এম এম সিকদার
আল কিন্দি একজন আরব আধ্যাত্মিক দার্শনিক। যিনি বিশ্বাস করতেন মানুষ আর পৃথিবীতে অন্তর্নিহিত সত্য বলে আর কিছু নেই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ছাড়া।তাই কিনদি সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে অধ্যয়ন করার চেষ্টা করেছেন। বাস্তববাদী দার্শনিক অ্যারিস্টটলের দর্শন ছিল অস্তিত্ব আছে এমন সব সত্যকে নিয়ে কাজ করা, সেখানে কিন্দির দর্শন সৃষ্টিকর্তার খোঁজ করা। কারণ কিনদি বিশ্বাস করতেন, সৃষ্টিকর্তাই সকল জাগতিক অস্তিত্বের কারণ। আর তাই সৃষ্টিকর্তাকে নিয়ে ভাবনার মধ্যেই জাগতিক সকল দর্শন নিহিত।
দর্শন মানে সত্যের সন্ধান। আল কিন্দির কাছে এই সত্যের মূলেই আছেন মহান সৃষ্টিকর্তা। কিনদির সেরা দার্শনিক সৃষ্টিকর্ম হচ্ছে‘অন ফার্স্ট ফিলসফি’ যাকে অনেকে বলেন ‘স্টাডি অব গড’ বা সৃষ্টিকর্তার অধ্যয়ন।
আল কিন্দির দর্শন আলোচনা করতে গিয়ে অনেকেই তাঁকে ইসলামের গণ্ডিতে আবদ্ধ দার্শনিক মনে করেন। কিন্তু আল কিন্দি সব সময়ই ধর্ম আর দর্শনের মধ্যে দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন সতর্কভাবে। আধ্যাত্মবাদ নিয়ে তার সমৃদ্ধ দর্শনকে তাই ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে মেলানো অসমীচীন বলা যায়। কিনদি সৃষ্টিকর্তার একত্ববাদের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে এর পক্ষে প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন। তিনি পরিবেশ- প্রকৃতির প্রতিটি অংশে খুঁজে পেয়েছেন ঐক্যের অগণিত উদাহরণ, যারা প্রত্যেকেই অধিকের সমন্বয়ে গঠিত। দৃষ্টান্ত হিসেবে, লাখো প্রজাতির সংখ্যাধিক্যের ঐক্যে গঠিত এক প্রাণীজগৎ। আবার এতো প্রজাতির মাঝে মানবজাতি একটি বিশেষ প্রজাতি হলেও তাদের মধ্যে রয়েছে স্বাতন্ত্র্য। তবে সকল স্বাতন্ত্র্যের ঐক্যেই গঠিত মানবজাতি। এ সব স্বাতন্ত্র্য রূপকার্থে এক ঈশ্বরের প্রতিনিধিত্ব করছে। পৃথিবীর সকল ভিন্নতাই একসূত্রে গাঁথা। সেই ঐক্যের মূলেই আছেন ঈশ্বর।
কিনদির লেখা ‘অন ফার্স্ট ফিলসফি- এর চতুর্থ অধ্যায়ে তিলি বলেছেন, এভাবেই আমরা খুঁজে পাই অনুপম সেই এক সত্ত্বাকে, যাঁর কোনো আকার, ওজন, মাত্রা কিংবা কোনো গোত্র, বর্ণ, প্রজাতি স্বাতন্ন্ত্র্য নেই। পার্থিব যে কোনো কিছুর সঙ্গে তিনি অতুলনীয়, তবু সবকিছুর মধ্যেই তিনি আছেন এবং সমানভাবে বিদ্যমান। তিনি সকল ঐক্যের মধ্যে উপস্থিত। এবং তিনি মহাসত্য।’
আল কিন্দি আরবের কিনদা গোষ্ঠির সদস্য ছিলেন। কিনদা গোত্র ছিল তৎকালীন আরবের সবচেয়ে প্রতাপশালী, যারা ইসলামের স্বর্ণযুগের প্রাথমিক পথপ্রদর্শক বলা হয়। কিন্দির দর্শন বেশ শক্তিশালী হলেও সমসাময়িক আরও অনেকেই তাঁকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু আরবে তিনিই কেবল ‘ফিলসফার অব আরব’ খেতাব পান। ইতিহাসবিদরা মনে করছেন, কিনদির বংশগত প্রভাবে কিনদি সমসাময়িকদের তুলনায় অধিক খ্যাতি পেয়েছিলেন। তার দর্শন ও বিজ্ঞানচর্চা ছিল প্রবলভাবে গ্রীক অনুবাদ দ্বারা প্রভাবিত। কিন্দির সবচেয়ে বড় আদর্শ ছিলেন প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টোটল। এজন্য কিনিদি দর্শনকে আধ্যাত্মবাদ ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করেছিলেন। কিনদির দর্শনে অ্যারিস্টোটল এবং নিওপ্লেটোনিক চিন্তার সংমিশ্রণ আছে।
কিন্দির জন্মের সঠিক তারিখ জানা যায় নি। তবে তিনি খলিফা মামুন ও মুতাসিমের রাজ দরবারে কাজ করেছেন কলে প্রমাণ পাওয়া যায়। সেই থেকে ধারণা করা হয় যে তাঁর জন্ম সম্ভবত ৮০০ ষালের দিকে। ওই সময় আরবে মুসলমানদের মধ্যে গ্রিক ও রোমান ক্লাসিক্যাল দর্শন পাঠের আগ্রহ ছিল। এর প্রভাবে সে সময় ব্যাপক গ্রিক দর্শন অনুবাদ হয়। আজকের ইরাকের বসরায় জন্মগ্রহণ করা আল কিন্দি ইরাকের বাগদাদে পড়াশোনা করেন। বাগদাদে তখন অনুবাদের যে ধারা শুরু হয়, তাকে অনুবাদ বিপ্লব বলে অভিহিত করা হতো।
কৈশোর পার করেই তিনি অনুবাদের কাজে হাত দেন কিনদি। তবে তিনি সরাসরি অনুবাদ করতেন না । এনিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে নানা বিতর্ক আছে। ৮৬৬ সালে কিনদি বাগদাদে মারা যান। তবে এনিয়েও ইতিহাসবিদগণের মধ্যে মতবিরোধ আছে।
দশম শতকের অন্যমত পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক ইবনে আল নাদিম। যিনি মুসলিম বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের বইয়ের তালিকা বা ‘ফিরিস্ত’ তৈরি করেন। ইবনে আল নাদিমের দরুন আজ আমরা ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাওয়া অনেক বইয়ের কথা জানছি। আল কিন্দির কথাও এই ফিরিস্তিতে আছে। ইবনে আল নাদিমের ফিরিস্ত থেকে জানা যায়, বিজ্ঞান ও দর্শনের ওপর শতাধিক বই লিখেছিলেন কিন্দি। তাঁর কাজ কিনদিকে দার্শনিক হিসেবে পরিচিতি দলেও দর্শণের চেয়ে বিজ্ঞান বিষয়ক বই ছিল তাঁর বেশি। কিন্দির কাজের ওপর ভিত্তি করে তার পরিচয় বিজ্ঞানী হতেই পারতো। কিন্তু কিনদির বেশিরভাগ বিজ্ঞান বিষয়ক বই হারিয়ে যাওয়ায় তাঁকে দার্শনিক হিসেবে পরিচিত করার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে তাঁর একমাত্র টিকে থাকা গ্রস্থ‘অন ফার্স্ট ফিলসফি’। এই বইয়ের মূল কপি, কিন্দির নিজ হাতে লেখা। তুরস্কের ইস্তাম্বুলে এর পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে।
মনস্তত্ত্ব নিয়ে কিন্দি বিচরণ করেছেন তাঁর চিন্তাক্ষেত্রে। এনিয়ে কিনদির বিখ্যাত কাজ হল ‘অন স্লিপ অ্যান্ড ড্রিম’, ‘ডিসকোর্সেস অন সোল’, ‘দ্যাট দেয়ার আর ইনকরপোরিয়াল সাবস্ট্যান্স’, ‘অন ডিসপেলিং সরোস’। এগুলোর মধ্যে কেবল অন ডিসপেলিং সরোস’ কেবল টিকে আছে। সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়েও কাজ করেছেন এই গুণী কিনদি। ‘অন দ্য এজেন্ট কজ অব জেনারেশন অ্যান্ড করাপশন’, ‘ অন দ্য প্রোস্ট্রেশন অব দ্য আউটারমোস্ট স্ফিয়ার’ সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ক দুটি অনবদ্য রচনা আছে তাঁর। এই রচনাগুলোতে আবহাওয়াবিদ্যা ও পূর্বাভাস নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা আছে। গণিতশাস্ত্রেও বিচরণ ছিল তাঁর। এর প্রমান হচ্ছে তাঁর রচিত ‘অন পারস্পেক্টিভ’।
কিন্দির মনোবিজ্ঞান নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ছিল তৎকালীন সময়ের তুলনায় উন্নত। ‘দ্যাট দেয়ার আর ইনকরপোরিয়াল সাবস্ট্যান্স’ বইটির মূল আলোচনা ঘিরে আছে আত্মাকে নিয়ে। নানান যুক্তিতর্কের মাধ্যমে কিন্দি প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে প্রতিটি প্রাণীর মধ্যেই একটি অশরীরী, অপার্থিব, নিরবয়ব সত্ত্বা আছে। যা এর মধ্যে প্রাণের সঞ্চার করে। এটাই হলো স্ই সত্ত্বা যাকে আত্মা বলে। আত্মার ভিন্নতাই মানুষের চিন্তা-চেতনা, মননে আর ব্যক্তিত্বে ভিন্নতা আনে। আত্মা হলো সৃষ্টিকর্তারই জ্যোতি। এই জ্যোতিতেই মানুষ আলোকিত হয়। এর মধ্যদিয়ে কিন্দি এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, স্রষ্টার গুণাবলী মানবাত্মার মধ্যে মিশে আছে। তাই কিনদি এসব গুণ খোঁজার তাগিদ দিয়েছেন।
কিন্দির মত হলো, মানুষের আত্মার প্রকৃত রূপ হচ্ছে বিচক্ষণ, যুক্তিসঙ্গত এবং নৈতিক। কিন্তু বাহ্যিক পৃথিবীর নানা চাকচিক্য এসব গুণকে কলুষিত করলে এসবের একটি বিকৃত রূপ তৈরি হয়। মানব দেহের মৃত্যুতে সেই বিকৃত আত্মার মৃত্যু হলেও বেঁচে থাকে শুদ্ধ আত্মা। আর শুদ্ধ আত্মা মানেই ন্যায়, নৈতিকতা, বিচক্ষণতা যা দৈহিক মৃত্যুর পরও পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে বেঁচে থাকে। ‘অন ডিসপেলিং স্যাডনেস’ বইতে কিন্দি মানবাত্মাকে জাগতিক দুঃখ- দুর্দশা লাঘবে দর্শনের মাধ্যমে স্বান্তনা খোঁজার পরামর্শ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তাঁর মত হলো, পৃথিবীতে যা কিছুর বাহ্যিক অস্তিত্ব আছে , তার সবই অশুদ্ধ-অপবিত্র হওয়ার আশঙ্কা আছে। কারণ এসব বাহ্যিক বস্তু (বাড়ি, জমিজমা, অলঙ্কার ও অন্যান্য বিলাস সামগ্রী ইত্যাদি) প্রজন্মের পর প্রজন্ম টিকে থাকবে এবং এর দ্বারা কত পাপ সংঘটিত হবে তার হিসাব নেই। কিন্তু আত্মা পবিত্রও অবিনশ্বর। তাই নশ্বর বস্তুজগতের মোহে অন্ধ না হয়ে আত্মার অনুসন্ধান করাই হলো সত্যের অনুসন্ধান। এজন্য নিজের থাকার গৃহ জাঁকজমক করা বাঞ্জনীয় নয় বরং জ্ঞান ও পুণ্য দিয়ে আত্মাকে শুদ্ধ ও সুসজ্জিত করতে বলেছেন। এক্ষেত্রে তিনি আরও বলেছেন, যে ব্যক্তি বাহ্যিক চাকচিক্যে আর মোহময় জীবন থেকে বেরিয়ে এসে আত্মার সন্ধান করে তার জীবনে দুঃখের অস্তিত্ব থাকে না।
কিন্দির সবচেয়ে বড় সাফল্য এটা তিনি মুসলিম দর্শনের সঙ্পাগে শ্চাত্য এবং গ্রিক দর্শনের সমন্বয় করতে পেরেছিলেন। আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে তিনি আধুনিকতার সংমিশ্রণ করতে পেরেছিলেন।