`খনা’ প্রবাদপ্রতীম এক বিদুষী নারী

Spread the love

 

লিজা সাইয়্যেদা

প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে বাংলা সাহিত্য কিংবা ভারতবর্ষে খনা নামে এক বিদুষী নারীর প্রবাদ-প্রবচন আমাদের সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে আছে। এক সময় বাঙানী সমাজে সবাই কথায় কথায় ‘খনা’ নামের এই প্রবাদপ্রতীম নারীর প্রবাদ বলতেন। এজন্য ‘খনা’ নামের এই নারী এখনো আমাদের কাছে  কিংবদন্তী হয়ে আছেন। কিন্তু কে এই খনা? তাঁর পরিচয় কি?

এনিয়ে এখনো বাঙানী সমাজে তেমন আলোচনা নেই। কিংবা অনুসন্ধানও নেই। যদিও  তাঁকে নিয়ে  নানা কাহিনী প্রচলিত আছে।  খনার আবির্ভাব সম্পর্কে সঠিক , গ্রহণযোগ্য  তেমন কোনো সবিস্তার তথ্য জানা যায় না।  ধারণা করা হযয়ে থাকে  ৮০০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মহীয়সী এই নারীর আবির্ভাব ঘটেছিল। ঐতিহাসিক সূত্রগুলোর মতে,  তাঁর বাস ছিল পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বারাসাতের দেউলি গ্রামে।  তাঁর পিতার নাম অনাচার্য । ওই সময় চন্দ্রকেতু রাজার আশ্রম চন্দ্রপুরে বসবাস করতেন তিনি। প্রচলিত আছে  কোনো একমুহূর্তে   জন্ম নেওয়ায়  তাঁর নাম রাখা হয় সুক্ষনা বা খনা। এও কথিত আছে যে খনার প্রকৃত নাম লীলাবতী। এই নারীর করা   ভবিষ্যতবাণীগুলো খনার বচন নামে  বাঙালী সমাজে বহুল পরিচিত।

খনা যেসব ভবিষ্যতবাণী করেন তার সঙ্গে গণিতশাস্ত্রের যোগসূত্র রয়েছে। কারণ, তারিখ, তিথি, মাস ভেদে তিনি ভব্যিতবাণী করতেন। এবং এগুলোকে তিনি ছোট ছোট সূত্রে  গণিতের মূলভাব তুলে ধরতেন।
একটি প্রবাদ এমন যে “অঙ্কস্য বামা গতি” অর্থাৎ অংক দক্ষিণ থেকে বাম দিকে গণণা করতে হবে। খনার বাবার  নাম  অটনাচার্য। তাঁর একটি বচনে এমন পরিচয় পাওয়া মেলে। যেমন তাঁর একটি বাণী এমন-‘ আমি অটনাচার্যের বেটি, গণতে গাঁথতে কারে বা আঁটি’।

মতান্তরের আরেক ইতিহাস বলে,  খনা ছিলেন সিংহলরাজার মেয়ে। ওই সময় বিক্রমপুরের রাজা বিক্রমাদিত্যের সভা জ্যোতির্বিদ বরাহ(উপমহাদেশের প্রাচীন রাজ্য অবন্তী তথা উজ্জয়নের রাজা হর্ষ-বিক্রমাদিত্যের রাজপ্রাসাদে প্রধান জ্যোতির্বিদ ছিলেন বিখ্যাত পন্ডিত বরাহ) তাঁর শিশুছেলে মিহিরের জন্মের  পর গণনা করে দেখেন এই শিশুর আয়ু মাত্র এক বছর। তাই স্বল্পায়ুর এই শিশু ছেলেকে  তিনি একটি পাত্রে তুলে সাগরে  ভাসিয়ে দেন। পাত্রটি  ভেসে ভেসে  সিংহলদ্বীপে পৌঁছালে   সিংহল রাজা শিশুটিকে পান। উদ্ধার করে তিনি কাকে   লালন- পালন করেন।  নাম রাখেন মিহির। বড় হওয়ার  পর সিংহল রাজা যুবক মিহিরকে খনার সঙ্গে  বিয়ে দেন।  ধীরে ধীরে মিহির ও খনা জ্যোতিষ শাস্ত্রে পারদর্শিতা অর্জন করেন।  
মতান্তরে আরেক ইতিহাস বলছে,   নদীতে ভেসে ভেসে  শিশুটি চলে যায় অনেক দূরের এক রাজ্যে। সেখানে  নদী থেকে শিশুটি উদ্ধার করেন  অনার্য  সম্প্রদায়ের লোকেরা। তাদের আশ্রয়ে বড় হন।  তার বয় যখন ১৬ পূর্ণ  হয় তখন তীক্ষ্ম ও ক্ষুরধার বুদ্ধির এক মেয়ের প্রেমে পড়েন মিহির। পরে তাকে বিয়েও করেন।  আর সেই মেয়েটি  তার জ্যোতির্জ্ঞান প্রয়োগ করে  জানতে পারেন তার স্বামী মিহির হলেন  উজ্জয়নের বিখ্যাত পন্ডিত বরাহমিহিরের ছেলে। এরপর একদিন দুজন  রওয়ানা দেন উজ্জয়নের পথে।
ছেলে ও পুত্রবধুর পরিচয় জেনে  রাজপ্রাসাদে তাদের গ্রহণ করতে অপারগতা প্রকাশ করলেন  বাবা বরাহ। কারণ, বরাহ  তাঁর শাস্ত্রীয় গণনায় অনেক আগেই অবগত হয়েছিলেন  যে, এক বছর বয়সেই তাঁর ছেলে মিহিরের মৃত্যু হবে।

খনা তখন তাঁর একটি বচন দিয়ে শ্বশুরের ভুল গণনা ধরিয়ে দেন এবং বলেন,‘ কিসের তিথি কিসের বার, জন্ম নক্ষত্র কর সার।কি করো শ্বশুর মতিহীন, পলকে আয়ু বারো দিন’।
এর মানে হলো  গণনায় মিহিরের আয়ু হলো ১০০ বছর। পণ্ডিত বরাহ তখন আনন্দচিত্তে খনা ও মিহিরকে ছেলে ও পুত্রবধূ হিসেবে বরণ করেন।

 ফসল বোনা, তোলার কিংবা কৃষির তিথির বিষয়ে খনার  অগাধ জ্ঞান ছিল। গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান বিচার করে আবহাওয়ার চমৎকার পূর্বাভাস দিতে পারতেন তিনি।  উজ্জয়নের কৃষকেরা  এতে ব্যাপক উপকৃত হন। তা দেখে রাজা বিক্রমাদিত্য খনাকে তাঁর রাজ্যে দশরত্ম আখ্যা দেন।
খনার জ্ঞান আর দূরদর্শীতা প্রজা ও  রাজপ্রাসাদ, রাজণ্যদের মুগ্ধ করে। এতে পণ্ডিত  বরাহের গুরুত্ব প্রজা ও রাজ্যসভায় হ্রাস পায়। এমনকি একদিন জ্ঞানী বরাহ প্রজাদের সামনে  এক বিতর্কে পুত্রবধু খনার কাছে বাহাসে হেরে যান।এতে শ্বশুর বরাহ ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে ওঠেন। এরপর বরাহ গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ছেলেকে আদেশ দেন পুত্রবধূর জিহ্বা কেটে ফেলতে। চিরতরে তাঁর কষ্ঠ স্তব্ধ করতেই এই আদেশ।  ছেলে মিহির বাবার  সেই আদেশ পালন করেন।
খনা এমন একজন বিদুষী নারী যিনি সর্বযুগ, সর্বকালজুড়ে এক অপার রহস্যের আঁধার। তিনি নিঁখুত ভবিষ্যতবাণীর সমহান বক্তা এবং ছড়াকার। তাঁর দেওয়া জলবায়ু, আবহাওয়া ,  জ্যোর্তিবিদ্যা ও ভুতত্ত্ব  ভেদে  শস্যের ক্ষয়-ক্ষতি ও উৎপাদন সম্পর্কিত বচনগুলো সবই অদ্ভুত রকমের নির্ভুল এবং আজও তা  এক গভীর বিস্ময় হয়ে আছে।
এমন বুদ্ধিমতী, দুরদর্শী নারীর এমন অকাল পরিণতি ইতিহাসের এক মর্মান্তিক অধ্যায়। কিন্তু তাঁর প্রবাদ-বচন আজও কিংবদন্তি হয়ে আছে বাঙানী সমাজ-সংস্কৃতিতে। গ্রাম থেকে  শহর কোথায় আজও পরিবেশ-পরিস্থিতিতে কথা প্রসঙ্গে, আলাপচারিতায় ওঠে না আসে তাঁর বচন। তিনি যেন আজও উজ্জ্বল হয়ে আছেন, মিশে আছেন প্রতিটি বাঙালীর হৃদয় ও জীবনাচারণে।   
খনা-মিহিরের মূড়া
পশ্চিমবঙ্গে কলকাতা শহর থেকে  ৪০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে বারাসাত নগরী। এই নগরীর কাছে বীরচম্পা নামে এক  স্থান রয়েছে। যেখানে গেলে দেখা যায়, প্রাচীন এক নিদর্শনের ধ্বংসাবশেষ।

প্রচলিত  ধারণা আছে, এই স্থানই ছিল রাজা চন্দ্রকেতুর সাম্রাজ্য। এখানে  কৃষিকাজ বা অন্যান্য খননকাজ করতে গেলে মাটির নিচ থেকে প্রায়ই বের হয়ে আসে নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এরমধ্যে  যেমন মুদ্রা, পুঁতি, প্রস্তর ও পোড়ামাটির ভাস্কর্য অন্যতম। এখানে মহাসড়কের উত্তর পাশে শায়িত সমাধিফলকের মত শুয়ে রয়েছে এক ইঁটের একটি প্রাচীন স্থাপনা। বহুভুজাকৃতির উঁচু সেই  স্থাপনাটি কৌতূহল জাগানোর মত। এর উত্তর-দক্ষিণে রয়েছে স্থাপনাটির আরো সুবিন্যস্ত  অংশ। এটাই খনা-মিহিরের মূড়া (Mound of Khona-Mihir) নামে এখনো পরিচিত হয়ে আছে।
বিদুষী নারী খনার জীবন, জন্ম, মৃত্যু ও করুণ পরিণতি নিয়ে যত রকমকাহিনী প্রচলিত থাকুক না কেনো তিনি যে কল্পনার কোনো চরিত্র নয় এটা সত্য। একইসঙ্গে তাঁর জিহবা কেটে ফেলা, করুণ অকাল মৃত্যু এসই হয়েছিল তাঁর অসাধারণ প্রজ্ঞার কারনে। তিনি মূলত   ইর্ষার শিকার এক অসাধারণ প্রতিভা।  
 ইতিহাসের ভিত্তি বলছে, খনার বচন মূলত কৃষিতত্ত্বভিত্তিক এক ধরনের  ছড়া। আনুমান অস্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে  এসব রচিত। তবে এতে মতভেদও আছে। খনার অসংখ্য বচন  যুগ-কালের গণ্ডি পেরিয়ে এখনো গ্রাম বাংলার জনজীবনের সঙ্গে মিশে আছে ওতপ্রোতভাবে। খনার এসব রচনা চার ভাগে বিভক্ত। যেমন, কৃষিকাজের প্রথা ও কুসংস্কার; কৃষিকাজ ফলিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান; আবহাওয়া জ্ঞান; শস্যের যত্ন সম্পর্কিত উপদেশ।
খনার কিছু উল্লেখযোগ্য  বচন….

*‘মঙ্গলে ঊষা বুধে পা, যথা ইচ্ছা তথা যা’।
*‘কলা রুয়ে না কাটো পাত, তাতেই কাপড় তাতেই ভাত’।
*‘ব্যাঙ ডাকে ঘন ঘন, শীঘ্র হবে বৃষ্টি জান’।
*‘আকাশে কোদালীর বাউ
ওগো শ্বশুড় মাঠে যাও
মাঠে গিয়া বাঁধো আলি
বৃষ্টি হবে আজি কালি’।

*‘যদি হয় সুজন
এক পিড়িতে নয় জন
যদি হয় কুজন
নয় পিড়িতে নয় জন’।

*‘ শোল বোয়ালের পোনা
যার যারটা তার তার কাছে সোনা’।
*‘পরের বাড়ির পিঠা 
খাইতে বড় ই মিঠা’।

*‘কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ,
পাকলে করে ঠাস ঠাস!

*‘চোরের মার বড় গলা
লাফ দিয়ে খায় গাছের কলা’।

*‘নদীর জল ঘোলাও ভালো
জাতের মেয়ে কালোও ভালো’।

*‘দক্ষিণ দুয়ারি ঘরের রাজা
উত্তর দুয়ারি তাহার প্রজা
পূর্ব দুয়ারির খাজনা নাই
পশ্চিম দুয়ারির মুখে ছাই’।

*‘ডাক দিয়ে বলে মিহিরের স্ত্রী, শোন পতির পিতা
ভাদ্র মাসে জলের মধ্যে নড়েন বসুমাতা
রাজ্য নাশে, গো নাশে, হয় অগাধ বান
হাতে কাটা গৃহী ফেরে কিনতে না পান ধান’।

*কি করো শ্বশুর লেখা জোখা
মেঘেই বুঝবে জলের রেখা
কোঁদাল কুড়ুলে মেঘের গাঁ
মধ্যে মধ্যে দিচ্ছে বা
কৃষককে বলোগে বাঁধতে আল
আজ না হয় হবে কাল’।

*‘সাত পুরুষে কুমারের ঝি
সরা দেইখা কয়, এইটা কি’?

*‘ফল খেয়ে জল খায়
যম বলে আয় আয়’।

তথ্যসূত্রঃ

  1. “Varahamihira: The ancient astrologer, astronomer and mathematician” by Meera Sashithal; The Free Press Journal; (Weekly News Paper); Oct 3; 2015।
  2. বাংলা পীর সাহিত্যের কথা – ডক্টর গিরীন্দ্রনাথ দাস।
  3. মহাবংশ বা মিশ্রগ্রন্থ (পালি) – ধ্রুবানন্দ মিশ্র।
  4. কিংবদন্তী খনা ও খনার বচন – লেখিকা পূরবী বসু।
  5. ভারতের ইতিহাস (মধ্যযুগ)- তেসলিম চৌধুরী।
  6. ভারতবর্ষের ইতিহাস (আদি যুগ) – গোপাল চন্দ্র সিন্‌হা।
  7. সিংহল বিজয় কাব্য – শ্রী শ্যামচরন শ্রীমাঁনী।
  8. প্রাচীন বাংলার গৌরব – শ্রী হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।
  9. Bhaskaracharya’s Lilavathi –by Nithin Nagaraj. Our Scientists By Dilip M. Salwi।