আয়না ২৪ ভ্রমন
বান্দরবান (Bandarban) বলতে অনেকেই বুঝেন নীলগিরি-নীলাচল, স্বর্ণ মন্দির বা বগা লেগকে। প্রকৃতির এসব নান্দ্যনিক নৈসর্গ ছাড়াও বান্দরবানে আরও কিছু স্বর্গীয় স্থান আছে। সেরকম একটি দর্শণীয় স্থানের নাম তিন্দু (Tindu) যা বাংলাদেশের ভূ-স্বর্গ নামে পরিচিত। তিন্দু বান্দরবান জেলার থানচি (Thanchi) উপজেলার একটি প্রশাসনিক এলাকা। বান্দরবান শহর থেকে থানচি উপজেলা সদরের দূরত্ব ৮২ কিলোমিটার। প্রাকৃতিক আকর্ষণের কারণে অ্যাডভেঞ্চার প্রেমী পর্যটকদের কাছে তিন্দু অঞ্চলটি একটি আকর্ষণীয় পর্যটন স্থান হিসেবেই বেশ পরিচিত। আকাশ-কুয়াশা-মেঘ-নদী-পাথর-পাহাড়-ঝরনা-বন-নীল সবুজ পানি আর রহস্য-রোমাঞ্চ-ভয়—সব যদি একবারে পেতে চান, তাহলে জীবনে একবার হলেও ঘুরে আসুন তিন্দু । সকালে ঘরের ভেতরে ফুঁ দিয়ে মেঘ সরিয়ে যখন দরজা খুঁজে বের করতে হয় তখন নিজেকে বারবার ধন্যবাদ দিতে হয় এই দেশে জন্মানোর জন্য।
মেঘ-কুয়াশার দেশ তিন্দু এর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো বর্ষাকালে এখানে নৌকায় চড়ে মেঘের ওপরে যাওয়া যায়, সাদাটে মেঘের ভেতর দিয়ে কিছুক্ষণ চললেই মাথা ভিজে যায়। এখানে শক্ত কঠিন পাথরকে সারাক্ষণই বুকে নিয়ে লক্ষ্য ছাড়া দৌড়ে বেড়ায় স্বচ্ছ পানির ঢল। তিন্দু এর দুই পাশ দিয়ে চলে গেছে দুটো ঝিরিপথ, সারা দিন সেখান থেকে কলকল করে ছুটে আসছে পাহাড়গলা স্বচ্ছ পানি। পানি আর পাথর মিলে এখানে যে নকশিকাঁথা তৈরি করেছে, কোথাও তার একচিলতে ছিদ্র নেই, নেই অমসৃণতা। তিন্দুপাড়ের পাথুরে সৈকত এখানে যোগ করেছে নতুন একটা মাত্রা।
বান্দরবান কন্যা তিন্দুকে ফেলে আরও ওপরের দিকে এগোতে থাকলে তখন মনে হবে মিনিটে মিনিটে বদলে যাচ্ছে পানির নিচের পাথুরে জগৎটা, ছোট ছোট পাথর যেন আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠতে লাগল, উঠতে উঠতে নদীর বুক ফুঁড়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেল তাদের মাথা। জায়গাটার নাম ‘বড় পাথর’। এখানে এসে নদীটা হয়ে গেছে সিঁড়ির মতন, এখানে পায়ের পাতাসমান পানিতে নেমে ঠেলেঠুলে নৌকাকে ওঠাতে হয় উপরের দিকে, সেখান থেকে আরও ওপরে একেবারে মেঘের কাছাকাছি। এখানে পাথর আর পানি মিলে ভরদুপুরে তৈরি করে রংধনুর। উত্তুরে হাওয়ায় ভাসতে থাকা সেই রংধনুগুলোকে নিজের কোলে আশ্রয় দেয় নদীর পাড়জুড়ে ঝুলতে থাকা গাছের সবুজ পাতারা। এখানে সূর্যোদয় দেখতে হয় ফুঁ দিয়ে মেঘ সরিয়ে, এখানে সূর্যাস্ত দেখতে হয় পানির চোখে চোখ রেখে।
পানি আর পাথরের এক সাদা-কালো জাদুঘর গড়ে উঠেছে এই তিন্দুকে ঘিরে। এখানে পাহাড়গলা পানিতে পা ডুবিয়ে চলতি পথের নতুন নতুন মাছের সঙ্গে সারা দিন আড্ডা দিলেও ক্লান্তির ঘাম ঝরবে না কানের লতি বেয়ে, এখানে ঘোলাটে মেঘের ভিড়ে সারাক্ষণ ভিজতে থাকলেও এতটুকু ময়লা লাগবে না গায়ে। জল-পাথরের আড্ডা জমে এখানে। এটা মেঘের দেশ, এটা কুয়াশার দেশ, এটা পাথুরে পানির দেশ, এটা তিন্দু, মেঘ-কুয়াশার তিন্দু।
কখন যাবেনঃ
তিন্দু এর আসল সৌন্দর্য দেখার সময় হল বর্ষা কালে।
কিভাবে যাবেনঃ
প্রথমে আপনাকে বান্দরবান শহরে যেতে হবে। ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন বান্দরবানের উদ্দেশ্যে কয়েকটি পরিবহন কোম্পানির গাড়ি ছেড়ে যায়। যেমন শ্যামলি, হানিফ, ইউনিক, এস আলম, ডলফিন- এর যেকোনো একটি বাসে চড়ে আপনি বান্দরবানের যেতে পারেন। রাত ১০ টায় অথবা সাড়ে ১১টার দিকে কলাবাগান, সায়েদাবাদ বা ফকিরাপুল থেকে এসব বাস বান্দরবানের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। নন এসি বাসে জন প্রতি ভাড়া ৫৫০ টাকা। এসি ৯৫০ টাকা।
চট্টগ্রাম থেকে বান্দরবান যেতে পারেন। বদ্দারহাট থেকে বান্দারবানের উদ্দেশে পূবালী ও পূর্বানী পরিবহনের বাস যায়। এসব বাসে জনপ্রতি ২২০টাকা ভাড়া রাখা হয়।
বান্দরবান জেলা শহরে নাশ্তা সেরে চান্দের গাড়ি নিয়ে সোজা থানচির উদ্দেশে রওনা হবেন। এক্ষেত্রে গ্রুপে গেলে ভালো হয়। তাতে খরচ কম হবে। আপনি চান্দের গাড়ি রিজার্ভ করে নিতে পারেন। তবে এতে খরচ পরবে তিন থেকে চার হাজার টাকা।এছাড়া লোকাল চান্দের গাড়ী আছে, এটায় ভাড়া পড়বে ১০০-১৫০ টাকা করে।
বান্দরবান শহর থেকে থাচনি যাওয়ার পথে চাইলে মাঝে বলিপাড়ায় কিছুক্ষণ যাত্রা বিরতি নিতে পারেন। সকালে রওনা দিলে দুপুরের মধ্যে থানচি পৌছে যাবেন। তারপর সাংগু হেটে পার হয়ে থানচি বাজারে পৌঁছাবেন। এখান থেকে খাওয়া দাওয়া করে নিতে পারেন। খুব সুলবেই আপনি এখান থেকে খাওয়া দাওয়ার করতে পরবেন।
আপনাকে সবার আগের যে কাজটি করতে হবে তা হচ্ছে বিজিবিকে আপনার পরিচয় দিয়ে তাদের নিকট থেকে অনুমতি নেওয়া। বাজার থেকে অপনাকে নৌকা ভাড়া করতে হবে। বান্দরবানের থানচি থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে দুই ঘণ্টা ২০ মিনিট গেলেই পৌঁছে যাবেন তিন্দু। একটি কথা বলে রাখি, এখানে আলাদা কোন গাইড পাওয়া যায় না।তাই নৌকার মাঝিই আপনার গাইডের কাজ করবে। নৌকা ভাড়ার খরচ নির্ভর করবে দিনের পরিমানের ওপর। নৌকা ভাড়ার জন্য আপনাকে দিনপ্রতি প্রায় ৮শ থেকে ৯শ টাকা গুনতে হবে।
কোথায় থাকবেনঃ
তিন্দুতে রাতে থাকতে পারেন এখানকার ইউনিয়ন পরিষদের মহিলা মেম্বারের বাসায়। আর যদি আপনার তাবু নিতে পারেন তাহলে তো কথাই নাই। এ ছাড়া মারমাদের বাঁশ-কাঠের বাড়ীতে অনায়াসে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। মারমাদের প্রায় প্রতিটি বাড়ীতেই খুব অল্প টাকায় এমন থাকা-খাওয়ার সুবিধে রয়েছে। তিনবেলা খাওয়ার খরচ পরবে জনপ্রতি ২০০ টাকা, আর থাকা ফ্রি।