বাংলাদেশে আঘাত হানা ভয়াবহ কয়েকটি ঘূর্ণিঝড়

নভেম্বর ৬, ২০১৭
Spread the love

রাকিব ইসলাম

ঘূর্ণিঝড় হল ক্রান্তীয় অঞ্চলের সমুদ্রে সৃষ্ট বৃষ্টি, বজ্র ও প্রচন্ড ঘূর্ণি বাতাস সম্বলিত আবহাওয়ার একটি নিম্ন-চাপ প্রক্রিয়া যা নিরক্ষীয় অঞ্চলে উৎপন্ন তাপকে মেরু অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত করে। এই ধরনের ঝড়ে বাতাস প্রবল বেগে ঘুরতে ঘুরতে ছুটে চলে বলে এর নামকরণ হয়েছে ঘুর্নিঝড়। 

ঘুর্নিঝড়ের ঘুর্নন উত্তর গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার দিকে।

ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানলে যদিও দুর্যোগের সৃষ্টি হয়, কিন্ত্ত এটি আবহাওয়ার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যা পৃথিবীতে তাপের ভারসাম্য রক্ষা করে। গড়ে পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় ৮০ টি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়। এর অধিকাংশই সমুদ্রে মিলিয়ে যায়, কিন্ত্ত যে অল্প সংখ্যক উপকূলে আঘাত হানে তা অনেক সময় ভয়াবহ ক্ষতি সাধন করে।

বাংলাদেশ অত্যন্ত দুর্ভাগা একটি দেশ। তার অবস্থানগত কারণে, সমতল আর নিচু ভূমি তার সাথে সাথে ঘনবসতির কারণে খুব সহজেই নানা সামুদ্রিক ঝড় বাংলাদেশকে কাবু করে ফেলতে পারে। ঘূর্ণিঝড়ের মূল কারনটা আসলে সমুদ্র। সাথে সাথে তো অবশ্যই স্থলভাগ আছে। আরও আছে সূর্য, বায়ুমণ্ডল, বায়ুমণ্ডলের ঘনত্বের তারতম্য, তাপমাত্রা, তাপমাত্রার হেরফের প্রভৃতি।

বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে ও পরে যেসব ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে, সেগুলো নিয়ে আজকের আয়োজন-

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়

বাংলাদেশের মধ্যে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে অন্যতম ১৯৯১ সালের সেই ঘূর্ণিঝড়। নিহতের সংখ্যা বিচারে স্মরণকালের ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে একটি। এই ঘূর্ণিঝড়ে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চলে সংঘটিত হয়। ঘণ্টায় প্রায় ২৫০ কিলোমিটার বেগে আঘাত করে ঘূর্ণিঝড়টি। এই ঘূর্ণিঝড়ের ফলে ৬ মিটার (২০ ফুট) উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত করে এবং এর ফলে প্রায় ১ লক্ষ ৩৮ হাজার মানুষ নিহত হয়। এছাড়া প্রায় ১ কোটি মানুষ তাদের সর্বস্ব হারায়। ঘূর্ণিঝড়টি স্থলভাগে আক্রমণের পর এর গতিবেগ ধীরে ধীরে হ্রাস পায় এবং ৩০ এপ্রিল এটি বিলুপ্ত হয়। এতে সন্দ্বীপ, মহেশখালী, হাতিয়া দ্বীপে নিহতের সংখ্যা সর্বাধিক। যাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল শিশু ও বৃদ্ধ। ধারণা করা হয়- প্রায় ২০ লক্ষ লোক আশ্রয়কেন্দ্রে না গিয়ে বিপজ্জনক স্থানে অবস্থানের কারণে আক্রান্ত হয়। সেসময় প্রায় ১০ লক্ষ ঘর-বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে ১ কোটি মানুষ বাস্তুহারা হয়ে পড়ে।

বাকেরগঞ্জ ঘূর্ণিঝড় 
প্রাণহানী ও ভয়ংকরের দিক থেকে পৃথিবীর ঘূর্ণিঝড়ের ইতিহাসে ষষ্ঠ স্থান দখল করে আছে বাকেরগঞ্জ ঘূর্ণিঝড়। ১৮৭৬ সালের ৩১ অক্টোবর বাকেরগঞ্জের উপকূলের উপর দিয়ে বয়ে যায় এই প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়। এটি ‘দ্য গ্রেট বাকেরগঞ্জ ১৮৭৬’ নামেও পরিচিত। এ সময় মেঘনার মোহনা এবং চট্টগ্রাম, বরিশাল ও নোয়াখালী উপকূলে তীব্র ঝড়ো জলোচ্ছ্বাস ও প্লাবন সংঘটিত হয়। ঘূর্ণিঝড়ে বাকেরগঞ্জের নিম্নাঞ্চল সম্পূর্ণভাবে প্লাবিত হয়ে যায়। ঝড়ে আক্রান্ত ছাড়াও ঝড় পরবর্তী বিভিন্ন অসুখ ও অনাহরে মানুষ মৃত্যুবরণ করে। আনুমানিক ২ লক্ষ মানুষের প্রাণহানী ঘটে এই ঘূর্ণিঝড়ে। এরও বেশি মানুষ মারা যায় দুর্যোগ পরবর্তী মহামারী এবং দুর্ভিক্ষে।

ভোলার ঘূর্ণিঝড়
১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) দক্ষিণাঞ্চলে আঘাত হানে এ ঘূর্ণিঝড়। এ পর্যন্ত রেকর্ডকৃত ঘূর্ণিঝড়সমূহের মধ্যে এটি সবচেয়ে ভয়াবহ এবং সর্বকালের সবচেয়ে ভয়ংকরতম প্রাকৃতিক দুর্যোগের একটি। এ ঝড়ের কারণে প্রায় ৫ লাখ ব্যক্তি প্রাণ হারায়। যার অধিকাংশই গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের সমুদ্র সমতলের ভূমিতে জলোচ্ছ্বাসে ডুবে মারা যান। এটি সিম্পসন স্কেলে ‘ক্যাটাগরি ৩’ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় ছিল।

ঘূর্ণিঝড়টি ৮ নভেম্বর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয় এবং ক্রমশ শক্তিশালী হতে হতে এটি উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১১ নভেম্বর এর গতিবেগ সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ১৮৫ কিলোমিটারে (১১৫ মাইল) পৌঁছায় এবং সে রাতেই উপকূলে আঘাত হানে। জলোচ্ছ্বাসের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপসমূহ প্লাবিত হয়। এতে ওইসব এলাকার বাড়ি-ঘর, গ্রাম ও শস্য স্রোতে তলিয়ে যায়। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ছিল তজুমদ্দিন উপজেলা। সেখানে ১ লক্ষ ৬৭ হাজার অধিবাসীর মধ্যে ৭৭ হাজার জনই প্রাণ হারায়।

ঘূর্ণিঝড় সিডর

আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে ২০০৭ সালের ৯ নভেম্বর একটি দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়। ১১ নভেম্বর আবহাওয়ায় সামান্য দুর্যোগের আভাস পাওয়া যায়। এর পরের দিনই এটি ঘূর্ণিঝড় সিডরে পরিণত হয়। বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ জলরাশিতে এটি দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করে এবং বাংলাদেশে একটি দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সৃষ্টি করে। ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রীয় অংশ ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টার পর বাংলাদেশের পাথরঘাটায় বালেশ্বর নদীর কাছে উপকূল অতিক্রম করে। ঝড়ের তাণ্ডবে উপকূলীয় জেলাসমূহে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ঝড়ো হাওয়াসহ বিপুল পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়। এক রিপোর্টে বলা হয়- ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশের প্রায় ৬ লক্ষ টন ধান নষ্ট হয়। সুন্দরবনের পশুর নদীতে বেশকিছু হরিণের মৃতদেহ ভাসতে দেখা যায় এবং বিপুলসংখ্যক মানুষ এবং বিভিন্ন প্রাণীর মৃত্যু হয়। ঝড়ের প্রভাবে প্রায় ৯ লক্ষ ৬৮ হাজার ঘর-বাড়ি ধ্বংস এবং ২১ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়। এ ঝড়ে প্রায় ২ লক্ষ ৪২ হাজার গৃহপালিত পশু এবং হাঁস-মুরগী মারা যায়।

ঘূর্ণিঝড় আইলা 

২০০৯ সালে উত্তর ভারত মহাসাগরে জন্ম নেওয়া দ্বিতীয় ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে আইলা। ঘূর্ণিঝড়টি জন্ম নেয় ২১ মে ভারতের কলকাতা থেকে ৯৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে। ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানে ২৫ মে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ ও ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাংশে। এর ব্যাস ছিলো প্রায় ৩০০ কিলোমিটার, যা ঘূর্ণিঝড় সিডরের থেকে ৫০ কিলোমিটার বেশি। সিডরের মতোই আইলা প্রায় ১০ ঘণ্টা সময় নিয়ে উপকূল অতিক্রম করে, তবে পরে বাতাসের বেগ ৮০-১০০ কিলোমিটার হয়ে যাওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি, সিডর থেকে তুলনামূলক কম হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় মহাসেন 

২০১৩ সালের মে মাসের শুরুর দিকে বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণাংশে নিম্নচাপজনিত কারণে উৎপত্তি ঘটে মহাসেনের। কার্যত স্থির থাকলেও ১০ মে তারিখে ঘণিভূত অবস্থায় চলে যায়। পরবর্তীতে এটি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় হিসেবে মৌসুমের প্রথম নামাঙ্কিত ঘূর্ণিঝড় মহাসেনে রূপান্তরিত হয়। ১৪ মে এটি উত্তর-পূর্বাংশের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এতেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। কার্যত জনজীবন অচল হয়ে পড়ে।

ঘূর্ণিঝড় মোরা
          
সর্বশেষ ঘুর্ণিঝড় হলো ‘মোরা’।  ঘূর্ণিঝড় মোরা’র আঘাতে ইতিমধ্যে কক্সবাজার উপকূলের শতাধিক বাড়ি-ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। বেশকিছু গাছপালা উপড়ে পড়েছে।  এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ছয় জন নিহতের খবর  পাওয়া গেছে। ঘূর্ণিঝড় মোরা’র প্রভাবে উত্তাল রয়েছে সাগর। ঘূর্ণিঝড়টি সোমবার থেকে শুরু হয়ে মঙ্গলবার সকাল ৭টা থেকে ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে মহেশখালী-কুতুবদিয়ার উপকূল ছুয়ে চট্টগ্রাম, হাতিয়া ও সন্দীপের দিকে অগ্রসর হয়।