ইসলাম রাকিব
দীর্ঘ দুই দশকের বেশি সময় ধরে মালয়েশিয়ার রাষ্টীয় ক্ষমতায় আসীন ছিলেন মাহাথির মোহাম্মদ। মালয়েশিয়া ঔপনিবেশিক শাসনের কবল মুক্ত হওয়ার পর দেশটিকে অর্থনৈতিক ও সামগ্রিক উন্নয়নের শীর্ষে পৌছে মাহাথির। এজন্য পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় অনুকরণীয় রাজনৈতিক নেতা হন মাহাথির। তবে বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়নের যথেষ্ট অভিযোগ আছে সফল এই রাষ্ট নায়কের বিরুদ্ধে।
রাজনীতিতে হাতেখড়ি
মাহাথির মোহাম্মদ প্রথমে রাজনীতিতে হাতেখড়ি ঘটে ১৯৪৬ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে। ঔপনিবেশিক শাসন-শোষনের বিপক্ষে ওই সময় চরম উত্তাল ছিল মালয়েশিয়া। কথন প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনে (ইউএমএনও) যোগ দেন আজকের এই বর্ষিয়ান নেতা। দলটির মূলমন্ত্র ছিল জাতীয়তাবাদ।
মাহাথিরের উত্থান যেভাবে
মালয়েশিয়ায় দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় ছিলেন মাহাথির মোহাম্মদ। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির পর প্রথমবারের মতো দেশটিকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের শীর্ষে পৌঁছে দেন তিনি। এই একটি কারণেই দক্ষিণ এশিয়ার অনুকরণীয় রাজনৈতিক নেতায় পরিণত হয়েছিলেন মাহাথির। যদিও নিজ দেশে বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন চালানোর অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে।
রাজনীতিতে মাহাথির মোহাম্মদের হাতেখড়ি ১৯৪৬ সালে। তখন তাঁর বয়স ছিল মোটে ২১ বছর। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তখন উত্তাল মালয়েশিয়া। ওই সময়ে সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনে (ইউএমএনও) যোগ দেন তিনি। ওই দলের মূল আদর্শ ছিল জাতীয়তাবাদ। ইউএমএনও এখনো মালয়েশিয়ার অন্যতম প্রধান দল।
পেশায় চিকিৎসক মাহাথির দেশটির ইউনিভার্সিটি অব মালয় থেকে চিকিৎসা শাস্ত্রে পড়াশোনা করেন। এরপর তিনি নিজের জন্মস্থান কেদাহ রাজ্যে সাত বছর চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন। ধীরে ধীরে তিনি‘ডক্টর এম’ নামে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন দলের হয়ে ১৯৬৪ সালে তিনি মালয়েশিয়ার পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন । কিন্তু মাঝে ১৯৬৯ সালে তাঁর ছন্দপতন হয়। দল কাঁকে বহিষ্কৃত করলে পার্লামেন্ট থেকে আসন হারান ডক্টর এম। মালয় সম্প্রদায়ের অবহেলার বিষয় নিয়ে এরপর তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টুংকু আবদুর রহমানের কাছে খোলা চিঠি লিখেছিলেন মাহাথির। এতেই তিনি ক্ষমতাসীন দলের রোষে পড়ে বহিস্কার হন।
এতে মাহাথির রাজনৈতিকভাবে একঘরে হন। এর পর শুরু করেন বই লেখা। মাহাথির মোহাম্মদ নিজের আদর্শ ও চিন্তাভাবনা নিয়ে একটি বিতর্কিত বই লিখলেন। বইটির দেওয়া হলো ছিল ‘দ্য মালয় ডিলেমা’। বইটিতে মাহাথির লিখেন, ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকেই মালয় সম্প্রদায়কে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী এবং দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করার কথা। এমনকি বিষয়টিকে মেনে নিতে মালয় সম্প্রদায়কে বাধ্যও করা হয়েছিল বলে তিনি বইয়ে উল্লেখ করেন।
মালয় ডিলেমা বইটি প্রকাশের পর যেন রাজনীতিবিদ হিসেবে মাহাথিরের পুনরায় চরম উত্থান ঘটে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতি মালয়েশিয়ার ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি কি এবং কেমন হবে-তা বইটি দিকনির্দেশনা দিয়েছিল। বইটি প্রকাশ পাবার পর ব্যাপক আলোচনার ঝড় তোলে মালয়েশিয়ার রাজনীতি ্ও সামাজিক অঙ্গনে। এতে মাহাথির ইউএমএনও দলের তরুণ নেতাদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এতে তাঁর দলে ফেরার ক্ষেত্র তৈরি হয়। এরপর তিনি দলে ফিরেন এবং ১৯৭৪ সালে পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হন। ঠাঁই হয় মন্ত্রিসভায়। হলেন শিক্ষামন্ত্রী।
মন্ত্রীত্ব পাওয়ার চার বছরের মধ্যে তিনি দেশের অন্যতম প্রধান নেতায় পরিণত হন। ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের (ইউএমএনও) তিনি দ্বিতীয় প্রধান নেতায় পরিণত হন। এরপর আর পেঠনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। একেবারে দেশটির ক্ষমতার শিখরে চড়েন মাহাথির। ১৯৮১ সালে তিনি দেশটির প্রধানমন্ত্রী হন।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর দেশ নিয়ে মাহাথিরের চিন্তাগুলোকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার লক্ষে কাজ শুরু করেন। তিনি জাপানের মতো দেশের পদাঙ্ক অনুসরণ করে মালয়েশিয়াকে ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, স্টিল ও গাড়ি উৎপাদক দেশে পরিণত করলেন। এর আগে মালয়েশিয়া কেবল রাবার ও টিন রপ্তানিকারক দেশ ছিল। এরপর কেটে যায় টানা ২২ বছর। এই ২২ বছরে তিনি ক্ষমতায় থেকে মালয়েশিয়াকে এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেন । পরে ২০০৩ সালে তিনি ক্ষমতা ছাড়েন।
মাহাথিরের যত সমালোচনা
মালয়েশিয়াকে অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে, মাহাথিরের সমালোচনাও কম নেই। দেশটির রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দেশের অনেক মানুষই তাঁকে ‘বর্ণবাদী’ নেতা হিসেবে দেখছেন। বিশেষত, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত ভারতীয় বংশোদ্ভূত মালয়েশিয় নাগরিকেরা তাঁকে অপছন্দ করেন। তাঁর নিজ মালয় সম্প্রদায়ের প্রতি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নৃতাত্ত্বিক বৈষম্যের সূচনাও করেন এই নেতা।
সিএনএনের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, মাহাথিরের বিরুদ্ধে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের দমন-পীড়নের অভিযোগ ছিল। তিনি যাঁদের হুমকি মনে করতেন সে সব ব্যক্তি বা দলগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর দমননীতি চালান তিনি। যদিও এসব অভিযোগ স্বীকার করেন না মাহাথির। মাহাথিরের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত আনোয়ার ইব্রাহিম ছিলেন মাহাথির পরবর্তী যুগের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা। অথচ ১৯৯৮ সালে আনোয়ারকেই বরখাস্ত করেছিলেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে আনেন সমকামিতা ও দুর্নীতির মামলা। ওই মামলায় দণ্ডও দেওয়া হয় তাঁকে। ফলে এবারের নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি আনোয়ার।
কেবল আনোয়ার ইব্রাহিম নয়, ক্ষমতা ছাড়ার পর সব উত্তরসূরির সমালোচনাতেই মুখর ছিলেন দেশটির সবচেয়ে সফল এই প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় মাহাথির নাজিবকে মন্ত্রী বানিয়েছিলেন। নাজিব পরবর্প্রতীতে প্রধানমন্ত্রীও হন মাহাথিরের সমর্থনে। মাহাথির এবারের নির্বাচনে সেই শিষ্য নাজিবের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বলছেন, আগে আমি ভুল করেছিলাম! এখন সেগুলো শুধরে নিতেই ক্ষমতায় আসতে চাই।
মাহাথির এখন কী চাচ্ছেন ?
দেশটির বিরোধীদলীয় জোট পাকাতান হারাপান চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে মাহাথিরকে প্রধানমন্ত্রী পদে প্রার্থী ঘোষণা দেয়। নাজিবের পতনের জন্যই একসময়ের বিরোধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন বলে জানিয়েছেন মাহাথির। আবার এও জানিয়েছেন তিনি, নির্বাচিত হলেও বেশি দিন ক্ষমতায় থাকবেন না মাহাথির। তাঁর ভাষায়‘পুরোনো শত্রু’ আনোয়ার ইব্রাহিমকে ক্ষমতায় এনে তিনি মসনদ থেকে বিদায় নেবেন। যদিও সমালোচকদের ধারণা, ক্ষমতায় গেলে এই ঝানু রাজনীতিক মত বদলাতে পারেন।
ভোটগ্রহণের আগে টাইম ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মাহাথির বলেন, দেশের সাধারণ মানুষ বর্তমানে আর্থিক সংকটে আছে। এ জন্য প্রথমে নাজিবকে পদত্যাগ করার আহ্বান জানানো হয়েছিল। তা না করায় তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন।
মালয়েশিয়ার বর্তমান একদলীয় শাসন ব্যবস্থাকে মাহাথির শক্ত ভিত্তি দিয়েছিলেন। এখন সেটিই ভেঙে ফেলার কথা বলছেন এই একদলীয় সাবেক শাসক। এজন্য যুক্তি হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন নাজিবের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ইস্যু।
পার্লামেন্টে ১৫ বছর পর
দেশটির সাধারণ ভোটারদের অর্ধেকই মুসলিম ও মালয় সম্প্রদায়ের। তাদের ভোটের ওপরই নির্ভর করছে নাজিবের ভাগ্য। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, নির্বাচনের আগে নির্বাচনী সীমারেখা পরিবর্তন ও ভুয়া সংবাদ প্রতিরোধে আইন প্রণয়ন করায় কিছুটা সুবিধা পেয়েছেন বর্তমান প্নারধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক। তবে মাহাথিরকে বাতিলের খাতায় ফেলার সাহস এখনো কারোর নেই। কারণ মুসলিম মালয় সম্প্রদায়ের ভোটব্যাংক তাঁরই এবং তা তিনি দেখিয়েও দিয়েছেন।
বুধবারের ভোটের খবর যতটুকু পাওয়া যায়, তাতে দেখা বারিসান ন্যাশনাল ও পাকাতান হারাপানের মধ্যে তুমুল লড়াই হচ্ছে। আনুষ্ঠানিক ফলাফল আজ বৃহস্পতিবার পাওয়া যেতে পারে। অনানুষ্ঠানিক ফলাফলে এগিয়ে আছে বিরোধীদলীয় জোট। আর এটা মালয়েশিার জন্য একটি নজিরবিহীন ঘটনা।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, মাহাথির ও আনোয়ার ইব্রাহিমের জন্য এবারের এই জাতীয় নির্বাচন পাশা খেলার শেষ দানের সমতুল্য। অন্যদিকে নিজের রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক। এবারের এই নির্বাচনে মাহাথির জিতলে তা হবে এক ব্যক্তির জনপ্রিয়তার জয় । আর যদি হেরে যান, তবুও বলতে হবে যে, মালয়েশিয়ার একদলীয় শাসনের ভিতে বড়সড় ফাটল তৈরি করে ফেলেছেন মাহাথির। সেই ফাটলে নাজিবের ক্ষমতার স্তম্ভ ধূলায় মিশিয়ে দিলেও দিতে পারে।