অনিন্দ্য আফরোজ
পণ্ডিত চাণক্যের নাম আমরা সবাই কমবেশি জানি। উপমহাদেশ ছাড়া সারা বিশ্বে তিনি অন্যতম প্রাচীন এবং বাস্তববাদী পণ্ডিত হিসেবে স্বীকৃত।মহাকবি কালিদাস যুগেরও অনেক আগে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন। এই পণ্ডিত ওই সময় থেকেই ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছিলেন।মানব জীবনের নানা দিক নিয়ে তিনি লিখে গেছেন অমর সব তত্ত্বগাথা।
চতুর্থ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে এই দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক ও রাজ পরামর্শদাতা তাঁর অমূল্য পরামর্শ দিয়ে গিয়েছিলেন। পাশাপাশি লিখে গিয়েছিলেন বই। তাঁর ‘অর্থশাস্ত্র’ ও ‘চাণক্য নীতি’ গ্রন্থ নামে রচিত দুটি বই আজও সামাজিক ও আর্থিক জীবনে নসমান গুরুত্ব বহন করছে।
কীভাবে করে দারিদ্র্য দূর কিংবা কীভাবে কলহ-বিবাদ থেকে নিজেকে দূরে রাখা যায় অথবা ভয় থেকে মুক্তি পাওয়া যায়— সেসব ব্যাপারে চাণক্যের পরামর্শ আজও প্রাসঙ্গিক। কলহ বা ঝগড়া থেকে দূরে থাকতে মৌন থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি ।
চাণক্য বলেছেন, ভয় দূর করতে হলে নিজেকে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। আপনি যদি সারাক্ষণ সতর্ক থাকেন, তাহলে আর ভয় আপনার মনে প্রবেশ করতে পারবে না।
দারিদ্র দূর করার তাঁর উপদেশ, বিদ্যালাভ করা। বিদ্যালাভ করলে সুখপ্রাপ্তি হয়। পাশাপাশি বিদ্যার্জনের ফলে উপার্জনের যোগ্যতা তৈরি হয়। এর ফলে দারিদ্র দূর হয়।
প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে বলে যাওয়া এই সব কথা আজকের দিনের মানুষেরও পথ চলার পাথেয় হয়ে রয়েছে। আসুন আজ জেনে নিই পণ্ডিত চানক্য সম্পর্কে।
কে এই চাণক্য
পণ্ডিত, ভবিষ্যৎদ্রষ্টা চাণক্য ছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৩৭০ থেকে ২৮৩ অব্দের প্রাচীন ভারতের একজন পণ্ডিত, দার্শনিক ও রাজ উপদেষ্টা। তিনি ছিলেন প্রাচীন তক্ষশীলা বিহারের অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ের অধ্যক্ষ। প্রাচীন ভারতের শাসকগোষ্ঠী মৌর্য রাজবংশের প্রথম রাজা চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যভার অর্জন এবং মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল।
ইতিহাস বলছে, অসাধারণ পাণ্ডিত্য, দার্শনিক প্রজ্ঞা ও কূটনৈতিক ক্ষমতার গুণে অসামান্য প্রতিভাধর চাণক্যের জন্ম বর্তমান পাকিস্তানের তক্ষশীলায়। এই তক্ষশীলায় ছিল তৎকালীন যুগে উপমহাদেশে উচ্চতর জ্ঞান আহরণের পাদপীঠ। রাজনীতি বিজ্ঞান ও দর্শনের বাস্তব চর্চা এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় সেসব কৌশল প্রয়োগ পদ্ধতির সম্পর্কে দিক নির্দেশনা দিতে চাণক্য ছিলেন খুবই দক্ষ। পণ্ডিত চাণক্যের আসল নাম বিষ্ণুগুপ্ত। আর তিনি ‘কৌটিল্য’ ছদ্মনামে বিখ্যাত ছিলেন। তিনি কৌটিল্য নামেই সংস্কৃত ভাষার অমরগ্রন্থ ‘অর্থশাস্ত্র’ লিখেছেন। দেশশাসন ও কূটনৈতিক কৌশলের ক্ষেত্রে তাঁর এই অর্থশাস্ত্রকে এখনো বিশ্বের সেরা শাস্ত্র বলে গণ্য করা হচ্ছে। তিনি ‘কুটিলা গোত্র’ জন্মেছিলেন বলে নিজ গোত্রকে টিকিয়ে রাখতে ‘কৌটিল্য’ ছদ্মনাম ধারণ করেছিলেন । তবে তাঁর পরিচিত নাম ‘চাণক্য’। ‘চানকা’ থেকেএর উদ্ভব । চানকা হলো তিনি যে গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেই গ্রামের নাম।
পাণ্ডিত্য
চাণক্য কতটা জ্ঞানী এবং পণ্ডিত ছিলেন তা তাঁর রচিত শাস্ত্রতেই প্রমান মেলে। একাধারে তিনি ছিলেন একজন দক্ষ শিক্ষক। পাশাপাশি তিনি ছিলেন সফল লেখক, দার্শনিক, শাসক এবং কূটনীতিক। প্রচলিত সমাজ ও মানবজীবন সম্পর্কিত তাঁর তাত্ত্বিক বক্তব্যগুলো এই আধুনিককালে মানব জীবনে সমানভাবে প্রযোজ্য হচ্ছে। প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রবক্তা হিসেবে গণ্য করা হয় চাণক্যকে। তাঁর রচিত‘অর্থশাস্ত্র’ (Arthashastra) গ্রন্থে তিনি সুন্দরভাবে চিত্রিত করেছেন একটি রাষ্ট্র কী উপায়ে গড়ে ওঠে এবং তা পরিণত রূপ নেয়। এই গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেছেন কীভাবে একজন শাসক নিজ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আরো ভূখন্ড অধিকার করতে পারে এবং কীভাবে মূল্যবান ধনসম্পদ নিজের রাষ্ট্রের অধিভূক্ত করতে পারে। উল্লেখ করেছেন সেই সম্পদ ব্যবহার করে কীভাবে নিজ দেশের প্রজাদের কল্যাণ, নিরাপত্তা এবং জীবনমান উন্নয়ন করা সম্ভব। মোদ্দাকথায় তাঁর রচিত গ্রন্থটির নাম অর্থশাস্ত্র হলেও এই গ্রন্থে শাসককে কীভাবে দেশ শাসন করতে হয় এবং সেজন্যকি কি কৌশল অবলম্বন করা যায় সেসব উল্লেখ করেছেন। আছে কূটনীতির নানা কৌশল ও পরামর্শ। প্রাচীনকালে রাজ দরবারে পণ্ডিতদের কদর ছিল। প্রত্যেক রাজ দরবারেই এক, দুজন রাজপণ্ডিত থাকতেন। রাষ্টের গুরুত্বপূর্ণ নীতি-নির্ধারণী ক্ষেত্রে এসব পণ্ডিতের ভূমিকা ছিল অসামান্য। এজন্য কৌটিল্যের বা চাণেক্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ পরবর্তীকালের রাজাদের রাষ্ট্র পরিচালনা ও জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দিক-নির্দেশক হিসেবে পরিগনিত হতো। পড়েছে। চাণক্যের মহাজ্ঞানের বদৌলতে মৌর্যশাসনের প্রতিষ্ঠাতা রাজা চন্দ্রগুপ্তের ২৪ বছরের শাসনকাল ছিল বর্ণিল। তেমনি মৌর্য রাজবংশের দ্বিতীয় প্রজন্ম বিন্দুসারার সমৃদ্ধি ও বিপুল জনপ্রিয়তার চাণক্যের অবদান ছিল । আমরা ইতিহাসে এর প্রমান দেখতে পাই।রাজা চন্দ্রগুপ্ত পরবর্তী সময়ের প্রজাবৎসল শাসকদের রাজ্যশাসন ও রাজ্য পরিচালনা নীতি এর উজ্জল উদহারন।
ভালো থাকার চার সূত্র
মহামতি চাণক্য শুধু রাষ্ট্রনীতি, কূটনীতি, দর্শন নিয়েই তাঁর লেখালেখি সীমাবদ্ধ রাখেন নি। জীবনের প্রয়োজনে অনেক বিষয়ের প্রতিই তাঁর যেমন আগ্রহ ছিল তেমনি সে সব বিষয়ের ওপর আলোকপাতও করেছেন তিনি। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষ মাত্রই সব সময় ভালো থাকার পক্ষপাতি। এজন্য ভাল থাকতে মহাজ্ঞানী চাণক্য বেশ কয়েকটি উপায় বা সূত্রের কথা উল্লেক করেছেন। এরকম চারটি সূত্র আছে। এগুলো হলো-
এক. নিদারুণ অর্থ সংকট থাকলেও তা কাউকে কখনও বলা উচিত নয়। কারণ, এতে কেউ যেমন সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে না, বরং কেউ কেউ মিথ্যা সাহায্যের আশ্বাস দিতে পারে।েএক্ষেত্রে তাঁর মত হলো, গরিবেরা সমাজে তেমন মর্যাদা পান না। এজন্য তাদের উচিত নিজের সম্পদ নিজের কাছেই রাখা।
দুই. মহাপণ্ডিত চাণক্যের আরেকটি সূত্র হলো, ব্যক্তিগত সমস্যার ব্যাপারে। তাঁর মতে, ব্যক্তির ব্যক্তিগত কোনো সমস্যা কখনো কাউকে বলা উচিত নয়। কারণ, এসব বললে তারা অন্যের কাছে নিচু ও বিরক্তিকর গন্য হয় এবং যার কাছে তা করেন তিনি আড়ালে তাকে নিয়ে হাসাঠাট্টা করেন। জ্ঞানী ব্যক্তির মতো ব্যক্তিগত সমস্যা নিজের মধ্যে আমৃত্যু জমা রাখা উচিত।
তিন. তাঁর আরেকটি সূত্র হচ্ছে, যদি কেউ নিম্নপদস্ত ব্যক্তির দ্বারা অপমান-অপদস্ত হন তবে তা অন্যদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করাই উচিত। কারণ, এতে বক্তার সামনেই তিনি নিয়ে হাসি-ঠাট্টার শিকার হতে হতে পারেন। এতে ব্যক্তির মর্যাদা ও আত্মবিশ্বাসে আঘাত লাগতে পারে।
চার. চাণক্য সন্তান লালন-পালনের ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্রের উল্লেখ করেছেন। এক্ষত্রে তিনি বলেছেন, আদর করার দোষ অনেক, আর শাসন করার গুণও অনেক । এজন্য তিনি সন্তান বা শিষ্যকে শাসন করার কথা বলেছেনম আদর নয়। কাঁর মতে, পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত পুত্রদের লালন-পালন করবে, ১০ বছর বয়স পর্যন্ত তাদের পরিচালনা করবে, ১৬ বছর বয়সে পড়লে তাদের সঙ্গে বন্ধুর মত আচরণ করবে। আর ছেলেকে যারা পড়ান না, সেই বাবা-মা সন্তানের মিত্র নয় শত্রু। একটি চাঁদই অন্ধকার দূর করতে পারে, সব তারা মিলেও কখনো তা পারে না। তেমনি একটি গুণী ছেলে একশ মূর্খ ছেলের চেয়ে উত্তম।
সন্ন্যাস জীবন
চাণক্য রাজা চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রীত্ব লাভের কয়েক বছর পর প্রাসাদের ভোগময় জীবন ছেড়ে কুঁড়েঘরে সন্ন্যাস জীবন বেছে নিয়েছিলেন। সেখানে তিনি তাঁর শিষ্যদের নানা বিষয়ে নৈতিক এবং আর্থ-সামাজিক বিষয়াদীতে দিক্ষা দিতেন। এসব নীতিকথা সংগৃহীত হয়েছিল। এসব নিয়ে তাঁর একটি সংকলন রয়েছে। নাম ‘চাণক্য নীতি দর্পণ’। চাণক্যের সেই নীতিদর্পণের কিছু বিষয় এবার জানা যাক।
এক. শত্রুর গতিবিধি সম্পর্কে যে রাজা ধারণা করতে পারেন না এবং শুধু অভিযোগ করেন যে তার পিঠে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে, তবে সেই রাজাকে সিংহাসনচ্যুত করা উচিত।
দুই. জীবনের সব উদ্যোগগুলো নির্ভর করে কেবলমাত্র অর্থের ওপর। এজন্য সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত রাজস্ব আদায় বা খাজাঞ্চিখানার ওপর।তারমতে, রাজ তহবিল বা অর্থ আত্মসাতের ৪০টি পদ্ধতি আছে। এক্ষেত্রে তাঁর মতামত এমন, জিহবার ডগায় বিষ রেখে যেমন মধুর আস্বাদন করা অসম্ভব, তেমনি কোনো রাজকর্মচারী রাজার রাজস্বের সামান্য পরিমাণ অর্থ হলেও না খেয়ে ফেলার ঘটনাও অসম্ভব। জলের নিচে মাছের গতিবিধি যেমন জল পান করে বা পান না করেও বোঝা সম্ভব নয়, তেমনি রাজকর্মচারীর তহবিল আত্মসাৎ দেখা সম্ভব নয়। অতি উঁচু আকাশে পাখির উড্ডয়ন দেখা যেমন সম্ভব, তেমনি কোনো রাজকর্মচারীর গোপন কার্যকলাপ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া অসম্ভব।
তিন. বিষ থেকে সুধা, নোংরা স্থান থেকে সোনা, নীচ কারও থেকে জ্ঞান এবং নিচু পরিবার থেকে সুলক্ষণা স্ত্রী এসব গ্রহণ করা সঙ্গত।
চার. মনের বাসনাকে দূরীভূত করা উচিত নয়। এই বাসনাগুলোকে গানের গুঞ্জনের মতো কাজে লাগানো উচিত।
পাঁচ. যারা পরিশ্রমী, তাদের জন্য কোনো কিছুই জয় করা অসাধ্য নয়। শিক্ষিত কোনো ব্যক্তির জন্য কোনো দেশই বিদেশ নয়। মিষ্টভাষীদের কোনো শত্রু নেই।
ছয়. বিরাট পশুপালের মাঝেও শাবক তার মাকে খুঁজে পায়। তেমনি যিনি কাজ করেন অর্থ সব সময় তাকেই অনুসরণ করে।
সাত. মন যদি খাঁটি হয় তবে পবিত্র স্থানে গমন অর্থহীন।
মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা
ঐতিহাসিকগণ, মহামতি চাণক্যের উত্থান কিংবদন্তি কিংবা গল্পের মতো হলেও এর ঐতিহাসিক সত্যতা আছে বলেই মানেন। ঐতিহাসিকদের মতে, ধনানন্দ ছিলেন ওই সময় মগধ রাজ্যের পরাক্রমশালী নন্দ বংশের শেষ রাজা । তবে তিনি ছিলেন অন্যায়কারী শাসক। এ জন্য তিনি প্রজাদের কাছে ছিলেন দারুণ অপ্রিয় । রাজা ধনানন্দ একবার চাণক্যকে অপমান করেন। রাজা ধনানন্দের বাবার শ্রাদ্ধে পৌরহিত্য করার জন্য একজন ব্রাহ্মণ প্রয়োজন। এজন্য ধনানন্দের মন্ত্রী শকটা ব্রাহ্মণ খোঁজার দায়িত্ব পান। তিনি চাণক্যকে ধনানন্দের বাবার শ্রাদ্ধের পুরোহিত হওয়ার অনুরোধ করেন। চাণক্য যথাসময়ে রাজপ্রাসাদে উপস্থিত হয়ে পুরোহিতের আসন নেন। চাণক্যের চেহারা খুব ভালো ছিল না। পুরোহিতের আসনে কদাকার চেহারার ব্রাহ্মণকে দেখে রাজা ধনানন্দ রেগে যান। তিনি চাণক্যকে তিরস্কার করে বের করে দেন। চাণক্য প্রথমে রাজাকে হিতবাক্যে বুঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু রাজা কিছেই শুনতে চাইলেন না। উল্টো অন্যদের দিয়েও চাণক্যকে অপমান করান। এরপর চাণক্য ক্ষুব্ধ হয়ে সেখান থেকে থেকে চলে আসেন এবং অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন।
ইতিহাসের ভাষ্য, রাজা ধনানন্দের এক সৎ ভাই (পিতা মহাপদ্মের ঔরসে দাসী ‘মুরা’র গর্ভজাতপুত্র) রাজ্যের কিছু পদস্থ ও উচ্চাভিলাষী তরুণ সামরিক কর্মকর্তা চন্দ্রগুপ্ত সিংহাসন দখলের পরিকল্পনা করছিলেন। কারণ পিতা মহাপদ্মের মৃত্যুর পর রাজা ধনানন্দ দাসীমাতা মুরা ও সৎ ভাই চন্দ্রগুপ্তকে রাজ্য থেকে বিতারিত করেছিলেন। অপমানিত চন্দ্রগুপ্ত তাই ধনানন্দকে পরাজিত করে মগধের সিংহাসন দখলের চেষ্টা চালান। কিন্তু চন্দ্রগুপ্তের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হলে প্রাণ বাঁচাতে তাকে বিন্ধালের জঙ্গলে পলাতক ও নির্বাসিত জীবন বেছে নিতে হয়েছিল। তখনই ঘটনাচক্রে চাণক্যের সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের সাক্ষাৎ হয়। কে জানত চন্দ্রগুপ্ত আর চাণক্যের এই সাক্ষাৎ ইতিহাসের বাঁক বদলে দেবে ।
চাণক্য চন্দ্রগুপ্তের ভেতরের প্রতিশোধপরায়ণতার কথা জেনেছিলেন। জেনেছি্যেলন চন্দ্রগুপ্তের সিংহাসনের বাসনা। তিনি সেটা সব সময় কাজে লাগাতে চেষ্টা করলেন। চন্দ্রগুপ্তও চাণক্যের পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হলেন। আর এতে চন্দ্রগুপ্ত তাঁর জীবনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য চাণক্যকে গুরু, উপদেষ্টা ও মন্ত্রণাদাতা হিসেবে স্বীকার করে নেন। চাণক্যের সক্রিয় সহযোগিতায় চন্দ্রগুপ্ত শক্তিশালী এক সেনাবাহিনী গড়ে তুললেন।চন্দ্রগুপ্তকে বুদ্ধি, পরামর্শ দিয়ে তাঁর পরিকল্পনাকে আরও বেশি নিখুঁত করে তুললেন চাণক্য। চাণক্যের পাণ্ডিত্য আর চন্দ্রগুপ্তের বীরত্বে শেষ পর্যন্ত সিংহাসনচ্যুত হলেন নন্দরাজা। মগধের সিংহাসনে আরোহণের পর রাজা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য শাসন প্রতিষ্ঠা করলেন। মৌর্য বংশই পরবর্তীতে ভারতীয় ইতিহাসে শক্তিশালী সাম্রাজ্যে প্রতিষ্ঠা করে।চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যেরই দ্বিতীয় পুরুষ হলেন বিন্দুসারা এবং তৃতীয় প্রজন্ম প্রতাপশালী শাসক সম্রাট অশোক।
বৈচিত্র্যময় জীবন
মগধের সিংহাসনে আরোহণের পর চন্দ্রগুপ্ত পাটালিপুত্রকে রাজ্যের রাজধানী করেন। পাটালিপুত্র বিহারের আধুনিক শহর পাটনার কাছে অবস্থিত। রাজা চন্দ্রগুপ্ত খ্রিস্টপূর্ব ৩২২ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২৯৮ সাল পর্যন্ত রাজ্য শাসন করেন। তিনি ছিলেন শান্তি ও ন্যায় পরায়ন এক শাসক। তার সময়ে এই রাঝ্যের প্রভূত সম্মান ও সমৃদ্ধি আসে। চন্দ্রগুপ্তের দরবারে গ্রিক দূত মেগাস্থিনিস তার ‘ইন্ডিকা’ গ্রন্থে এসব উল্লেখ করে গেছেন। পণ্ডিত চাণক্য জীবদ্দশায়, এমনকি মৃত্যুর পরেও ভারতবর্ষে খুব জনপ্রিয় এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় পণ্ডিত ছিলেন। এবং এখনো টিকে আছেন তার কর্মময় জীবনদর্শন ও অসাধারণ সৃষ্টিতে।
কর্মজীবনের শুরুতে চাণক্য পাঞ্জাবকে বিদেশি শাসনমুক্ত করতে সাহায্য করেছিলেন সেখানকার রাজাকে। এরপর অযোগ্য শাসক নন্দ রাজাকে উৎখাত করে চন্দ্রগুপ্তের সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটাতে সাহায্য করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় সাম্রাজ্যে শান্তি, সমৃদ্ধি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়েছিল। শুধু চন্দ্রগুপ্তের শাসনারেলই নয়, পরবর্তীকালে ভারতীয় সম্রাটদের শাসন কৌশলে দারুণভাবে প্রভাব ছিল চাণক্যনীতির। মৌর্য বংশের তৃতীয় শাসক সম্রাট অশোকের শাসন এর বড় উদহারবন। বর্তমান ভারতের রাষ্ট্রীয় মনোগ্রামেও প্রাচীন ও গভীর ঐতিহ্যবাহী অশোক-স্তম্ভের উপস্থিতি আছে। এমনকি এরও পরে বিক্রমাদিত্যের শাসনকালের কিংবদন্তীয় উপকথাগুলোর জনপ্রিয় লোকভাষ্য থেকেও তা ধারণা করা যায়। বিজ্ঞ ও বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন দার্শনিক, নীতিশাস্ত্র, সামাজিক আচরণ ও রাজনীতির ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু পর্যবেক্ষণ রয়েছে তাঁর। আধুনিক যুগের পরিশীলিত কথাবার্তা থেকে ভিন্ন হলেও আজকের দিনেও চাণক্যের এসব বানী ঠিক একই তাৎপর্যময়।
জ্ঞানী চাণক্য শারীরিকভাবে খুব একটা সবল ছিলেন না। ছিলেন দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী। কিন্তু এই বিজ্ঞ ও বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন মহাজ্ঞানীর সমাজ, সংসার, ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি সম্পর্কিত নীতিবাক্য হাজার বছর পরেও এখনো বাস্তব হয়ে আছে।
চাণক্যের কিছু শ্লোক
বাস্তবাদে বিশ্বাসী চাণক্যের অর্থনীতি, রাজনীতি, জীবনযাপন নিয়ে বলা কথামালাগুলো ‘চাণক্য শ্লোক’ নামে পরিচিত। কথিত আছে, ভারতের রাজনীতিতে এখনো অনেকাংশে চাণক্যনীতি চলমান। চাণক্যের নীতি পৃথিবীর বহুভাষায় অনূদিত হয়েছে। হাজার বছর পেরিয়ে গেলেও তার নীতি এখনো সমানভাবে কার্যকর। আসুন কিছু শ্লোক জেনে নেওয়া যাক-
♦ দুর্বলের বল রাজা, শিশুর বল কান্না, মূর্খের বল নীরবতা, চোরের মিথ্যাই বল।
♦ দুষ্ট স্ত্রী, প্রবঞ্চক বন্ধু, দুর্মুখ ভৃত্য এবং সসর্প-গৃহে বাস মৃত্যুর দ্বার, এ বিষয়ে সংশয় নেই।
♦ পাপীরা বিক্ষোভের ভয় করে না।
♦ আকাশে উড়ন্ত পাখির গতিও জানা যায়, কিন্তু প্রচ্ছন্ন প্রকৃতি-কর্মীর গতিবিধি জানা সম্ভব নয়।
♦ অতি পরিচয়ে দোষ আর ঢাকা থাকে না।
♦ অধমেরা ধন চায়, মধ্যমেরা ধন ও মান চায়। উত্তমেরা শুধু মান চায়। মানই মহতের ধন।
♦ অনেকে চারটি বেদ এবং ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করলেও আত্মাকে জানে না, হাতা যেমন রন্ধন-রস জানে না।
♦ অন্তঃসার শূন্যদের উপদেশ দিয়ে কিছু ফল হয় না, মলয়-পর্বতের সংসর্গে বাঁশ চন্দনে পরিণত হয় না।
♦ আপদের নিশ্চিত পথ হলো ইন্দ্রিয়গুলোর অসংযম, তাদের জয় করা হলো সম্পদের পথ, যার যেটি ঈঙ্গিত সে সে পথেই যায়।
♦ আড়ালে কাজের বিঘ্ন ঘটায়, কিন্তু সামনে ভালো কথা, যার উপরে মধু কিন্তু অন্তরে বিষ, তাকে পরিত্যাগ করা উচিত।
♦ গুরু শিষ্যকে যদি একটি অক্ষরও শিক্ষা দেন, তবে পৃথিবীতে এমন কোনো জিনিস নেই, যা দিয়ে সেই শিষ্য গুরুর ঋণ শোধ করতে পারে।
♦ অবহেলায় কর্মনাশ হয়, যথেচ্ছ ভোজনে কুলনাশ হয়, যাঞ্চায় সম্মান নাশ হয়, দারিদ্র্য বুদ্ধিনাশ হয়।
♦ অভ্যাসহীন বিদ্যা, অজীর্নে ভোজন, দরিদ্রের সভায় বা মজলিশে কালক্ষেপণ এবং বৃদ্ধের তরুণী ভার্যা বিষতুল্য।
♦ ধর্মের চেয়ে ব্যবহারই বড়।
♦ বিনয়ই সবার ভূষণ।
♦ বষ থেকেও অমৃত আহরণ করা চলে, মলাদি থেকেও স্বর্ণ আহরণ করা যায়, নীচজাতি থেকেও বিদ্যা আহরণ করা যায়, নীচকুল থেকেও স্ত্রীরত্ন গ্রহণ করা যায়।
♦ ভাগবাসনায় বুদ্ধি আচ্ছন্ন হয়।
♦ মিত ভোজনেই স্বাস্থ্যলাভ হয়।
♦ ইন্দ্রিয়ের যে অধীন তার চতুরঙ্গ সেনা থাকলেও সে বিনষ্ট হয়।
♦ উপায়জ্ঞ মানুষের কাছে দুঃসাধ্য কাজও সহজসাধ্য।
♦ ঋণ, অগ্নি ও ব্যাধির শেষ রাখতে নেই, কারণ তারা আবার বেড়ে যেতে পারে।
♦ একটি মাত্র পুষ্পিত সুগন্ধ বৃক্ষে যেমন সমস্ত বন সুবাসিত হয়, তেমনি একটি সুপুত্রের দ্বারা সমস্ত কুলধন্য হয়।
♦ একশত মূর্খ পুত্রের চেয়ে একটি গুণীপুত্র বরং ভালো। একটি চন্দ্রই অন্ধকার দূর করে, সব তারা মিলেও তা পারে না।
♦ একটি দোষ বহু গুণকেও গ্রাস করে।
♦ একটি কুবৃক্ষের কোটরের আগুন থেকে যেমন সমস্ত বন ভস্মীভূত হয়, তেমনি একটি কুপুত্রের দ্বারাও বংশ দগ্ধ হয়।
♦ উৎসবে, বিপদে, দুর্ভিক্ষে, শত্রুর সঙ্গে সংগ্রামকালে, রাজদ্বারে এবং শ্মশানে যে সঙ্গে থাকে, সে-ই প্রকৃত বন্ধু।
♦ কর্কশ কথা অগ্নিদাহের চেয়েও ভয়ঙ্কর।
♦ খেয়ে যার হজম হয়, ব্যাধি তার দূরে রয়।
♦ গুণবানকে আশ্রয় দিলে নির্গুণও গুণী হয়।
♦ গুণহীন মানুষ যদি উচ্চ বংশেও জন্মায় তাতে কিছু আসে যায় না। নীচকুলে জন্মেও যদি কেউ শাস্ত্রজ্ঞ হয়, তবে দেবতারাও তাঁকে সম্মান করেন।
♦ অহংকারের মতো শত্রু নেই।
♦ তিনটি বিষয়ে সন্তোষ বিধেয় : নিজের পত্নীতে, ভোজনে এবং ধনে। কিন্তু অধ্যয়ন, জপ, আর দান এই তিন বিষয়ে যেন কোনো সন্তোষ না থাকে।
♦ দারিদ্র্য, রোগ, দুঃখ, বন্ধন এবং বিপদ-সব কিছুই মানুষের নিজেরই অপরাধরূপ বৃক্ষের ফল।
♦ দুর্জনের সংসর্গ ত্যাগ করে সজ্জনের সঙ্গ করবে। অহোরাত্র পুণ্য করবে, সর্বদা নশ্বরতার কথা মনে রাখবে।