ফ্রান্সের নোত্র দাম গির্জাটি পৃথিবী বিখ্যাত এক ঐতিহাসিক নিদর্শন। এটা ফ্রান্সের সবচেয়ে উঁচু ভবনের কৃতিত্ব ধরে রেখেছিল। গির্জাটি ঐতিহাসিক দিক বিবেচনায় সবার কাছেই কমবেশি পরিচিত। কিন্তু এখন এই ঐতিহাসিক গির্জাটি আলোচনায় এসেছে অগ্নিকাণ্ডের জন্য। আসুন জেনে নিই পৃথিবীবিখ্যাত এই রোমান ক্যাথলিক গির্জাটি সম্পর্কে জানাচ্ছেন অনিন্দ্য আফেরোজ।
প্যারিসবাসীর কাছে সোমবার বিকেলটা ছিল বিষাদমোথিক এবং বিষণ্ণ এক বিকেল। এই বিকেলেই পুড়ে ছাই হয়ে যায় প্যারিসের ‘দ্য ফরেস্ট’খ্যাত —নোত্র দাম নামে ঐতিহাসিক গির্জাটি।
নোত্র্ দাম দ্য পারি ( Notre Dame de Paris) সংক্ষেপে নোত্র দাম, অর্থাৎ কুমারী মেরি গির্জা। এই ঐতিহাসিক গির্জাটি ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অবস্থিত। এটি একটি ক্যাথেড্রাল (খ্রিস্ট্রান ধর্মপালের আসনবিশিষ্ট গির্জা)। রোমান ক্যাথলিক এই গির্জাটি বর্তমানে প্যারিসের আর্চবিশরপন অধীনে আছে। নোত্র দাম, প্যারিস শহরের চতুর্থ আরোঁদিসমঁ বা প্রশাসনিক পৌরবিভাগের অভ্যন্তরে পড়েছে। ভৌগোলিকভাবে এটি প্যারিসের কেন্দ্রস্থলে সেন নদীতে অবস্থিত ইল ত্য লা সিতে নামে একটি ক্ষুদ্র দ্বীপের পূর্বভাগে অবস্থিত। ঐতিহ্যবাহী গির্জাটির পশ্চিমমুখী অংশের সামনে রয়েছে উন্মুক্ত জঁ-পল চত্বর। মধ্যযুগে থেকেই এই গির্জায় ক্যাথিড্রালে সঙ্গীতবাদনের বড় ঐতিহ্য রয়েছে।
নির্মাণের ইতিহাস ও শৈলী
বিশপ মোরিস দ্য সুলির উদ্যোগে ১১৭৩ খ্রিস্টাব্দে গির্জাটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। প্রায় ২০০ বছর ধরে চলে এই ঐতিহাসিক গির্জার নির্মাণ কাজ। এর নির্মাণকাজ শেষ হয় চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি ১৩৪৫ খ্রিস্টাব্দে। এজন্য গির্জাটির ভবনের নির্মাণশৈলী সবজায়গায় অভিন্ন রূপের নয়। তবে গির্জাটি মূলত গোথিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত। ১৮৪৪ থেকে ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্থপতি ভিওলে-ল্য-দুকের অধীনে ক্যাথেড্রালটিকে পুনরুদ্ধার ও সংস্কার হয়। ২০১৩ সালে গির্জাটির ৮৫০তম জন্মদিন পালন করা হয়।
প্রায় ৫২ একর জমির ওপর নির্মাণ করা হয় এই ঐতিহাসিক গির্জা। ওক বন কেটে নির্মাণ করা হয় গির্জা। গির্জার ভেতরের সাজসজ্জার মূল কাঠামো নির্মাণ করতে ব্যবহার হয় অন্তত এক হাজার ৩০০ কাঠের গুঁড়ি। গুঁড়িগুলো সূক্ষ্ম কারুকাজে খোদাইকৃত। বিপুল পরিমাণ কাঠের ব্যবহার হওয়ায় প্যারিসবাসীর কাছে এই গির্জা ‘দ্য ফরেস্ট’ নামে পরিচিত। ঐতিহাসিকরা বলছেন, সুউচ্চ ওই কাঠামো তৈরিতে যে গাছ ব্যবহার করা হয়েছিল সেগুলোর বয়স ছিল ৩০০ থেকে ৪০০ বছর। অর্থাৎ ৮০০ থেকে ৯০০ শতকে জন্মানো এসব গাছ।
প্রায় দশ মিটার উঁচু এই গির্জার দৈর্ঘ্য ১০০ মিটার । আর এর মাঝের অংশের প্রস্থ প্রায় ১৩ মিটার। গথিক রীতিতে নির্মিত এ ধরনের গির্জার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, লম্বাটে গড়নের এবং এর মাঝ বরাবর একটি অংশ দুদিকে বাহুর মতো বের হয়ে থাকে। ওপর দিক থেকে দেখলে এই গির্জাকে মনে হয় একটি ক্রুশ।
গির্জাটির নিজস্ব ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, মধ্যযুগে নির্মিত এই গির্জার বিভিন্ন অংশ আলাদা আলাদা ভাবে তৈরি করে তারপরে জোড়া লাগানো হয়েছে।যেমন প্রথমে ভিত ও দেয়াল পরে ছাদ আলাদা করে তৈরি করে তারপর জোড়া লাগানো হয়। গির্জাটির ছাদের নকশা যে কাউকে তাক লাগাবে। গথিক রীতিতে নির্মাণ করা এই ছাদ কাঠ দিয়ে কোনাকুনি বেশ খানিকটা উঁচু । আর উঁচু কাঠগুলো আকাশের দিকে ৫৫ ডিগ্রি কোণে হেলানো। ছাদটির ওজন প্রায় ২১০ মে. টন। ওক গাছের গুঁড়ি ব্যবহার করা হয়। গির্জায় ৬৯ মিটার লম্বা দুটি মিনার বা ‘বেল টাওয়ার’ রয়েছে। প্যারিসের সবচেয়ে উঁচু ‘আইফেল টাওয়ার’ নির্মাণের আগ পর্যন্ত ( ১৮৮৯ সাল) এই গির্জাটি ছিল প্যারিসের সবচেয়ে উঁচু স্থাপনা।
লম্বা, চওড়া, সুউচ্চ নোত্র দাম গির্জা স্থাপত্যের দিক থেকে পৃথিবীর বিস্ময়। চার তলা বিশাল বাড়ির তিন তলায় কারুকাজ খচিত গোল ছাদ। যা ভেতর থেকে দেখা যায়।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব
দীর্ঘকাল প্যারিসের সবচেয়ে উঁচু ভবন হিসেবে নোত্র্-দামের কৃতিত্ব ধরে রেখেছিল। ১৮৩১ সালে এটি প্যারিসের সবচেয়ে উঁচু ভবন ছিল ভিক্টর হুগোর উপন্যাস নোত্র্ দাম দ্য পারি-তে ভবনটিকে কেন্দ্রীয় ভূমিকা দেওয়া হয়েছে। অভিষেককালে ফ্রান্সের রাজা ও সম্রাটদের এই গির্জাতেই শপথ পড়ানো হত। আধুনিক ফ্রান্সের অনেক রাষ্ট্রপতির মৃত্যুর পর এই গির্জাতেই তাঁদের অন্ত্যোষ্টি হয়েছিল। এরমধ্যে আছেন শার্ল দ্য গল, ফ্রাঁন্সোয়া মিতেরঁ, জর্জ পোঁপিদ।
পর্যটন
গগনস্পর্শী উচ্চতা ও নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর নোত্র্-দাম গির্জাটি পর্যটকদের কাছে বিশেষভাবে আকর্ষণীয় স্থান। প্যারিস নগর, ফ্রান্স, এমনকি সমস্ত ইউরোপের পর্যটকদের কাছে সর্বাধিক জনপ্রিয় ক্যাথেড্রাল এটি। প্রতি বছর দুই কোটি লোক এটি দেখতে আসেন। প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ পর্যটক গির্জার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। এ গির্জায় প্রবেশের জন্য পর্যটকদের কোন ফি দিতে হয় না।
অগ্নিকাণ্ড
২০১৯ সালের ১৫ এপ্রিল সোমবার সন্ধ্যায় নোত্র দাম গির্জায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ওই সময় প্রায় ৬০ লাখ ইউরো ব্যয়ে এই গির্জার ছাদ রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলছিল। এই রক্ষণাবেক্ষণ কাজের সূত্র ধরেই অগ্নিকাণ্ড হতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে। অগ্নিকাণ্ডের ফলে গির্জার ওক গাছের কাঠে নির্মিত মোচাকৃতির চূড়া ও ছাদ সম্পূর্ণ পুড়ে ধসে পড়েছে। তবে ভবনের পাথরে নির্মিত সম্মুখভাগ ও মূল কাঠামোটি মোটামুটি অক্ষত আছে। ভবনের ভেতরে বহু মূল্যবান শিল্পকর্ম ছিল যেগুলির বেশিরভাগই অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। ধ্বংসপ্রাপ্ত গির্জাকে পুনর্নিমাণের জন্য বিত্তবান ফরাসি ব্যক্তি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো কয়েক কোটি ইউরো অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ।
তথ্য সূত্রঃউইকিপিডিয়া, নোত্র্-দামের নিজস্ব ওয়েবসাইট