দ্বিগুণ হয়ে ৭০ বছরে পৌঁছায়। সোভিয়েত আমলে মজুরী বৃদ্ধির পাশাপাশি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানেও এসেছিল অভাবনীয় উন্নতি। মেহনতী মানুষের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছিল যেমন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার, তেমনি অবারিত হয়েছিল শিল্প-সাহিত্যের দ্বার। ক্রীড়াক্ষেত্রেও সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল অগ্রসর। প্রতিটি মানুষের আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণে, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়নে ও বাস্তবায়নে তৃণমূলের মানুষের মতামত প্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৩৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন যে সংবিধান রচনা করে তা কোটি কোটি কপি ছেপে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। তাদের মতামত নিয়ে তবেই সংবিধানের চূড়ান্ত রূপ ঠিক করা হয়। কলকারখানায় উৎপাদনে, পরিচালনায় ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে শ্রমিকেরা বিশ্বে প্রথমবার মুখ্য ভূমিকা পালনের অধিকার লাভ করে।
সোভিয়েত আমলের প্রথম দুটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় শিল্পের বিকাশ জারের আমলের চাইতে ৮০০ শতাংশের চেয়েও বেশী বৃদ্ধি পায়। পুঁজিবাদের সঙ্কটকালীন সময়ে সারা বিশ্ব যখন অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন, তখনও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রবৃদ্ধি উত্তরোত্তর বেড়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সবচাইতে ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েও ১৯৪৭ সালের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার শিল্পের উৎপাদন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ করে ফেলে। কৃষকদের সমবায়ভিত্তিক যৌথখামার ও কৃষি আন্দোলন এবং শ্রমিকদের স্ট্যাখানোভাইট আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উদ্দীপনা সৃষ্টি করে মেহনতী মানুষের রাষ্ট্রটি সমৃদ্ধির শিখরে উঠতে থাকে। বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্র নির্মাণ, তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, মহাশূন্যে সর্বপ্রথম মানুষ পাঠানো ইত্যাদি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের খবরই জানিয়ে দেয়। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও মেহনতী মানুষের সোৎসাহ কর্মোদ্দীপনা ও অংশগ্রহণ মানুষের জীবনে কতটা যে পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে তা দেখিয়ে দিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন।
সোভিয়েত ইউনিয়ন শুধুমাত্র নিজস্ব সীমানার গন্ডির ভেতরের সাধারণ মানুষকে নতুন জীবনের আস্বাদ দেয় নি, বরং সারা বিশ্বের মেহনতী মানুষের সংগ্রামে আদর্শিক উদ্দীপনা জাগিয়েছে। ফ্যাসিস্ট হিটলার বাহিনীকে পরাজিত করে বিশ্বসভ্যতাকে নাৎসীবাদের ভয়াল কবল থেকে রক্ষা করেছে। দেশে দেশে মেহনতী মানুষের সংগ্রামকে সমর্থন করার পাশাপাশি সাম্রাজ্যবাদের অধীনস্ত দেশগুলোর জাতীয় মুক্তি সংগ্রামেও সোভিয়েত ইউনিয়ন রেখেছে সক্রিয় ভূমিকা। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে সোভিয়েত ইউনিয়ন পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল।
সোভিয়েত ইউনিয়ন আজ আর নেই। কিন্তু সেদেশে ও বিশ্বের সব দেশে সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদের আন্দোলন অব্যাহত আছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয় অক্টোবর বিপ্লবের মাহাত্মকে কোনোভাবেই ক্ষুণœ করে নি বরং তার তাৎপর্যকে আরো উজ্জ্বল করে তুলেছে।
সোভিয়েত-পরবর্তী বিশ্বে পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। কয়েকটি বৃহৎ একচেটিয়া আন্তর্জাতিক ব্যাংক, কারখানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এখন বিশ্ব অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো লগ্নি পুঁজির রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তিকেন্দ্র হিসেবে সারা দুনিয়ার মানুষকে শাসন-শোষণ করছে। শুধুমাত্র অর্থনৈতিকভাবে নয়, সামরিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমেও তারা গোটা বিশ্বের উপর নিজেদের আধিপত্য বজায় রেখেছে। তাদের তাঁবেদারীত্ব গোটা বিশ্বে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ও সরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহকে বেসরকারীকরণের প্রক্রিয়াকে দুর্বার করে তুলেছে। ফলে মুষ্টিমেয় অংশের হাতে সম্পদ জমা হচ্ছে এবং ভয়াবহরূপে বৃদ্ধি পাচ্ছে বৈষম্য। আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তার নিজের সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সাহায্যে তথাকথিত ‘তৃতীয় বিশ্বের’ দেশগুলোর শ্রমশক্তি, কাঁচামাল, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, কলকারখানার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ও বাজারের দখল নিয়ে অবাধে লুটপাট চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, মুনাফালোভী লগ্নি পুঁজির প্রকৃতি বিধ্বংসী পদক্ষেপ ইতিমধ্যেই পৃথিবীর প্রাকৃতিক চক্রসমূহের ও পরিবেশগত ভারসাম্যের অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করে ফেলেছে।
পুঁজিবাদের আজ অন্তিম দশা। সে সরাসরি রূপ নিয়েছে ফ্যাসিবাদের। তার নৃশংসতা এখন সর্বত্রব্যাপী। পুঁজিবাদ অস্ত্র ও মাদকব্যবসা করছে। সমস্ত প্রগতিশীল চিন্তার সে কণ্ঠরোধ করেছে। তার মিডিয়া ভোগবাদিতাকে নিরন্তর উৎসাহিত করে চলেছে। মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতার বৃদ্ধিতে উৎসাহ যোগাচ্ছে। হতাশা সৃষ্টি করছে বিশ্বব্যাপী। প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের ধ্বংসে তার তৎপরতার কোনো বিরাম নেই। আতঙ্কিত ধরিত্রী আজ বিপন্ন।
বর্তমান সময়ের বাংলাদেশের দিকে তাকালে নির্দ্ধিধায় বলা যায় যে, যে-আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে এই দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, সেই আশা-আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন হয় নি। আমাদের মুক্তি সংগ্রামে জাতীয়তাবাদী ধারার পাশাপাশি সমাজতান্ত্রিক ধারাও যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। প্রকৃতপক্ষে সমাজতন্ত্রীরাই সর্বপ্রথম স্বাধীনতার আওয়াজ তোলেন। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন এবং তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষার আন্দোলনসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনেই তারা ছিলেন চালিকা শক্তি। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে সমাজতান্ত্রিক ধারার দুর্বলতার সুযোগে, আমাদের এই দেশ জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা লুটেরা পুঁজিবাদী ধারায় পরিচালিত হয়েছে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বাস্তবায়নের বিপরীতে বৈষম্য বেড়েছে, বেড়েছে দুর্নীতি ও লুটপাট। সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী শক্তির আগ্রাসন থেকে মুক্ত হয় নি লাখো শহীদের বাংলাদেশ। এমনকী ন্যূনতম নির্বাচনী গণতন্ত্রও আজ অনুপস্থিত, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পরিবারতন্ত্র, পুনরুত্থান ঘটেছে ফ্যাসিবাদী প্রবণতার ও সাম্প্রদায়িক শক্তির। যে মেহনতী মানুষের শ্রমে-ঘামে টিকে আছে আমাদের এই রাষ্ট্র, তাদের জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করা তো দূরের কথা, বেঁচে থাকবার মতো ন্যূনতম মজুরী কিংবা কষ্টে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দামটুকুও নিশ্চিত করা যায় নি। নারী নিপীড়ন-নির্যাতন-ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। পাহাড় ও সমতলে বিভিন্ন জাতিসত্ত্বা আজ নিপীড়নে বিপন্ন। তিনধারার শিক্ষাব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ এবং সাম্প্রদায়িকীকরন দেশকে এক ভয়াবহ বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমাদের জাতীয় সম্পদকে বিদেশী কোম্পানীগুলোর কাছে বিকিয়ে দেওয়া হচ্ছে সংকীর্ণ স্বার্থে কিংবা ক্ষমতার লোভে। উন্নয়নের নামে চলছে লুটপাটের মহোৎসব, পাচার হয়ে যাচ্ছে জাতীয় সম্পদ। কণ্ঠরোধ করা হয়েছে মতপ্রকাশের অধিকারের। বুর্জোয়া ধারার দুটি জোটের কাঠামোতে দেশকে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। তারা উভয়েই সাম্রাজ্যবাদ তোষণকারী ও লুটেরা পুঁজিবাদের সেবাদাস। দেশকে সংকটমুক্ত করতে হলে এই দ্বিদলীয় বুর্জোয়া ধারার বিপরীতে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতী মানুষকে সচেতন ও সংগঠিত করে সমাজতান্ত্রিক ধারাকে শক্তিশালী করে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলা আজ অপরিহার্য কর্তব্য হয়ে উঠেছে। এই শক্তির বিকাশের প্রয়াসে অক্টোবর বিপ্লব অনিঃশেষ প্রেরণার উৎসধারা হয়ে আছে এবং থাকবে।
এই বছর মহান অক্টোবর বিপ্লবের শততম বার্ষিকী। সারা বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক শক্তি, শ্রমিক-কৃষক-মেহনতী মানুষ অক্টোবর বিপ্লবের শতবর্ষ উদযাপন করতে যাচ্ছে। বাংলাদেশেও অক্টোবর বিপ্লব শতবর্ষ উদ্যাপন জাতীয় কমিটি গঠিত হয়েছে। এই কমিটি কর্তৃক কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকায় আগামী ১লা অক্টোবর, অক্টোবর বিপ্লব শতবর্ষ উদযাপনের কর্মসূচী শুরু হবে, ৭ই নভেম্বর একটি মহাসমাবেশ ও লাল পতাকা মিছিলের মধ্য দিয়ে কর্মসূচী আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত হবে। এই সময়ের মধ্যে দেশের প্রগতিশীল শ্রমিক-কৃষক-ক্ষেতমজুর-ছাত্র-যুব-নারী-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো ঢাকায় সভা-সমাবেশ-প্রদর্শনী-সেমিনার-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানামাত্রিক কর্মসূচি পালন করবে। দেশে ইতিমধ্যেই অনেক জায়গায় স্বতস্ফূর্তভাবে অক্টোবর বিপ্লবের উদ্যাপনের কমিটি গঠিত হয়েছে, কর্মসূচি পালিত হচ্ছে, সেই সকল কার্যক্রমকে অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি আমরা দেশের প্রতিটি জেলায় শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-যুব-নারী-সংস্কৃতিকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সমন্বয়ে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানাই। অনুষ্ঠানসর্বস্বতা নয়, বরং অক্টোবর বিপ্লবের তাৎপর্য সকল মানুষের কাছে তুলে ধরে এদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে বেগবান করার প্রয়োজনেই অক্টোবর বিপ্লবের শতবর্ষ পালন করা আবশ্যক।
তাই অক্টোবর বিপ্লবের শতবর্ষের প্রাক্কালে আমরা অব্যাহত লুটপাট, অগণতান্ত্রিক শাসন, ফ্যাসিবাদী প্রবণতা, ধর্মীয় জঙ্গিবাদ-সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদ-আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সারা দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের জন্য আহ্বান জানাই। আমাদের আশা এই উদ্যাপন অক্টোবর-নভেম্বরেই শেষ হয়ে যাবে না, এর মধ্য দিয়ে উজ্জীবিত উৎসাহ আমাদের সমষ্টিগত মুক্তির স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করতে সাহায্য করবে।
-অক্টোবর বিপ্লব শতবর্ষ উদযাপন জাতীয় কমিটি সৌজন্যে