হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) ছিলেন মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও আত্মত্যাগী সাহাবী। জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সর্বদা পাশে ছিলেন এবং ইসলামের প্রতি ধারাবাহিক মূল্যবান সেবা প্রদান করেছেন।প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে ও যুদ্ধ-বিগ্রহে অতি প্রয়োজনীয় ও কার্যকর ভূমিকা পালন করায় মহানবী (সা.) তাঁকে খুব বেশি ভালোবাসতেন।
আলী (আ.) ছিলেন মহানবীর চাচা হযরত আবু তালিবের সন্তান। আবু তালিব ছিলেন আরবের সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে প্রসিদ্ধ গোত্র কুরাইশের একজন স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। হযরত আলীর মা ও একজন কুরাইশ ছিলেন। তাঁর নাম ছিল ফাতেমা। আরবে তিনি একজন মহীয়সী ও সম্মানিতা নারী হিসেবে সমাদৃত ছিলেন। তিনি ছিলেন আসাদ ইবনে মানাফের কন্যা। একই বংশ হোয়ার কারণে হযরত আলীকে প্রথম শিশু হিসেবে ধরা হয় যিনি কুরাইশ পিতা ও কুরাইশ মাতার মাধ্যমে জন্মগ্রহণ করেন।
হযরত আলী (রাঃ) র জন্ম ও নামকরণ:
হযরত আলী (আ.) অলৌকিকভাবে পবিত্র কাবাঘরে জন্মগ্রহণ করেন। পৃথিবীর ইতিহাসে আল্লাহর ঘর কাবায় জন্মগ্রহণ করার সম্মান হযরত আলী ছাড়া আর কারো হয় নি। জন্মগ্রহণের পর তিনি তিন দিন কাবাঘরে ছিলেন। তিন দিন পর সেই পবিত্র স্থান থেকে তিনি মায়ের কোলে বের হন।
প্রথমে তাঁর নামকরণ করা হয়েছিলো ‘আসাদ’ এবং ‘জায়েদ’। তবে মহানবী (সাঃ) মক্কায় ফিরে আসার পর তাঁর নাম রাখেন আলী (রাঃ) । তবে বিভিন্ন সময়ে তাঁকে ভিন্ন নামে ডাকা হতো।
তেমনই এক মজার নাম হল আবু তুরাব যার অর্থ হল “ধুলোবালির আব্বা”। একদিন নবীজী মসজিদে প্রবেশের পূর্বে দেখেন হযরত আলী এমন এক জায়গায় শুয়ে আছেন যা ধুলোবালিতে পূর্ণ। তখন তিনি রসিকতা করে ডাক দেন,
“হে আবু তুরাব (ধুলোবালির পিতা), উঠো”।
তাছাড়া বড় ছেলে হাসানের নামে তাঁকে ডাকা হত ‘আবু-আল-হাসান।‘ এসব ব্যতীত মহানবী (সাঃ) তাঁকে ‘আসাদ আল্লাহ্’ উপাধি দান করেন যার অর্থ হল আল্লাহ্র সিংহ।
হযরত আলী (রাঃ) এর বিবাহ এবং পরিবারঃ
মহানবীর জামাতা ও চাচাতো ভাই আলী (আ.) ছিলেন বীরত্ব, মহানুভবতা ও ন্যায়বিচারের প্রতীক। বেহেশতী নারীদের নেত্রী ফাতিমা (সালামুল্লাহি আলাইহা)-কে বিয়ে করার জন্য আবুবকর ও ওমরসহ অনেক সাহাবিই প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে মহানবী (সা.) আল্লাহর নির্দেশে আলী (আ.)-কেই ফাতিমার সঙ্গে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করেন।
হিজরতের সময়কালে নবী (সাঃ) একদিন আলী (রাঃ) কে ডেকে বলেন আল্লাহ্র নির্দে্শ যেন হযরত ফাতিমা (রাঃ) এর সাথে হযরত আলী (রাঃ) এর বিবাহ কার্য সম্পাদন করেন। এরপর হযরত খাদিজা (রাঃ) এবং মহানবী (সাঃ) এর সবচেয়ে প্রিয় আদরের কন্যা হযরত ফাতেমা (রাঃ) কে বিবাহ করেন হযরত আলী (রাঃ)। বিয়ের সময় হযরত ফাতেমা (রা.) এর বয়স ছিল ১৪ বছর এবং হযরত আলী (রা.) এর বয়স ছিল ২২ বছর। পরবর্তীতে তাঁদের কোলজুড়ে জন্ম নেয় হযরত ইমাম হাসান (রাঃ) এবং ইমাম হোসেইন (রাঃ)। হযরত ফাতেমা (রাঃ) এর মৃত্যুর পর আলী (রাঃ) দ্বিতীয় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হোন এবং ওই সংসারে জন্ম নেয় মোহাম্মদ ইবনে-আল-খলিফাসহ আরো কয়েকজন।
প্রাথমিক জীবন:
হযরত আলী (রা.) এর বয়স ছিল তখন প্রায় ২২ বছর । আল্লাহ্ তা’আলার নির্দেশে হযরত মুহাম্মদ (সা.) ইয়াছরিবে হিজরত করার শেষ রাতে শত্রুদের চোখের সামনে দিয়ে নিরাপদে গৃহ ত্যাগ করলেন। যাওয়ার সময় হযরত আলী (রা.) কে আমানতের গচ্ছিত সম্পদ প্রদানের দায়িত্ব দিয়ে গেলেন। প্রত্যুষে শত্রুপক্ষ দেখল, রাসুলুল্লাহ (সা.) এর বিছানায় ছেড়ে হযরত আলী (রা.) নিশ্চিন্ত মনে শুয়ে আছেন।
তিনি বদর, উহুদ ও খন্দক(পরিখা)-এর যুদ্ধে যোগদান এবং তাবূক ছাড়া অন্য সমস্ত অভিযানে নবীজী (সা.)-এর সঙ্গে গমন করেন। তাবূক অভিযানের সময় নবীজী (সা.) এর অনুপস্থিতিতে তাঁর পরিবার-বর্গের তত্ত্বাবধান এবং মদিনার শাসনভার তাঁর উপর ন্যস্ত ছিল। উহুদের যুদ্ধে তিনি ষোলটি আঘাতপ্রাপ্ত হন; তাঁহার প্রচণ্ড আক্রমণে খায়বারের দুর্জয় কা’মূস দূর্গের পতন ঘটে ।
নবীজী (সা.) এর উপর নবম সূরা (আল বারা’আঃ বা আত-তাওবা) অবতীর্ন হওয়ার অল্প পরে তার প্রথম তেরটি আয়াত হাজ্জের সময় মিনা প্রান্তরে সর্বসমক্ষে ঘোষণা করার জন্য নবীজী (সা.) আলী (রাঃ) কে প্রেরণ করেন । দশম হিজরি, মুতাবিক ৬৩১-৩২ সনে আলী (রা.) ইয়ামানে এ প্রচার সফরে গমন করেন । এরই ফলে হামাদানীরা ইসলাম গ্রহণ করেন।
হযরত আলীর মদিনায় হিজরত:
সময়কাল ৬২২ খ্রিষ্টাব্দ। মোহাম্মদ (সাঃ) জানতে পারেন তাঁকে মেরে ফেলার জন্যে শত্রুরা পরিকল্পনা কষছে। তাই তিনি আলী (রাঃ) কে নির্দেশ দেন তাঁর শয়নকক্ষে অবস্থান করতে এবং বিভিন্ন মানুষ হতে পাওয়া আমানতসমূহের রক্ষণাবেক্ষণ করতে। এ বলে তিনি হযরত আবু বকর (রাঃ) কে সঙ্গে নিয়ে নীরবে মদিনার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। এ
পরিকল্পনা মতে যখন তাঁরা মহানবীকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁর শয়নকক্ষে প্রবেশ করে তখন তাঁর বদলে আলী (রাঃ)কে দেখে তারা যারপরনাই অবাক হয়ে যায়। সাক্ষাৎ মৃত্যুকে সামনে দেখেও আলী (রাঃ) এর দৃঢ়তা এবং সৎসাহস দেখে কোন ক্ষতি না করে চলে যায়। পরে নির্দেশ পাওয়ার পর আলী (রাঃ) মোহাম্মদ (সাঃ) এর পরিবারকে নিয়ে মদিনার উদ্দেশ্যে রওনা দেন যা বর্তমানে নবীজীর শহর নামে পরিচিত। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, হযরত আলী (রাঃ) প্রথম মুসলিম যিনি মদিনায় হিজরত করেন।
ইসলামের অগ্রযাত্রায় হযরত আলীর অবদান:
যখন ইসলাম ধর্ম ভীষণ চাপের মধ্যে ছিল এবং কাফের-মুশরিকরা মহানবী (সা.)-এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল সেই সময় হযরত আলী (আ.)-এর পিতা হযরত আবু তালিব আল্লাহর নবী (সা.)-কে সমর্থন করেন ও তাঁর সুরক্ষা দেন। তিনি নবুওয়াতের মিশনের ১০ম বর্ষে ইন্তেকাল করেন। সেই বছরেই কিছুদিন পর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সম্মানিতা স্ত্রী হযরত খাদিজাও ইন্তেকাল করেন। এজন্য মহানবী (সা.) সেই বছরের নামকরণ করেন ‘আমুল হুয্ন’ (শোকের বছর)। মহানবী (সা.) হযরত আলী (আ.)-কে খুব অল্প বয়সেই নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন। আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর বাড়িতেই বড় হয়ে ওঠেন। মহানবী (সা.)-এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ও নির্দেশনায় তিনি বয়োপ্রাপ্ত এবং উন্নত হন।
যখন ওহীর ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) মক্কার নগরীর হেরা গুহায় আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর কাছে অবতীর্ণ হন এবং এই মহান ব্যক্তিও তাঁর নবুওয়াতি দায়িত্ব পালনের নির্দেশপ্রাপ্ত হন তখন আলী (আ.)-এর বয়স ছিল দশ বছর। এই ঘটনা শোনার পর হযরত আলীই ছিলেন সেই আহ্বানে সাড়াদানকারী এবং ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম পুরুষ।
মহানবী (সা.) নবুওয়াতি দায়িত্ব পালনের নির্দেশ পাওয়ার পর তিন বছর পর্যন্ত তাঁর কর্মকান্ড- প্রকাশ্যভাবে শুরু করেন নি। নবুওয়াত ঘোষণার তৃতীয় বর্ষে তিনি প্রকাশ্যে জনসমক্ষে ইসলামের আহ্বান জানানোর জন্য মহান আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশপ্রাপ্ত হন। প্রথম যেসকল লোককে মহানবী (সা.) আল্লাহর ধর্ম গ্রহণের আহ্বান জানান তারা হলো তাঁরই নিকটাত্মীয়। তিনি তাদের জন্য ভোজের ব্যবস্থা করেন। ভূরিভোজনের সময় তিনি তাদেরকে সম্বোধন করে বলেন : ‘হে আবদুল মুত্তালিবের সন্তানরা! আল্লাহ আমাকে সমগ্র মানবের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য, বিশেষ করে আপনাদের- আমার বংশধরদের জন্য মনোনীত করেছেন। তিনি আমাকে সর্বপ্রথমে আমার পরিবারকে সতর্ক করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন এবং আমার আত্মীয়-স্বজনকে বলতে বলেছেন যেন তারা আল্লাহর অবাধ্য না হয়।’
সেই ভোজসভায় মহানবী (সা.) এই কথা তিনবার পুনরাবৃত্তি করেন। কিন্তু আলী ছাড়া আর কেউ তাঁর আহ্বানে সাড়া দেয় নি। আলী (আ.) সেই সময় তের বছর বয়সের একজন কিশোর ছিলেন মাত্র। মহানবী (সা.) বলেন : ‘হে আলী! তুমি আমার ভাই ও উত্তরসূরি। তুমি আমার উত্তরাধিকারী ও উযির।’
হযরত আলী (রাঃ), রাসুল (সাঃ) এর জীবিত দশায় সংঘটিত সব যুদ্ধে সশরীরের অংশগ্রহণ করেন। উল্লেখযোগ্য যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তুলে ধরা হল।
বদরের যুদ্ধ:
ইসলামের ইতিহাসে প্রথম প্রধান যুদ্ধ হল বদরের যুদ্ধ। ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত হওয়া যুদ্ধটি মদিনার মুসলিম এবং মক্কার কুরাইশদের মধ্যে সংঘটিত হয়। শত্রুপক্ষের ৯৫০ জন সৈন্য, ১০০ টি ঘোড়া এবং ১৭০ টি উটের বিপক্ষে বুক পেতে সাহসিকতার সহিত দাঁড়িয়ে ছিল মুসলমান পক্ষের ৩১৩ জন সৈন্য, ২ টি ঘোড়া এবং ৭০ টি উট। এতে শত্রু পক্ষের ৭০ জন নিহত এবং ৭০ জন বন্দী হয় এবং মুসলমানদের পক্ষের ১৪ জন শহীদ হন।
উহুদের যুদ্ধ:
৬২৬ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত হওয়া এই যুদ্ধে শত্রুপক্ষের ৩০০০ সৈন্য, ৩০০০ উট এবং ২০০ টি ঘোড়ার বিরুদ্ধে মুসলিমদের ছিল ৭০০ সৈন্য, ৫০ জন তীরন্দাজ এবং ৪ টি ঘোড়া। তবে এই যুদ্ধটির ফলাফল অমীমাংসিত রয়ে যায়।
খন্দকের যুদ্ধ এবং জুলফিকার তরবারি প্রাপ্তি:
হযরত আলী (রাঃ) এর জীবনে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ছিল জুলফিকার তরবারি। সময়কাল ৬২৭ খ্রিষ্টাব্দ, খন্দকের যুদ্ধের সময়ের। যুদ্ধের ময়দানে ৩০০০ মুসলিম সৈন্য দাঁড়িয়ে আছে ১০ হাজার বিশাল সৈন্যের বিপক্ষে যার নেতৃত্বে ছিলেন আবু সুফিয়ান। এতো বিশাল শত্রুপক্ষের বিপক্ষে মাত্র ৩ হাজার সৈন্যের মনোবল ভেঙ্গে যাওয়াটা স্বাভাবিক। এসময় মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) করজোড়ে মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলে ওইসময়ে হযরত জিবরাঈল (আঃ) এর মাধ্যমে ‘জুলফিকার’ নামক তরবারিটি পাঠান এবং রাসুল (সাঃ) সেটি হযরত আলী (রাঃ) কে প্রদান করেন। বলা চলে ওই যুদ্ধ শেষে মুসলিম সৈন্যদের আহত হওয়ার সংখ্যা কম হলেও আবু সুফিয়ানের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়।
বেশ কিছু ইতিহাসবিদের মতে, জুলফিকার তরবারি হযরত আলী (রাঃ) এর ইন্তেকালের পর বড় পুত্র হাসান (রাঃ) এর কাছে দেয়া হয়। পরে হাসান (রাঃ) শহীদ হওয়ার পর পালাক্রমে আসে হোসাইন (রাঃ) এর কাছে এবং তা দিয়ে কারবালায় ইয়েজিদ সৈন্যের বিপক্ষে যুদ্ধ করেন।
আমাদের নবীজী (সাঃ) তখনকার যুগের নয়টি তরবারি রেখে যান যার মধ্যে আটটি তুর্কির তোপকাপি যাদুঘরে এবং অন্যটি মিশরের কায়রোতে সংরক্ষিত আছে। তবে জুলফিকার তরবারিটি আর খুঁজে পাওয়া যায় নি। এ সম্পর্কে মহান রাব্বুল আলামীনই ভালো জানেন।
খায়বারের যুদ্ধ:
৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে মদিনা হতে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে খায়বার মরুভূমিতে মুসলিম সেনারা মুখোমুখি হয় ইহুদিদের। এখানেও মাত্র ১৬০০ মুসলিম সৈন্য দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো প্রায় ১০ হাজার শত্রু সৈন্যের বিপক্ষে। এ যুদ্ধে মুসলিমরা বিজয়ী হয়।
উটের যুদ্ধ:
হযরত উসমান (রাঃ) র হত্যাকাণ্ডের পর শাসনভারের দায়িত্ব আসে হযরত আলী (রাঃ) এর উপর। তবে হযরত তালহা, জুবায়ের এমনকি মহানবীর পত্নী আয়েশা (রাঃ) উসমান (রাঃ) র হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবী করেন। কিন্তু ঘটে যাওয়া গৃহযুদ্ধের ফলে তৎক্ষণাৎ কিছু করা সম্ভব হচ্ছিলো না। পরক্ষণে শত্রুপক্ষের কূটনৈতিক চালে হযরত উসমান (রাঃ) এর হত্যাকারীদের হাতে নিহত হয় হযরত জুবাইর এবং তালহা। এতে করে অবস্থা আরো সঙ্গিন হয়ে দাঁড়ায় এবং হযরত আয়েশা (রাঃ) নিজেই তাঁর জামাতার বিপক্ষে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। যদিও আলী (রাঃ) যুদ্ধে জয়ী হোন এবং আয়েশা (রাঃ) কে সসম্মানে মদিনায় পৌঁছে দেন।
সিফফিনের যুদ্ধ:
ক্ষমতা গ্রহণের পর ৬৫৭ খ্রিষ্টাব্দে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয় হযরত আলী এবং সিরিয়ার গভর্নর আবু সুফিয়ানের মধ্যে। এই যুদ্ধে হযরত আলী (রাঃ) হারান তাঁর একনিষ্ঠ সমর্থক আম্মার ইবনে ইয়াসিরকে যার মৃত্যু সম্পর্কে বহু আগেই মোহাম্মদ (সাঃ) ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছিলেন,
“আম্মার সত্যের সাথে, সত্য আম্মারে সাথে। চোখ নাকের যতটা কাছে, আম্মার ঠিক আমার ততোটা কাছের কিন্তু হায় হায়!! একটা বিদ্রোহী দল তাঁকে হত্যা করবে”।
সিফফিনের যুদ্ধের বর্ণনা দিয়ে একটা আলাদা প্রবন্ধ লেখা সম্ভব। যদিও যুদ্ধের ফলাফল অমীমাংসিত ছিল তবে ইসলামের বুকে এই যুদ্ধটি অত্যন্ত গুরুত্ববহ।
কোরআন সংরক্ষণ ও সংকলন:
কোরআন যখন নাযিল হচ্ছিলো তখন এর কিছু কিছু আয়াতাংশ নাজিল হত যা নবীজি বারবার তেলোয়াত করতেন এবং সাহাবীদের শোনাতেন। সাহাবীরাও তেলোয়াত করতে করতে তা মুখস্থ করে নিতেন যা কাতিবরা লিপিবদ্ধ করে নিতেন। সেসময়ে দশজন ব্যক্তি কোরআন অন্তরে ধারণ করে রেখেছিলেন সম্পূর্ণ যার মধ্যে হযরত আলী (রাঃ) অন্যতম।
মৃত্যু
৬৬১ সালের ১৯ রমজান এক খারিজি (ইসলাম থেকে বিচ্যুত) সন্ত্রাসী কুফার মসজিদে ফজরের নামাজে ইমামতিরত অবস্থায় আলী (আ.)’র ওপর তরবারির আঘাত হানে। আর এই আঘাতের ফলেই আজ তিনি শহীদ হন। ফলে শেষ হয়ে যায় বিশ্বনবীর (সা.) পর ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে ন্যায়বিচারপূর্ণ শাসন।
উল্লেখ্য, বহু বছর আগে এক শাবান মাসের শেষ শুক্রবারে রমজানের ফজিলত সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিশ্বনবী (সা.) ভাষণের শেষ পর্যায়ে কাঁদতে থাকেন। তা দেখে হযরত আলী (আ.) এর কারণ জানতে চান। জবাবে মহানবী বহু বছর পর রমজান মাসে আলী (আ.)’র মর্মান্তিক শাহাদতের ভবিষ্যদ্বাণীর কথা উল্লেখ করলেন। তিনি বললেন,”হে আলী, এই মাসে তোমার ওপর যা নেমে আসবে সে জন্য আমি কাঁদছি। (আমি নিজেকে কল্পনা করছি) তোমার স্থানে যখন তুমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছ এবং সামুদ জাতির কাছে পাঠানো (খোদায়ী) উটের পা কর্তনকারী লোকটির মতই মানব ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তিটি তোমার মাথার ওপর আঘাত হানবে এবং তোমার দাড়ি তাতে (রক্তে) রঞ্জিত হবে।”
হযরত আলী (রাঃ) র কবর:
হযরত আলী (রাঃ) কে কুফার নিকট নাযাফ নামক স্থানে দাফন করা হয়। প্রায় শত বছর পর্যন্ত হযরত আলীর কবরস্থান গোপনে রাখা হয়। ইমাম সাদিক (রাঃ) এর আমলে খারেজীদের (হযরত আলী রাঃ এর বিরোধী) নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পর সাহাবী সাফওয়ান (রহঃ) কে নির্দেশ দেন হযরত আলীর কবরস্থানের উপর গাছ লাগিয়ে চিহ্নিত করতে। গোপন রাখার কারণ হিসেবে জানা যায়, কবরস্থান চিহ্নিত করতে পারলে হযরত আলীর বিরোধীরা তাঁর প্রতি অবমাননাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করার আশংকা ছিল।
আলী সম্পর্কে মহানবীর কথা
আলী (আ.) তাঁর মূল্যবান জীবনকালে মহান আল্লাহর ধর্মের প্রসারে প্রাণপণ চেষ্টা করেন। ইতিহাসে আলী (আ.)-এর প্রচুর সংখ্যক মূল্যবান সেবার কথা উল্লিখিত হয়েছে। আমরা এখানে সেগুলোর মধ্য হতে অল্প কয়েকটি এখানে উল্লেখ করব :
বিশ্বনবী (সা.)’র একটি হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী আলী(আ.)-কে পুরোপুরি বা পরিপূর্ণভাবে চেনেন কেবল আল্লাহ ও তাঁর সর্বশেষ রাসূল (সা.) এবং আল্লাহ ও তাঁর সর্বশেষ রাসূল (সা.)-কে ভালভাবে চেনেন কেবল আলী (আ.)।
হযরত আলী (আঃ) ছিলেন সেই ব্যক্তিত্ব যার সম্পর্কে রাসূলে পাক (সাঃ) বলেছেন, মুসার সাথে হারুনের যে সম্পর্ক তোমার সাথে আমার সেই সম্পর্ক, শুধু পার্থক্য হল হারুন (আঃ) নবী ছিলেন, তুমি নবী নও।
আলী (আ.) এমন এক নাম যাঁর নাম উচ্চারণ ও যাঁর বরকতময় জীবনের আলোচনা মানুষের ঈমানকে তাজা করে দেয়। রাসূল (সা.) বলতেন, আলীর দিকে তাকানোও ইবাদত।
বিশ্বনবী (সা) বলেছেন, আমি জ্ঞানের নগর আর আলী তার দরজা। অর্থাৎ বিশ্বনবী (সা)’র জ্ঞানের শহরে প্রবেশ করা সম্ভব নয় আলী (আ)’র মাধ্যম ছাড়া। আলী (আ) নিজেও বলতেন, কুরআনের এমন কোনো আয়াত নেই যে বিষয়ে আমি রাসূল (সা)’র সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করিনি। বলা হয় বিশ্বনবী (সা) আলী (আ)-কে এক হাজার বিষয় বা অধ্যায়ের জ্ঞান শিখিয়েছিলেন। আর এসবের প্রত্যেকটির ছিল এক হাজার শাখা। আলী (আ) নিজেও বলতেন, আমাকে হারানোর আগেই যা কিছু জানার জেনে নাও, আমাকে যে কোনো বিষয়ের প্রশ্ন কর না কেন আমি তার জবাব দেব।
আলী সম্পর্কে মনীষীদের মতামত
হযরত আলী (আ.)’র আকাশ-ছোঁয়া বীরত্ব ও মহত্ত্ব কেবল মুসলিম কবি, সাহিত্যিক বা মনীষীদেরই প্রভাবিত করেনি, অমুসলিম পণ্ডিতরাও তার সুবিশাল ব্যক্তিত্বের ব্যাপকতায় অভিভূত ও হতবাক হয়েছেন। তাঁর মহত্ত্ব ও উদারতার প্রশংসা করে আর ডি ওসবোর্ন বলেছেন, আলী (আ.) ছিলেন মুসলমানদের ইতিহাসের সর্বোত্তম আত্মার অধিকারী সর্বোত্তম ব্যক্তি।
ওয়াশিংটন আরভিং বলেছেন, “সব ধরনের নীচতা ও কৃত্রিমতা বা মিথ্যার বিরুদ্ধে আলী (আ.)’র ছিল মহত সমালোচনা এবং আত্মস্বার্থ-কেন্দ্রিক সব ধরনের কূটচাল থেকে তিনি নিজেকে দূরে রেখেছিলেন।”
ঐতিহাসিক মাসুদির মতে, রাসূল (সা.)’র চরিত্রের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি মিল যার ছিল তিনি হলেন আলী (আ.)।
আমীরুল মুমিনীন আলী সম্পর্কে মাওলানা রুমী লিখেছেন,
“সাহসিকতায় তুমি ছিলে খোদার সিংহ তা জানি
পৌরুষত্বে আর বদান্যতায় কি তুমি তা জানেন শুধুই অন্তর্যামী।”
সাফীউদ্দীন হিল্লী (মৃ. ৮ম হিজরী) আলী (আ.) সম্পর্কে বলেছেন,
তোমার স্বভাব-চরিত্রের কমনীয়তা ভোরের মৃদুমন্দ সমীরণকেও করে লজ্জিত
আর তোমার শক্তি ও সাহসের কাছে কঠিন পাথরও হয় বিগলিত
তোমার মান-মর্যাদা এতটা মহান ও উচ্চ যে, তা কাব্যে করা যায় না প্রকাশ
আর না গণনাকারী তোমার গুণাবলী গণনা করতে সক্ষম।
আলী সম্পর্কে অজানা তথ্যঃ
ইসলামের চতুর্থ খলিফা আলী ইবনে আবু তালিব, যিনি নানা গৃহযুদ্ধে জর্জরিত ছিলেন। খলিফা উসমান হত্যার সাথে সাথে একের পর এক যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। খলিফা আলী নবী মুহাম্মাদের অত্যন্ত আস্থাভাজন ছিলেন, তিনি নবী মুহাম্মাদের আপন চাচাতো ভাই, মেয়ের জামাতা ও আপন নাতনীর জামাতা ছিলেন। তিনিও সেই দশজন সৌভাগ্যশালীদের একজন নবী মুহাম্মাদ যাঁদের বেহেস্তের সুসংবাদ প্রদান করেছিলেন।
খলিফা আলী সাতটি বিয়ে করেছিলেন:
১.ফাতেমা
২.উম্মাহ্ বিনতে জয়নব
৩.উম্মুল উল-বানিন
৪.লেইলা বিনত মাসুদ
৫.আসমা বিনতে উমায়
৬.খল্লা বিট জাফর
৭.আল সাহবা বিনত রবিয়াহ
উম্মাহ বিনতে যয়নাব হল, খলিফা আলীর স্ত্রী, নবী মুহাম্মাদের প্রথম সন্তান যয়নাবের ও আবু আস ইবনে আল রাবি র প্রথম কন্যা ও ফাতিমা বিনতে মুহাম্মাদের আপন বোনের মেয়ে। ৬৬১ সালে আলীকে খুন করার পর উম্মাহ বিনতে যয়নাব ফাতিমার বড় বোনের মেয়েকে মুয়াবিয়া ১ বিয়ে করেন সে ঘরে একটি সন্তান হয় ইয়াহিয়া।
খলিফা আলীর দশ সন্তান ছিলেন এর মধ্যে একটি মিসকারেজ(মুহসিন ইবনে আলী) সন্তান সহ পাঁচটি সন্তান ফাতিমার। চারটি অন্যান্যদের ও একটি আসমা বিনতে উমায় এর পূর্ববর্তী স্বামীর।
খেলাফতের নির্বাচনের পরপরই তিনি ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী, মদীনা থেকে ইরাকের কুফায় সরিয়ে নেন, যা ছিল অধিকতর কেন্দ্রীয় একটি স্থান।
তাঁর নির্বাচনের পরপরই তিনি জনগণের বিশেষ করে নবী এর প্রভাবশালী সাহাবী যেমন তালহা এবং যুবাইর এর উত্থাপিত উসমান-এর হত্যাকারীদের যথাশীঘ্র শাস্তির জনপ্রিয় দাবীর সম্মুখিন হন।
আলী ঘোষণা করেন যে, তাঁর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার রাষ্ট্রে শান্তি- শৃংখলা পুনঃস্থাপন করা কিন্তু তালহা এবং যুবাইর , আলী এর এই সিদ্ধান্তে রাজী হননি; তারা সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করা শুরু করেন। আলী উসমান হত্যায় হত্যাকারীদের সাজা দিতে নিরুৎসাহিত ছিলেন। আয়েশা ও হযরত উসমানের হত্যাকারীদের শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্যে তালহা এবং যুবাইর এর সাথে যোগ দেন। তিনজনে মিলে বসরার উদ্দেশ্যে এক সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেন। বিখ্যাত সাহাবী তালহা ও যুবাইর নৃশংস ভাবে নিহত হন। আয়েশা কে সন্মানের সাথে বন্দি করে মদিনায় নিয়ে যাওয়া হয়। আয়েশা এবং আলীর যুদ্ধ টি উটের যুদ্ধ নামে পরিচিত কারন আয়েশা ঊটের উপর চড়ে যুদ্ধর নেতৃত্ব দেন।
তিনি তার সন্তানসহ কাছের মানুষদের অনেক ঊচ্চপদ দান করেন। তার বিষয়ে উসমান হত্যাকান্ডে খুনিদের মদদ সহ তৎকালিক মুসলমানদের অনেক অভিযোগ থাকলেও বেশির ভাগ ঐতিহাসিকদের মতে তিনি অত্যান্ত প্রভুভক্ত খলিফা ছিলেন।
তার গুণাবলি আজও মুসলিম বিশ্বের একটি বড় সম্পদ।
কবি হযরত আলী (রাঃ)
হযরত আলী (রা) ছিলেন একজন সুবক্তা ও বিখ্যাত কবি। তাঁর কবিতার একটি ‘দীওয়ান’ আমরা পেয়ে থাকি। তাতে অনেক কবিতায় মোট ১৪০০ শ্লোক আছে। গবেষকদের ধারণা, তাঁর নামে প্রচলিত অনেক কবিতা প্রক্ষিপ্ত হয়েছে। তবে তিনি যে তৎকালীন আরবি কাব্য জগতের একজন বিশিষ্ট দিকপাল ছিলেন এতে পণ্ডিতগণের কোনো সংশয় নেই। ‘নাহজুলবালাগা’ নামে তাঁর বক্তৃতার একটি সঙ্কলন আছে যা তাঁর অতুলনীয় বাগ্মিতার স্বাক্ষর বহন করে চলেছে।
হযরত আলীর (রা) কবিতার বিষয়বস্তু বিচিত্রধর্মী। বংশ অহমিকা, মূর্খের সাহচর্য, যুগের বিশ্বাসঘাতকতা, যুগ-যন্ত্রণা, দুনিয়ার মোহ, দুনিয়া থেকে আত্মরক্ষা, সহিষ্ণুতার মর্যাদা, বিপদে ধৈর্য ধারণ, দুঃখের পর সুখ, অল্পে তুষ্টি, দারিদ্র্য ও প্রাচুর্য ইত্যাদি বিষয় যেমন তাঁর কবিতায় স্থান পেয়েছে, তেমনিভাবে সমকালীন ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনা, যুদ্ধের বর্ণনা, প্রিয় নবীর (সা) সাহচর্য, তাকদির, আল্লাহর প্রতি অটল বিশ্বাস, খোদাভীতিসহ নানা বিষয় তাতে বাক্সময় হয়ে উঠেছে। তিনি মৃত্যুর অনিবার্যতা, যৌবনের উন্মাদনা, বন্ধুত্বের রীতিনীতি, ভ্রমণের উপকারিতা, জ্ঞানের মহত্ত্ব ও অজ্ঞতার নীচতা, মানুষের অভ্যন্তরের পশুত্ব ইত্যাদি বিষয়ের কথা যেমন বলেছেন, তেমনিভাবে প্রিয় নবীর (সা) ও প্রিয়তমা স্ত্রী ফাতিমার (রা) মৃত্যুতে শোকগাথাও রচনা করেছেন।
বংশ অহমিকা যে অসার ও ভিত্তিহীন সে কথা হযরত আলী (রা) বলেছেন এভাবে :
‘আকার-আকৃতির দিক দিয়ে সকল মানুষ সমান।
তাদের পিতা আদম এবং মা হাওয়া।
মায়েরা ধারণের পাত্রস্বরূপ, আর পিতারা বংশের জন্য।
সুতরাং মানুষের গর্ব ও অহঙ্কারের যদি কিছু থেকে থাকে
তাহলো কাদা ও পানি।’
পুত্র হুসাইনকে (রা) তিনি উপদেশ দান করেছেন এভাবে :
‘হে হুসাইন! আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি,
তোমাকে আদব শিখাচ্ছি; মন দিয়ে শোন।
কারণ, বুদ্ধিমান সেই যে শিষ্টাচারী হয়।
তোমার স্নেহশীল পিতার উপদেশ স্মরণ রাখবে,
যিনি তোমাকে শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়েছেন।
যাতে তোমার পদস্খলন না হয়।
আমার প্রিয় ছেলে!
জেনে রাখ, তোমার রুজি-রিজিক নির্ধারিত আছে।
সুতরাং উপার্জন যাই কর, সৎভাবে করবে।
অর্থ-সম্পদ উপার্জনকে তোমার পেশা বানাবে না।
বরং আল্লাহভীতিকেই তোমার উপার্জনের লক্ষ্য বানাবে।’
বুদ্ধি, জ্ঞানের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের কথা তিনি বলেছেন এভাবে :
‘মানুষের জন্য আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ অনুগ্রহ হলো তার বোধ ও বুদ্ধি।
তার সমতুল্য অন্য কোন ভালো জিনিস আর নেই।
দয়াময় আল্লাহ যদি মানুষের বুদ্ধিপূর্ণ করে দেন
তাহলে তার নীতি-নৈতিকতা ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূর্ণতা লাভ করে।
একজন যুবক মানুষের মাঝে বুদ্ধির দ্বারাই বেঁচে থাকে।
আর বুদ্ধির ওপরই তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়।
সুস্থ-সঠিক বুদ্ধি যুবককে মানুষের মাঝে সৌন্দর্যময় করে-
যদিও তার আয়-উপার্জন বন্ধ হয়ে যায়।
আর স্বল্প বুদ্ধি যুবককে মানুষের মাঝে গানিময় করে-
যদিও বংশ মর্যাদায় সে হয় অভিজাত।’
তিনি পৃথিবীর নশ্বরতা ও নিত্যতাকে মাকড়সার জালের সাথে তুলনা করে বলেছেন :
‘নিশ্চয় দুনিয়া নশ্বর।
এর কোন স্থায়িত্ব নেই।
এ দুনিয়ার উপমা হলো মাকড়সার তৈরি করা ঘর।
হে দুনিয়ার অন্বেষণকারী!
দিনের খোরাকই তোমার জন্য যথেষ্ট।
আর আমার জীবনের শপথ!
খুব শিগগির এ দুনিয়ার বুকে যারা আছে,
সবাই মারা যাবে।’
তিনি দুনিয়াকে সাপের সাথে তুলনা করেছেন এভাবে :
‘দুনিয়া হলো সেই সাপের মত যে বিষ ছড়ায়-
যদিও তার দেহ নরম ও কৃশকায়।’
দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী সুখ-দুঃখে ধৈর্যহারা না হওয়ার কথা বলেছেন এভাবে :
‘যুগ বা কাল যদি আমাকে দুঃখ দেয়
তা হলে আমি সঙ্কল্প করেছি ধৈর্য ধরার।
আর যে বিপদ চিরস্থায়ী নয় তা খুবই সহজ ব্যাপার।
আর যুগ যদি আনন্দ দেয় তাহলে উল্লাসে আমি মাতি না।
আর যে আনন্দ ক্ষণস্থায়ী তা একান্ত তুচ্ছ ব্যাপার।’
খায়বার যুদ্ধের দিন মারহাব ইহুদি তরবারি কোষমুক্ত করে নিম্নের এই শোকটি আওড়াতে আওড়াতে দ্বন্দ্ব যুদ্ধের আহবান জানায় :
‘খায়বার ময়দান জানে যে, আমি মারহাব।
আমি অস্ত্রধাণকারী,
অভিজ্ঞ বীর-যখন যুদ্ধের দাবানল জ্বলে ওঠে।’
এক পর্যায়ে হযরত আলী (রা) এই শোকটি আবৃত্তি করতে করতে অসীম সাহসিকতার সাথে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন :
‘আমি সেই ব্যক্তি যার মা তাকে ‘হায়দার’ নাম রেখেছে।
আমি জঙ্গলের বীভৎস দৃশ্যরূপী সিংহ।
আমি শত্র“ বাহিনীকে সানদারাড় পরিমাপে পরিমাপ করি।
অর্থাৎ তাদেরকে পূর্ণরূপে হত্যা করি।’
উহুদ যুদ্ধের পর হযরত আলী (রা) হযরত ফাতিমার (রা) কাছে এসে বললেন, ফাতিমা! তরবারিটি রাখ। আজ এটি দিয়ে খুব যুদ্ধ করেছি। তারপর তিনি এই দু’টি শোক আবৃত্তি করলেন :
‘হে ফাতিমা!
এই তরবারিটি রাখ যা কখনো কলঙ্কিত হয়নি।
আর আমিও ভীরু কাপুরুষ নই এবং নই নীচ।
আমার জীবনের কসম!
নবী আহমাদের সাহায্যার্থে এবং বান্দার সবকিছু সম্পর্কে জ্ঞাত
প্রভুর সন্তুষ্টি বিধানে আমি এটাকে ব্যবহার করে
পুরনো করে ফেলেছি।’
কবিতা সম্পর্কে হযরত আলীর (রা) মনোভাব তাঁর একটি মূল্যবান উক্তিতে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। তিনি বলেছেন :
‘কবিতা হলো একটি জাতির দাঁড়িপাল্লা (অথবা তিনি বলেছেন) কথার দাঁড়িপাল্লা।’
অর্থাৎ দাঁড়িপাল্লা দিয়ে যেমন জিনিসপত্রের পরিমাপ করা হয় তেমনি কোন জাতির সাহিত্য-সংস্কৃতি, সভ্যতা, নৈতিকতা ও আদর্শের পরিমাপ করা যায় তাদের কবিতা দ্বারা।
তিনি শুধু নিজে একজন উঁচু মানের কবি ছিলেন শুধু তাই নয়, বরং অন্য কবিদেরকেও তিনি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন। তাদের কবিতার যথাযথ মূল্যায়নও করতেন।
যেমন, একবার এক বেদুঈন তাঁর কাছে এসে কিছু সাহায্য চাইলো। তিনি তাকে একটি চাদর দান করলেন। লোকটি যাওয়ার সময় তার নিজের একটি কবিতা শোনালো। এবার হযরত আলী (রা) তাকে আরো পঞ্চাশটি দিনার দিয়ে বললেন, শোন, চাদর হলো তোমার চাওয়ার জন্য, আর দিনারগুলো হলো তোমার কবিতার জন্য। আমি রাসূলকে (সা) বলতে শুনেছি যে, তোমরা প্রত্যেক লোককে তার যোগ্য আসনে সমাসীন করবে।’
রাসূল (সা) কবি ও কবিতাকে ভালোবাসতেন। কবিকে যথাযথ মর্যাদা দিতেন। পৃষ্ঠপোষকতা করতেন।অনুপ্রেরণা দান করতেন। রাসূলের (সা) এই কর্মধারায় সাহাবীগণও অভিষিক্ত ছিলেন। হযরত আলীও (রা) কবি ও কবিতাকে যেমন ভালোবাসতেন তেমনি তার পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতাও করতেন। রাসূলের (সা) প্রত্যক্ষ সান্নিধ্য ও শিক্ষায় উদ্ভাসিত ছিলেন তাঁরা। সুতরাং কবি ও কবিতার যথাযোগ্য মূল্য ও মর্যাদা দেয়া সুন্নতেরই একটি বড় অধ্যায়।
হযরত আলী (রাঃ) র ন্যায় বিচারের দৃষ্টান্ত:
মহানবী (সাঃ) এর মৃত্যু পরবর্তী সময়ে সকল ধরণের অপসংস্কৃতি এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবার আগে দেয়াল হয়ে দাঁড়াতেন হযরত আলী (রাঃ)। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রাঃ) প্রায় বলতেন,
“যদি আলী না থাকত তবে ওমর ধ্বংস হয়ে যেত”।
চতুর্থ খলিফা হিসেবে তিনি ছিলেন দৃষ্টান্ত। এর প্রেক্ষিতে একটি ঘটনা সংক্ষিপ্তাকারে জেনে নেয়া যাক।
সিফফিনের যুদ্ধের পর আলী (রাঃ) এর হারানো প্রিয় ও মূল্যবান বর্মটি দেখতে পেলেন বাজারে যা একজন অমুসলিম লোক বিক্রি করছিল ছিলো। তিনি কাছে গিয়ে বললেন বর্মটি তাঁর এবং সে যেনো ফিরিয়ে দেয়।
লোকটি বললো – “জ্বী না, আমিরুল মুমিনীন। এটি আমার বর্ম”।
আলী (রাঃ) পুরোই নিশ্চিত ছিলেন বর্মটি তাঁর কিন্তু লোকটি মানতে নারাজ। লোকটি আলী (রাঃ) কে ব্যাপারটি নিয়ে কাজীর দরবারে যাওয়ার পরামর্শ দিলে দুইজনে সেখানে উপস্থিত হোন।
তখনকার কাজী শুরাইহ (রাঃ) আলী (রাঃ) এর কাছ হতে সাক্ষ্যপ্রমাণ চাইলে তিনি বলেন সাক্ষ্য হিসেবে নিজ পুত্র ইমাম হাসান এবং ক্রীতদাস কাম্বররকে উপস্থিত করতে চাইলে কাজী সাহেব বলেন,
“কিন্তু পিতার পক্ষে সন্তানের সাক্ষ্য আমি গ্রহণযোগ্য বলে স্বীকার করি না হে আমিরুল মুমিনীন”।
হযরত আলী (রাঃ) নিরুপায় হয়ে লোকটিকে বললেন,
“যাও, তুমিই এটি নিয়ে যাও কারণ আমার আর কোন সাক্ষ্য নাই”।
মুসলিম জাহানের এতোবড় একজন শাসক সামান্য একজন লোকের কাছে এভাবে ন্যায়পরায়ণ হওয়াটা তাকে বিস্মিত করে। চাইলে খলিফা পারতেন জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিয়ে তাকে শাস্তি দিতে।
লোকটি বলে উঠলো,
“কিন্তু আমি তো আছি, আমিই সাক্ষ্য দিচ্ছি যে বর্মটি আপনার। হায় আল্লাহ্! আমিরুল মুমিনীন আমার বিরুদ্ধে বিচার প্রার্থী হয়েছেন কাজীর দরবারে! আবার তাঁরই অধীনস্থ কাজী তাঁরই বিরুদ্ধে আমার পক্ষে রায় দিলেন! আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, যে দীন (ধর্ম) এমন সুন্দর শিক্ষা দেয় সেই দীন অবশ্যই সত্য। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ্ ছাড়া ইবাদতের উপযুক্ত আর কোন মাবুদ নাই এবং মোহাম্মদ (সাঃ) তাঁর বান্দা এবং রাসুল”।
“হে কাজী! নিঃসন্দেহে বর্মটি আমিরুল মুমিনীনের। তাঁর যে বাহিনী সিফফীন যুদ্ধের উদ্দেশ্যে রওনা করেছিলো, আমি তাঁদের পিছে পিছে যাওয়ার সময় হঠাৎ দেখলাম ধূসর রঙের উটের পিঠ হতে বর্মটি পড়ে যায় এবং আমি তা তুলে নিই”।
হযরত আলী (রাঃ) লোকটির ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায় খুশি হয়ে বর্মটি তাঁকে দান করেন এবং সাথে একটি ঘোড়াও উপহার দেন।
সেই লোকটি বেশ কিছুদিন পর আলী (রাঃ) এর পতাকা তলে খারেজীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন এবং চরম বীরত্বের সহিত লড়াই করে নাহারওয়ান এর যুদ্ধে শাহাদাত বরন করেন। (তথ্যসূত্র- তাবেঈদের ঈমানদীপ্ত জীবন।)
হযরত আলীর (রাঃ) মু্যেজাঃ
আলী (আ.)’র জীবনের অনেক বিস্ময়কর অলৌকিক ঘটনা বা মু’জিজা রয়েছে। যেমন, জন্মের সময় পবিত্র কাবা ঘরের দেয়াল ভেঙ্গে আবার তা মিলিয়ে যাওয়া যাতে তাঁর মা ফাতিমা বিনতে আসাদ তাঁকে জন্ম দিতে পারেন, রাসূলের (সা.) ওফাতের পর কুবা মসজিদে রাসূল (সা.)-কে জীবিত অবস্থায় দেখানো, সূর্যকে পেছনে ঘুরিয়ে দেয়া যাতে সঙ্গীরা নামাজ আদায় করতে পারেন সময়মত ইত্যাদি ।
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন: মক্কা বিজয়ের পর ফেরার পথে এক রাতে মহানবী (সা.) আলী (আ.)-কে বলেন যে, সূর্য যখন উদিত হবে তখন তুমি সূর্যের সঙ্গে কথা বলবে। আমি ফজলকে বললাম দেখবো আলী কিভাবে সূর্যের সঙ্গে কথা বলে। সূর্য ওঠার পর আলী (আ.) সূর্যকে লক্ষ্য করে বলেন: সালাম তোমায় হে সূর্য, তুমি আল্লাহর সৎ দাস ও আল্লাহর নির্দেশ পালনে অবিচল।
সূর্য জবাবে বলল: ওয়া আলাইকাসসালাম হে আল্লাহর রাসূলের ভাই!
আসমা বিনতে উমাইস বর্ণনা করেন হযরত ফাতিমা জাহরা (সা. আ.) বলেছেন: কোনো এক রাতে আলী (আ.) ঘরে প্রবেশ করলে আমি ভীত হয়ে পড়ি। আসমা বলেন: হে বিশ্বের নারীকুলের নেত্রী! কিভাবে ভয় পেয়েছিলেন আপনি! তিনি বলেন: আমি শুনলাম যে জমিন বা মাটি আলীর সঙ্গে কথা বলছে এবং আলীও জমিনের সঙ্গে কথা বলছেন!
একবার আলী (আ.) একদল সঙ্গীসহ কুফার মসজিদে উপস্থিত ছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি ইমাম আলী (আ.) বলে: আমার বাবা-মা আপনার জন্য উৎসর্গ হোক, আমি বিস্মিত যে এই দুনিয়া এই গ্রুপের হাতে রয়েছে এবং আপনি এই দুনিয়া থেকে কিছুই পাচ্ছেন না! আলী (আ.) বললেন, তুমি কি মনে কর আমরা (বিশ্বনবীর-সা. আহলে বাইত) যদি দুনিয়াকে চাইতাম তাহলে কী আমাদের দেয়া হত না? এরপর তিনি এক মুঠো পাথরের কণা হাতে নিয়ে সেগুলোকে মূল্যবান পাথরে পরিণত করে প্রশ্ন করেন-এসব কি? লোকটি বলল: সবচেয়ে মূল্যবান পাথর। আমরা দুনিয়া চাইলে তা দেয়া হয়, কিন্তু আমরা তা চাই না-এ কথা বলে তিনি সেগুলো দূরে ফেলে দেন এবং সেগুলো আবারও সাধারণ পাথরের কণায় পরিণত হয়!
এ ছাড়াও একবার বেশ কিছু সময় ধরে ভূমিকম্প হতে থাকলে ও পাহাড়গুলো কাঁপতে থাকলে লোকজন ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে আলী (আ.)’র শরণাপন্ন হন। আলী (আ.) সে সময় খলিফা ছিলেন না। তিনি ভূমিকে লক্ষ্য করে বলেন: তোমার কি হলো? শান্ত হও। ফলে ভূমিকম্প বন্ধ হয়ে যায়। এরপর বিস্মিত লোকজনকে লক্ষ্য করে তিনি বলেন: “আমি হচ্ছি সেই ব্যক্তি যার সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন:
«اذا زلزلت زلزالها و اخرجت الارض اتقالها و قال الانسان مالها»
-যখন পৃথিবী তার কম্পনে প্রকম্পিত হবে, যখন সে তার বোঝা বের করে দেবে। এবং মানুষ বলবে, এর কি হল ?
আমি হচ্ছি সেই ব্যক্তি যে কিয়ামতের দিন জমিনকে বলবো, তোমার কি হলো? (এরপর কুরআনে এসেছে) یومئذ تحدث اخبارها- সেদিন সে তার বৃত্তান্ত বর্ণনা করবে, ফলে আমার জন্য খবরগুলো বর্ণনা করবে জমিন।”
আলী (আ.)’র একদল সঙ্গী তাঁকে বললেন: মুসা ও ঈসা নবী জনগণকে অনেক মু’জিজা দেখিয়েছেন। আপনিও যদি সে ধরণের কিছু দেখাতেন তাহলে আমাদের হৃদয় সুনিশ্চিত হত। আলী (আ.) বললেন: তোমরা এ জাতীয় নিদর্শন দেখা সহ্য করতে পারবে না। কিন্তু তারা বার বার একই অনুরোধ করতে থাকায় তিনি এক শুষ্ক উপত্যকায় একটি কবরস্থানের দিকে তাদের নিয়ে যান। সেখানে তিনি দোয়া পড়ে ধীর কণ্ঠে বললেন: তোমার পর্দা সরিয়ে ফেল। ফলে হঠাৎ কিছু বাগান ও নহর বা খাল দেখা গেল একদিকে এবং অন্যদিকে জাহান্নামের আগুন দেখা যাচ্ছিল। একদল বলে উঠলো: যাদু যাদু। কিন্তু অন্য একদল এই মু’জিজাকে বিশ্বাস করে বললেন: বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন: কবর হচ্ছে বেহেশতের বাগান অথবা জাহান্নামের গর্ত।
একবার জনগণ বৃষ্টির অভাবে আলী (আ.)’র কাছে গিয়ে নালিশ করায় তিনি দোয়া করলে সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি বর্ষণ শুরু হয়। এতো বৃষ্টি হলো যে এবার জনগণ বলতে লাগলো: খুব বেশি বৃষ্টি হচ্ছে। ফলে তিনি আবারও দোয়া করায় বৃষ্টি কমে যায়। (সূত্র: বিহারুল আনোয়ার)
বলা হয় একবার হযরত আলী (আ)-কে একইসঙ্গে ১৫০টি জটিল প্রশ্ন করা হয়েছিল। আলী (অ) সব প্রশ্ন শোনার পর একে-একে সেসবের জবাব দিয়েছিলেন এবং একবারও প্রশ্নকারীকে বলেননি যে তোমার অত নম্বর প্রশ্নটা কি ছিল আবার বল! তিনি একনাগাড়ে এভাবে বলছিলেন যে, তোমার ১ নম্বর প্রশ্নের উত্তর হল এই, ২ নম্বর প্রশ্নের উত্তর হল এই… তোমার ১৫০ নম্বর প্রশ্নের উত্তর হল এই।
হযরত আলী (আ)-কে জব্দ করার জন্য তাঁকে একবার প্রশ্ন করা হয় আপনি সেইসব প্রাণীর নাম বলুন যেগুলো ডিম পাড়ে ও যেগুলো বাচ্চা প্রসব করে। আলী (আ) বললেন, যেসব প্রাণীর কান মাথার ভেতরে থাকে সেসব ডিম পাড়ে আর যাদের কান মাথার বাইরে থাকে সেসব বাচ্চা প্রসব করে। প্রশ্নকারীরা ভেবেছিল, আলী (আ) এই জটিল প্রশ্নে উত্তর দিতে দিতে অনেক সময় নেবেন এবং সময়ের অভাবে সব প্রাণীর নাম বলতে পারবেন না। ফলে তিনি এ বিষয়ে পুরোপুরি জানেন না বলে অপবাদ দেয়া সম্ভব হবে!
আমিরুল মু’মিনিন আলী (আ) একবার যখন বলেছিলেন, আমাকে হারানোর আগেই যা কিছু জানার জেনে নাও, আমাকে যে কোনো বিষয়ের প্রশ্ন কর না কেন আমি তার জবাব দেব। তখন এক ব্যক্তি বললো, হে আলী! বলুন তো আমার মাথার কতটি চুল আছে? আলী (আ) বললেন, এটাও আমি বলতে পারব, কিন্তু এটা জেনে তোমার তো কোনো লাভ হবে না। অর্থাৎ এর মধ্যে তো উপকারী জ্ঞান নেই।
একটি বর্ণনায় এসেছে, সে যুগে ইরানের খ্যাতনামা বিদ্যাপীঠ জুন্দিশাপুর বিশ্ববিদ্যালয় হযরত আলী (আ)-কে অধ্যাপনার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। কিন্তু হযরত আলী (আ) তা সম্ভব নয় বলে জানান এবং বলেন যে, কোনো প্রশ্ন থাকলে তিনি তার জবাব দেবেন। উটের একটি বিশেষ রোগের চিকিৎসা- যে রোগ এই জন্তুর শরীরে গর্ত সৃষ্টি করে, সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আলী (আ) জানান, কেবল ভারতের একটি উপাসনালয়ের একটি লোহার খুঁটি যা লোহা হওয়া সত্বেও তাতে আঘাতের ফলে সৃষ্ট শব্দ অন্য যে কোনো লোহার মধ্যে আঘাতজনিত শব্দের মত হয় না, তার স্পর্শই কেবল এ রোগ ভালো করতে পারে। বলা হয় ইউরোপীয়রা গবেষণার জন্য ওই খুঁটি নিয়ে যায় এবং আজো তার কোনো হদিস নেই।
রসায়ন শাস্ত্রের ইতিহাস থেকে জানা যায় আলী (আ) নিকৃষ্ট ধাতুকে স্বর্ণে পরিণত করার বিদ্যাও জানতেন। কিন্তু তাতে বিদ্যুতের প্রয়োজন হত বলে তার প্রয়োগ করা তখনও সম্ভব হয়নি।
হযরত আলী (রাঃ) বাণী:
১. ক্ষমাই সর্বোৎকৃষ্ট প্রতিশোধ।
২. কামবাসনাকে আয়ত্তে আনো, তোমার জ্ঞান নিখুঁত হবে।
৩. আল্লাহ্ তোমাকে স্বাধীন করে সৃষ্টি করেছেন তবে কেন অন্যের অধীনে পরাধীন হয়ে থাকবে?
৪. তাঁদের কখনোই নিরাশ করো না যাদের শেষ ভরসা তুমি।
৫. কখনো যদি কাউকে ধোঁকা দিতে সক্ষম হও তবে তাঁকে বোকা ভেবো না বরং চিন্তা করো কতোটা বিশ্বাস সে তোমাকে করেছিলো।
৬. বোকাদের সঙ্গে তর্ক করা নিরর্থক।
৭. যে নিজে সতর্কতা অবলম্বন করে না, দেহরক্ষী তাকে রক্ষা করতে পারে না।
৮. জীবন দুইদিনের। একটি তোমার পক্ষে আর অন্যটি বিপক্ষে। জিতে গেলে অহংকার করো না এবং হেরে গেলে ধৈর্য ধরো। দুটি দিনই তোমার জন্য পরীক্ষার।
৯. নারীজাতি মহান রাব্বুল আলামীনের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট সৃষ্টি যার মধ্যে প্রকট আবেগ দ্বারা পূর্ণ, যাদের কাঁধে রয়েছে সমাজকে শিক্ষিত এবং সামনে অগ্রসর করার দায়িত্ব।
১০. অসৎ লোক কাউকে সৎ মনে করে না। সবাইকে নিজের মতো ভাবে।
১১. গোপন কথা যতক্ষণ তোমার কাছে আছে ততোক্ষণ তোমার কাছে বন্দী কিন্তু কারোও নিকট প্রকাশ করা মাত্র তার কাছে তুমি বন্দী হয়ে গেলে।
১২. যে সম্মুখে তোমার তারিফ করে সে তোমার দুশমন।
১৩. লোকের যেসব দোষ ত্রুটির উপর আল্লাহ্ পর্দা দিয়ে রেখেছেন তা তুমি প্রকাশ করার চেষ্টা করো না।
১৪. দুনিয়াতে সবচেয়ে কঠিন কাজ হল নিজেকে সংশোধন করা এবং সবচেয়ে সহজ কাজ অন্যের সমালোচনা করা।
১৫. পানির মতো হও যে নিজের পথ সৃষ্টি করে নিজেই, পাথর হইয়ো না যে অন্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
১৬. অন্যের বদভ্যাসের প্রতি ঘৃণা পোষণ করে লোকচক্ষুর অন্তরালে সেই বদভ্যাসে লিপ্ত হওয়া ব্যক্তিরা সর্বাপেক্ষা আহাম্মক ব্যক্তি।
১৭. পাঁচটি জিনিস খুব খারাপ:
- আলেমের খারাপ কাজ।
- শাসকের লালসাবৃত্তি।
- বৃদ্ধের জেনাকারীতা।
- ধনীর কৃপণতা।
- নারীর নির্লজ্জতা।
মুসলিম জগতে ইসলামের চতুর্থ খলিফা এবং মোহাম্মদ (সাঃ) এর প্রিয় সাহাবী হযরত আলী ছিলেন অসাধারণ জ্ঞানের অধিকারী যা নবীজীর একটি উক্তির মাধ্যমে বুঝা যায়,
“আমি জ্ঞানের শহর হলে হযরত আলী সেই জ্ঞানের দরজা”।
হযরত আলী (রাঃ) এর শাহাদাত বরণের মধ্য দিয়েই শেষ হয়ে যায় ইসলাম যুগের খলিফাদের শাসনামল। যুগে যুগে অনেক শাসক বিশ্বজুড়ে এসেছে কিন্তু ইসলামের এই চার খলিফা যে পদচিহ্ন রেখে গিয়েছেন তার দৃষ্টান্ত বিরল।